হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩
সাইয়ারা মম

-নীলু তোর কি এখন জেদ ধরার বয়স?
-আমিতো জেদ ধরছি না।আমিতো আবদার করেছি
-তুই যেখানে জানিস এটা পসিবল না সেখানে কেন মিছে বায়না করছো?
-ভাইয়া আমি কিছু জানি না,আমি শুধু জানি তুমি বিয়ে করবে ব্যাস্
আরফান কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই ওর ফোন এলো।ফোনে ফারিশের নাম দেখে নীলুকে বলল

-এখন আমার একটা জরুরী কাজ আছে।আমার একটু অফিসে যাওয়া লাগবে।এ বিষয়ে পরে কথা বলব
বলেই আরফান উপরে নিজের রুমে চলে গেল।কিন্তু নীলু নিজের জায়গায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।এতক্ষণ মন খারাপের অভিনয় করলেও এবার সত্যিকারেই মন খারাপ করেছে।ওর ভাইয়ার কাছে এখন ওর থেকে কাজ ইমপর্টেন্ড হয়ে গেল। ওর কান্না পাচ্ছে খুব।তাই দৌড়ে ওপরে নিজের রুমে চলে গেল।দরজা আটকিয়ে বিছানায় বসে বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে লাগল। ওর ভাই কখনো ওকে এক্সকিউজ দেখায় না কিন্তু আজ এই সামান্য বিষয়ের কারনে ওকে উপেক্ষা করল।সদ্য সতেরো এর ঘরে পা দেওয়া নীলু অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।তার কাছে মনে হতে লাগল তার ভাই তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই বয়সটা আসলেই একটা গোলকধাঁধা।কখন কি মনে হয় সেটা কেউই ভাবতে পারে না।অনেক সময় সামান্য আঘাতে তারা অসীম বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে আবার অনেক বড় ঘটনাকেও পাশ কাটিয়ে যেতে পারে।তারা কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তা মানতে চায় না।তারা তাদের মনের অনুভূতিটাকে প্রধান্য দেয় হোক সেটা ভুল।তবে নীলুর করা এই ভুলের কারণে হয়ত বদলে যেতে পারে কারো জীবন।

আরফান অফিস ড্রেস পড়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে নিচে নামল। একবার ড্রয়িং রুমের দিকে তাকালো কিন্তু নীলুকে দেখতে পেলো না।সে ভেবেছিল তার আবেগ প্রবণ বোনকে একটু বুঝিয়ে যাবে যে তার এখন সময় নাই।মিটিং এর মাত্র বিশ মিনিট সময় আছে কিন্তু সেটা বলতে পারল না।সত্যিই তার দেরি হচ্ছে,ফারিশ ফোন না দিলে তো আজকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো।

পিয়াস আরফানকে বের হয়ে যেতে দেখে বাড়িতে ডুকল। এতক্ষণ সে বাইরে এমনিই ঘুরঘুর করছিল।কারণ সত্যিকারেই তার মা তাকে কি যেন নিয়ে যেতে বলেছিল।বার বার করে বলে দিয়েছিল আনতে এমন কি নামটা লিখেও দিয়েছিল যাতে ভুলে না যায় কিন্তু সে প্রেস্টিজ দেখিয়ে বলেছিল
– ‘মা আমি কি বাচ্চা মানুষ? আমি এখন বড় হয়েছি।দেখেছো আমার বয়সী নেহাল বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলল আর আমি কিনা ভুলে যাব?হাহ্ মা তুমি হয়তো ভুলে গেছো তোমার একটা আবিয়াইত্তা ছেলে আছে যাকে বিয়ে করানো দরকার’
কথাটা বলার পরেই ওর মা ওকে বেলন দৌড়ানি দিছে আর বলেছে

– ‘যেদিন ঠিক মতো বাজার করতে পারবি ঐ দিন বিয়ের কথা মাথায় আনবি তার আগে না’
এখন বাজার না নিয়ে ফিরলে নিশ্চিত জিন্দেগিতে বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দেবে।আর নেহালের কাছে যাওয়াও বৃথা।কারন সে তার হবু বৌ এর সাথে ডাটা ট্রান্সফার করতে আছে।তাই সে নীলুর রুমের দিকে রওনা দিল।নীলুর রুমে সবসময় দরজা খোলা থাকে কিন্তু পর্দা দেওয়া থাকে আর সবসময়ের মতো এটা ভেবে ও ঢুকতে গেছে কিন্তু নাকে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে।

-বজ্জাইত্তা মহিলা দেখিস তোর জীবনে বিয়ে হবে না।আর হলেও নাকবোচা জামাই পাবি।
-কে নাকবোচা জামাই পাবে?
নেহালের ধারালো মার্কা চোখ দেখে পিয়াস ক্যাবলা কান্তের মতো হেসে বলল
-আরে ভাই আমার কথা বলছি আমি নাকবোচা বৌ পামু।আর কারো কথা বলি নাই বিশ্বাস। এই তোরে ছুয়ে বলছি বিশ্বাস কর।

কথাটা বলে পিয়াস নেহালের হাত ধরেছিল।নেহাল হাত ছাড়িয়ে বলল-তোর কথা তোর মাও বিশ্বাস করে না।সর দূরে যা।শেষে দেখা যাবে বিয়ের আগেই আমার বৌ বিধবা হয়ে যাবে
কথা শেষ হওয়ার আগেই পিহুর কল এলো।নেহাল ফোন নিয়ে দৌড় দিল।পিয়াস নিজেকে গালি দিয়ে বলল-জীবনে করলাম ডা কি?না করলাম প্রেম আর না হলো বিয়া।কিন্তু এইবার দুইভাইয়ের বিয়েতে একটা প্রেম করবই
সকাল সকাল সব কাজ শেষ করে ফেলল মিহু।আজকে বিকেলের দিকে একটু ভার্সিটিতে যেতে হবে।

আর তাছাড়াও দশটার দিকে ফুফুদের আসার কথা।আবার তুলি আপুর খালার ও আসার কথা।তাদের জন্য রুম গোছাতে হবে।আবার রান্নার জন্যও সব কিছু প্রস্তুত করতে হবে।এসব ভেবে নিজের বিছানায় বসে পড়ে।ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও।কিন্তু বিশ্রাম নেবার সময় নাই।হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠল,প্রমির নম্বরটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল।কিন্তু মিহু ফোনটা ধরল না কারণ এই ফোনটা তাকে তার দাদুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।পিহু যখন কলেজে উঠে বায়না ধরে ফোন কেনার জন্য তখন ওর বাবা দুটো ফোন আনে।একটা দেয় পিহুকে আর একটা দেয় তুলিকে।ওর দাদু যখন ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করে যে
মিহুর ফোন কোথায়?তখন বলেছিল ও তো আর পিহুর মতো দূরের কলেজে পড়ে না তাই ওর ফোন লাগবে না।

তারপর ওর দাদুর কথার চাপে পড়ে বলেছিল তুলির পুরনো ফোনটা ওকে দিবে আনে।কয়েকদিন পরে তুলি ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে যায় তারপর ওর দাদু ওকে একটা ফোন কিনে দেয়।
দাদুর কথা মনেকরে ওর চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।ফোনটা দুইবার কেটে যাওয়ার পরে তৃতীয়বারে মিহু ফোনটা ধরে।

-পেত্নীর বাচ্চা হাতি এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে?
প্রমির কথা শুনে মুচকি হাসে মিহু।প্রমি মেয়েটাই এমন।ভিত্তিহীন কথা বললেও সবার মুখে হাসি ফোটে।
-এইতো একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম
-হুহ্ বিশ্রাম না ছাই।তুই সত্যি করে বলতো ঐ ঘষেটি বেগম সকাল থেকে তোকে কি কি কাজ করিয়েছে?
-তুই জীবনেও শুধরাবি না।বলতো কি জন্য ফোন দিয়েছিস?
-তুই তো ভারী পাজি মেয়ে।আমি তোর হয়ে তোর চাচির বিরুদ্ধে কথা বলছি আর তুই তার পক্ষ নিচ্ছিস? একেই বলে যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। আচ্ছা যাক বাদ দে,,,শোন তোর হোয়াট্স অ্যাপ এ যা।তোর দাদুভাই কথা বলবে।

-ভাই আমার এমবি নাই তো
-অহ্ আমার তো মনে থাকে না।আচ্ছা বিকেলে ভার্সিটিতে আসবি যখন তখন বলবি আনে।
-আচ্ছা।এখন রাখি একটু পরে ফুফু আসবে।
ডবল এ গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রির মিটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছে বিদেশী কয়েকজন ক্লায়েন্ট।অন্য কম্পানির কয়েক জন সেই ক্লায়েন্টদের শুনিয়ে ফারিশ কে বার বার জিজ্ঞেস করছে

-দশটা তো বেজে গেলো।আপনার বন্ধু কখন আসবে?আপনি তো বলেছিলেন সে নাকি পাংচুয়াল।কখনো লেইট করেনা।দশটা বাজার আর মাত্র এক মিনিট বাকি,সে কি আদতেও আসবে?
-আমরা কিন্তু দশটার একমিনিট বেশিও ওয়েট করবো না।যে লোক টাইম ই মেইনটেন করতে পারে না সে কি করে একটা কম্পানির মালিক হয়।
ফারিশ ওদের কথায় কর্ণপাত করে না।কারণ ও আরফান কে ছোট থেকে চিনে।ও জানে আরফান কতটা পাংচুয়াল।ঘড়ির কাটায় যখন ঠিক দশটা বাজলো তখন

-আরফান আদিত্য কখনো টাইম লস করে না।সব সময় টাইম মেইনটেন করে চলে।
আরফানের এরকম টাইম মেইনটেন দেখে ক্লায়েন্টরা হাত তালি দিলো।আর খুশি হয়ে বলল
-মিস্টার আরফান আমরা অনেক খুশি হলাম আপনার টাইম মেইনটেন দেখে।এখন বাকি কথা গুলো হয়ে গেলে আমরা আমাদের প্রজেক্টা আপনাদের কম্পানিকে দিতে চাই।
ফারিশ একটু টিটকারী মেরে বলল

-আগেই আমাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। আরফানের টাইম নিয়েই শুধু খুশি হয়েন না ওর বাকি কাজগুলোও দেখুন।না মানে সবার ই তো জানা উচিত কম্পানির মালিক হতে গেলে যে যোগ্যতা লাগে তা সবার আছে কিনা?
ফুফুরা এসে পৌছালেন সাড়ে দশটায় আর তুলি আপুর খালা এসেছেন দশটার দিকে।বিদিশা এসেই মিহুর সাথে লেগে থাকে।ও সবথেকে মিহুকে বেশি পছন্দ করে।মিহু রান্নাবান্নার জন্য মহুয়ার সাথে জোগাড় করছিল কিন্তু বিদিশা এসে ওকে টেনে নিয়ে গেল। ওর সাথে গল্প করতে হবে।এটা দেখে তুলি আপুর খালা চিৎকার করে বলে উঠল

-এই মেয়ে তুমি কই যাও?তুমি গেলে রান্না করব কে?
মিহুর হয়ে বিদিশা উত্তর দেয়
-কেন মহুয়া আপু করবে
-কি আমরা খামু কামের বেটির রান্না?ও তুলির মা ও তুলির মা দেখে যা তোর বারিতে আইসা এইরহম অপমান করতেছো?
মিহু রান্না ঘরে যেতে চাইছে কিন্তু বিদিশা যেতে দিচ্ছে না।খালার চিৎকারে ঘরের সবাই দৌড়ে আসে।

-কি হয়েছে আপা?
-দ্যাখ এই মাইয়্যা আমারে কয় আমি নাকি কামের বেডির রান্না খামু
-আন্টি আমি তা কখন বললাম
বিদিশার মা ওকে একটা ঝাড়ি দিয়ে বলল
-বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে হয় নাকি।যাও ঘরে যাও।
বলার পরে বিদিশা থমথমে মুখ করে ওপরে চলে গেল।
-মিহু তুই এখানে কি কর যা রান্নাটা কর গিয়ে।খালি সুযোগ খুঁজে কাজ না করার।যা
মিহু ফুফুর দিকে একবার তাকায়।তিনি কিছু বলছেন না।তারপর রান্নাঘরে চলে যায় ।খালাও পান চিবুতে চিবুতে চলে গেল।ওর ফুফু বলল

-ভাবি মেয়েটাকে এত কেন কষ্ট দিচ্ছ?
-তোমার এত দরদ থাকে তুমি নিয়ে যাও
-আমি নিতাম ঠিকই যদি না আমার হাত পা বাধা থাকত। আমি ওকে সাহায্য করতে পারছি না তো কি হয়েছে, দেখবে একদিন ঠিকই ওর জীবনে এমন কেউ আসবে যেকিনা ওর সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে
ওর চাচি মুখ বেকিয়ে চলে গেল। ওর ফুফু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ২

-আল্লাহ তুমি সব কিছুর মালিক। তুমিতো জানো আমি সব কিছু জেনেও কিছু করতে পারছি না।কিন্তু তুমি ওর জীবনে এমন কাউকে পাঠিও যে ওকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দেবে

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪