সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে শেষ পর্ব 

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে শেষ পর্ব 
ফারজানা আফরোজ 

শুভ্রতা থমকে গেল। হঠাৎ তার পুরো দু’নিয়া এলোমেলো হতে শুরু করল। ঝাপসা আঁখিযুগল হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নেহার দিকে তাকিয়ে বলল,
– মজা করছিস তাই না? স্পন্দন আমাকে ভীষন ভালোবাসে ও কখনোই এ ভুল করবে না। মানছি অভি’যোগ ছিল কিন্তু সবকিছুর ইতি টেনেছে স্পন্দন। ও আমাকে ঠ’কাতে পারে না। আমি না বুঝে দো’ষ করেছি কিন্তু সে বুঝে শোনে দো’ষ কেন করবে?

এক নিমিষেই কথাগুলো বলে ফোন খোঁজতে লাগল শুভ্রতা। স্পন্দনের নাম্বারে ডায়াল করে বরাবরই বন্ধ পেল ফোন। তিশান স্যারকে ফোন দিল। গম্ভীর স্বরে তিশান বলল,
– স্পন্দন কোথায় আমি জানি না শুভ্রতা। প্রতি’শো’ধের নে’শায় তোমাকে ইউজ করেছে। ভালোবাসেনি কখনো। ভুলে যাও স্পন্দনকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিশান ফোন কেটে দিল। শুভ্রতা শব্দ করে কেঁদে উঠল। নেহা, মিষ্টি এবং অনিক সামলানোর চেষ্টা করল কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ তারা। শুভ্রতার বাবা দরজা বন্ধ করে রূমের ভিতরে বসে আছে। শুভ্রতার মা ড্রইং রুমের এক কোণায় চুপটি করে বসে আছেন। লোকজন বলাবলি করছেন, মেয়ে পালিয়েছে আগের বার এখন ছেলে পালিয়েছে। প্রতি’শো’ধ নেওয়ার জন্যই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে বরপক্ষ। আরো নানান কথা বলতে লাগল। কথায় আছে, অন্তরে বি’ষ মুখে হাসি তারই নাম প্রতিবেশী। তারা সুযোগ খোঁজে কীভাবে অন্যকে শা”য়েস্তা করা যায়।

শুভ্রতা দাঁড়ালো। সে স্পন্দনের বাসায় যাবে বলে ঠিক করল। মিষ্টি ও নেহা বারণ করেছে কিন্তু শুভ্রতা যাবেই যাবে। বাসার মেইন দরজা দিয়ে যেতে পারবে না বলে আগের মতোই জানালা টপকে বের হলো স্পন্দনের বাসায় উদ্দেশ্য।

আকাশে আজ তারার মেলা চাঁদের অস্তিত্ব নেই। ফোনের লাইট অন করে শুভ্রতা এগুচ্ছে মেইন রাস্তায়। একটা রিক্সা ডেকে চলল স্পন্দনের বাড়ি। কা’ন্নার কারণে ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। অন্যমনস্ক হয়ে যখন সে যাচ্ছিল আচমকা রিক্সা থেমে যাওয়াতে বড় বড় চোখে তাকালো। অন্ধকারে লম্বা ছায়া মূর্তি দেখে ভ’য় পেল ভী’ষন। ভ’য়ে ভ’য়ে বলল,

– কে আপনি?
লোকটি ফোনের লাইট শুভ্রতার মুখে ধরল। শুভ্রতা আলো চোখে পড়তেই চোখজোড়া বন্ধ করে কঠিন গলায় বলল,
– কী হচ্ছে এসব? আলো সরান।
লোকটি বলল,
– প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণা মিটাচ্ছি।
শুভ্রতা আবারও থমকে গেল। কাঁ’পা সুরে বলল,

– স্পন্দন!
স্পন্দন ফোনের লাইট অফ করে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসল। শুভ্রতা স্বপ্ন দেখার মত বিস্মিত হলো। স্পন্দনের হাতে চি’মটি কা’টল। স্পন্দন আ’র্ত’না’দ করে উঠল,
– এই কী করছো তুমি?
– আপনি সত্যিই এসেছেন নাকি স্বপ্ন দেখছি?
স্পন্দন বিরক্তি নিয়ে তাকালো শুভ্রতার পানে। শুভ্রতা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

– আমার প্রতি এত অভি’যোগ তাহলে ভালোবাসা শিখালেন কেন?
– সময় বলবে সবকিছু এখন চুপ থাকো। মামা কাজী অফিসের সামনে নিয়ে যান।
শুভ্রতা অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। কিছু বলতে যাবে তখনই স্পন্দন মুখ চে’পে ধরে গরম চোখে তাকালো। রিক্সা গিয়ে থামলো কাজী অফিস। ভাড়া মিটিয়ে শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই তিশানকে দেখে আবারও চমকে উঠল শুভ্রতা। স্পন্দন কাজীকে বলল,

– মিয়া বিবি চলে এসেছে তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজ সম্পূর্ন করুন।
শুভ্রতা এবার তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠল। তার বাবা কত টাকা খরচ করে বিয়ের আয়োজন করেছে। এখন পাড়াপড়শি বা’জে কথা বলছে সেখানে এ ছেলে কাজী অফিসে বিয়ে করতে নিয়ে এসেছে। রা’গ হলো ভীষন। রা’গ অভি’মান নিয়ে বলল,

– এই বিয়ে আমি কিছুতেই করব না।
– বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছ এখন নাকি বিয়ে করবে না। চুপচাপ সিগনেচার দেও। কথা বলবা তো থা’প্পড় খাবা।
– হু’মকি দিচ্ছেন?
স্পন্দন কঠিন চোখে তাকালো শুভ্রতা ভ’য়ে তাড়াতাড়ি সই করে দিলো কাবিন নামায়। প্রকৃতির নিয়ম বড়ই অদ্ভুত। প্রথমে বউ পালালো , দ্বিতীয়বার বর পালালো। জাকজমোক বিয়ে হলো লুকিয়ে। স্পন্দন শুভ্রতার কানে ফিসফিস করে বলল,

– বলে ছিলাম বিয়ে আমি পালিয়েই করব। কথা আমি রেখেছি।
শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে রাখল। আপাতত সে ভীষন রে’গে আছে স্পন্দনের উপর। স্পন্দন ফোন দিল শুভ্রতার বাবার কাছে,
– আসসালামু আলাইকুম বাবা, আমি স্পন্দন আপনার মেয়ের হাজব্যান্ড। আমার ইচ্ছে ছিল পালিয়ে বিয়ে করার সেজন্য আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেলাম।

জানি আপনার অনেক ক’ষ্ট হয়েছে সেজন্য আমি খুবই দুঃখিত। আজ যদি আমি পালিয়ে না যেতাম তাহলে আমার পরিবার শুভ্রতাকে খোঁ’চা দিয়ে কথা বলার সুযোগে থাকতো। যেহেতু এখন আমরা দুজনই একই রকম অ’ন্যায় করেছি সেক্ষেত্রে দুই পরিবার আমাদের খোঁ’চা মে’রে কথা বলতে পারবে না। আমাদের দুজনের ভু’লগুলো ক্ষ’মা করবেন আপনারা। আমরা ছোট মানুষ ভু’ল আমরাই করব, আপনারা গুরুজন ক্ষ’মা আপনারাই করবেন। ভালো থাকবেন এবং দু’আ করবেন আমাদের জন্য।

স্পন্দন চট করে ফোন কেটে দিল। শুভ্রতার অবাক চাহনি দেখে দুষ্টু হেসে বলল,
– আজ আমাদের বাসর রাত হবার কথা না? কিন্তু রাত তো অনেক হয়ে গেছে।
শুভ্রতা লাজুক চোখে আশেপাশে চোখ বুলালো। তিশান কানে হাত দিয়ে বলল,
– আমি কিছু শুনিনি।

গভীর রাত। স্পন্দন বাইক নিয়ে অজানা রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে তারই পিছনে পিঠে মা’থা ঠেকিয়ে স্পন্দনের রাজ্যেয় পাড়ি দিচ্ছে শুভ্রতা। হালকা মৃদু বাতাসে কেঁ’পে উঠছে শুভ্রতার দে’হ’স্ত। শুভ্রতার শীতল স্পর্শে স্পন্দন হারাচ্ছে মহিমায়।
বাইক এসে থামলো একটি বাংলোর সামনে।

স্পন্দন শুভ্রতার হাত শক্ত করে ধরে ভিতরে প্রবেশ করল। পুরো রুম হলদে ভাব। মোমবাতির আলোয় আলোকিত পরিবেশ। শুভ্রতা মুগ্ধ চোখে দেখছে সে দৃশ্য। স্পন্দন আচমকা শুভ্রতার কো’মড়ে স্পর্শ করে চুল পিঠ থেকে সরিয়ে আলতো ঠোঁটে স্পর্শ করতেই কেঁ’পে উঠল শুভ্রতা। স্পন্দন শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে চলল ডাইনিং টেবিলের সামনে।

– খাওয়া দাওয়া হয়নি সারাদিন? খাবার আছে খেয়ে নাও।
স্পন্দন আগে থেকেই সব রেডি করে রেখেছিল। সে জানতো শুভ্রতা বিয়ে ভাঙার পর তার সাথে দেখা করতে আসবে। সেকারনেই সব প্ল্যান অনুযায়ী গুছিয়ে রাখে। শুভ্রতা খাবার দেখে এক মিনিট সময় নষ্ট না করে খেতে লাগল। সারাদিন খুব ধকল গিয়েছে তার উপর। শুভ্রতা এক লোকমা খাবার নিজের মুখে দিতে যাবে তখনই স্পন্দন লোকমা নিজের মুখে পুরে নিলো। শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

– কী হলো এটা?
স্পন্দন বলল,
– জানো, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে স্বামী তার স্ত্রীকে এক লোকমা ভাত খাইয়ে দিবে, আল্লাহ ওই স্বামীর ছগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দিবেন এবং যে স্ত্রী তার স্বামীকে এক লোকমা ভাত খাইয়ে দিবে আল্লাহ ওই স্ত্রীর ছগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দিবেন এবং প্রতি লোকমার বিনিময়ে ১০০০ নেকি উভয়ের আমলনামায় দান করবেন।’ (মুসলিম শরীফ) ।

– তাহলে এখন আপনি আমায় খাইয়ে দেন।
স্পন্দন শুভ্রতার মুখে ভাত তুলে দিলো। শুভ্রতাও স্পন্দনের মুখে ভাত তুলে দিলো। খাওয়া দাওয়া সেরে স্পন্দন শুভ্রতাকে নিয়ে একটি রুমে প্রবেশ করল। রুমটি ছিল ফুলের সমাহার। চারদিক থেকে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। রাতের অন্ধকারে ইতি টানবে পুরনো অতীত, ভোরের আলো ফোটার পরপর শুরু হবে জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

পরের দিন স্পন্দনের মা প্রথমে ছেলের কাজে অ’সন্তুষ্ট থাকলেও পরে অবশ্য মেনে নেই দুজনকে। আবারো মেতে উঠে দু’পরিবার আনন্দে উল্লাসে। বিয়ে শব্দই দুটো মনের নয় দুটো পরিবারেরও সেতু বন্ধন। সন্তানের করা অ’ন্যায় বাবা মা সহজেই ভুলতে পারে কারণ মা কিংবা বাবা ডাক না শোনার কষ্ট তারা সইতে পারে না।

অ’ন্যায় করলেও সন্তান সন্তানই থাকে। দেখতে দেখতে দু’মাস চলে গেল। আজ স্পন্দনের পরিবার সবাই মিলে শুভ্রতাদের বাসায় যাবে। বিয়ের পর তৃতীয়বারের মতো শুভ্রতা বাবার বাড়ি যাচ্ছে। আজ নেহা এবং অনিকের বিয়ে। নেহা অনিকের কথা তার পরিবারকে প্রথম জানানোর পরই নেহার পরিবার মেনে নেয়।

ছেলের ক্যারিয়ার ভালো এগিয়ে যেতে স’মস্যা হবে না তাছাড়া মেয়েরও বয়স হচ্ছে সে কথা বিবেচনা করেই দুই পরিবার মিলে বিয়ের আয়োজন করে। তবে ওদের এক্সাম থাকায় দুমাস পর বিয়ের তারিখ ফাইনাল করতে হয়। ছয় জনই সিলেট থেকে দু’দিন আগে চলে আসে। বিয়ের আমেজ যেন এ ছয় জনের পিছু ছাড়ছে না, প্রথমে মিষ্টি তিশান, দ্বিতীয়ত স্পন্দন শুভ্রতা এখন বন্ধু মহলের শেষ কপোত-কপোতী অনিক নেহা।

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে নেহা, অনিক কেশে রুমে প্রবেশ করল। বি’ব্র’ত’বো’ধ করছে সে। গলা ঝেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে বুঝালো, নেহা এখন তোর বউ, বি’ব্র’ত’বো’ধ করছিস কেন?
নেহা অনিকের দিকে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

– কথা বলছিস না কেন? হা’দা’রা’ম।
– এখন আমি তোর বর ভুলেও ব’কা দিবি না। জামাইকে আপনি বলতে শিখ।
– বয়ে গেছে তোকে আমার আপনি বলতে! ছ্যাঁ’কা-খোর শিল্পী।
– আমি মোটেও ছ্যাঁ’কা খাইনি। তাছাড়া আমি রোমান্টিক গান গাইতে পারি।
– তাই নাকি? তাহলে শুনতে হয় তো রোমান্টিক গান। বল, বল।
– বাসর রাতে সোহাগ প্রীতি হয়। গান নয়।
– আমি গাইতে বলছি তুই গান গাইবি। আমি আর কোনো কথা শুনব না। হুম।

নেহার কথায় রাজি হয়ে অনিক গাইতে লাগলো,
কন্যা কইরো নাগো আড়ি
আমার লগে যাইবানি গো
আমার বাপের বাড়ি(২)
কন্যা কইরো নাগো দেরি
কিইনা দিমু রেশমি চুরি
সাথে দিমু শাড়ি।

বইয়ের মাঝে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে মিষ্টি। তিশান ফ্রেশ হয়ে এসে মিষ্টিকে এভাবে ঘুমাতে দেখে মৃদু হাসলো। মেয়েটা বড্ড পাগলী এবং ঘুম কাতুরে। মিষ্টির ঘুম যেন না ভাঙ্গে সেজন্য মিষ্টিকে সযত্নে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সেও আলতো জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে রইল। মনে মনে বলল,
– পৃথিবীটা আসলেই সুন্দর। ভালোবাসাময় পৃথিবীতে থাকতে চাই তোমার হাত ধরে শত জনম।

শুভ্রতা আজ লাল শাড়ি পরেছে। খোলা চুল, ডাগর ডাগর চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। স্পন্দন এক পলক তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। শুভ্রতার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বলল,

-মাশাআল্লাহ দারুণ লাগছে। ওহে মোর প্রেম পূজারী প্রিয়দর্শিনী,
তুমি এই স্পন্দনের হৃদয় গহীনের অধিকারিণী,
তুমি থাকবে এই স্পন্দনের হৃদমাঝারে বন্দিনী ।
ওহে আমার হৃদয় হরণী ,হৃদ মহিণী
তুমি এই স্পন্দনের আগামী দিনের পথচলার সঙ্গিনী ‌।
শুভ্রতা মুচকি হেসে জবাব দিলো,
–” নামের মতোই তুমি আমার প্রা’ণের স্পন্দন,
তোমার সুভাসে আমি শুভ্রতা ছড়াতে চাই,
হৃদয়ের স্পন্দনের প্রতিটি প্রহরে,
ভোরের শুভ্রতার মতো তোমার ছোঁয়া পেতে চাই!!

সমাপ্ত

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা আমি আগে থেকেই ভেবেছি এভাবে লিখব। চাইলে গল্পটা আরো বড় করা যেত কিন্তু তখন মনে হতো স্টার জলসা হয়ে যাচ্ছে গল্পটা। রা’গ অভি’মান গল্পের সুন্দর্য নষ্ট করে দিত (আমার একান্ত মতামত)। জানি না গল্পটা আপনাদের কাছে কীরকম লেগেছে তবে আমি ইচ্ছে করেই গল্পটা বড় করিনি। ভালো না হলে ক্ষ’মা করবেন। নতুন গল্প নিয়ে আসবো কিছুদিনের ভীতরে। ধন্যবাদ।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে  পর্ব ১০