হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩২

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩২
সাইয়ারা মম

সারা রাতে আরফানের জ্ঞান ফিরেনি । মিহুকে জোর করেও কেউ কিছুই খাওয়াতে পারেনি । শুধু পানি খেয়ে রোজা রেখেছে । নেহাল সবাইকে রাতে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে কিন্তু মিহু কিছুতেই যায় নি । এখন বর্তমানে এখানে মাহিন , নেহাল , পিয়াস আর মিহু রয়েছে । ফজরের সালাত আদায় করার পরে মিহু আরফানের পাশে বসে যত দোয়া – দরুদ জানতো সব পড়ছে ।

ওর মনে শুধু একটাই চাওয়া আরফান যেন সুস্থ হয়ে যায় । সারা রাতে মিহু তেমন ঘুমাতে পারেনি । তাই এখন আরফানের হাত ধরে একটু ঘুমের মত পড়েছে । হঠাৎ নড়াচড়ার জন্য মিহুর ঘুম উড়ে গিয়েছে । আরফান চোখ খুলে মিহুর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে । আরফানের জ্ঞান ফেরার খবর মিহু নেহালকে জানালো । নেহাল ডক্টর কে নিয়ে আসতে গিয়েছে । পিয়াস, মাহিন খবর পেয়ে আরফানের কাছে চলে গিয়েছে ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিহু আরফানের হাত ধরে কান্না করতে আছে ।
হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরফান নিজের হাত টেনে নিয়ে গেল । নেহালের দিকে তাকিয়ে বলল
– পিয়াস ইনি কে ? আমার হাত ধরে কান্না করছে কেন ? আর আমার কি হয়েছিল ?
মিহুর চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসলো । মিহু দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে । বাকি সবাই ও একথায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে ।মিহু নিজেকে স্থির করল । তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগল

– আপনি মজা করছেন নিশ্চয়ই? আপনি আমাকে ভুলে যেতে পারেন না । প্লিজ এরকম করেন না । আপনি একবার, শুধু একবার বলুন যে আপনি মজা করছেন । আমাকে ভোলেন নি ।
– দেখুন আপনার হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে । আমি তো আপনাকে এই প্রথম দেখলাম । আর আপনি প্লিজ বেশি সিনক্রিয়েট করবেন না । আরফান আদিত্য কখনো কোনো মেয়ের সাথে ঝামেলা করেনি । তাই আপনি প্লিজ এরকম কিছু করেন না যেটা আমার মান সম্মানে আঘাত করে

মিহু আর কিছুই শুনতে পারলো না । একে তো না খেয়ে রোজা রাখছে তার ওপর আবার আরফানের এমন ব্যবহার মিহু মেনে নিতে পারছে না । তাই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল । কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই মাহিন মিহুকে ধরে ফেলল । মাহিন মিহুকে কোলে করে নিয়ে গেল অন্য কেবিনে যেখানে নীলুকে রেখেছিল ।

আরফানের এই দৃশ্য দেখে আপনা আপনিই মন খারাপ হয়ে গেল । কিছু বিষাক্ত অনুভূতি ওর মধ্যে হানা দিতে লাগল । এগুলো কেন হচ্ছে আরফান বুঝতে পারছে না । হঠাৎ করেই মাথায় ব্যাথা করতে শুরু করল । নেহাল ডক্টর কে সাথে নিয়ে আসলে তিনি আরফানকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেয় যার ফলে আরফান ধীরে ধীরে অতল ঘুমের দেশে হারিয়ে যায় । পিয়াস ডক্টর কে সব ঘটনা বললে তিনি বলেন

– আমি দুঃখিত । তিনি তার কিছু স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন ।
– ডক্টর ভাই কি কখনো স্মৃতি গুলো ফিরে পাবে না ?
– পেতে পারেন তবে সেটা সময়ের ওপর ডিপেন্ড করে । কয়েক দিনের মধ্যেও পেতে পারে আবার কয়েক সপ্তাহ ও হতে পারে সেটা গড়িয়ে বছরেও হতে পারে । তবে হ্যাঁ এটা তার নিজের মাধ্যমে ফিরে পাবে । আপনারা কেউ বাইরে থেকে এটার জন্য প্রেশার দিবেন না । তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে ।

– আরফান ভাইকে আমরা কখন বাসায় নিয়ে যেতে পারবো ?
– উনি ধরতে গেলে পুরোপুরি সুস্থ । তাই জ্ঞান ফেরার পরেই নিতে পারবেন । তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন এমন কোনো পরিস্থিতি যেনো সৃষ্টি না হয় যেটা তাকে ঐ স্মৃতি গুলো মনে করাতে চাপ সৃষ্টি করবে ।
নেহাল কিছু একটা ভেবে বলল – ডক্টর ভাই তো তার স্ত্রী কে ভুলে গিয়েছে । তাহলে কি ভাই তার বিয়ের পরের থেকে স্মৃতি গুলো ভুলে গিয়েছে?
– এমনটাই হবে ।

কেটে গেছে ২৪ ঘন্টা । মিহু মনমরা হয়ে নীলুর রুমের বেলকনীতে বসে আছে । ওর রুমের বেলকনীতে আগে কাচ লাগানো ছিল । কিন্তু নীলু একদিন অসুস্থ হওয়ার পরে আরফান কাচ ভেঙে ঢুকেছিল । তারপরে ওর বেলকনীতে গ্রীল লাগিয়ে দিয়েছে । ওর বেলকনীতেও দোলনা আছে । তবে সেখানে না বসে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে । গ্রীলের ফাঁকা স্থান থেকে আকাশের নীল রং দেখা যাচ্ছে । বিকেলের দিকে রোদের দাবানল কমে এসেছে তবে সেটাও অনেকটা অসহনীয় । মিহুর চোখ দেখে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ।

– আপনি খুব খারাপ আরফান । আপনি ঠিকই বেলী ফুলকে ভালোবাসেন তবে সেটা আমি নয় গাছের ফুল ।
কি করে পারলেন আমাকে ভুলে যেতে।
কাঁধে কেউ হাত রাখায় মিহু পেছনে তাকায় । পেছনে ফিরে দেখে নীলু ওর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে । নীলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে

– ভাবি তুমি এত নিরাশ হয়ে পড়ো কেন ? তুমি নিজেই তো বলো আল্লাহ্ যা করেন সব সময় ভালোর জন্যই করেন । তাহলে এখন ভেঙে পড়লে চলবে ? এখন তো তোমাকে ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে । তাঁকে তোমার কথা মনে করাতে হবে ।

– কিন্তু ডক্টর তো বলেছে তাতে হীতে বিপরীত হবে । ওনাকে আগের কথা মনে করাতে গেলে তো ওনার ই ক্ষতি হবে
নীলু একটা বড় দম নিল । তারপর মিহুর দুই কাঁধ ধরে সোজা করে বলল
– ভাবি সফলতার মূলে পৌঁছাতে গেলে একটা রাস্তা যে থাকবে সেটা না । আরো অনেক রাস্তা থাকে । হোক সেটা একটু কন্টক যুক্ত ।

– আমি বুঝিনি নীলু
– তোমার মাথাটা একদম ডাউন হয়ে গিয়েছে । আগে তুমি শোক থেকে বের হও । ভাইয়া তোমাকে ভুলে গিয়েছে তো কি হয়েছে? তুমি আবার তাকে তোমাকে চিনিয়ে দাও । নতুন করে তাকে তোমার ভালোবাসায় সিক্ত করো । ভাইয়া তো এমন না যে তোমাকে ভুলে গিয়েছে কিন্তু অন্য কাউকে মনে রাখছে । ভাইয়ার জীবনে অন্য কোনো মেয়ে নেই । তাই ভাইয়াকে আবার তোমার প্রেমে পড়াতে বাধ্য করো ।

মিহু নীলুর দিকে তাকালে নীলু চোখ দিয়ে সহমত জানায় । মিহু ওর কথায় ভরসা খুঁজে পায় । আসলেই আরফান মিহুকে ভুলে গিয়েছে তো কি হয়েছে? মিহু আবার আরফানকে ভালোবাসায় রাঙাবে ।
– ভাবি এখন চলো নিচে । আজকে তুমি ইফতারি বানাবে
আরফানকে বাসায় নিয়ে আসার আগেই মিহুর সব জিনিস পত্র নীলুর রুমে সিফ্ট করা হয়েছে । যাতে আরফান ওগুলো দেখে প্রেসারে না পড়ে । আর আরফানকে বলা হয়েছে পিহু ও নেহাল রেবেকার ভয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছে । মিহু হলো পিহুর বোন , ও পড়াশোনার জন্য এখানে থাকছে ।

ইফতারির টেবিলে বসে সবাই উৎসুক মুখে আরফানের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । আরফান মিহুর রান্না খেয়ে কেমন রিয়্যাক্ট করে সেটা দেখার জন্য । আরফান শরবতের গ্লাস নিতে গিয়ে দেখে সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । আরফান শরবতটা খেয়ে বলল
– সবাই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ?
– ভাইয়া খাবারগুলো কেমন হয়েছে ?
– খাবার তো খাবারের মতো । খাবার আবার কিসের মতো লাগবে ?

পিয়াস নীলুর কথা কেড়ে নিয়ে বলল – ভাই আসলে নীলু বলতে চাইছে খাবারের স্বাদ কেমন লাগছে ? পরিচিত ? মানে বড় মা তো আজকে খাবার তৈরি করেনি । তাই জিজ্ঞেস করলাম
আরফান একটু চিন্তা করল । তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল – ও হ্যাঁ আজকে খাবারটা ভিন্ন স্বাদের । তবে পরিচিত
সবাই ভাবলো আর যাই হোক মিহুর রান্নার কথা তো ভোলেনি । এটা ভেবে সবাই খেতে আরম্ভ করল ঠিক তখনই
– খাবারটা রেস্টুরেন্টের মতো মনে হচ্ছে । বাহির থেকে এনেছিস ?

মিহু রেস্টুরেন্টের কথা শুনে হিচকি উঠে গেল । শেষ মেষ কিনা তাকে রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি বানিয়ে দিল । পিয়াস খুশি মনে বেগুনীতে হাত দিয়ে ছিল কিন্তু আরফানের কথায় বেখেয়ালী হয়ে পাশে রাখা মরিচ উঠিয়ে কামড় দিল । তারপর তো সবাই একটা চিৎকার শুনলো ।

আরফান খেতে খেতে পিহুকে বলল – আপনি যে পালিয়ে বিয়ে করেছেন এটা কি আপনার পরিবার জানে ? মেনে নিয়েছে
পিহু একটু থমকে গিয়েছিল তারপর আমতা আমতা করে বলল – না মানে হ্যাঁ জানে । তবে কালকে একবার দাদু আসবে । তিনি শহরের বাইরে গিয়েছিলেন কাজে । আজকেই আসতে চেয়েছিলেন তবে পারেনি
– ওহ আচ্ছা । আর মিহু

বলে তাকাতেই দেখলো সবাই খাবার রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মিহুর হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেল । ধক ধক করতে লাগলো । আরফান সবাইকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
– সবাই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন ?
ওর কথায় সবাই আবার খাবার খেতে লাগে । আরফান বলতে লাগল – ওহ যা বলছিলাম । মিহু আপনি পড়াশোনার জন্য এখানে এসেছেন ভালো কথা । তবে আপনি কোথায় পড়েন ?

– এইতো কাছেই একটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ।
– কি নিয়ে পড়েন জানতে পারি ?
– আমি আসলে বাংলা নিয়ে পড়ছি । আমাদের বাসা থেকে যাতায়াত করাটা অনেক সমস্যা তাই আরকি ।
– সেটা তো ভালো এখানে থাকবেন । তবে আপনি কি অন্য কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারতেন না বা কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেন নি

– আমার একটু সমস্যা হয়েছিল তো তাই ভর্তি পরীক্ষা গুলো দিতে পারিনি আর আমি যেহেতু মানবিকের স্টুডেন্ট তাই আমার বাংলা ছাড়া অন্য কিছু পছন্দ হয় নি।
– আচ্ছা তাহলে ভালোমতো পড়াশোনা করবেন । যেহেতু আমাদের বাসায় আছেন তাই আমি চাই আপনি যেন আমাদের মর্যাদা বজায় রাখেন
– মিহু মাথা নাড়ালো

অফিসের ফাইল গুলো দেখে আরফান কিছুই বুঝতে পারছে না । সে একটা এক্সিডেন্ড করেছে মাত্র । আর সব উল্টা পাল্টা হয়ে গেল । মাথাটা ধরে বিছানায় বসে পড়ল । ওর নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলো । কারো অনুপস্থিতি ওকে ভীষণ করে পোড়াচ্ছে । তবে কে এমন ব্যক্তি? আরফান অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল । ও তো এতদিন এভাবেই কাটিয়ে এসেছে তাহলে ?
ল্যাপটপ অন করতে গিয়ে পাসওয়ার্ড দিতে গিয়ে দেখে পাসওয়ার্ড ভুল দেখাচ্ছে । কয়েকবার দেওয়ার পরেও মনে পড়ল না যখন তখন নীলুকে ডাকল । নীলু এসে বলল

– কি হয়েছে?
– পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছি ।
– ল্যাপটপের ?
– হুম
– বেলী ফুল লিখ
ল্যাপটপ অন হওয়ার পরে আরফান অবাক হলো বলল- তুই পারলি কীভাবে ?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩১

– কারণ বেলী ফুল তোমার সব চেয়ে প্রিয়
– তাইতো আমার মাথায়ই আসেনি
নীলু কিছু না বলে চলে গেল । আরফান আসলে যে বেলী ফুলের কথা ভাবছে এটা সে বেলী ফুল না । এই বেলী ফুল তো একজন জলজ্যান্ত মানুষ যাকে মনে রেখেও ভুলে গেছে ।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৩+৩৪