হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৪

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৪
রাউফুন

‘আমি আজকে আমাদের বাড়ি যাবো তুলিকা! একটা রাত আপনি আর মিষ্টি একটু কষ্ট করে থাকতে পারবেন না?’
অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললো মাইজিন। অফিস থেকে সরাসরি বাড়ি যাবে মাইজিন তাই তুলিকাকে সাবধানের বুলি আউড়ালো। মাইজিন বাড়ি যাবে শুনেই তুলিকার দু চোখ ভিজে উঠে নিজের অজান্তেই। বাড়ি যাবে মাইজিন তা যেনো সে মানতে নারাজ। অন্তরটা কেমন ধক করে উঠলো তার।

মাইজিন যে আজ বাড়ি যাবে এটা তো সে রাতে বললো না।
‘স্যরি আপনি কি কষ্ট পেলেন? আমার সামনে তো আপনাকে কাঁদতে বারন করেছি! তাও যদি এভাবে কাঁদেন আমার কেমন লাগে বলুন তো? দেখুন আপনি ঘুমিয়ে গেছিলেন তাই রাতে জানাতে পারিনি। বাবা ফিরছেন দেশের বাইরে থেকে। তাই আমাকে গাজীপুর যেতেই হবে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আগে বাবাকেই বলবো। তাছাড়া এক মাস হলো বাসায় ও যায়নি আমি!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ আমি তো কাঁদছি না। চোখে পাপড়ি বা ময়লা ঢুকেছে মনে হয়। আর এভাবে এক্সপ্লেইন করার দরকার নেই। আপনি গিয়ে ঘুরে আসুন আমি আর মিষ্টি আজকের রাত টা ম্যানেজ করে নিবো!’
মাইজিন মানি ব্যাগ থেকে কত গুলো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বের করে তুলিকার হাতে দিলো। বললো, ‘যখন তখন লাগতে পারে টাকা। তাই এগুলো রেখে দিন!’

‘আমি টাকা দিয়ে কি করবো? এতো গুলো টাকার তো প্রয়োজন নেই। আপনি রেখে দিন আপনার কাছে।’
‘নাহ রাখুন তো আপনি।’ মাইজিন হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললো, ‘সময় নেই তুলিকা। আসছি হ্যাঁ?’
তুলিকা মাথা নাড়ালে মাইজিন বেরিয়ে গেলো। তুলিকার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। বুকের ভেতর টা এমন ব্যথায় টইটম্বুর কেন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে মাইজিন আসবে না আর? সে নিজের এমন অবান্তর ভাবনা নিজের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পরক্ষণেই!

হঠাৎই মাইজিন ফিরে এসে তুলিকাকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো। তুলিকা একই সঙ্গে খুশি আর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। মনের গুপ্ত কুঠুরিতে কোথাও না কোথাও যেনো এই ছোট্ট জিনিসটাকে মিস করছিলো তুলিকা। রোজ ই তো মাইজিন এমন করে। তবে আজ ভুলে গেছিলো কিভাবে? সে মাইজিনের পেছন পেছন সিড়ি বেয়ে ছুটে নামলো! কেচি গেট খুলে মাইজিন বের হলো। তুলিকাও হুড়মুড় করে ছুটে গিয়ে ডাকলো মাইজিনকে! মাইজিন ভেজা চোখে তাকালো তুলিকার দিকে। তুলিকার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মাইজিনের ভেজা চোখ দুটো দেখে। হাঁপাতে হাঁপাতে তুলিকা বললো, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো মাইজিন। কাল সন্ধ্যায় আমি আপনাকে এখানে দেখতে চাই। আপনার জন্য খুব ভালো কিছু অপেক্ষা করছে মাইজিন!’

মাইজিন মুচকি হাসলো চোখের পানি লুকিয়ে। সে সামনে ফিরে হাঁটা ধরলো। এতোটা কষ্ট কেন হচ্ছে তার? সে তো কাল ই ফিরবে তবে যেতে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? বুকে এই অদ্ভুত চিনচিন ব্যথার কারণ কি? বক্ষস্থল টা শুন্য শুন্য কেন লাগছে? সে যদি পেছনে ফিরে দেখতো তবে সে দেখতে পেতো দু-জোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ এখনো তাকে দেখছে৷ কিন্তু সে সাহস পেলো না মাইজিন।

এবার পিছনে ফিরে তাকালে যে বড্ড ইচ্ছে করবে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কপালে গাঢ় করে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে। গাঢ় চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে খুব করে। কিন্তু তা তো সম্ভব না। অটো পেতেই সে উঠে পরলো। বাড়িতে থাকলে গাড়িতে যাতায়াত করে সে। কিন্তু এখানে তো গাড়ি সঙ্গে আনেনি তাই অটোতেই যাতায়াত করতে হচ্ছে।

মাইজিন অটোতে উঠতেই তুলিকা দৌঁড়ে চলে আসে। সিড়ি বেয়ে উঠার সময় কয়েকবার হোচট খেয়ে পরে গেলো সে। কিন্তু সে ব্যথার তোয়াক্কা না করে রুমে এসে মাইজিন যেখানে শুয়ে থাকে সেই খান টাই শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ গুজে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। একটি বার মাইজিন ফিরে তাকালো না আর? সে তো আশা করে শেষ অব্দি দাঁড়িয়ে ছিলো যেনো মাইজিন একটি বার ফিরে তাকাই। কিন্তু মানুষটা তাকালো না। তার কষ্টটা দ্বিগুণ বারানোর জন্য যে এটাই যথেষ্ট ছিলো!

মিষ্টি স্কুলে গেছে। ব্যাগে সে পাঁচশো টাকার একটা নোট রেখেছিলো। এই মুহুর্তে সে তা খুঁজে পাচ্ছে না। বুঝতে পারলো টাকা টা কেউ চু’রি করেছে। শেষ পর্যন্ত তার ই টাকা চু’রি হতে হলো? সে একটু একটু আন্দাজ করতে পারছে কে নিয়েছে টাকাটা। কারণ শেষ বার তার ব্যাগের কাছে সে একজনকেই দেখেছিলো। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন এর কাছে গেলো।কারণ এভাবে সে কাউকেই জাজ করতে পারে না। ক্লাস ক্যাপ্টেন টাকার সমস্যা না মিটিয়ে দিতে পারলে প্রিন্সিপাল এর কাছে নালিশ করবে। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন রাফির কাছে গিয়ে বলল,

‘এই রাফি আমার ব্যাগ থেইকা পাঁচশো টাকা হারায়ে গ্যাছে তুই কি খুঁইজা দিবি একটু? দেখ আমার সন্দেহ টাকাখানা ক্লাসের কেউ-ই নিসে। তুই যদি একটু খুঁইজা বাইর কইরা দিতে পারস তাইলে আমি পরীক্ষার ফী দিতে পারুম।’
রাফি অত্যন্ত বাজে ভাবে মুখ বাকালো। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দেখ মিষ্টি তোর মতো ফকিন্নি মেয়ের কাছে এতো টাকা আসবে কোথা থেকে? মিথ্যা বলার জায়গা পাস না। তোর ব্যাগ থেকে কে টাকা নিবে?’

‘বিশ্বেস কর রাফি টিফিন টাইমের আগেও আমার ব্যাগে টাকা আছিলো। তহন পরীক্ষার ফী দেওনের জন্য আমি গেছিলাম কিন্তু বড় স্যার আছিলো না। তাই ফিরে এসে ব্যাগে টাকা রাকছি। এহন দেহি নাই!’
‘হুশ যাহ ফকিন্নি। তুই আগে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখে আয় যাহ! ফট এই খান থেকে!’
‘রাফিইইই!’

‘চেঁচাস না মিষ্টি। তোর যদি টাকা হারিয়েও থাকে আমি খুঁজে দিতাম না।’
‘তাহলে আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাবো। ক্লাস ক্যাপ্টেন তুই আগে তোকে জানানোর প্রয়োজন ছিলো তাই জানালাম।’
রাফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিষ্টির দিকে।
‘আর এই মিষ্টি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে জানে। কিন্তু আমার ওভাবেই কথা বলতে ভালো লাগে তাই বলি। আমি চাইছিলাম না ব্যাপারটা ক্লাসের বাইরে যাক। কিন্তু এখন আমাকে প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাতেই হবে।’
‘যাহ! গেলে কি হবে? আমি ভয় পাচ্ছি মনে হয়!’

‘স্যারকে যখন বলবো তুই আমাকে সাহায্য করিসনি তাহলে কি হবে ভেবেছিস রাফি? তোকে কিন্তু ক্যাপ্টেন থেকে বাতিল ও করে দিতে পারে।’
রাফি ভাবলো এখন যদি মিষ্টি গিয়ে প্রিন্সিপালকে নালিশ করে তবে তার জন্য ভালো হবে না। এখন সবার কাছে তার দাম আছে। সবাই তাকে সমীহ করে। ভয় পাই! যদি ক্যাপ্টেন থেকে বঞ্চিত হয় তবে তো তার সেই নিজস্ব পাওয়ার টা থাকবে না। তাই সে মিষ্টিকে যেতে বারন করলো। মিষ্টি বাকা হেসে দাঁড়িয়ে পরলো। রাফি এক পলক দেখলো মিষ্টিকে। পরে সবার ব্যাগ সার্চ করলো কিন্তু কারোর ব্যাগেই টাকাটা নেই। তাই সে রাগান্বিত হয়ে গেলো। বললো,

‘এই কই ক্লাসের কারোর ব্যাগেই তো পেলাম না। তুই তো বললি তোর কাউকে সন্দেহ হয়। এখন বল দেখি কাকে সন্দেহ করছিস? নাকি মিথ্যা গল্প ফাঁদছিস। তোর টাকায় হারাইনি।’
‘আমার টাকা হারিয়েছে রাফি। তোর মানি ব্যাগ টা দে তো?’
কিঞ্চিৎ অবাক হয় রাফি। ক্রোধের সহিত বলে, ‘তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? তুই জানিস আমি কে? আমার বাপির এক্সাক্টলি কত গুলো টাকা আছে? আমি তোর ওই সামান্য পাঁচশো টাকা নেবো? চু’রির বদনাম দিস না মিষ্টি। তবে কিন্তু ভালো হবে না।’

‘আরে রিল্যাক্স দে তো আগে। এখনো সবাই টিফিন খাচ্ছে। ওঁরা আসার আগেই কাজ টা শেষ করতে হবে তো।’
রাফি কটমট করতে করতে নিজের মানিব্যাগ বের করে মিষ্টির হাতে দিলো। মিষ্টি রাফির মানি ব্যাগ থেকে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে রাফির মানি ব্যাগ ফিরিয়ে দিলো। রাফি তখন নির্বাক। অবাক হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে মিষ্টি? তুই আমার টাকা কোন সাহসে নিচ্ছিস?’

‘কারন আছে তাই নিয়েছি। শোন রাফি আমার টাকায় এম লেখা আছে। মানে আমার নামের ফার্স্ট লেটার। আমি এই টাকাটা নিয়ে ফী দিয়ে আসছি আর তুই আমার টাকা খুঁজে পেয়ে সেটা নিয়ে নিস!’
‘টাকা কে না কে নিয়েছে সেজন্য তুই আমার টাকা নিবি?’

‘নিজের জিনিস হারালে মানুষ যতটা গুরুত্ব দিয়ে খুৃঁজে বের করে অন্যের জিনিস খোঁজায় ঠিক ততটাই বেপরোয়া হয়। এখন তোর টাকা আমি নিয়েছি তাই তোর খারাপ লাগছে। আমি জানি এখন তুই ঠিক টাকাটা খুঁজে বের করবি। কারণ টাকাটা এখন তোর!’
রাফি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিষ্টির যাওয়ার পানে। কি চালাক মেয়েরে বাবা। কোন ট্রিক খাটালো দেখেছো? রাফি হুলুস্থুল করে টা খোঁজায় মন দিলো।

বাড়ি ফিরে মিষ্টি আজকের ঘটনা সবটাই বললো। সবটা শুনে তুলিকা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘এটা তুই কি করেছিস মিষ্টি? অন্য একজনের টাকা নিয়ে ফী দিয়েছিস তুই? যদি ছেলেটা টাকা না পাই খুঁজে তখন?’
‘আমি জানি বুবুজান টাকা খুঁজে পাবে রাফি। ঠিক পাবে!’
‘তবুও তুই এটা ঠিক করিস নি। কাল গিয়ে আবার যার টাকা তাকে দিয়ে আসবি। আর যেনো এমন ভুল না হয় মিষ্টি!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৩

‘আচ্ছা বুবুজান। কিন্তু আমার টাকা যে গায়েব হলো
তার বেলা?’
‘যে জিনিস হারিয়ে যায় সেই জিনিস নিয়ে আফসোস রাখতে নেই মনে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস নিয়ে কখনোই আফসোস করবি না!’
‘মনে থাকবে বুবুজান।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৫