হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ৯

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ৯
নন্দিনী চৌধুরী

আজকে শিশিরের বাবার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকি।শিশির,সাবিনা,মহুয়া,শুভ্রতা,চাঁপা এসেছে এতিমখানায়।সেখানে এসে এতিম ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কাপড় আর খাবার খাওয়ানোর জন্য।শিশিররা প্রত্যেক মৃত্যুবার্ষিকিতে মসজিদেও এতিম খাওয়ায় এমনি এতিম খানায় এসেও খাওয়ায়।সব বাচ্চাদের নতুন জামা খেলনা বিতরণ করে মাঠের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে শিশির।সব বাচ্চাদের আনন্দ দেখছে সে।শুভ্রতা শিশিরকে দাঁড়ানো দেখে সেখানে গিয়ে কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়ায়।দুইজনেই চুপ।অনেকক্ষন চুপ থেকে শিশির বলা শুরু করলো,

শিশির:জানেন মিস শুভ্রতা আমার কাছে এই বাচ্চাগুলোর হাসি খুব তৃপ্তি দেয়।কারন কি জানেন। এরাও আমার মতো এতিম, কেউ আবার অনাথ, কেউ আবার বাবা মা থেকেও অনাথ।জানেন আমি যখন ছোট ছিলাম বাবা আমাকে নিয়ে এখানে আসতেন দাদুর মৃত্যুবার্ষিকিতে।সব ছেলেমেয়েদের খাওয়াতেন জামা কাপড় দিতে।বাবার কাছে এদের হাসি মুখ গুলো বড্ডো অমুল্য ছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর আমার কাছে এখন তাই।এরা যখন এই সুন্দর জিনিস গুলো পেয়ে খুশি হয় তখন আমার অনেক ভালো লাগে।মহান আল্লাহর কাছে এক মাত্র এইরাই নিস্পাপ।কারন এই নিস্পাপ শিশু গুলো কোনো অন্যায় করেনা।এদের মুখে যদি আমরা হাসি ফুটাতে পারি তাহলে মহান আল্লাহ নিজেও খুশি হোন।এদের অনেককেই তাদের মা বাবা ফেলে রেখে গেছে আবার অনেকেরে আপনজনরা ফেলে দিয়ে গেছে মা বাবা নেই বলে।সত্যি আফসোস হয় তাদের জন্য।

কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
শুভ্রতা:বাবাকে অনেক মিস করেন তাইনা?
শিশির:হ্যা অনেক আমার ছোট থেকে একটাই ইচ্ছা ছিলো।যে আমিও আমার বাবার মতো একজন আইডেল পুলিশ অফিসার হবো।আমার বাবা যেমন তার সততা দিয়ে কাজ করে গেছে আইনের রক্ষা করে গেছে।আমিও বাবার মতো একজন সৎ পুলিশ অফিসার হবো।বাবা ও আমার ইচ্ছাটাকে এপ্রিসিয়েট করতো।বাবা ছিলো আমার আইডল।কিন্তু একদিন সব শেষ হয়ে গেলো।বাবা একদিন সকালে বের হলেন একটা কেসের উদ্দেশ্য নিয়ে।কেসটা ছিলো নাড়িপাচার কেস।

বাবা জেনে গিয়েছিলো কারা এর পিছনে তাদের ধরতে বাবার টিমরা যাচ্ছিলো।কিন্তু পথেই একটা ব্লাস্টে বাবা সহ সবাই মারা যায়।সবাই যদিও বলে এটা একটা এক্সসিডেন্টে কিন্তু আমি জানি এটা মাডার।সেদিন থেকে নিজে নিজেকে প্রমিস করেছি আমার বাবাকে যারা মেরেছে যারা অসহায় মেয়েদের পাচার করে দিচ্ছে তাদের আমি শাস্তি দিবো।বেস তারপর থেকে একজন পুলিশ অফিসার হবার জন্য যা করা লাগে তাই তাই করলাম।জানেন এই দুনিয়ায় বাবা মা ভাই বোন ছাড়া কেউ আমাদের আপন না।

আপনার একটা বিপদ হলে সর্ব আগে এগিয়ে আসে আমাদের বাবা মা।খুব অমুল্য সম্পদ আমাদের জীবনে তারা।আল্লাহ কর্তৃক শ্রেষ্ট উপহার বাবা মা।আমাদের বেচেঁ থাকার কারন আমাদের বাবা মা।মায়ের পর সব থেকে জরুলি জিনিশটা হলো বাবা।সে আমাদের মাথার উপর একটা ছায়া।একটা বটগাছ।সে ছাড়া আমরা কিছুইনা।

শুভ্রতা:ঠিক বলেছেন একজন বাবা নিজের আগে তার সন্তানের কথা ভাবে।একজন বাবা একজন শ্রেষ্ট যোদ্ধা।আমাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করে।সমাজের কাছে আমরা যেমনি হই।আমাদের বাবা মায়ের কাছে আমরা খুব অমুল্য ধন।একজন মা আর বাবার কাছে তার সন্তান সব থেকে ভালো।তাতে সেই সন্তানের যতই খুত থাকুক।বড় অপরাধ করলেও বাবা মা ঠিক ক্ষমা করে বুকে টেনে নেয়।আমিও আমার বাবাকে খুব খুব ভালোবাসি।

আমি কালো বলে সবাই আমাকে অবহেলা করলেও আবার বাবা আমাকে বুকে আগলে রাখতো।কোনোদিন কষ্ট জিনিশটা বুজতে দেয়নি।বাবার রাজকন্যা ছিলাম আমি।কিন্তু একদিন বাবা আমাকে আর মাকে একা করে চলে গেলেন।নানা নিয়ে তারপর তাদের বাড়ি।মাও দুইবছর পর চলে গেলো অন্যের বাড়ি বউ হয়ে।আমার খোজ নেওয়ার সময়ই ছিলোনা তার।আমি তখন বুজলাম দুনিয়া কত কঠিন।মামিদের অত্যাচার।সমাজে সবার কটু কথা হজম করা।সব কিছু আমি সয্য করেছি।আজ আমি বড় হয়েছি এইসব সয্য করেই।বাবা থাকলে আমার ভাগ্য কোনোদিন এমন হতোনা।একজন বাবা একটা সন্তানের বেচেঁ থাকার কারন।বাবার হাত ধরেই প্রথম পথ চলা শিখা।ভালো মন্দ সব কিছু শিখিয়েছে।

বাবা মা আমাদের প্রত্যেকটা খুশির কারন।
আমার বাবাও আমার কাছে শুধু একজন আইডল নয় একজন সুপারহিরো।
শুভ্রতার কথা গুলো বলতে বলতে গলা কাঁপছিলো।চোখ থেকে পানি পরছিলো।শিশির বুজতে পারছে শুভ্রতা তার বাবাকে কতটা মিস করে।শিশির একটু এগিয়ে এসে শুভ্রতার হাত ধরলো।শুভ্রতা এতে চমকে যায়।শিশির শুভ্রতার হাত ধরে বললো,
শিশির:কাঁদবেন না।বাবার জন্য দোয়া করবেন।আল্লাহ যেনো তাকে ভালো রাখে।নামাজ পড়ে সব সময় তার জন্য দোয়া করবেন।

শুভ্রতা:হুম।
এরপর শিশির শুভ্রতার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।শুভ্রতাও নিজের চোখের পানি মুছে চলে আসে।আসরের নামাজ পরে সবাই এতিম খানা থেকে চলে আসে।
শিশির বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে থানায় চলে যায়।শিশির থানায় এসে দেখে মৌ হাসান তার জন্য অপেক্ষা করছে।
শিশির:হ্যা বলুন কিছু জানতে পারলেন?

মৌ:স্যার আমরা সব মেয়েগুলোর পরিবারের সাথে আবার কথা বলেছি পারাপ্রতিবেশি সবার সাথে।এদের মধ্য এইযে যাদের ছবি এখন আপনার হাতে আছে তাদের মধ্য তিনজন মেয়ের বিয়ে হবার কথা ছিলো।তিনজনেরই বিয়ে বড়লোক পরিবারে হচ্ছিলো।বিয়ের আগেই মেয়ের পরিবারকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয়েছে।আর তিনজন মেয়েই বিয়ের আগের দিন রাতে নিখোঁজ।তারপরের চারজন মেয়েকে একটা এনজিও থেকে নাকি চাকরির দেওয়ার অফার করা হয়েছে এমনটা আমাদের অই মেয়েগুলো এলাকার প্রতিবেশি জানিয়েছে।কিন্তু আমরা খোজ নিয়ে জানলাম এরকম কোনো এনজিও নেই।একটা ফেক এনজিও।এই মেয়েগুলো এক সাথে নিখোঁজ হয়েছে।

আর তার পরের মেয়েগুলো সব কলেজ আর স্কুল থেকে নিখোঁজ হয়েছে।
শিশির:এই সব গুলো মেয়ে একই এলাকাএ রাইট?
হাসান:জি স্যার।
শিশির:তার মানে নিখোঁজ দাতাও এই এলাকারই।নাহলে ৩২টা মেয়ে এখান থেকে এক এলাকা থেকে নিখোঁজ করা সহজ ব্যাপার না।আর যেই মেয়েগুলো নিখোঁজ হয়েছে তারাও তাকে চেনে।আচ্ছা লাস্ট যেই মেয়েটার নিখোঁজ রিপোট আসলো কি জানি নাম,,
মৌ:আয়না আহমেদ।আজমির আহমেদের নেয়ে।
শিশির:হ্যা রাইট আয়না।তোমরা একটা কাজ করো আবার ওদের এলাকায় যাও আর গোপন ভাবে আরো একবার ইনভেস্টিকেশন করো।বাট তোমরা এবার ছদ্মবেশে যাবে যাতে কেই সন্দেহ না করে।
মৌ:ওকে স্যার আরো একটা কথা জানানোর ছিলো।
শিশির:বলো।

মৌ:স্যার যেই মহিলা কলেজ থেকে ১০টা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিলো সেই এড়িয়াতে একটা টং এর চাচা আছে তিনি আমাদের জানিয়েছে যেদিনই একটা মেয়ে নিখোঁজ হতো সেদিনই ওখানে আগের রাতে একটা লাল কালারের গাড়ি এসে থাকতো।আমরা তথ্য মতে খোজ নিয়ে জানলাম সেখানে হুন্ডাক্রোস ব্রান্ড এর একটা লাল কালারেএ গাড়ি এসে থাকে।
হাসান:অই গাড়িতেই মেয়েগুলোকে তোলা হয়েছে।
শিশির:হুন্ডাক্রোস ব্রান্ড এর মালিকের কাছে খোজ নিতে আমাদের কন্সটেবলদের পাঠাও।
যে কোন নাম্বারের গাড়িটা ওটা।
হাসান:ওকে স্যার।
শিশির:ওকে আপনারা আপনাদের কাজে লেগে পরেন।
মৌ:জি স্যার।

হাতে প্রেগ্নেন্সির ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া।হ্যা প্রেগন্যান্ট সে।রাহাতের বাচ্চার মা হতে চলেছে সে।কিন্তু রাহাত তাকে ছেড়ে দিয়েছে।বাচ্চার কথা রাহাতকে জানাতেই সে বলেছে,
রাহাত:কি প্রমান আছে এই বাচ্চা আমার।তুমি যেমন আমার সাথে বেডে গেছো অনেকের সাথেই গেছো নিশ্চই তাদের কারো মধ্য বাচ্চা হয়তো এটা।তার পাপা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো।তোমার মতো মেয়েরা এমনি বড়লোক ছেলে দেখলে টোপকে পরো তাদের ঘারে।

তুমি কি মনে করেছো আমি জানিনা তোমার সায়ানের সাথে রিলেশন ছিলো।আমি শুরু থেকেই জানতাম কিন্তু আমি কিছু বলিনি কারন তুমি আমার কাছে ভোগের জিনিশ ছিলে।সো আমার সেসব নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিলোনা।আমি তোমাকে টাকা দিছি তুমি আমাকে শরীল দিছো বেস শোধবোধ হয়েগেলো তাইনা।তাই এই বাচ্চার কথা তো আসেইনা।এখন তুমি চাইলে একে রাখো না ফেলে দেও তা তোমার ব্যাপার।এই নেও ২লাখ টাকা ডিএনসি করালে টাকা লাগলে এগুলো ইউজ করো।আর এই ২লাখ টাকা তোমার ওই শরীর দেওয়ার দাম মনে করে নিতে পারো।ওকে সো বাই।

কথা গুলো বলেই রাহাত চলেগেছিলো।প্রিয়া চাইলেও কিছু বলতে পারেনি।কি বলবে আসলেইতো সে অন্যায় করেছে।সায়ানকে ঠকিয়ে রাহাতের কাছে এসেছে।যে শুধু ওর শরীলটাকে ভালোবাসতো।আজ প্রিয়ার সব শেষ।না আছে সায়ানের কাছে ফেরার উপায়,না আছে সমাজে মুখ দেখানোর উপায়।প্রিয়া হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারের পার্কে বসে কাঁদছে আর এসব ভাবছে।
রাতে শুভ্রতা শিশিরের রুমে আসলো।শিশির তখন ফাইল নিয়ে বিজি ছিলো।শুভ্রতা কফি নিয়ে আসছে শিশিরের জন্য।

শুভ্রতা:আপনার কফি।
শিশির ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে শুভ্রতাকে দেখে অবাক হলো।
শিশির:আপনি মহুয়া কই?
শুভ্রতা:মহুয়া আপু নাই।উনি এক বান্ধুবির বাসায় আজকে থাকবেন।তাই আন্টি আমাকে দিয়ে পাঠালেন এটা।

শিশির:অহ আচ্ছা আপনি কফি টেবিলে রেখে যেতে পারেন।
শুভ্রতা কফির মগ টেবিলে রেখে যেতে নিলে টেবিলের একটা ফাইলের উপর চোখ আটকে যায়।আয়নায় ছবি সেখানে।শুভ্রতা ফাইলটা হাতে নিয়ে বললো,
শুভ্রতা:আয়নার ছবি এখানে কেন!
শিশির শুভ্রতাকে এই কথা বলতে দেখে অবাক চোখে বললো,
শিশির:আপনি চেনে একে!
শুভ্রতা:হ্যা এ আমার ছোট মামা আজমির মামা মেয়ে আয়মা।আমার মামাতো বোন।ওর ছবি আপনার কাছে কেন?

শিশির:ও আপনার মামাতো বোন।আরে এই মেয়েটা এক সপ্তাহ আগে স্কুল থেকে নিখোঁজ হয়েছে।এক মিনিট মিনিট তার মানে আপনি আহমেদ পরিবারের মেয়ে।
শুভ্রতা আয়নার নিখোঁজ হবার কথা শুনে চমকে গেলো।চমকে যাওয়া কন্ঠে বললো,
শভ্রতা:নিখোঁজ হয়েগেছে মানে।আয়নার কি হয়েছে?
“কোনো একটা নারী পাচার কারিদের খবলে আপনার বোন ও শিকার হয়েছে।”

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ১০