সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ১০

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ১০
ফারজানা আফরোজ 

বিয়ে বাড়ীতে মানুষের অভাব নেই। শা’ন্তিতে কোথাও গিয়ে বসবে সে জায়গাটা খোঁজে পাওয়া দু’ষ্কর। মিষ্টিকে বউ সাজিয়ে স্টেজে বসানো হয়েছে। মিষ্টি করুণ চোখে অনিকের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

– দোস্ত, আমার ভালো লাগছে না। প্রচণ্ড গরম লাগছে।
– বিয়ে করার আগে ভাবতে হয়। এখন গরম ঠান্ডা যাই হোক চুপচাপ বসে থাক আর দাঁত ক্যা’লিয়ে হাসতে থাক। সাজ নষ্ট করতে চাইলে কা’ন্না করতে পারিস সমস্যা নাই তবে তখন ভুত ভেবে অনেকের হার্ট অ্যা’টাক হওয়ার চান্স আছে। বুঝে শোনে বল হাসবি নাকি কান্না করবি?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– তোর সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। আগে জানলে পালিয়ে বিয়েটা করে ফেলতাম এখন এত ক’ষ্ট করতে হতো না।

নো মানি, নো হানি।
বউ যদি নিতে চান টাকা আগে দিয়ে যান।
গেইটের সামনে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা উপরের কথাগুলো। গেইট প্রাইজ ধরা হয়েছে বিশ হাজার টাকা। স্পন্দন ভ্রু নাচিয়ে লেখাগুলো পড়ল। পাত্রীপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– বউয়ের সাথে বেয়াইন ফ্রী দিচ্ছেন আপনারা? বাহ ভালোই হলো আমাদের।
শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– বউয়ের সাথে ফ্রী মানে? বউ যে দিচ্ছি সেটাই অনেক। আগে টাকা পরে বউ।
স্পন্দন বলল,

– মামার বাড়ি আবদার। বিশ হাজার টাকা দিয়ে বিয়ে করার চেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে সে টাকা দিয়ে কক্সবাজারে হানি’মুন প্ল্যান হয়ে যাবে। তিশান চল আমরা চলে যাই, সিলেটে গিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে পালিয়ে যাস।
তিশান বিড়বিড় করে বলল,

– মিষ্টি তখন আমাকে জুতো ছুঁ’ড়ে মারবে। দেখলে ভোলাভালা হলেও রা’গ কিন্তু অনেক।
শুভ্রতা , নেহা হেসে উঠল। কোনো উপায় না পেয়ে পনেরো হাজারে রাজি হলো দু’পক্ষ। ফিটা কেটে ভিতরে প্রবেশ করেই শুভ্রতার দিকে চোখ টিপ দিয়ে বলল স্পন্দন,
– রেডি থেকো। পরের বার তোমার পালা যদিও আমি পালিয়েই বিয়ে করব। টাকা বাছিয়ে চলে যাবো সাজেক কিংবা কক্সবাজার।
শুভ্রতা লাজুক হেসে বলল,
– অ’সভ্য পুরুষ

বিয়ের কাজ সম্পূর্ন শেষ হলো। এখন বিদায়ের পালা। কিন্তু মিষ্টির চোখে পানি নেই সে আনন্দ উৎসাহে বিদায় নিচ্ছে। মা চাচীরা যখন কাঁদছিল তখন মিষ্টি অভিমানী কণ্ঠে বলল,
– আমাকে বিয়ে দেওয়ার সময় মনে ছিল না। তাছাড়া ভাববে তোমাদের মেয়ে সিলেটে গেছে পড়াশোনা করতে। তোমাদের কান্না দেখে আমি কিন্তু এখন সত্যি সত্যিই কেঁ’দে দিবো।

ঠোঁট কাঁপতে লাগলো মিষ্টির। আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ আগেও নিজেকে সামাল দেওয়ার জন্য হাসি খুশি নাটক করছিল কিন্তু এখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মিষ্টির কান্না দেখে তিশান পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

– মিষ্টির অযত্ন আমি হতে দিবো না। ওর যখন ইচ্ছে আপনাদের সাথে দেখা করতে পারবে। আমি আগলে রাখব সবসময়।
মিষ্টির বাবা কাঁপা সুরে বলল,

– তোমার ভরসাতেই আমার মেয়েকে পাঠিয়েছি সিলেটে। আমি জানি আমার মেয়ের খা’রাপ তুমি হতে দিবে না বাবা। মেয়েটা আমার ভোলাবালা। অ’ন্যায় করলে বুঝিয়ে বলবে। আমাদের সবার চোখের মণি তোমার হাতে তুলে দিলাম।

মিষ্টিকে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হলো। সকলের অনুমতি নিয়েই শুভ্রতা, নেহা এবং অনিককে মিষ্টির সাথে পাঠানো হলো। তিশানের বাড়িতে মিষ্টিকে বরণ করে ঘরে তুলল। নিয়ম অনুযায়ী মিষ্টির আজ বাসর রাত। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটি। মিষ্টিকে সেখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বুকের ভিতরে হা’তুড়ি পে’টা’নোর শব্দ হচ্ছে, ভ’য়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, এ প্রথম তিশান আর সে এক ঘরে থাকবে ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে আসছে মুখ।

– অনুভুতি মিশে যাক হৃদয়ে গভীরে, মজেছি আমি একজনেরই অন্তরে।

ছাদের একদম কর্ণারে দাঁড়িয়েয়ে আছে শুভ্রতা। বাতাবি লেবুর গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। কাঠগোলাপ ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গোলাপ, গাঁদা, বেলির সঙ্গে ছাদের চৌবাচ্চায় ছোট পুকুর বানিয়ে শাপলা-পদ্ম ফুটিয়ে তৈরি করা হয়েছে ফুলের রাজ্য। শুভ্রতা বাগান প্রচন্ড ভালোবাসে। আপনমনে উপভোগ করতে লাগল পরিবেশ। বেলি ফুলের গন্ধ আর রূপ, দুটোই অপরূপ। নাকে ঘ্রাণ গেলেই মস্তিষ্কে খবর চলে যায়।

ভালোবাসার মন ফাগুনে,
তোমার জন্য সুর বুনেছি।
সুরের সাথে তাল সাজিয়ে,
ছোট্ট একটি গান লিখেছি।
গানের ভাষায়, মনের আশায়
তোমার একটা নাম রেখেছি।
নামের সাথে যতন করে,
তোমায় অনেক ভালোবেসেছি।

কবিতাটি কূর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই শুভ্রতা পিছন ফিরে স্পন্দনকে দেখে চমকে উঠল। শুভ্রতার মুখে ফোঁটে উঠলো মিষ্টি হাসি। স্পন্দন আসবে সে আশা করিনি।

– হঠাৎ এখানে?
শুভ্রতাকে লজ্জায় ফেলার জন্য স্পন্দন বলল,
– বন্ধুর কারণে এসেছিলাম কিন্তু বন্ধু তো আজ মধু পেয়ে নিমপাতাকে ভুলে গেছে। নিম তিতা হলেও উপকারী সেটা সে ভুলে গেছে। বন্ধুর দেখাদেখি আমিও মৌমাছির মত মধু আহরণ করতে এসেছি।

– লা’গাম ছাড়া কথা বার্তা। অ’সভ্য পুরুষ লোক।
– ভুল বললে, অ’সভ্য পুরুষ নয় অ’সভ্য প্রেমিক পুরুষ হবে কথাটা।
– আম্মুকে বলেছি আমাদের কথা। আম্মু ভ’য় পাচ্ছে আপনার পরিবারের সাথে কথা বলতে।
– সমস্যা নেই আমি সামলে নিবো।
– সত্যি?
– হুম।

আরো দুটো দিন বরিশালে থেকে সিলেটের উদ্দেশ্য যাত্রা দিল ছয়জন। বাসায় এসে গভীর ঘুমে ডুব দিল শুভ্রতা এবং নেহা। মিষ্টি তিশানের সাথে আরেক বাসায়।
স্পন্দন রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল তখনই মায়ের ফোন আসাতে রিসিভ করল।
– তুই নাকি শুভ্রতাকে বিয়ে করতে চাস? আমাদের এত অ’পমান করা সত্ত্বেও তুই কীভাবে ওই মেয়েকে বিয়ের কথা ভাবলি। আমি কিংবা তোর বাবা কিছুতেই মেনে নিবো না ওই মেয়েকে।

– আমি শুভ্রতাকে ভালোবাসি। বিয়ে করব বলেছি তাহলে আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করব, হয় বিয়ের আয়োজন করো নয় তোমাদের নাতি নাতনী দেখার ইচ্ছে বন্ধ করো।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলো স্পন্দন। আবারো ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিল কাজে।

কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি। তিশান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কফি হাত থেকে নিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
– তুমি আমাকে ভ’য় পাচ্ছ না কেন মিষ্টি? তোমার ভ’য়ার্ত মুখ আমাকে খুব টানে।
মিষ্টি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল,

– যেকারনে ভয় পেতাম সেকারণ এখন নেই মিষ্টার স্বামী সো ভয় পাচ্ছি না।
– দিনদিন দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ তুমি।
– আমাকে দুষ্টু বানানোর মাস্টার মশাই তো আপনি। মাষ্টার যেমন ছাত্রী তেমন হবে না তো কীরকম হবে হ্যাঁ?
– আবারও আপনি? আমি কিন্তু রে’গে যাচ্ছি।

– চেষ্টা করছি তো কিন্তু হচ্ছে না।
– ওকে, বলো তুমি, তুমি এবং শুধুই তুমি।
লজ্জাকে বি’সর্জন দিয়ে বলল মিষ্টি,
– তুমি, তুমি এবং শুধুই তুমি।
– এইতো আমার বউটা পেরেছে। লাভ ইউ।

সময় চলতে লাগলো আপন গতিতে। দেখতে দেখতে দু’মাস সময় চলে গেল। পরীক্ষার পর শুভ্রতা এবং নেহা বাসায় গিয়েছে। শুভ্রতা বাসায় যাবার দুইদিন পরেই আবারও শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। এখন অবশ্য ঘটা করে মেয়ের বিয়েটা দিবেন আজিদ হাওলাদার।

পাড়াপড়শি আত্মীয়-স্বজন সবাইকে বলতে ভুলেননি। মিষ্টি চলে এসেছে বিয়ের দুদিন আগেই পাত্রী পক্ষ হয়ে। অন্যদিকে তিশান ছেলে পক্ষ হয়ে স্পন্দনের বাসায় হাজির। অনিক আসবে হলুদ পোগ্রমে। বিয়ের তিনদিন আগে থেকেই চলছে সানাইয়ের সুর। পুরো বাড়ি ঝলমল করছে লাইটিং।

মনে হচ্ছে কোনো দেশের রাজকন্যার বিয়ের আয়োজন। শুভ্রতা খুশিতে আ-ত্ম-হা-রা। তবে ব্যাস্ততার মাঝেও মুনির কাছ থেকে ক্ষ’মা চেয়ে নিয়েছে সে। মুনি তো খুশিতে গদগদ। মুনির খুশি দেখে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেনল স্পন্দনের বাবা মা। মুনি হচ্ছে তাদের কাছে সবথেকে ইম্পর্টেন্ট। মুনি খুশি তো তারাও খুশি।

কেননা, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুটিকে সঙ্গ দেওয়া, দেখাশোনার দায়িত্ব, তাদের মতামত সবকিছুই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিৎ। প্রতিবন্ধীদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ, ইসলামে এ বিষয়ে একটি হাদিস রয়েছে,

প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) একাধিকবার তাঁর অনুপস্থিতির সময় মদিনার মসজিদে নববিতে ইমামতির দায়িত্ব এক প্রতিবন্ধী সাহাবির ওপর অর্পণ করে তাদের সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত করার নজির তৈরি করেন। তিনি সেই প্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে আজান দেওয়ার কাজেও নিযুক্ত করেছিলেন। (বুখারি, অধ্যায়: মাগাজি, অনুচ্ছেদ: বদর ও ওহুদের যুদ্ধ)।
একারণেই মুনির মতামত সবার উপরে।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৯

বিয়ের আসরে বউ সেজে বসে অপেক্ষা করছে শুভ্রতা ঠিক তখনই নেহা দৌড়ে এসে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,
– স্পন্দন স্যার পালিয়ে গেছেন।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে শেষ পর্ব