অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ২৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
মুখোর দুটো সপ্তাহ পাড় হল। মধুর মতোই মিঠে কিছু স্মৃতিতে পরিপূর্ণ হল চৌদ্দটি দিন। মাঘ পেরিয়ে এলো ফাল্গুন। বসন্তের আগমনে প্রকৃতির সাথে সাথে সতেজ হয়ে উঠেছে কিছু মনও। প্রকৃতির সুসজ্জিত রূপের সাথে সাথে সেজে উঠেছে কারো কারো কল্পনার রাজ্য। প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মানুষের মন-মস্তিষ্ক।
বরাবরের মতোই ইউনাইটেড হসপিটালের সামনের রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। সেই পুরোনো উদ্দেশ্যে। নাজিফাকে একপলক চোখের দেখা দেখবে। হিসেব মতো পাঁচ মিনিট পর নাজিফার হাসপাতালে ঢোকার কথা। নাজিফাকে দেখেই ও চলে যাবে নিজের কাজে। কিন্তু পাঁচ মিনিটের জায়গায় বারো মিনিট কেটে গেল কিন্তু নাজিফা এলোনা। উচ্ছ্বাসের মধ্যে খানিকটা উদ্বিগ্নতা দেখা গেল এবার। নাজিফাতো এরকম করেনা কখনও। কোন সমস্যায় পড়েনিতো? গেইটের দিকে তাকিয়ে নিজের চিন্তিত দৃষ্টি স্হির রেখে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। নাজিফাকে একটা ফোন করবে কি করবেনা চিন্তা করতে করতেই একটা রিকশা এসে থামল ওর সামনে। উচ্ছ্বাস রিকশার দিকে না তাকিয়ে গেইটের দিকে ব্যস্ত দৃষ্টি রেখে বলল, ‘চাচা, একটু সামনে নিয়ে দাঁড় করান।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘ উঠে আসুন।’
হঠাৎ পরিচিত নারী কন্ঠ কানে পৌঁছতেই চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। যেন ঝংকার দিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। চকিতে তাকাল কন্ঠস্বর অনুসরণ করে। রিকশায় নাজিফা বসে আছে। ভ্রু জোড়া কোঁচকানো। উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ পড়তেই একপাশে সরে বসে হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ভ্রু জোড়া এখনো কোঁচকানো। উচ্ছ্বাস বোকার মতো তাকিয়ে রইল নাজিফার দিকে। প্রায় আধ মিনিট কেটে গেল এভাবেই। নাজিফা এবার চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘এই যে! রিকশায় উঠে বসতে বলছি শুনতে পাচ্ছোনা?’
নাজিফার এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে এমনিতেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল উচ্ছ্বাস। তারওপর ওর ‘তুমি’ সম্বোধনে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল একদম। ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল নাজিফার দিকে। নাজিফা এবার খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘কী হলো কী উঠুন?’
উচ্ছ্বাস রিমোট টেপা পুতুলের মতো উঠে বসল রিকশায়। গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বের হলো না। উচ্ছ্বাস উঠে বসতেই রিকশা চলতে শুরু করল। পাঁচ মিনিট পর হুঁশ ফিরল উচ্ছ্বাসের। এতক্ষণ একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছিল ও। কী হচ্ছিলো ওর সাথে নিজেও যেন বুঝতে পারছিল না। নাজিফা মেয়েটা ওর সামনে এলে এরকমই হয়। সব গুলিয়ে যায় ওর। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়। পরিস্থিতি বোধগম্য হতেই উচ্ছ্বাস গলা ঝেড়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
নাজিফা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। দু সেকেন্ডেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এতক্ষণে মনে হল কথাটা জিজ্ঞেস করা উচিত?’
জবাব দিলোনা উচ্ছ্বাস। এই প্রশ্নের ঠিক কী উত্তর দেওয়া যায় জানা নেই ওর। মেয়েটার সামনে এলেই ওর ব্যক্তিত্বের এরকম অদ্ভুত পরিবর্তন কেন ঘটে? জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলল উচ্ছ্বাস। পাল্টা প্রশ্ন করার জন্যে মনটা ছটফট করল। কিন্তু শব্দ ভান্ডারে এই মুহূর্তে একটাও শব্দ খুঁজে পেলোনা। শেষমেশ আশা ত্যাগ করে বসে রইল চুপচাপ। নাজিফা বলল, ‘এরকম চুপসে থাকো কেন তুমি? রুদ্র ভাইর মতো মানুষের সাথে থেকে এতো শান্ত থাকার তো কথা না। নাকি ভদ্র হওয়ার নাটক করছো?’
উচ্ছ্বাস এবারেও কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। এমন উদ্ভট প্রশ্ন করছে কেনো মেয়েটা? সহজ স্বাভাবিক প্রশ্ন করা যায়না? ইতস্তত করে বলল, ‘না, আসলে_’
এইটুকুতেই গিয়ে থামর উচ্ছ্বাসের কথার দৌড়। আর কোন শব্দ খুঁজে পেলোনা সে। নাজিফাও মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে রইল। অস্বস্তিকর নিরবতায় কেটে গেল আর দশটা মিনিট।
‘ চাচা, রেখে দিন এখানেই।’
নাজিফার গম্ভীর কন্ঠে নিরবতার অবসান ঘটতেই উচ্ছ্বাস হকচকিয়ে চারপাশে নজর বুলালো। রাস্তার ব্যস্ত এক মোরে এসে পৌঁছেছে ওরা। কারণটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাজিফার দিকে তাকাল। নাজিফা নেমে গেছে ততক্ষণে। বলল, ‘ কী হল নামো!’
উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে তাকিয়ে থেকেই নামল। সেই বোকা দৃষ্টি মেলেই তাকিয়ে রইল নাজিফার মুখের দিকে। নিজেই নিজেকে কয়েকটা জঘন্য গালি দিয়ে নিল মনে মনে। আজকে ওর হয়েছে কী? কথা বলতে পারছেনা কেন? কুহুর কাছ থেকে সেই ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজটা শিখে রাখা প্রয়োজন ছিল। আজ কাজে দিতো। নাজিফা চরম বিরক্ত হয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘ কী হল? ভাড়াটা দিচ্ছো না কেন?’
আরও এক দফা বোকা বনে গেল উচ্ছ্বাস। অসহায় চোখে একবার তাকাল নাজিফার মুখের দিকে। অবস্থাটা বোধগম্য হতেই ভীষণ লজ্জিত হল। ভাড়াটা আগেই বের করা উচিত ছিল ওর। ইতস্তত করে পকেট থেকে টাকা বের করে এগিয়ে দিল রিকশাওয়ালার দিকে। নিজের ভাড়া বুঝে নিয়ে দ্রুত প্রস্হান করলেন রিকশাওয়ালা।
নাজিফা এবার দুকদম এগিয়ে এলো উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস চোখে ইতস্তত ভাব নিয়ে নাজিফার চোখে চোখ রাখল। নাজিফা এবার গাম্ভীর্যতা হারাল। স্বাভাবিক মেয়েলী কন্ঠে বলল, ‘ফুচকা খাবো।’
অবাকের ওপর অবাক হতে হতে উচ্ছ্বাসের আজ নাজেহাল অবস্থা। বিস্মিত চোখ আর কোঁচকানো ভ্রু জোড়া নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ তুমি আমাকে নিয়ে এখানে ফুচকা খেতে এসছো?’
নাজিফার চোখে-মুখে এবার কৌতুক খেলে গেল। হাত ভাঁজ কলে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘ হ্যাঁ। এতো অবাক হওয়ার কী আছে? এইযে হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিদিন দু-বেলা আমার মুখদর্শনের সুযোগ করে দিচ্ছি তার বদলে আমারও তো কিছু পাওনা থাকে না-কি?’
উচ্ছ্বাস মাথার পেছন দিকটা চুলকালো। মেয়ে বলে কী! ইতস্তত ভাব নিয়ে আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যে বলেছিল তোমার ডিউটি আছে আজ। সমস্যা হবে না?’
‘ মিথ্যে বলেছিলাম।’ অকপট স্বীকারোক্তি নাজিফার।
উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল ব্যপারটা। বুঝতে পারল বলেই অবাক হল। ওকে সাথে নিয়ে ফুচকা খেতে আসবে বলে নাজিফা মিথ্যে বলে ওকে হসপিটালের সামনে নিয়ে এলো? কেন? জল কোন দিকে গড়াচ্ছে! উচ্ছ্বাসের মনের ভাবনা হয়তো বুঝতে পারল নাজিফা। তাই বলল, ‘এতো ভাবনায় পড়ে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। বললাম না, এটা আমার পাওনা।’
ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। অস্বস্তি আর জড়তা কেটে গেল অনেকটা। মৃদু হেসে বলল, ‘তাহলে চলো তোমার পাওনা মিটিয়ে দেই।’
দুজনেই গেল একটা ফুচকার দোকানে। ফুচকা খেতে খেতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল উচ্ছ্বাস। এই প্রথম এতোটা সময় নাজিফার সাথে কাটালো। যার ফলে সংকোচ নামক বস্তুতে ভাটা পড়েছে অনেকটাই। এতোদিনতো কেবল দূর থেকে দেখা অবধিই সীমাবদ্ধ ছিল সবকিছু। ও দাঁড়িয়ে থাকতো হসপিটালের সামনে আর নাজিফা রিকশা থেকে নামার সময় কখনও কঠোর, কখনও মোলায়েম দৃষ্টি উপহার দিতো ওকে। এইটুকুই। উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল, ‘বাড়িতে কে কে আছে তোমার?’
‘ বাবা, মা, বড় দুই ভাই। তোমার?’
মলিন হাসল উচ্ছ্বাস। কিছুটা নরম আওয়াজে বলল, ‘ রাশেদ বাবা, রুদ্র, কুহু, জাফর কাকা, জ্যোতিও আছে।’
নাজিফা একটা ফুচকা মুখে পুরতে পুরতে বলল, ‘ ওরাতো রাশেদ বাবার বাড়ির লোক। তোমার কথা বলছি আমি।’
‘ সতেরো বছর যাবত ওটাই আমার বাড়ি।’ কোন সংকোচ দ্বিধা ছাড়া অনায়াসেই বলে ফেলল উচ্ছ্বাস।
নাজিফা ফুচকা চিবোনো থামিয়ে তাকিয়ে রইল উচ্ছ্বাসের দিকে। ব্যপারটা বুঝতে পারল পাঁচ সেকেন্ড চিন্তা করেই। ও কিছু বলার আগেই উচ্ছ্বাস হেসে ফেলল। বলল, ‘ আচ্ছা পরিষ্কার করেই বলছি। আমি অনাথ।’
নাজিফা কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকল। খুব ধীরে ধীরে ফুচকা চিবুতে চিবুতে ভাবল কিছু একটা এরপর বিষয়টা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
উচ্ছ্বাস নিজের কন্ঠে কৃত্রিম বিস্ময় ঢেলে বলল, ‘বাপরে! তুমি পার্মিশন নিচ্ছো?’
নাজিফা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগী ছাত্রের মতো সিরিয়াস হয়ে গেল উচ্ছ্বাস। নাজিফা পুনরায় তার সেই গম্ভীর কন্ঠে ফিরে গিয়ে বলল, ‘এভাবে ডেইলি দুইবেলা চোখের দেখা দেখে কী লাভ হয়?’
উফ! আবার সেই উদ্ভট প্রশ্ন। যার উত্তর দেওয়া উচ্ছ্বাসের পক্ষে সম্ভব নয়। নাজিফার করা সব প্রশ্নেই বেচারা কেমন মিইয়ে যাচ্ছে। নাজিফা ওকে বড়সর আস্ত বলদ ভেবে বসে আছে হয়তো। উচ্ছ্বাসকে হতভম্ব করে দিয়ে নাজিফা এক ভয়ানক প্রশ্ন করে বসল এবার। বলল, ‘ভালোবাসো?’
উচ্ছ্বাস স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকাল নাজিফার দিকে। হাত-পা অসাড় হয়ে এলো। শুকনো দুটো ঢোক গিলে হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে উঠল যেন। কন্ঠে একরাজ্যের ব্যস্ততা ঢেলে ফুচকাওয়ালাকে বলল, ‘কতো বিল হয়েছে, মামা?’
সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রাকৃতিক আলোর মায়া কাটিয়ে কৃত্রিম আলোয় সেজে উঠেছে গোটা শহর। আমের ভিলার বৈঠক ঘরটাতে আজ আবার গোপন মিটিংয়ের ডাক পড়েছে। নিয়মানুযায়ী রাশেদ ছাড়াও জাফর, ইকবাল, উচ্ছ্বাস উপস্থিত হয়েছে। বরাবরের মতোই রুদ্র এসে পৌঁছলো সবার শেষে। ও এসে নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসতেই আলোচনা শুরু হল। কিছুক্ষণ চলাকালীন কাজ নিয়ে আলোচনা আর হিসেব-নিকেশ সেড়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল রাশেদ। আধ মিনিট পিনপতন নিরবতা চলল ঘরটাতে। ঘরে উপস্থিত সকলের মুখ থেকে একবার করে ঘুরে এলো রাশেদের অভিজ্ঞ, তীক্ষ্ণ, কঠোর চোখজোড়া। এরপর থমথমে দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘ রুদ্র?’
সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল রুদ্রর। শিড়দাঁড়া সোজা করে বলল, ‘ হ্যাঁ বাবা?’
‘ সেদিন তোমাকে কেউ ফলো করছিল বলছিলে। কারা সেটা এখন জানো নিশ্চয়ই?’
‘ জানি বাবা। ডার্ক নাইটের লোক। কিন্তু হঠাৎ নজরে নজরে কেন রাখছিল বুঝতে পারছিনা। যেহুতু কোন আক্রমণ করেনি তাই আমরাও কিছু করছিনা। কিন্তু আমাদের লোক ওটাকে নজরে রাখছে। চিন্তা নেই।’
রাশেদ উত্তর দিলোনা। কপালের ভাজ দুটো গাঢ় হল খানিকটা। উচ্ছ্বাসের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘আর তোমাকে ফলো করছিল ব্লাক হোল। তাইতো?’
‘ হ্যাঁ রাশেদ বাবা। ঐদিন রাতেই চালের গোডাউনটায় তুলে এনেছিল ওটাতে। পেট থেকে কথা বের করে মে’রে ফেলেছি। জীবিত ফিরে গেলে সমস্যা হতো।’ ইতস্তত করে বলল উচ্ছ্বাস।
মৃদু মাথা ঝাকালো রাশেদ। হাতের কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে কিছু একটা ভাবল ভীষণ গভীরভাবে। জাফর বলল, ‘ব্যাপারটা কিন্তু একটু ঘোলাটে লাগছে, ভাইজান। আমাদের কোন ইনফমেশন কোন পথে আসছে সেটা ওরা আগেই জেনে গিয়েছিল। রুদ্র একা চট্টগ্রাম যাচ্ছে, কোন হোটেলে উঠছে সেটাও ওরা আগেই জেনে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কতোটা ভয়ংকর! আর তারওপর রুদ্র আর উচ্ছ্বাসকে নিঃশব্দে ফলো করে যাওয়াটাও স্বাভাবিক কিছু নয়। মনেতো হচ্ছে বিষ ভেতরেই লুকিয়ে আছে।’
কথায় বাঁধা দিয়ে ইকবাল বলল, ‘কিন্তু সেটা কী সম্ভব? এগুলো আমরা কয়েকজন ছাড়াতো কেউ জানেনা। স্বপন তপুদের ঘটনা থেকেতো আমরা সতর্ক হয়েছি।’
রুদ্র আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘ ব্যপারটা যাই হোক আমি দেখছি। প্রতিদিন আপডেট আসছে আমার কাছে। ওরা একশন নেওয়ার আগেই খবর পৌঁছে যাবে। আর রইল দলের ভেতরের কথা, সেটাও আমি দেখে নেব।’
রাশেদ এবার চশমাটা খুলল চোখ থেকে। সামনে থাকা হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে বললেন, ‘ শুধু দেখে নিলেই হবেনা। পরবর্তী দুই বছর আমাদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবার আমরা যে কাজে হাত দিচ্ছি সেটা সোলার সিস্টেমের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক কাজ। অন্যকারো সাহস না হলে ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। আর ওদের প্রথম লক্ষ্য হবে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। কারণ এই দুজনকে মে’রে ফেলা মানেই সোলার সিস্টেমের পঞ্চাশ ভাগ অকেজো করে দেওয়া। সুতরাং এই দুই বছর তোমরা মরার জন্যেই বেঁচে থাকছো। পরের সেকেন্ড শ্বাস নিতে পারবে কি-না সেটা শুধুমাত্র তোমাদের সতর্কতার পরিমাণই বলে দিতে পারবে। অন্যকেউ না। আর রুদ্রর ওপর সকলেরই ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে। ওকে মে’রে ফেলার একটা সামান্য সুযোগও কেউ হাতছাড়া করবেনা।’
রুদ্রর দিকে তাকাল রাশেদ। বলল, ‘তোমাকে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম মৃ’ত্যু দেওয়া কারো কারো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। যাই হোক, এটা দেখ। এখানেই আমাদের পরবর্তী কাজ সম্পর্কে লেখা আছে।’
কথাটা বলে একটা ফাইল এগিয়ে দিল রাশেদ রুদ্রর দিকে। ফাইলটা পড়ার পর হঠাৎই বিষিয়ে গেল রুদ্রর মন। বসন্ত যেন আসতে না আসতেই বিদায় নিল। সদ্য গজানো সতেজ পাতাগুলোও মুষড়ে পড়ল অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ে। মধুর মতো মিষ্ট মুহুর্তগুলো কালকূট বিষের চেয়েও ভয়ানক যন্ত্রণার হয়ে গেল। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস। ফাইলটা পড়ে উচ্ছ্বাসের অবস্থাটাও অনেকটা সেরকমই হল। আজ দুপুরেও যেই সোনালী স্বপ্নের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছিল, এক ধাক্কায় সেই জাল ছিন্ন করে ওকে বাস্তবতার সামনে মুখ থুবড়ে ফেলল। রাশেদ আবার রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ ইদানিং বনানীর ফ্ল্যাটের দিকে একটু বেশিই যাচ্ছো শুনলাম। কোন প্রয়োজন থাকে?’
রুদ্র শান্ত চোখে তাকাল নিজের বাবার দিকে। বিষণ্ন গলায় বলল, ‘ হ্যাঁ, এদিকে এতোদিন কাজ কম ছিল তাই। ওখানে যেতাম কিছুটা সময় কাটাতে। শান্তির খোঁজে। তবে কালকের পর থেকে আর যাওয়ার প্রয়োজন হবেনা।’
পাল্টা কোন প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করল না রাশেদ। আরও কিছু আলাপ সেড়ে নিয়ে শেষ করল সেদিনের বৈঠক। বৈঠক ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ভারী বাস্তবতার আঘাতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া দুটো হৃদয়।
রাত সাড়ে আটটার দিকে বনানীর ফ্লাটটাতে গিয়ে পৌঁছালো রুদ্র। কলিং বেল চাপার পরপরই খুলে গেল দরজাটা। দরজা খুলে রুদ্রকে দেখেই হেসে ফেলল প্রিয়তা। প্রিয়তার হাস্যজ্জ্বল মুখে চোখ আটকে গেল রুদ্রর। আজ হালকা সেজেছে বোধ হয়। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। অপরূপ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। সেদিন রাতের পর থেকে ওদের মধ্যকার সম্পর্কটা অজান্তেই বদলে গেছে। সেদিনের পরের সকালে ঘুম থেকে উঠে রুদ্র নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করে। মাথায় একটু জোর দিতে আগের রাতের সবকথাই মনে পড়ে যায়। এটুকু ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যে ব্যপারটা শুধুমাত্র এক চুম্বন অবধি সীমাবদ্ধ ছিল।
এরচেয়েও মারাত্মক কোন অঘটন ঘটেনি। কিন্তু যেটুকু হয়েছে সেটাও কম কোথায়! জীবনে প্রায় সমস্ত রকম অপরাধ করলেও কোন নারীকে তার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করার পাপ করেনি ও। অস্বস্তিতে জমে যাচ্ছিল সর্বাঙ্গ। বেডরুম থেকে বেরিয়ে দেখল প্রিয়তা খাবার বানাচ্ছে। বিগত রাতের ব্যবহারের কোন ক্ষমা চাওয়ায় মতো শব্দও খুঁজে পায়নি ও। অস্বস্তি, দ্বিধা, দ্বন্দ্বে অবস্থাটা এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে ঐ ঘটনা নিয়ে একটা শব্দও বের হলো না মুখ দিয়ে। প্রিয়তাও ঐ বিষয় নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনি ওকে। তবে সারাদিন অনেকটা গম্ভীর আর মনমরা হয়ে পরেছিল মেয়েটা। যা দেখে অপরাধবোধ আরও বেড়ে যাচ্ছিল রুদ্রর।
কিন্তু পরের দিন থেকেই সম্পর্কের রং যেন বদলে গেল। প্রিয়তার স্ত্রীসুলভ ব্যবহার চমকে দিল রুদ্রকে। বুঝতে পারল মাতাল অবস্থায় এক পুরুষের করা ঐ অকপট, নিষ্ঠুর, হৃদয়স্পর্শী স্বীকারোক্তি গভীরভাবে দাগ কেটেছে রমনীর মনে। উপেক্ষা করতে পারেনি একটা শব্দকেও। প্রণয়ের সুর বেজে উঠেছে প্রিয়তার হৃদয়জুড়ে। রুদ্রকেও যেন গ্রাস করে ফেলল এক অদ্ভুত মায়াজাল। মন বলে উঠল, হোক না একটু ভুল। নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ তো প্রকৃতিও করে, আমরাতো তার অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র। ব্যস! প্রেমরোগ ছাড়ল না দুজনের কাউকেই।
অপ্রকাশিত হলেও প্রণয়ের রঙে দুজনেই রঙিন হল। আরও এক সপ্তাহের জায়গায় দুটো সপ্তাহ পাড় হয়ে গেল। রুদ্রের বনানীতে কাটানো মুহূর্তগুলো দীর্ঘ হল। রাতের পর রাত জেগে অপ্রয়োজনীয় ফোনালাপ হল। কিন্তু রুদ্রর মধ্যে প্রিয়তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার কোন লক্ষণ দেখা গেলোনা। প্রিয়তা দু’বার পেড়েছিল কথাটা। দু’বারই রদ্র পাল্টা প্রশ্ন করেছে ‘যেতেই হবে?’। উত্তর দিতে পারেনি প্রিয়তা। সুতরাং যাওয়াটাও আর হয়ে উঠেনি। মুখোর ছন্দেই কাটছিল ওদের অব্যক্ত প্রেমের এই চৌদ্দটা দিন। রুদ্রকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা হেসে দিয়ে বলল, ‘এভাবে কী দেখছেন মিস্টার? আজ আমাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে বুঝি?’
রুদ্র কোন কথা না বলে গম্ভীর মুখে ভেতরে এলো। প্রিয়তা কিছুটা অবাক হল। ওনার আবার কী হল? এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো! গাল ফুলিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে এলো প্রিয়তা। রুদ্র সোফায় এখনো গম্ভীর মুখে বসে আছে। প্রিয়তা গিয়ে বসল রুদ্রর পাশে। বুঝতে পারল রুদ্রর মন ভালো নেই। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। ইতস্তত করে বলল, ‘ কোন সমস্যা হয়েছে?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বসে রইল। প্রিয়তা বুঝতে পারল ব্যপারটা গুরুতর কিছু হয়তো। প্রিয়তা আলতো করে রুদ্রর চুলের মাঝে আঙুল চালিয়ে বলল, ‘আমি হয়তো আপনাদের ব্যাপার বুঝবোনা। তবে যদি চান তো বলে হালকা হতে পারেন।’
‘ একটু পানি দেবে, প্রিয়?’ ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল রুদ্র।
প্রিয়তা দ্রুত উঠে গিয়ে পানি আনলো রুদ্রর জন্যে। রুদ্র দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে অনেকটা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আমি না কষা মাংস রান্না করেছিলাম আপনার জন্যে। আপনি বলেছিলেন আপনার সবচেয়ে প্রিয় ওটা। খেয়ে যাবেন তো? না খেয়ে কিন্তু উঠতে দিচ্ছিনা আজকে আমি।’
রুদ্র তাকাল প্রিয়তার দিকে। যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘খাবো।’
দুজনে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে নিল। প্রিয়তা বরাবরের মতোই কথার ঝুলি নিয়ে বসে পড়েছিল। বরাবরের মতোই রুদ্র চুপ ছিল। কিন্তু পার্থক্য ছিল একটাই। সবসময় রুদ্র চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনতো প্রিয়তার প্রতিটা কথা। কিন্তু আজ প্রিয়তার একটা শব্দতেও মনোযোগ নেই রুদ্রর। ভয়ানক বিষণ্ন এক ভাবনায় ব্যস্ত সে। প্রিয়তা থালাবাসন সব গুছিয়ে রেখে আসতেই রুদ্র বলল, ‘ মীরার সাথে কথা হয় তোমার?’
প্রিয়তার হাত মুছতে মুছতে বলল, ‘ হ্যাঁ আজকেও হয়েছে। বলল মিস্ করছে আমাকে ভীষণ। একা থাকতে ভালো লাগছেনা। পাগল মেয়ে। আমি ভাবছি ওকে একজন_’
‘ আর মিস করবেনা। ‘
রুদ্রর পাল্টা কথায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেল প্রিয়তা। মুখে হাসি রেখেই জিজ্ঞেস করল, ‘ করবেনা কেন?’
রুদ্রর চোখমুখ হঠাৎ কেমন কঠিন হয়ে উঠল। দপদপ লাফাচ্ছে কপালের ডানপাশের শিরাটা। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ব্যাগ প্যাক করে ফেলো প্রিয়তা। কাল সকালে আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছি।’
প্রিয়তা আকাশ থেকে পড়ল। বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘চট্টগ্রাম?’
‘ হ্যাঁ, এখন আর কোন বিপদ নেই তোমার। সুতরাং এখানে থাকার আর কোন কারণও নেই। আমারও এসব ঝামেলা ভালো লাগছেনা আর। অনেক কাজ আছে।’
প্রিয়তা হাত থেকে টাওয়েলটা খসে পড়ল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র চোখ সরিয়ে বলল, ‘কাল আটটায় আসব আমি। ব্রেকফাস্ট বানাতে হবেনা। বাইরে থেকে খেয়ে নেব আমরা। আটটার মধ্যে রেডি হয়ে থেকো।’
প্রিয়তা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, ‘যেতেই হবে?’
প্রিয়তার এই প্রশ্নটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল রুদ্রকে। এতোদিন এই প্রশ্নটা ও করতো প্রিয়তাকে। কিন্তু আজ! ভেতর ভেতর নিজের ওপরেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল রুদ্র। কিন্তু মুখে বলল, ‘ কেন নয়?’
‘ এতোদিন তাহলে_’
বাঁধা দিল রুদ্র। অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল, ‘কিছুই হয়নি এতোদিন। এমন বিশেষ কিছুই হয়নি। যদি সেদিন রাতের কথা বলোতো আ’ম সরি ফর দ্যাট। আমি জানি একটা সরিই ব্যাপারটার জন্যে যথেষ্ট নয়। কিন্তু এছাড়া আর কী করব আমি? যা ঘটে গেছে সেটা বদলাতে তো পারবোনা। আমি ড্রাংক ছিলাম। তুমি কিন্তু সজ্ঞানে থেকেও আমাকে আটকাও নি। তবুও আমি তোমাকে ব্লেম করছিনা কারণ তোমার না আটকানোতে আমার করা অপরাধটা কম হয়ে যাচ্ছেনা। একটা ভুল ছিল ওটা। নাথিং এলস্।’
কিছুটা থেমে রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আর আমার ওসব কথা ধরে বসে থেকোনা। মাতালরা অনেক কথাই বলে। সব ধরতে নেই।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। চোখদুটো ছলছল করছে। হয়তো যেকোন মুহূর্তে জল গড়িয়ে পড়বে। রুদ্র চোখ সরিয়ে নিল প্রিয়তার চোখ থেকে। বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালা করছে আজ। ও বুঝতে পারছে এক রমনীর সদ্য ফুটে ওঠা প্রেমের ফুলকে মুচড়ে ফেলে দিয়েছে ও। সদ্য রঙিন অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠা একটা নিষ্পাপ মনকে ভেঙ্গে গুড়িতে দিয়েছে। কিন্তু এটাই নিয়তি, এটাই ওদের ভাগ্য। ভুলটা রুদ্রর ছিল। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ধাক্কাতো ওকে খেতেই হতো আজ নয়তো কাল। ভালো এটাই হয়েছে যে খুব বেশি দেরী হওয়ার আগেই নিজের সীমাবদ্ধতা দেখতে পেয়েছে রুদ্র। ওর প্রেমিক সত্ত্বার যাত্রা এখানেই শেষ। রুদ্র-প্রিয়তার কাহিনী এ পর্যন্তই ছিল।
অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ২৭
[ অনেক দেরীতে দিলাম পর্বটা তাইনা? অনেকেই হয়তো চরম বিরক্ত হয়েছেন। আসলে রোজার মাস তারওপর সব কাজিনরা চলে আসায় ঝামেলা হয়ে গেছে। সময় সংকটে ভুগছি। আর যেহেতু এই গল্পটার ধাঁচ একটু আলাদা তাই পরবর্তী কয়েকটা পর্ব মাথায় রেখে আমায় একেকটা পর্ব লিখতে হয়। তাই চাইলেও দায় ছাড়াভাবে লিখে দিতে পারিনা। আশা করি, সমস্যাটা বুঝে ঈদ পর্যন্ত এই অনিয়মকে একটু প্রশ্রয় দেবেন। ঈদের পর থেকে ইনশাআল্লাহ একটা নির্দিষ্ট নিয়মমাফিক গল্প পাবেন। ভালোবাসা আর শুভকামনা সবার জন্যে। ]
অসাধারণ হয়েছে
Kobe diben next part?? Eid to ses….. Golpo ta owsm
Aktu taratari dan Eid to ses.??
please understand ak sathe na porle moja asena. ?
And this part amazing ?☺️