হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৩

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৩
রাউফুন

রোজকার মতো অফিস থেকে ফিরে মাইজিন রান্না ঘরে গিয়ে তুলিকাকে সাহায্য করছে। তুলিকার বারণ শোনার পাত্র তো মাইজিন নয়। বরাবরের মতোই মাইজিন কোনো কোনো নতুন ডিস করবেই স্পেশালি মিষ্টি আর তার জন্য। এসবে এখন তুলিকা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে জানে মাইজিন তার কথায় কোনো কর্ণপাত করবে না৷ তার কথা সে বহালতবিয়তই রাখবে৷ রাতে খাওয়ার পর তুলিকা মিষ্টির রুমে উঁকি দিলো। দেখলো মিষ্টি মনোযোগ দিয়ে নিজের পড়া পড়ছে।

এক মাস থেকে মিষ্টির কি হয়েছে কে জানে। খেয়ে দেয়ে গিয়েই রুমের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। তুলিকা ডাকলেও সারা দিচ্ছে না। পড়ছে শব্দ করে। শুধু তুলিকা ডাকলেই গাঁইগুঁই করে। এটা সেটা বাহানা দিতে থাকে। প্রথম এক সপ্তাহ এরকম টানা করাই মিষ্টিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে মিষ্টি বলে, ‘বুবুজান আমি আর তোমার সঙ্গে থাকতে চাই না। আমারও একটা প্রাইভেসি থাকা দরকার। আমি একাই থাকবো এখন থেকে। তুমি ভাইয়ার রুমে থাকোগে!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিষ্টির কথায় প্রথমে ভীষণ কষ্ট হয় তুলিকার। বুকটা ফেটে যাবে এমন অবস্থা। এতোদিন তো মিষ্টি তার কাছেই থাকতো। তার বোনটা কি খুব তারাতাড়ি বড় হয়ে গেলো? তাকে ছাড়া মেয়েটা ঘুমাতে পারে না সেটা কি সে জানে না? জানে! সে জানে মিষ্টি কেন তাকে এমন কড়া কথা বলেছে। যাতে মাইজিনের কাছেই থাকে সে। এসব কিছু আশফির কাজ৷ এরপর সে যখন বুঝতে পারলো আসলে মিষ্টি ইচ্ছে করেই এমন করছে তখন সে বোনকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু ফেলেছে। মিষ্টির যে কষ্ট হয় তাকে ছাড়া থাকতে তা কিন্তু মুখ ফুটে একটি বারের জন্যও বলে না মেয়েটা।

এতো দিনের পুড়নো অভ্যাস কি এতো সহজে ছাড়ানো যায়? এখন অভ্যাসগত ভাবেই তুলিকা আর মিষ্টির রুমে ঘুমাতে যায় না। সবটাই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। মাইজিন বসে বসে কম্পিউটারে কিছু একটা প্রজেক্ট করতে ব্যস্ত। তুলিকা আর তার সম্পর্কটা অনেকটাই উন্নতি করেছে এই এক মাসে। সে মাইজিনের প্রতি খুব অদ্ভুত একটা টান অনুভব করে। কিন্তু সেটা ভালোবাসা না কি বোধগম্য হয় না তুলিকার। মাইজিন ল্যাপটপে চোখ রেখে বলে,

‘মন খারাপ কেন মিসেস সুলতানের?’
‘কই না তো?’
‘আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনার মন খারাপ। কেন লুকাচ্ছেন? আমার কাছে লুকিয়ে কি পাবেন বলুন তো! নাকি এতোদিনে আপনার মনে বন্ধুত্বের জায়গা টাও অর্জন করতে পারিনি।’
‘একটা কথা বলবো?’
‘হুম একটা কেন হাজার টা বলুন।’
‘আপনি কিছু মনে করবেন না তো?’

তুলিকার কন্ঠ সিরিয়াস শোনালে মাইজিন ল্যাপটপ রেখে তুলিকার দিকে দৃষ্টিপাত করে। তার চোখে চোখ রেখে বলে,
‘মনে হচ্ছে আমি জানি আপনি কি বলতে চাইছেন। আমিই বলি? দেখুন আমাদের বিয়ের ব্যাপারে এখনো সবাইকে কেন জানাচ্ছি না বাড়িতে তাই তো?’

‘কেন জানাচ্ছেন না বলুন তো? আমার এখানে খুব বোরিং লাগে। মিষ্টি স্কুলে যায়। প্রাইভেট শেষ করে তারপর বাসায় আসে সন্ধ্যায়। আপনিও থাকেন না। তখন সারাদিন বাসায় খুব একা হয়ে যায় আমি। আশুকে কল দিলে বড়জোর আধ ঘন্টা কথা হয়। ওরঁও তো একটা সংসার আছে। আমাকে সব সময় কি সময় দিতে পারে?’

বলতে বলতে তুলিকা কেঁদে ফেলে। মাইজিনের ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় তার কান্না দেখে। ইচ্ছে করে তুলিকা বুকের ভেতর জাপটে ধরে তাকে আগলে রাখতে। কিন্তু এটা সে করতে পারবে না। ইচ্ছেতো অনেক কিছুই করে তাই বলে কি সব ইচ্ছে পূরণ হয়? উঁহু! এই যে তারা এক মাস থেকে একই বিছানায় ঘুমাচ্ছে কিন্তু এরপরেও কতটা দূরত্ব তাদের মধ্যে। সে মানে যে তারা মনের দিক থেকে অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু তুলিকা যে তাকে নিয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে এটা সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। মাইজিন ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমি কেন জানাচ্ছি না এখনো এটা আপনাকে কিভাবে বোঝায় বলুন তো? আমার কি খারাপ লাগছে না এভাবে থাকতে? বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে এই ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছি না। আমাকে ভরসা করেন তো আপনি তুলিকা?’
‘হুম সম্পুর্ন ভরসা করি আমি আপনাকে। আপনি আমাকে নতুন একটা জীবন দিয়েছেন। আপনাকে ভরসা না করে থাকি কিভাবে? এই যে দিন শেষে আপনি আমাকে সাহায্য করেন রান্নার কাজে, অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য ছোট ছোট গিফট বক্স এনে হাতে দেন। এসবই তো আমার আপনার প্রতি বিশ্বাস জোড়ালো করেছে। যদিও প্রথম দিন থেকেই আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কিন্তু এখন সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’

‘শুধু এই ভরসা টুকু রাখবেন আমার প্রতি তাই হবে। আমি মাইজিন সুলতান কখনোই আপনাকে ঠকাবো না কথা দিচ্ছি। আমাকে শুধু আরেকটু সময় দিন আমি ঠিক সব কিছু গুছিয়ে বাসায় জানাবো। এবার একটু হাসুন তুলিকা প্লিজ! না হাসলে আপনাকে খুব বা’জে লাগে দেখতে।’
ফিক করে হেসে ফেলে তুলিকা।
‘এই তো দ্যাটস মাই গুড গার্ল! এবার ঘুমান। রাত অনেক হয়েছে।’

মাইজিন আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই তার ফোন বিকট শব্দে বে’জে উঠলো। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো শাপলা ফোন করেছেন। সে না চাইতেও উঠে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করতেই শুনলো কর্কশ কন্ঠের বুলি,
‘তুমি কি শুরু করেছো টা কি? তোমার বাবা, আমার ফোন ধরছো না কেন? অফিস তো নিয়ম মতোই যাচ্ছো! শুধু এক মাসে একটি বারও বাসায় আসো নি! কেন বাসায় আসছো না? কোথায় থাকছো, কি করছো, কি খাচ্ছো, কিচ্ছু জানি না।’

‘এমন ভাবে বলছেন যেনো আমাকে নিয়ে আপনি খুব বেশিই চিন্তিত। কই আগে তো এমন চিন্তা করেন নি? আগে যেহেতু আমার জন্য কোনোদিন চিন্তা ছিলো না আপনার মনে, সেহেতু এখনো না থাকাই শ্রেয়। থাকার কথাও না অবশ্য! নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন আপনার তাই কল করেছেন! এবার ঝেড়ে কাশুন তো। কি দরকার বলুন!’

‘এভাবে কেন কথা বলছো? তোমাকে নিয়ে কি আমি চিন্তা করি না? ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আর এখন বলছো তোমার জন্য আমি চিন্তিত ছিলাম না কখনোই!’
‘কি জানি। হেয়ালি ছাড়ুন। কি বলতে চাচ্ছেন সেটা বলুন!’
‘আমার একাউন্টে টাকা দাও!’

‘এইতো! কেনো যে এতোটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেন সেটাই বুঝি না। একাউন্ট চেইক করে দেখুন আপনার একাউন্টে অলরেডি টাকা চলে গেছে। চেইক করে দেখুন আমি ফোন ধরছি।’
শাপলা চেইক করে দেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে, ‘তুমি বাসায় আসো। কাল তোমার বাবা আসছেন। কাল তোমায় না দেখলে সব ডলিশন আমার উপর দিয়ে যাবে।’
‘আর যদি বলি আমি যাবো না তাহলে?’

‘আসবে না মানে? আলবাত আসবে। তুমি আসতে বাধ্য! কাল যেনো তোমায় স্ব শরীরে এখানে উপস্থিত দেখি!’
টুট-টুট কল কে’টে গেলো। মাইজিন হতাশার শ্বাস ফেলে। ফোন হাতে ঘরে এসে দেখে তুলিকা ঘুমিয়ে গেছে। মাইজিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলে আরো বেশিই টানে তাকে। কি স্নিগ্ধ মুখাবয়ব। রোজ মাইজিন ভোর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে তুলিকাকে দেখে। দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে যায় খেয়ালই থাকে না।

এই যে রোজ নিজের প্রা’ণের স্ত্রীকে দেখে ঘুমায় সে তাতে যেনো একটা সুখ সুখ অনুভব হয়। তুলিকা তার কাছে কখনোই পানসে হবে না। জীবনে এতো এতো মেয়ে দেখেছে কই তাদের তো এতোটা মোহনীয় লাগেনি তার কাছে? তারা সব সময় মুখে মেক-আপের প্রলেপে নিজেদের প্রাকৃতিক চেহেরাটা ঢেকে রাখতো বলেই কি মাইজিনের মন ছুঁতে পারেনি তারা? তুলিকা সব সময় সাদাসিধা থাকে। দিন শেষে মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখলেই তার সারাদিনের ক্লান্তি সবটা উবে যায়।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১২

এটাই তো একটা বড় পাওয়া তার কাছে। কাল যদি বাসায় যায় সে তবে যে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ দেখে ঘুমানো হবে না৷ কাল কি খুব বেশি মনে পরবে তুলিকাকে? আচ্ছা মাইজিন যদি কাল না আসে তবে তুলিকা তাকে কতটা মিস করবে? নাকি মিস করবে না। অনিমেষ তাকিয়ে থাকে মাইজিন। কখন যে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরেছে বুঝতে পারলোনা!

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৪