মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৫

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

“আপনি একজন ছেলে হয়ে কেন মেয়েদের স্পর্শ করছেন। ছাড়ুন ওনাকে। আমি দেখছি।
এখন গুছানোর দরকার নেই। অন্য কাজে যান। আধ ঘন্টার ভেতরে আমরাই চলে যাবো। তারপরে যা ইচ্ছে করবেন।”
ধ্রুব গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলতেই ওয়ার্ড বয় বিনা বাক্যে প্রস্থান করল। আমি পিছিয়ে বেডের উপর বসলাম। জুস এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। অনেকটা পথ যেতে হবে।”
“আমাকে হসপিটালে কেন এনেছেন?” জুস না নিয়েই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম।

“তোমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলে বুঝি, নাকি আমার বাড়িতে যাওয়ার ধান্দা করছ? বাড়িতে নিয়েই বা কী বলব? আশ্চর্য ভাবনা। হসপিটাল ছাড়া আর কোথায় নিতাম শুনি?” একরোখা জবাব দিলেন।
ধ্রুব এসে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন বেডের মাঝ বরাবর। বিনিময়ে একটু হেলে পড়লাম নিচের দিকে। রেলিং ধরে ভারসাম্য বজায় রাখলাম। একজনের উপযুক্ত বেডে দুজন শুলে যা অবস্থা হয় আর-কী? অস্বস্তির রেশ নিয়ে বললাম,
“আমার ফোনটা?”
“গাড়িতে আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে চলো, পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে।”
তিনি পুনরায় গম্ভীর গলায় বললেন, “চড়ুই, আমাকে দেখে তোমার কি পরিচিত মনে হয়? আজ চশমা ছাড়া তোমার চোখের দিকে তাকাতেই বারবার মনে হয়, এই চোখ দুটিতে আমি আগেও একবার চোখ রেখেছিলাম। তবে ক্ষণস্থায়ী। তাই মনে নেই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি প্রতুক্তি না করেই খাওয়াতে মনোনিবেশ করলাম। সারারাত না খেয়ে সকালে জুস। এই কোমল পানীয় খাওয়া যায়। কী ধারণা? স্যার বিদেশ থেকে এসেছেন, তিনি কী করে আমায় চিনবে? আমিও একবার গভীর নয়নে চেয়ে রইলাম। পরিচিত ঠেকল, তবে তেমন নয়। পরক্ষণেই নিজেকে শান্তনা দিলাম, এটা হতেই পারে না।
“ভাবতে হবে না। বাদ দাও।
একটা কথা বলো, তুমি ছোটবেলা থেকেই চশমা পড়? চশমা ছাড়া কিছু দেখতে পাও না?”
আজব প্রশ্নে হতবাক হলাম কিঞ্চিৎ। চোখের মণি ঘুড়িয়ে উত্তর দিলাম, “পাঁচ ছয় বছর হবে চশমা পড়ি। চশমা ছাড়া হালকা ঝাঁপসা লাগে। আগে হতো না। মায়ের মৃত্যুর পর এমন হচ্ছে। মাকে ভুলতে সবসময় পড়ায় ডুবে থাকতাম তাই এখন ভুগতে হচ্ছে।”

“তোমার মা নেই?”
“শুধু মা কেন? বাবাও নেই। একাই বেঁচে আছি আমি।”
ধ্রুব স্যার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। নিজের অজান্তেই আমাকে হার্ট করে ফেললেন। ভাঙা গলায় বললেন, “স্যরি! চড়ুই আসলে..
“স্যরি কেন বলছেন স্যার? দোষটা আমার। আমি চাইলে একটি মাত্র শব্দে উত্তর দিতে পারতাম। অহেতুক নিজেকে দোষারোপ করবেন না।”

নির্জন হয়ে গেল পরিবেশ। কথা হলনা আর। দুজনেই চুপ। আমিও চুপ। আর কথা হলনা আমাদের মাঝে। বাড়িতে চিন্তা করছে, এবার ফেরা উচিত। তাই পায়ে হেঁটেই গাড়ির কাছে এলাম। ধ্রুব স্যার বাড়ির দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ভেতরে আসলেন না। আমিও জোর করলাম না। বাড়িতে আসতেই মামুনি উতলা হয়ে গেলেন। মেয়ের ন্যায় ভালোবাসেন তো তাই। শাওয়ার নিয়ে বের হতেই নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর নিদ্রার দেশে পাড়ি জমালাম। নিদ্রা ভঙ্গ হল মাঝ রজনীতে। যখন চাঁদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে আলোয় উজ্জ্বল করতে করতে। নাকের কড়া নাড়ল তীব্র পারফিউমের সুভাস। বুকের উপর ভারী বস্তু অনুভব করলাম। ললাটে উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ পেলাম। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়েছিল কণ্ঠ। রেশ কাটিয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে অবলোকন করতেই ছায়ামূর্তি দৃষ্টিগোচর হল। ভয়ে শিউরে উঠলাম। খামচে ধরলাম বেডশিট। মিনমিনে স্বরে শুধালাম,

“কে? কে এখানে? আমার ঘরে কী করেছেন?”
বিনিময়ে প্রতুক্তি শ্রবণপথে গেল না। লহমায় ছায়ামানবটি সরে গেল। ব্যালকেনি টপকাল। এখনও দরজাটা নড়ছে। স্পষ্ট হল, কেউ ছিল। আমি বিচলিত হলাম। দ্রুত টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলাম। তৎক্ষণাৎ আলোকিত হল রুমের ভেতরটা। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। ঝাঁপসা চোখ পরিষ্কার করে চশমা পড়লাম। ব্যালকেনির দিকে অগ্রসর হলাম। না কেউ নেই। নিরুপায় হয়ে ঘরে চলে এলাম। ফ্যানের হাওয়াতে ডাইরীর পাতা নড়ছে। পাশেই ফেভিকল পড়ে আছে। ডাইরীর পাতায় লেখা আছে কিছু লাইন। পেপারের বড় বড় হেডলাইন কেটে ফেভিকল দ্বারা ডাইরীর পাতায় আঁটকে দিয়েছে।

“প্রিয়,
ফিরে এসেছি। হিসেব চুকাতে এসেছি। সাত বছর আগে তুমি আমায় মুক্তি দাওনি। এবার আমিও তোমায় মুক্তি দিবো না।”
আর কিছু নেই। ‘সাত বছর’ মাথায় আসতেই মন পড়ল ধ্রুব আর আমার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। সালটা ঠিক মনে নেই। তখন নাইনে পড়ি আমি। পড়ালেখার চেয়ে এই বাড়ির আম, ঐবাড়ির লিচু চু’রি করাই আমার প্রধান কাজ ছিল। ধ্রুব ছিল আমার বিপরীত। পড়াশোনা ছাড়া সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ। পড়ালেখার নিমিত্তে পরিবার থেকে হোস্টেলে থাকতেন তিনি। অবশ্য ধ্রুবের সাথে আমার দেখাই হয়নি, সবছিল বাবার কথা। বন্ধুর চেয়ে বৈকি। একটু বেশিই বলতেন। বাবা ও তার বন্ধু ব্যবসার কাছে বেশিভাগ সময় দেশের বাইরেই থাকতেন। দেশে ফেরার সময় বিমান হামলায় নিহত হলেন দুই বন্ধু। মা হার্ট অ্যাটাক হল। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। সর্বদা আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। চিন্তার হাত থেকে বাঁচাতে রমিলা তার ছেলে ধ্রুব সাথে বিয়ে দেয়। ধ্রুব বিয়ের ব্যাপারটা জানত না। রমিলা তার অসুস্থতার কথা জানিয়ে এনেছিল ধ্রুবকে। ধ্রুবের বয়স তখন বিশ। গম্ভীর দেখতে তিনি। এক নজর দেখেছিলাম। মুখটা মনে নেই। ললাট কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন মিনিটখানেক। দৃষ্টি মেলাতে না পেরে নত হয়ে ছিলাম। পরক্ষণে তাকিয়ে দেখলাম তিনি নেই। তারপরে আর দেখা হয়নি। তিনি শহরে চলে এসেছিলেন। সপ্তাহ পেরোনোর আগেই শোনা গেল তিনি দেশে নেই। জার্মানে গেছে। রহিলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। চিঠিতে জানিয়েছিল, আমার মত বাচ্চা এবং গ্ৰামের মেয়েকে সে নিজের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মানেন না। আমাকে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে বললেন। তিনি আরও পড়ালেখা করবেন।
এরপর থেকে মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। বেশি চিন্তা মস্তিষ্ক নিতে ব্যর্থ হয়ে টাটা, বাই-বাই বলে চলে গেলেন। একা হয়ে গেলাম আমি। রমিলা তার বাড়িতে অবশ্য আমাকে নিয়ে গেছিলেন, কিন্তু সেখানে আনমনা হয়ে থাকলাম। খাওয়া-দাওয়া দুষ্টুমি বিদায় নিল।

বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিল। পালিয়ে বিয়ের নিমিত্তে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ির সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন ছিল। মায়ের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেই আমাকে তার সাথে নিয়ে আসেন মামা। তারাই এখন আমার পরিবার। পড়ালেখায় মনোযোগী হলাম। চোখে সমস্যা হল। তাই এখন চশমা পড়ি। পুরো গম্ভীর ভাব চলে এসেছে।

মামুনি আর ভার্সিটিতে যেতে দিলেন না। তার সাথেই অতিবাহিত হল চারদিন । আজ বসন্ত উৎসব। ভার্সিটি থেকে ক্রমাগত ফোন করছে আঁখি। আমি যাবো না মানে যাবো না। খবর পেয়েছি ওরাও যাবে না। উৎসবে থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। সম্মান বলে একটা কথা আছে না। মামুনি যেতে বলছে, তার ভাষ্যমতে ভার্সিটির এই সময়গুলো অন্তরে দৃঢ় বাঁধনে আঁকড়ে থাকে। তাই বাধ্য মেয়ের মত তৈরি হলাম।
আজ পহেলা ফাল্গুন। পাখিরা শহরেও ডাকছে। বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাওয়ায় হাওয়ায় মিষ্টি গন্ধ বসন্তে। এই বসন্তের আমেজে গাইতে ইচ্ছে করছে একটি প্রিয় গান,
বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে..
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে, সই গো!
বসন্ত বাতাসে।

বসন্ত রঙের শাড়ি। রাস্তায় বেরিয়ে গাঁদা পলাশের সংমিশ্রণে খোঁপা কিনে মাথায় গুঁজে গাড়িতে চড়লাম। রাস্তায় কিশোর কিশোরীদের দেখা পেলাম। সবাই হয়ত রবীন্দ্র সরোবরে যাচ্ছে। আমাদের ভার্সিটিতেও প্রতিবছর বিরাট আয়োজন করা হয়। এবারও কম নয়। ভাবতে ভাবতেই চলে এলাম ভার্সিটির মেইন দরজার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে নেড়ে পড়লাম।
দেখা হলো না নিরব ও তারিফের সাথে। তারা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে যাবে নিশ্চয়ই। ভিড় ঠেলে সামনের যাওয়ার উপায় নেই। তবুও পাশ কাটিয়ে খুব কষ্টে গেলাম। যেখানে আঁখি আর প্রিয়া আছে, সেখানে আমার চিন্তা নেই। কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে সামনে এসেছি। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ঢের আগে। প্রতিটি শিক্ষকের ভাষণ শুনতে শুনতেই কান নষ্ট হয়ে গেল। গরমে অবস্থা ভালো নয়। ওদের রেখে দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশে তাকাতেই দেখতে পেলাম কয়েকটা ছেলে আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। বিনিময়ে কটু কথা বেড়ে গেল। এর মাঝেই প্রিয়া আর আঁখি উপস্থিত হল। আমাকে আড়াল করে মিনমিনিয়ে বলল,

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৪

“দোস তোর ব্লাউজের চেইন ছিঁড়ে গেছে।”
তৎক্ষণাৎ হাত গিয়ে ঠেকল পিঠে। আঁচল সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। হাত পা যথারীতি থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। কী করব আমি?

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৬