স্বামী পর্ব ১১

স্বামী পর্ব ১১
লেখকঃপারভেজ ইসলাম

আমি খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে দুইহাত ভাজ করে কটমট দৃষ্টিতে আদৃতের দিকে তাকিয়ে আছি।আর সেই মহাশয় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে।ডাক্তার তার হাত ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন।আল্লাহ খুব অবাক হচ্ছি এইভাবে কাটা জায়গায় সেভলন লাগাচ্ছে আর উনি চুপচাপ বসে আছেন।ব্যাথায় চিল্লানো তো দূরে থাক হাতটাও নাড়াননি।এতো শক্ত মানুষও হয়।বুঝেছি উনি বোঝাতে চাইছেন যে ব্যথা বলতে উনার কিছুই নেই।কিন্তু উনি যে হৃদয়ের ব্যথায় এসব করেছেন তা বুঝতে আমার একটুও সময় লাগেনি।যেসব মানুষরা নিজেদের শক্ত,কঠোর বোঝাতে চাই দেখতে গেলে তারা মনের দিক দিয়ে অনেক নরম হয়।

একটু কষ্ট পেলেই তা তাদের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে।তাদের মনকে ভাঙতে বা ব্যথা দিতে বেশি কষ্ট করা লাগে না। কিন্তু তারা যে ব্যথা প্রকাশই করে না তাই তোহ মানুষ ভাবে তারা কষ্ট পাইনি আর বারবার তাদের আঘাত করতেই থাকে।আবার আদৃতের দিকে তাকালাম সে মুখ নিচু করেই বসে আসেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখন রক্তমাখা হাত দেখে অনেক ঘাবরে যাই।দৌড়ে গিয়ে দেখি আদৃত খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আসেন।সামনে ভাঙা কাচের ছড়াছড়ি।সেই কাচগুলোরি কোনো এক টুকরাই কেটে গিয়েছে আদৃতের বা হাতের তালু।আর সেই কাটাস্থানই হলো রক্তের উৎস।আমি আদৃত বলে চিল্লিয়ে উঠি।আদৃত আমার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেন।আর আমি তার অবস্থা দেখে পুরাই থমকে যাই।পুরাই কাবির সিং।পরনে সাদা শার্ট তাও ছেড়াব্যাড়া হয়ে আছে শার্টটা।তাতে রক্ত মাখা আর কালো প্যান্ট।আল্লাহগো আল্লাহ আমার জন্য কেউ নিজের এমন অবস্থা করেছেন ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।আমি জলদি করে আদৃতকে ধরে উঠাতে লাগলাম।আদৃত এই অবস্তাতেও জিজ্ঞেস করছে,

আদৃতঃজান্নাত আপনি কি আমায় মাফ করেছেন নাকি শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছেন।
আমার মন চাচ্ছে বলি আপনায় উগান্ডার ফ্লাইটে উঠিয়ে দিতে এসেছি।নাম্বার ওয়ান গর্ধব।এরই মধ্যে ময়না খালা দৌড়ে আসেন।আমি উনায় বলি ডক্টরকে ফোন দিতে।
আমিঃআপনার বাসা ঘুরে দেখতে এসেছি।এখন মুখ বন্ধ করে বসে থাকবেন।হাত কতখানিক কেটে গিয়েছে।বাচ্চা নাকি আপনি?পাগল হয়ে গিয়েছেন?

আমি উনাকে উঠিয়ে খাটে বসিয়ে উনার কাটা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কথাগুলো বলি।আমার জন্য উনি এমনটা করেছেন।সব অপরাধ আমার।মনে আছে উনি একবার বলেছিলেন আমি নাকি আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে ভাবি।কিন্তু উনি ভুল ছিলেন আমি যদি বিবেক খাটিয়ে শান্ত মনে ঘটনাকে বোঝার চেষ্টা করতাম তাহলে এমন কোনো কিছুই হতো না।আদৃত যে ঠিক তা আগেই বুঝতে পারতাম।হুম আদৃতকে মাফ করে দিয়েছি।তার স্ত্রী হয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়।

তার প্রিয়তমা,তার ভালোবাসার মানুষ হয়েই থাকতে চাই।তাকে এগুলোই বলতে এসেছিলাম।আমি বাবুকে আর জিনিস নিয়ে আসেনি কারণ তার একটু হলেও শাস্তি পাওনা আছে?।আর এই জন্য ভেবেছিলাম এসে একটু রেগে থাকার নাটক করে তাকে চমকে দেব।কিন্তু এসে তো আমি নিজেই চমকে গিয়েছি।সে অলরেডি নিজেকে সহ আমাকে শাস্তি দিয়েই বসে আছে।এই লোকটাকে বুদ্ধিমান ভাবার মতো ভুল করলাম কিভাবে?যে জেনেশুনে অন্যের জন্য নিজের ক্ষতি করে তার চেয়ে বোকা প্রাণী দুনিয়াতে আছে বলে আমার মনে হয়না।অন্যের জন্য নিজেকে কষ্ট নাহ দিয়ে সমস্যার সমাধান খুজাই বুদ্ধিমানের কাজ।আরে ভাই আমি রাগ করেছি বলে কিহ গিয়ে আমাকে সব বুঝিয়ে বলা যেত না?হুম আমি নাহ চিল্লাতাম না হয় এক দুই ঘা দিতাম তা এমন ডাইনোসরের মতো লোকের তাতে এক চুলও নড়ত না।

হঠাৎ করে ডাক্তারের কণ্ঠ শুনে আমি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া কথাগুলো ভাবা বন্ধ করে ডাক্তার কাকে কিহ বলছেন এটা বোঝার চেষ্টা করি।ডাক্তার আসলে আমাকে ডাকছিলেন?।
ডাক্তারঃমিসেস আজাদ খান।
আমি অপ্রস্তুতভাবেই উত্তর দিলামঃজ্বি ডক্টর।
ডাক্তারঃমিঃআদৃতের ক্ষতটা মোটামুটি তেমন গভীর নই।বেশি ব্যথা করলে পেইন কিলার দিয়ে দেবেন।আর খেয়াল রাখবেন যেন কয়দিন এই হাতের উপর প্রেসার না পড়ে।

বলে ডাক্তার চলে গেলেন।ময়না খালা গেলেন ডাক্তারের পিছু পিছু।আমি এবার গিয়ে আদৃতের সামনে বসে তার ডান গালে নিজের ডান হাতটা রাখলাম।আদৃত মুখটা তুলে সামনের দিকে তাকালেন।তার চোঁখ দুটো ছলছল করছে।আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন কাপুনি দিয়ে উঠলো।অনেক কেঁদেছেন তিনি।আমি কিছু বলার আগেই আদৃত আমায় অনেক জোড়ে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে দিলাম।আমি পুরাই নিস্তব্ধ তাকে এইভাবে কান্না করতে দেখে।কতোটা কষ্ট দিয়েছি আমি তাকে।নইলে আদৃত কখনো এইভাবে কাদেন।নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।আদৃত আমায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,
আদৃতঃপ্লিজ জান্নাত প্লিজ আমাকে মাফ করে দেও।আমায় ছেড়ে যেও না।একবার তোমায় হারিয়ে আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।এবার হারালে মরেই যাব।যা করেছি সবই তোমার জন্য করেছি।

উনার প্রতিটি কথা তীরের ন্যায় আমার বুকে এসে লাগল।কান্নাটাও বাচ্চাদের ন্যায় আর অনুরোধটাও বাচ্চাদের ন্যায়।এই প্রথম আদৃত আমায় তুমি করে বললেন।এবার উনাকে আরো বেশি করে নিজের কেউ বলে মনে হলো।আমিও উনার শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।তার সাথে তাল মিলিয়ে চোঁখের পানি ঝড়াতে থাকি।কিন্তু শব্দ করে কাঁদতে পারিনা।
আমিঃছেড়ে গেলে কি আর এইখানে আসতাম?ফিরে আসবো বলেই তো আসলাম।আর আমি তো অভিমান করেছি রাগ করেছি নাকি যে মাফ করতে বলছেন।

উনি এবার আমায় ছেড়ে চোঁখ মুখমুছে বললেন,
আদৃতঃতুমি সত্যি বলছ?নাকি আমি অসুস্থ বলে এসব বলছো?আর তুমি কানছো কেন?
আমিঃকানছি না চোঁখের ট্যাংকি লিক হয়ে গিয়েছে।আর কে বললো আপনি অসুস্থ।নিজে নিজে কেটেছেন হাত।যদি ভুলবশত হাত কাটতেন তাহলে নাহয় বুঝতাম।
আদৃতঃসত্যি বলছ তো?

আমিঃএখন কি লিখে সই করে দেব?এসব রাখেন আগে বলেন নিজেকে কাবির সিং বানিয়ে রেখেছেন কেন?
আদৃতঃতোমায় হারিয়ে।প্লিজ আর কখনো একা ফেলে চলে যেওনা।
আমিঃভুলেও ছেড়ে যাব না।এখন এসব কান্নাকাটি বাদ দেন।জানেন হৃদিতা চলে যাচ্ছে।
আদৃতঃহুম জানি।বাট তুমি এটা জানো রায়হান এখন নিঃস্ব।তোমায় দেওয়া কষ্টের শাস্তি সে পাচ্ছে আজকে।
আমিঃজানিনা জানতে চাইও না।রায়হানকে আর মনে করতে চাইনা।
আদৃতঃঠিক আছে।বাবু কোথাই আর তোমার জিনিসই বা কোথায়?
আমিঃ এখন কি বলি.(মনে মনে)লায়লাপুর কাছে রেখে এসেছি। আর জিনিস আনিনি?
আদৃতঃএমা কেন?

আমিঃআমি এমা না আমি জান্নাত।আর আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে রেগে থাকার নাটক করব তাই আর কি।
আদৃতঃতুমিও না।এখন বসো আমি রেডি হিয়ে আসি।বাবুকে আর জিনিস আনতে হবে এমা।
আমিঃআপনায় তো।
আদৃত বাথরুমে দৌড় দিলেন।কতো সহজেয় না সব রাগ অভিমান শেষ হয়ে গেল।একটু বুঝলে সব কতই না সহজ।একটু পর আদৃত আসলেন।হলুদ শার্টটায় মাশাল্লাহ লাগছে তাকে।তাকে দেখেই যাচ্ছি।
আদৃতঃআমার লজ্জা লাগছে না চাইলে আরো কিছুক্ষণ দেখতে পারো।
আমি গিয়ে বাহুতে মেরে বললামঃপঁচা।

আদৃতঃআউচ হাত ভেঙে গেল রে আমার।এই ভাবে কেউ কাউকে মারে?
আমিঃআশ্চর্য একটু আগেই তো দেবদাস হিয়ে বসে ছিলেন এখন এতো লাফানি আসছে কোথাথেকে?
আদৃতঃকারণ তখন আমার পারু রাগ করেছিল আর এখন তার রাগ ভেঙে গিয়েছে তো তাই।
আমিঃআমায় যে পারু বললেন পারুকে কিন্তু দেবদাস পাননি।সে কিন্তু অন্য কারো স্ত্রী ছিল।
আদৃতঃযদি তাই হয় আমায় যে দেবদাস বললে সব শেষে কিন্তু দেবদাস মারা গিয়েছিল।
আমিঃআদৃত প্লিজ কি বলছেন?

স্বামী পর্ব ১০

আদৃতঃমরতে তো সবাইকেই হবে জান্নাত।এটা বাস্তব।
আমিঃএখন প্লিজ এসব কথা বাদদেন।আমার ভালো লাগছে না।আপনি আদৃত আমি জান্নাত।
আদৃতঃহে তুমি আদৃত আমি জান্নাত।
আমিঃকি???
আদৃতঃআরে মানে আমি আদৃত তুমি জান্নাত।
আমিঃআপনাকে সবসময় গম্ভীর সিরিয়াস মানুষ ভাবতাম।
আদৃতঃআমি সবার কাছেই গম্ভীর শুধু প্রিয় মানুষগুলো ছাড়া।এখন চলো জাহান তার বাবাই এর অপেক্ষা করছে।
আমিঃচলেন।

আমি আর আদৃত লায়লা আপুর বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে।সব কিছু এলোমেলো লন্ডভন্ড হয়ে আছে।সোফার কুশন গুলো এইখানে সেইখানে পড়ে আছে।পুরো ঘরে কাদামাটি মাখা জুতোর ছাপ।কোথাও কোথাও লাল লাল ছাপ।বাড়ির মধ্যে ঢুকেই আমি আর আদৃত এই অবস্থা দেখে থেমে গেলাম।দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে পড়লাম।এসব কিভাবে হলো।তারপর আদৃত আর কিছুই না বলে উপিরের দিকে দৌড় দেই।আমিও যাই তার পিছন পিছন।
উপরে উঠে আমি তো আকাশ থেকে পড়ি।আদৃতেরও সেই একই অবস্থা।আমার রুমের অবস্থাটা জঘন্য।মনে হচ্ছে কয়েক দফায় লোকজন এসে কিছু খুজেছে।মেঝেতে রক্ত আর রক্ত।আমি আর আদৃত রুমে ঢুকেই দেখি লায়লাপু মাটিতে পরে আছে।তার পেটে কেউ ছুড়ি মেরেছে।আপু গোঙাচ্ছে।জাহান কোথাও নেই।আমি হাউমাউ করে গিয়ে আপুর পাশে হাটুগেড়ে বসে পড়ি।আদৃত জলদি এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন দেই।

আমিঃআপু জাহান কোথায়?
আপু কিছু বলছেন।কিন্তু বুঝতে পারছি না।খুব করে বোঝার চেষ্টা করছি তাও বুঝতে পারছি না।আদৃত এবার এসে আমার পাশে বসে আপুর মুখের কাছে কানটা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভয়মাখা কণ্ঠে বলে,
আদৃতঃরায়য়হানন।

স্বামী পর্ব ১২