স্বামী পর্ব ৪

স্বামী পর্ব ৪
লেখকঃপারভেজ ইসলাম

ঘুমের ঘোরেই কাত হয়ে শুয়ে নিজের ডান হাতদ্বারা নিজের বাপাশে থাকা ব্যক্তিকে স্পর্শ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ হাত এই দিক থেকে ওইদিক সরিয়েও সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলাম তখন অগত্যা নিজের মাথার নিচ থেকে বামহাত বের করে বাড়িয়ে দিলাম তাকে খোঁজার জন্য।বামহাত দিয়ে এদিক ওদিক খুঁজেও পেলাম না রাইহানকে।আলসেমিটা আমার উপর ভর করে থাকায় চোঁখ খুলতে পারছি না।এরই মধ্যে বুঝতে পারলাম কোনো স্থান হতে তীব্র আলো এসে আমার চোঁখের উপর পরেছে।উফফ বিরক্তিকর।কিন্তু আমি তো জালনার উলটো পাশে ঘুমোই আর জালনা দিয়ে এতো তীব্র আলো আসা সম্ভব নয় তাহলে।

জলদি করে নিজের চোঁখজোড়া খুলে উপরে তাকায়।এই ফ্যান কই গেল?উঠে বসে জানালার দিকে তাকাতেই সব নতুন জিনিস গুলো চোঁখে পড়তেই এক এক করে সব স্মৃতি চোঁখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে উঠে।স্মৃতিগুলো ডানা ঝাপটাতেই চোঁখের সামনের সব ঝাপসা হয়ে আসে।নোনা পানির ফোটা গাল বেয়ে পরল।আমি জলদি করে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সেই জল মুছে গায়ের চাদর
সরিয়ে উঠে দাড়ালাম।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৮ঃ৩০।আমার এখোনো হাই উঠছে।ঘুমঘুম ভাব কাটেনি।ফ্রেস হতে হবে।কিন্তু আমার ব্যাগ কই।পুরো রুম খুঁজে কোথাও পেলাম না।এখন জিজ্ঞেস করব কাকে?এখন না হয় মুখ ধুয়ে নি। টাওয়াল নেওয়ার জন্য আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আলমারি খুলতেই চোঁখগুলো কুটোর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম।আমার সব কাপড় আর জিনিস আলমারিতে খুব সুন্দর পরম যত্নসহীত রাখা হয়েছে।বেশ ভালোই লাগল দেখে।নিশ্চয়ই দাদি করেছেন।কাবার্ড থেকে সবার উপরের ড্রেসটা নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে গেলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জালনার পাশে হাত ভাজ করে স্থির চাহনীতে বাহিরে চেয়ে রয়েছি।সত্যি বলতে সবার সামনে সত্য মেনে নিলেও মন আমার সত্য মেনে নিতে নারাজ।বাড়ি থাকলে এখন ব্যস্ততার ভীড় আমাকে ঘিরে রাখত,ঘুম থেকে উঠেই রায়হানের নাস্তা বানিয়ে টাই বেধে দিয়ে অফিসে পাঠানো,,ঘরের কাজ,,রান্না,রায়হানের খেয়াল রাখা এতো কিছু করতে গিয়ে এই নিজেকেই ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছি।আসলে রায়হান এতোটাকে ভালোবাসত আমাকে যে আমার আর নিজেকে ভালোবাসার প্রয়োজন পরেনি।
ঃতোমাকে এতো বুঝিয়েও কোনো লাভ হলো না।(দাদি

হঠাৎ এমন এক বাক্য কানে ভেসে আসতেই অজানা কোনো জিনিসের উপর থেকে চোঁখ সরিয়ে পিছনে তাকালাম।তাকানোর আগেই কণ্ঠের সাহায্যে বুঝতে পেরেছি যে দাদি এসেছেন।আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম দাদি মুখটা ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।আমি আহত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
আমিঃশুভ সকাল দাদি।

দাদিঃআমি কি তোমার প্রতিউত্তরে সুপ্রভাত বললে মানাবে?আমার কাছে সকালটা শুভ হলেও তোমার কাছে যে এই সকাল মোটেও শুভ নয় তা তোমার চাহনীতে প্রকাশ পাচ্ছে।নাস্তা করে নেও।বেশিক্ষণ খালি পেটে থেকো না।
আমিঃদাদি আপনি আমাকে যে ব্যক্তিকে ভুলে থাকতে বলছেন নিজের অজান্তেই যে সে আমার খেয়ালে চলে আসে।৭ টা বছর ধরে তার মায়াতেই নিজেকে বেধে রেখেছি।আয়নার সামনে দাড়ালে নিজের মাঝে তাকেই দেখি।আকাশের পানে তাকালেও তার মুখখানাই ভেসে ওঠে।কিভাবে ভুলে থাকব তাকে?

কথাগুলো বলতে বলতেই দাদিকে জড়িয়ে কান্না করে দিলাম।দাদিও আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
দাদিঃআমি তোকে একবারো ওকে ভুলতে বলিনি বলেছি ওর কথা ভেবে মন খারাপ করবি না।ওর কথা ভাববি কিন্তু ওর কথা ভাবলে তখন তোর মাথায় যেন একটা জিনিসই আসে সেটা হলো শাস্তি, ওর জন্য যেন তোর মনে আর মায়া না জন্ম নেই।
আমিঃকিন্তু দাদি চাইলেও যে ওর জন্য মনের মধ্যে যে মায়া রয়েছে তা ত্যাগ করতে পারছি না।
দাদিঃকারণ তোর মনে ওর জন্য যেটা সৃষ্টি হয়েছে সেটা হলো অভিমান ঘৃণা নই।একবার ঘৃণার জন্ম দিলে তোর সব কষ্ট নিমিষেই ওকে শাস্তি দেওয়ার নেশায় পরিণত হবে।

আমিঃ যাকে এতো বছর ভালোবেসে এসেছি তাকে চাইলেও যে ঘৃণা করতে পারছি না।
দাদিঃকারণ তুই ওর ক্ষেত্রে বাইরে থেকে নিজেকে কঠোর দাবি করলেও ভিতরে অনেক দুর্বল।তুই ভাবছিস ভালোবাসার মানুষটাকে কিভাবে শাস্তি দিবি?কিন্তু সে কিন্তু তোর ভালোবাসার মানুষ ছিল কাল অবধি আজ সে তোর অপরাধী।শুধু তোর না তোর বাচ্চারও অপরাধী।

আমিঃদাদি রায়হান জানে না আমি অন্তসত্ত্বা।আমি ওকে বলার আগেই এতো কিছু হয়ে গিয়েছে।
দাদিঃকিহহ!আমি ভেবেছি ও সব জানে।কালকে বাচ্চার দাবি নিয়ে তোর সামনে দাড়ালে তুই কি করবি?
আমিঃকোন অধিকারে দাঁড়াবে দাদি?আমি ৯ মাস পেটে রাখব আমার বাচ্চাকে তার মতো বেইমানকে দেওয়ার জন্য?যে আমার সাথে এইভাবে বেইমানি করল সে যে আমার বাচ্চাকে ভালো রাখবে আমাকে মেরে ফেললেও এ কথা মানব না।দরকার হলে তার বিরুদ্ধে কেস করে লড়ব তাও আমার বাবুকে কাউকে দেব না।

দাদিঃদেখলি মায়ের ভালোবাসার জোর।বাচ্চার কথা উঠতেই কিভাবে সব ভালোবাসা,সব মায়াকে ভুলে গিয়ে বাচ্চার জন্য সবার সাথে লড়তে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেললি।এটাই মায়ের ভালোবাসা।আর এই ভালোবাসার কাছে সব ভালোবাসা হেরে যাই।
আমিঃখুব ভয় করে বাবুকে নিয়ে।
দাদিঃমায়ের মন বলে কথা একটু ভয় তো লাগবেই।এখন আগে খেয়ে নে চল।
আমিঃহুম দাদি আদৃত চলে গিয়েছেন?
দাদিঃনা নাস্তা করছে।নাস্তা করে যাবে।
আমিঃওহ।চলেন।

আমি সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখি আদৃত ফোনে কাজ করা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছেন।নামমাত্র তার সামনে নাস্তার প্লেট রাখা।আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা কাশি দিতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।আমি উনার এমন কাজে হাসি দিয়ে তার এমন কাজের জবাবে তার উত্তরই তাকে দিয়ে দিলামঃআমি আপনার অফিসের বস নই যে আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
উনি আমার এমন উত্তরের উত্তরস্বরূপ খুব সুন্দর হাসি দিয়ে বললেনঃআমি আপনাকে দেখে নই আপনার জন্য চেয়ার বের করতে দাঁড়িয়েছি।

উনি উনার কথাটুকু শেষ হওয়া মাত্রই আমার পাশে দাড়িয়ে চেয়ার বের করে দিয়ে চোঁখের ইশারায় বসতে বললেন।আমিও ভদ্র মেয়ের মতো বসে পড়লাম।এবার উনি উনার আসনে বসতেই আমি বললামঃআমার উপর আপনারা করুণা করেছেন,আমি আপনাদের উপর করুণা করিনি।তাই আমি নিজের কাজ একা করতে পারব আদৃত।
আদৃত আমার কথা শুনে কি বলবে হয়তবা বুঝতে পারলেন না।তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপরে বললেনঃআপনার বাসায় যদি আপনার সব থেকে পছন্দের মানুষ বেরাতে আসে আর আপনি আমাকে যে কথা বললেন সে যদি আপনাকে সেই কথা বলে আপনার কতটুকু খারাপ লাগবে জান্নাত।

আমি মাথা নিচু করে আছি।আমি এখনও তার সব থেকে পছন্দের মানুষ তারমানে।
আমিঃকিন্তু আমি তো আর বেরাতে আসিনি।
আদৃতঃতাহলে কি সারাজীবন থাকবেন আমাদের সাথে?
আমি উনার দিকে চোঁখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললামঃআমি তো বাবু হলেই চলে যাব।
আদৃতঃআমার জানা মতে যারা মেহমান তারাই কিছুদিন পর চলে যাই।
আমি এক বড়নিঃশ্বাস ফেলে বললামঃআপনার সাথে তর্কে জেতা অসম্ভব।আপনি বেশ ভালোই যুক্তি দিতে পারেন।
উনি এবার কিছুটা জোরেই হাসলেন।তারপর আবার ফোনে মন দিলেন।হাসলেন কেন বুঝলাম না।এরই মধ্যে দাদি এসে আমার সামনে বসেন।একজন সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে চলে গেলেন।আমি চুপচাপ খাবার খাচ্ছি।দাদি হঠাৎ করে চিল্লিয়ে বললেনঃদাদুভাই কয়বার বলা লাগে যে

খাবারের টেবিলে বসে ফোন চালাবি না।
আদৃতঃদাদি আমি তো অফিসের কাজ করছি।আর খাচ্ছিও তো।
আমি কৌতুহলি ভাব নিয়ে বললামঃকখন খেলেন?কই আমি তো আপনাকে এক গাল খাবারো খেতে দেখলাম না।
উনি আমার কথা শুনে বিষম খেলেন।জলদি করে তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম।উনি এক ঢোকে সব পানি খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা পাশে রেখে দাদিকে বললেন,

আদৃতঃদাদি তুমি দেখি ভালোই সঙ্গী পেয়েছো।একদম তোমার ফটোকপি।
আমিঃযা সত্যি তাই তো বললাম আর খাবার এইভাবে রাখলে খাবার রাগ করবে।
আদৃতঃখাবারেরও যে রাগ হয় আমার জানা ছিলো না।
আমিঃমুরুব্বিদের কথা।আর খাবার খাওয়ার সময় বেশি কথা বলাটাও ঠিক না।
আদৃতঃভাগ্যিস খাবার খাওয়াটা খারাপ কাজ না।নইলে যে কি হতো।
দাদিঃআবার কথা বলে।
কেউ আর কিছু বললাম না।খাবার শেষে আদৃত যাওয়ার সময় বললেন উনি নাকি সন্ধ্যায় বই নিয়ে আসবেন।আমি শুধু মাথা ঝাকালাম।

সন্ধ্যায় বসে আছি।সারাদিন বসে বসে ভেবেছি কিভাবে কি করব,,কিভাবে সামনে এগোবো।সব ভেবে এই সিন্ধান্ত নিয়েছি যে রায়হানের খুশির জন্য নিজেকে বদলে যে ভুল করেছি সবার আগে সেই ভুল শুধরাবো।স্মার্টনেস বলতে এসব লেয়ার কাটের চুল আর ছোটো টাইট ফিটিং পোশাককে বোঝাই না।যদি ছোটো পোশাকেই মেয়েদের স্মার্ট সুন্দর লাগত তাহলে শাড়ি নামক পোশাকে নাড়ী নামক প্রাণীকে দেখে মানুষ তার প্রেমে পড়ত না।সব গল্পে নারীকে শাড়িতে কতটা মানাই তা লেখকদের লেখার ভাষাতেই স্পষ্ট।লম্বা চুলের মেয়েদের এতো কদরও করত না।কারো জন্য নিজেকে বদলানোর থেকে সেই মানুষটার মানসিকতা বদলানোটাই হলো বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া।যা আমি এতো পড়ে বুঝেছি।

ঃএতো চিন্তায় মশগুল থাকলে একদিন তো চিন্তাবিদ হয়ে যাবেন।
আমি সামনে তাকিয়ে দেখি আদৃত গেটে দাঁড়িয়ে।আমি উঠে দাঁড়ালাম না।উনি এসে আমার সামনে একটা ব্যাগ রাখলেন।
আদৃতঃসো মিস চিন্তাবিদ আপনার বই।
আমি জলদি উঠে ব্যাগ খুলতেই আশ্চর্যের সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে তৎক্ষনাৎ আবার যেইখানে ছিলাম সেইখানেই ফিরে আসলাম।সব গুলো বই এক এক করে বের করছি আর গুনছি।পুরো ১৯ টা চাকরির বই।

স্বামী পর্ব ৩

আমিঃএতো বই আমি কি করব আদৃত?
আদৃতঃকি করবেন মানে?পড়বেন।দেখেন দেড় বছর আগে মাস্টার্স শেষ যা পড়েছিলেন সব হজম হয়ে গিয়েছে। আর আমিও হেল্প করব যথাসম্ভব।
আমিঃএতো পড়ব কখন?এতো বই।
আদৃতঃদিনে,দুপুরে,বিকেলে,সন্ধ্যায় পড়বেন আর রাতে ঘুমোবেন।
আমিঃকিছু না বলে বই গুলো দেখতে লাগলাম।

এইভাবেই আস্তে আস্তে দিন যেতে যেতে পুরো একটা মাস পার হয়ে গেল।এই একমাসে অনেক যত্ন নিয়েছেন আমার আদৃত আর দাদি মিলে।
কিন্তু রায়হান আমার খোঁজ নেওয়া তো দূরে থাক আমাকে হয়তবা ভুল করেও তার চিন্তাতে আনেনি।সে নাকি তার বসের বাড়িতেই থাকে।কথাগুলো সব জেনেছি আমার বান্ধবীর কাছে থেকে।এই একমাসে নিজেকে যতটুকু পেরেছি পাল্টানোর চেষ্টা করেছি।চোঁখের নিচের কালিটা কিছুটা কমেছে।মুখের ফ্যাকাসে ভাবটাও চলে গিয়েছে।এখন আর রায়হানের কথা মাথায় আসলে কষ্ট হয়না।একদম কষ্ট হয়না যে তা নই।কিন্তু সাথে রাগও হয়।মনের মধ্যে রায়হান নামের মানুষের জন্য ঘৃণার বীজ বুনতে আমি কিছুটা হলেও সফল।আদৃত অনেক সাহায্য করে আমায় চাকরির পরা করতে।যতটুকু পারে সময় দেই।আমিও নিজের সবোর্চটাই দি।

আজকে সকাল থেকে মনটা কেমন একটা করছে।এক অজানা ভয় কাজ করছে বুকের মধ্যে।কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না।তার উপর ঘড়ি নষ্ট বার বার সময় দেখার জন্য টিভি দিতে হচ্ছে।ঔষধ খেতে হবে তো।না পেরে টিভির রিমোট থেকে ব্যাটারি বের করলাম ঘড়িতে লাগাবো বলে।খাটের পাশের টুলের সব জিনিস খাটের উপর রেখে টুল টেনে দেয়ালের পাশে আনলাম।এই কাজ রোজ করি পড়ার ভয় নেই।টুলের উপর উঠে ঘড়ি নেওয়ার জন্য উপরের দিকে হাত বাড়ালাম।নাগাল পাচ্ছে না?।আমি আবার বেশি লম্বা না আর টুল টাও বেশি বড় নই।পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পায়ের পিছনের দিক টা কিছুটা উপরে যেন হাত যাই তাই উঠালাম।কিন্তু হঠাৎ করে যে কি দিয়ে কি হলো বাম পা টাই টান খেলাম।আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।টুল থেকে পা পিছলে গেল আর…………

স্বামী পর্ব ৫