সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৯

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৯
ফারজানা আফরোজ 

শুভ্রতার ভ’য়ার্ত মুখখানা দেখে মৃদু হাসলো স্পন্দন। আচমকা শুভ্রতার চিবুকে স্পর্শ করল। শুভ্রতা স্পন্দনের স্পর্শে কেঁপে উঠল। আলতো হাতে শুভ্রতার চুলে মুখ গুজে ওষ্ঠ জোড়া স্পর্শ করে ঘ্রাণ নিল। নেশালো কণ্ঠে বলল,

– চুলের ঘ্রাণ আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। সেদিন যদি বিয়েটা হয়ে যেত তাহলে আজকে আমাদের সম্পর্কের নাম থাকত কিন্তু আফসোস সেটা হয়নি। মানুষ যা দেখে সবকিছুই কিন্তু সত্য হয়না। অবাস্তব পবিত্র সম্পর্ককে আপনি নিচু দৃষ্টিতে দেখেছেন।
শুভ্রতা কম্পিত সুরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– সেদিন আমার বিহেভে আপনি ক’ষ্ট পেয়েছিলেন?
স্পন্দন হাসলো। হাসির মাঝই লুকিয়ে ফেলল পুরনো অতীত।
– আমাদের জন্য ওরা অপেক্ষা করছে।
শুভ্রতা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
– শা’স্তি দিবেন না?
স্পন্দন ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে শুভ্রতার কোমড়ে আলতো স্পর্শ করে বলল,

– এখনও শাস্তি চাই?
শুভ্রতা বরফের মত জমে গেল। স্পন্দন এমন করবে সে ভাবেনি। নিজেকে সামাল দিয়ে বলল,
– আপনি কিন্তু ঠিক করছেন না।
স্পন্দন শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে স্থান ত্যাগ করল। শুভ্রতা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে সামাল দিয়ে আবারও যোগ দিলো আড্ডা মহলে।

সময় দ্রুত চলে যায়। দেখতে দেখতে মিষ্টির গায়ে হলুদের দিন চলে আসলো। শুভ্রতা ও নেহা হলুদ রঙের শাড়ি, ফুলে সেজেছে। মিষ্টি হলুদ এবং গোলাপি মিক্স শাড়ি, ফুলের মালা, গয়নায় সেজেছে অপরূপা। অনিক হলুদ শেরওয়ানি, গোল্ডেন কটি।

ছেলেরা সবাই একই রকম সেজেছে এবং মেয়েরাও একই রকম সাজ শুধু কনে বর দুজন ব্রাইডাল সাজে সজ্জিত। গ্রামের বিয়ে সাধারণত যেভাবে হয় সেইরকম ভাবেই মিষ্টির বিয়ে হচ্ছে। পায়ে হেঁটে মেয়েরা ছেলের বাড়ি যাচ্ছে । দশ মিনিটের রাস্তা, মেয়ে পক্ষকে হাতে হাতে গোলাপ ফুল দিয়ে বরণ করছে ছেলে পক্ষরা। মেয়ে পক্ষরা চলে যাবার পরপরই ছেলে পক্ষরা যাবে কনে বাড়িতে।

শাড়ির আঁচলে টান পড়াতে নেহা গরম চোখে তাকালো। অনিক বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল,
– বিয়ে বিয়ে ভাব পাচ্ছে চল বিয়ে করে ফেলি।
– তোর মত আ’হম্মকে বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে। আমি তো ভাবছি এখান থেকে বেয়াই একটা পটিয়ে বিয়ে করে ফেলব।

– দেখি কার কত সাহস আমার জা’নে হাত বাড়ায়। তোকে কিন্তু আজ মা’রাত্মক সুন্দরী লাগছে। চোখ কিছুতেই অন্যদিকে যাচ্ছে না।
– কেন অন্য মেয়ের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে? চোখ খু’লে মা’র্বল খেলব বলে দিলাম।
– যে চোখ এক নারীতে আ’সক্ত সে চোখ অন্য নারীর পানে তাকায় না। সুন্দরী রমণী সে চোখে একজনই থাকে।
নেহা লজ্জা পেলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে আসা মুখটির দিকে তাকিয়ে অনিক একটি ভ’য়ানক আবদার করে বসল।
– আমি যদি আজ তোর কপালে চুমু খাই সেটা বড্ড অন্যায় হয়ে যাবে নেহু? ভুল বুঝিস না।

নেহা শুনল সে কথা। দম ছেড়ে বলল,
– খুব তাড়াতাড়ি তোর ইচ্ছেটা পূর্নতা পাক সেটার জন্য লড়ব আমি। সিলেট যাবার পর আমি আমাদের সম্পর্কের কথা জানাবো। আজকাল ইন্টারের ছেলে মেয়েরা প্রেম করে বিয়ে করে ফেলে সেখানে আমরা অনার্স। জানি বাসায় সমস্যা হবে কিন্তু আমি ম্যানেজ করে নিবো।

আমাদের ছোট্ট সংসার তৈরি করব। তুই তো এখন আর বেকার নস।
অনিক অবাক চোখে তাকালো। হঠাৎ চোখ বেয়ে দু’এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। দুঃখের জন্য নয়, প্রাপ্তির অশ্রু। নেহা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল,

– ছেলে মানুষের কাঁ’দতে বারণ জানিস না। হা’দা’রা’ম।
– কেন? ছেলেদের বুঝি মন নেই? সুখে দুঃখে মনের ভিতরে থাকা অনুভুতিটা প্রকাশ করতে পারবে না? তোদেরই বুঝি অনুভূতি আছে?
নেহা কথা বাড়ালো না। অনিকের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।

গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে শুভ্রতার মা’থায় ছুঁড়ে মা’রল স্পন্দন। শুভ্রতা চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
– স্যার মানুষের নি’র্লজ্জ হওয়া ঠিক নয়। ছাত্রীর সাথে প্রেম করাটা ঘোর অন্যায়।
– স্যার কী সাধে হয়েছি? আপনাকে দেখার তৃষ্ণা মেটানোর জন্যই সিলেটে টিচার হয়ে আসা। যদি এই তৃষ্ণার্ত চাতকের কথা ভাবতেন তাহলে তো হয়েই যেত আমার।

– কী হতো?
– নেগেটিভ না ভেবে পজিটিভ ভাবুন। বলছি বিয়েটা হয়ে যেত।
শুভ্রতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে মনে মনে কতগুলো কথা সাজালো। স্পন্দনের হাত ধরে বাড়ির পিছনের দিকটায় হাঁটা ধরল। স্পন্দন অবাক হলো ভীষন। শুভ্রতা তার হাত ধরেছে ভাবতেই শিউরে উঠল প্রা’ণ।

– আপনাকে আমি অ’পমান করেছি, আপনার পরিবারকে অ’সম্মান করেছি তারপরও আমায় ভালোবাসেন? সত্যিই কী ভালোবাসেন? ছ’লনা করছেন না তো?
শুভ্রতার প্রশ্নে স্পন্দন থমথম খেয়ে গেল। উত্তর কী দিবে তা নিয়ে দ্বিধা’বোধ। চোখজোড়া বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে বলল,

– যদি ভালোবাসি তাহলে আপনিও ভালোবাসবেন আমায়?
স্পন্দনের এ ধরনের প্রশ্ন কিংবা উত্তর পাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শুভ্রতা।
– আপনার পরিবার মেনে নিবে আমাকে?
– আমি যদি মানি সেখানে আমার পরিবার মেনে নিতে একশো পার্সেন্ট বাধ্য।
– আমার সময়ের প্রয়োজন।

– ওকে দিলাম। সময়ের পর যেন ‘হ্যাঁ’ শব্দই শুনতে পারি। আমি কিন্তু না বলাতে অভ্যস্ত নই। সোজা আ’ঙ্গুলে ঘি না উঠলে আ’ঙ্গুল বাঁকা করতে এ স্পন্দনের এক বিন্দু সময় নষ্ট হবে না।
– হু’মকি দিচ্ছেন?

– নাহ। সোজা কথা বললাম। বাই দা ওয়ে, রাতে দেখা করবেন? পুকুর ঘাটে?
শুভ্রতা জবাব দিলো না। নিরব থেকে সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিল।
মেয়ে পক্ষ চলে এসেছে। তাদের পিছন পিছন ছেলে পক্ষরা এসেছে। ধুমধাম করে হলুদ প্রোগ্রাম শেষ হলো। রাত দুটো, শুভ্রতা চুপিসারে পুকুর ঘাটে হাঁটা দিল। স্পন্দন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে লাইটিং ঝলমল করছে চারদিকে। পিছন থেকে বলে উঠল স্পন্দন,

– হঠাৎ এক ডাকে এত রাতে চলে যে এসেছেন এখন যদি আপনার সাথে খা’রাপ কিছু ঘটনা ঘটে তখন কী করবেন?’
খুব সিরিয়াস হয়ে কথাগুলো বলল স্পন্দন। শুভ্রতা ভ’য়ে কিঞ্চিৎ ভড়কে গিয়ে চারপাশে চক্ষু যুগল ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আমতা আমতা করে বলল,
-কেন ডেকেছেন আমাকে?

শুভ্রতার ভ’য় মিশ্রিত কণ্ঠ স্পন্দনের কুর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই হেসে উঠলো স্পন্দন। ভুবন কাঁ’পিয়ে হাসা যাকে বলে। শুভ্রতা স্পন্দনের হাসি শোনে আবারো চারদিক চোখ বুলালো। নিস্তব্ধ নির্জন পরিবেশ, বিয়ে বাড়ি থেকে মাঝারি সাইজের টেবিল এনেছে স্পন্দন, দু’দিকে চেয়ার, মোমবাতির আলোয় হলদে ভাব চারপাশ।

মাঝে মধ্যে বাতাসের মৃদু আঁচ মোমবাতিগুলোকে নিভিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে সফল হয় কিন্তু সেই সফলকে বেশিক্ষণ স্থায়ী না করে স্পন্দন লাইটার দিয়ে আবারো মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দেয়। শুভ্রতা স্পন্দনের দু’চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেতে চায় অজানা রাজ্যের রানী হয়ে। স্পন্দন মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে স্মিত কণ্ঠে বলল,

– কথা বলছেন না কেন? এক ডাকেই যে চলে আসলেন, আপনি কি ঠিক কাজ করেছেন? এখন আমি যদি আপনার সাথে খা’রাপ কিছু করে ফেলি তখন নিজেকে কীভাবে বা’চাঁ’বেন?’
আবেগে চলে আসা শুভ্রতা এখন চিন্তা ভাবনায় মগ্ন। কিছুদিন আগেও স্পন্দন তাকে কিস করেছে, গতকাল রাতেও স্পন্দন এমন করেছে। তার আসাটা কী তাহলে ভুল হয়েছে? মন বলল না ভুল হয়নি।

শুধু পছন্দ নয় সে ভালোবাসতে শুরু করেছে স্পন্দনকে। ভালোবাসার টানেই যখন স্পন্দন বলল তাকে রাতে একবার দেখা করার জন্য তখনই সাথে সাথে নিরবে ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়। ‘হ্যাঁ’ বলার পর আবার কিছুক্ষণ থমকে গিয়েছিল সে।

মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে মিষ্টির থেকে নেওয়া নীল শাড়ি অঙ্গে জড়িয়ে হালকা সাজে খোলা চুলে রাত দুটোয় বাসা থেকে বের হয়। অবশ্য মিষ্টি এবং নেহা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাড়ির বড়রা ব্যাস্ত কাজ নিয়ে, কেউ কেউ মশলা পিষছে, কেউ মুরগি কেউ বা গরুর মাংস সাইজ করছে। । এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো স্মরণ করে ডাগর ডাগর চোখে তাকালো শুভ্রতা। স্পন্দন শুভ্রতার চোখের পানে তাকিয়ে চোখজোড়া নিচু করে মুচকি হেসে বলল,
– সময় নিয়েছিলেন সেটা কী স্থ’গিত করবেন মিস শুভ্রতা?

শুভ্রতার হঠাৎ কী হলো সে জানে না। আচমকা স্পন্দনের শার্টের ক’লার চে’পে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
– ভালোবাসি। ভালোবাসা কীভাবে হয়েছে জানা নেই তবে আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আপনার প্রেমে পড়েছি। আপনাকে পাওয়ার লোভ আমার সেদিনই জন্ম নিয়েছিল যেদিন আপনি আমার ভুল শুধরে দিয়েছিলেন।
স্পন্দন বলল,

– আমি তো কাজল চোখের মায়ায় পড়েছি। গোলাপি রঙের পাঁপড়ির মত ঠোঁট জোড়ার নেশায় বুদ হয়ে গেছি। ভ’য়ার্ত কথার জালে আটকা পরে গেছি। পৃথিবীতে যেমন চন্দ্র, সূর্য, নকত্র সত্য তেমন আমার ভালোবাসাও সত্য। আপনাকে হারানোর ভ’য়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ৮

সেই হারানোর মুহূর্তে এক মুঠো রোদ্দুর নিয়ে তিশান জানালো আপনি সিলেটে, মন বলেছিল আপনাকে আমি পেয়ে গেছি। আমি যদি আবারও আপনাকে বিয়ে করতে চাই আপনি কি রাজি হবে? পালিয়ে যাবেন না তো আবার?
শুভ্রতা বলল,
– মানুষ একবার ভুল করে, বারবার নয়।

সেদিন তুমি প্রেম নিয়ে এসেছিলে পর্ব ১০