উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৮

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৮
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

(আগের পর্ব ডিলিট, নতুন পর্ব)
শান্ত বিকেল, নিরিবিলি প্রকৃতি। এমন উপভোগ্য পরিবেশেও ভেতর ঘরে ভ*য়। সমস্ত নিরবতাকে ছুটি দিয়ে পর্দার আড়াল থেকেই ঊর্মি নিচুস্বরে বলল,
-“আমার কিছু কথা আছে।”

নিশ্চুপ হয়ে ড্রয়িংরুম থেকে সম্মতি দেওয়া হলো। অনেক ভেবেচিন্তে লম্বা শ্বাস নিলো ঊর্মি। ধীর কন্ঠে বলল,
-“আমি কোনরূপ সমাধান চাইনা। একবার যে পরিবার থেকে বেরিয়ে এসেছি, দ্বিতীয়বার সেখানে যেতে চাইনা। নিজেকে নিরাপদ মনে করিনা আমি। বর্তমান জীবনে আলহামদুলিল্লাহ আমি একটি স্বস্তির জীবনযাপন করছি।
সবচেয়ে বড় কথা তিনি আমাকে তা*লা*ক দেওয়ার পরই বিয়ে করেছেন। আমি নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কোন রাস্তা দেখিনা। আমি ফিরলাম তার সংসারে, তখন কি হবে? আবারও সেই ঘটনাটি ঘটবে, যা আমার সাথে ঘটেছিল। বিনা অপরাধে আমি শা*স্তি পেয়েছি। একই শা*স্তি আরেকটি মেয়েও পাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। বরং উনি নিজের বর্তমান স্ত্রীকে নিয়ে একটি সুখী জীবনযাপন করলেই সমাধান মিলবে। আমি নিজের মনকে স্থির করে ফেলেছি পিছু ফিরে তাকাবো না। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি যা করেছেন, ভালোর জন্যই করেছেন।”

স্তব্ধ হলো রাহাত। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো পর্দার ওপারে। আড়ালে অস্পষ্ট কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ঊর্মি তাকে চমকে দিলো। এমন চমক তার কাম্য ছিলোনা। ঊর্মি সত্যিই তাকে চাইছেনা। এতদিন ভাবতো ঊর্মির মনের কোথাও একচিমটি পরিমাণ হলেও তার জন্য জায়গা আছে, শুধু উপর থেকেই যত রা*গ, অভিমান। তা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। ভালোবাসা যেমন সুখ দেয়, তেমনই পোড়ায়। এবার তার পুড়বার পালা।

হুজুর একবার এক একজনের দিকে তাকালেন। মোস্তফা সাহেব ও আনোয়ার হোসেন খানিক অবাক হলেও নিজেদের স্বাভাবিক রাখলেন। যেন এইমাত্র কিছুই শোনেন নি।
রাহাতের মুখভঙ্গি ভিন্ন। কেমন একটা বি*ষা*দ ফোটে উঠেছে। তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হুজুর। তার পূর্বেই থামিয়ে দিলো রাহাত। রুদ্ধশ্বাসে বলল,

-“আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
মাথানিচু করে বেরিয়ে গেলো রাহাত। কেউ বলার মতো কিছুই পেলোনা। ফিরে পাওয়ার এত এত আনন্দ, আয়োজন ওলট – পালট হয়ে গেলো।
আনোয়ার হোসেন আর বসে থাকলেন না। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠতে চাইলেন। সবাই আজ থাকার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি শুনলেন না।
উষা আরও দুদিন থাকার অনুমতি নিলো।
অনুমতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আনোয়ার হোসেন। মোস্তফা সাহেব মেয়ের সাথে কথা বলবেন বলে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। ঊর্মি দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। সবার এত ডাকাডাকি তার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও মস্তিষ্ক সচল হলোনা।

দিকবিদিকশুন্য হয়ে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। এই যাত্রা তাকে কোথায় পৌঁছাতে পারে জানা নেই। বাড়ি ফিরতে মন চাইলোনা আর। একটা মস্ত বড় ভুল তার জীবনটা শেষ করে দিলো।
পেছন থেকে অনবরত গাড়ির হর্ণ বেজে চলেছে। কিসের যেন ভোঁ ভোঁ শব্দ কানে বাজছে। রাস্তা ছেড়ে সরার কোনো তাড়া নেই। বেগতিক সিএনজির ধাক্কায় পাশে ছিটকে পড়লো রাহাত। সংবিৎ ফিরলো তার। শরীরে চিনচিনে অতঃপর তীব্র ব্যথা অনুভব করলো। হাতের চামড়া ছুঁলে কনুইয়ে বেশ ব্যথা পেয়েছে, মাথায় ও চোট লেগেছে। আস্তে আস্তে রাস্তা থেকে উঠে পড়লো। আশেপাশের মানুষগুলো চেয়ে চেয়ে দেখছে। কেউই এগিয়ে আসছেনা। ইটপাথরের শহরের মানুষগুলোও বড্ড কঠিন।
পা টে*নে আবারও উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে লাগলো।

লিলিকে সঙ্গে নিয়েই ডাক্তারের কাছে গেলো রিয়া। একজন ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ ধরেই তাকে দেখছে। কেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। অস্বস্তি হলো রিয়ার। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন।
তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
-“তোমরা কী সমস্যা নিয়ে এসেছো?”
লিলি জবাব দিলো,

-“আমার ননদের স্কিনে হালকা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাকেই ডাক্তার দেখাতে এনেছি।”
ভদ্রমহিলা আবারও রিয়ার দিকে নজর দিলেন। বললেন,
-”তোমরা দেখতে আমার মেয়ের বয়সী, তাই তুমি করে বললাম। কিছু মনে করোনা।”
লিলি আলতো হেসে বলল,“আমরা কিছুই মনে করিনি।”
চলে গেলেন ভদ্রমহিলা। এতক্ষণে রিয়ার মনে হলো চোখদুটো তার কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। বেশি ভাবতে পারলোনা। তাদের সিরিয়াল চলে আসলো।

বেশ সময় ধরেই উষার ফোন বেজে চলেছে। হাতের কাজ শেষ করেই ফোন হাতে নিলো। শামীমের ফোন।
-“এতক্ষণ ফোন ধরছিলেনা কেন?”
-“মায়ের সাথে কাজ করছিলাম।”
-“কাল তৈরি হয়ে থেকো। আমি অফিস শেষে নিয়ে আসবো।”
-“কাল যাবোনা আমি। বাবাকে বলে নিয়েছি।”
-“কেন আসবেনা? দুদিনের ছুটি চেয়েছিলে তুমি। বাবার কাছ থেকে কখন অনুমতি নিলে?”
-“বাবা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে।”
-“হঠাৎ?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবকিছু বলল উষা।
একের পর এক ঝা*মে*লা*র সৃষ্টি হচ্ছে। উত্তরে শামীম ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল,
-“আসবে কখন?”
-“আরও দুদিন থাকি। ভাবিও অসুস্থ, মা একা হাতে সব সামলাচ্ছে। আমি ফোন করবো আপনাকে।”
-“তাড়াতাড়ি ফেরো।”
-“চেষ্টা করবো।”
উষার কল কে*টে রাহাতকে কল দিলো শামীম। বারবার রিং হয়েও কে*টে যাচ্ছে। কিন্তু শামীম ফোন তুলছেনা। বাড়িতে রিয়াকে ফোন করলো।

-“রিয়া, ভাইয়া বাড়িতে ফিরেছে?”
-“না ভাইয়া। কেন বলোতো?”
-“ভাইয়া আজ আবার উষাদের বাড়িতে গিয়েছিল ভাবিকে ফিরিয়ে আনতে।”
স্পিকার অন থাকায় লিলি শুনে ফে*ল*লো। তারা মাত্রই ফিরেছে হসপিটাল থেকে। সবটা শুনলেও প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। রিয়া রাখছি বলে লাইন কে*টে দিলো।
রিয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো লিলি। এখানে তার জায়গা খুব বেশিদিনের নয়, সে অনেক আগেই টের পেয়েছিল। কিছুই তো ঠিক হলোনা। দীর্ঘশ্বাস ফে*ল*লো সে।

ঊর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উষা। তারও খা*রা*প লাগছে। এতদিন ঊর্মির কষ্ট যতটা উপলব্ধি করেছে, এখন তারচেয়ে বেশি উপলব্ধি করছে। একবার ঊর্মির জায়গায় নিজেকে আর রাহাতের জায়গায় শামীমকে বসিয়ে দেখলো। ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আজ দুজনের জন্যই মায়া জন্মাচ্ছে।
ঊর্মির কপালে ঠোঁট ছুইয়ে উষা বিড়বিড় করে বলল,

-“সবটা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাক আপু। তুমি আগের হাসিখুশি জীবনে ফিরে যাও।”
ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেলো। ঊর্মি চোখ খুলে তাকালো। চোখের কার্ণিশ বেড়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। উষা ভেবেছিল সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কষ্ট হচ্ছে তার। তবে মন টা*ন*ছে*না ফিরে যেতে।
শামীমের নাম্বারে ডায়াল করলো উষা।
মাত্রই শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলো শামীম। রিসিভ করে কানে ধরলো।
উষা বলল,

-“কী করছেন?”
-“মাত্রই শুয়েছি।”
-“খেয়েছেন?”
-“হুম। তুমি খেয়েছো?”
-“হুম।”
-“ভাবি কেমন আছে?”
-“ঘুমাচ্ছে।”
-”তুমি আসবে কবে?”
উদাসী গলায় উষা বলল,

-“যদি না আসি? আপুর মতো আমিও যদি চিরদিনের মতো আপনাদের বাড়িকে বিদায় জানিয়ে ফে*লি?”
রে*গে গেলো শামীম।
-“এখনো তো তোমার কানের নিচে দু-একটা থা*প্প*ড় পড়েনি! পড়লে সোজা হয়ে যেতে। আমিতো তোমায় জো*র করিনি আমাকে বিয়ে করতে। তুমি নিজেই এসেছো, আবার নিজের মর্জিমাফিক চলে যেতে চাইছো? একটা কথা আমার আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে বাকি সবার মতো তুমিও স্বা*র্থ*পর। নিজের স্বা*র্থে আমাকে ব্যবহার করেছো। যখন তোমার কাজের কাজ কিছুই করতে পারলেনা, তখন আমাকে ছুঁ*ড়ে ফে*ল*তে চাইছো।”
রা*গ দেখিয়ে কল কে*টে দিলো শামীম। সুইচ অফ করে বিছানায় ধ*প করেই ফোন ছুঁ*ড়ে ফে*ললো। এতটা প্রে*শা*র আর ভালোলাগছেনা তার।

উষার চোখে পানি চিকচিক করছে। সে তো হুট করেই এমন একটি কথা বলে ফে*লে*ছি*লো। মন থেকে তো কিছু বলেনি। আসলেই তো সে স্বা*র্থ*প*র। নাসিমা বেগমের ঘুম হা*রা*ম করবে বলে শামীমকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলোনা। নাসিমা বেগমের শা*স্তি উপরওয়ালা অন্যভাবে ঠিক করে রেখেছিলেন। তিনিও সংসার, সন্তান, স্বামী সবটা হারিয়ে বসে আছেন। উষা জানে এই শা*স্তি ক্ষণিকের। তবুও উপলব্ধি করুক সুখ হারানোর বেদনা কেমন!

চোখ মুছে আরও কয়েকবার শামীমকে কল দিলো। ফোন সুইচ অফ। উষা আবারও কল দিলো, বারবার দিলো। একই সুর ভেসে আসছে বারবার।
নিঃশব্দে পা ফেলে ঘরে ফিরলো উষা। সেও ফোন অফ করে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসছেনা চোখে। দুদিকে দুবোন নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিলো। কেউ ক্ষণিকের বেদনায়, কেউ সারাজীবনের।

খুব রাত করেই বাড়ি ফিরলো রাহাত। বিবর্ণ মুখ, একদিনেই চোখ কতটা গভীরে ঢুকে পড়লো। শরীরে কা*টা*ছেঁ*ড়া*র দাগ। বিকেলে গাড়ির ধাক্কায় আ*ঘা*ত পেয়েও ব্যান্ডেজ করানোর প্রয়োজন মনে করেনি। রাহাতের সাথে কিছু কথা বলবে বলে লিলি ঘুমায়নি। ড্রয়িংরুমেই বসে ছিলো। রাহাতকে এই অবস্থায় দেখে বিচলিত হলো। তবে এগিয়ে গেলোনা। হেলেদুলে ড্রয়িংরুম পেরোনোর আগেই লিলি বলল,

-“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
রাহাত অসহায় মুখে হাত জোড় করে বলল,
-“আমায় মুক্তি দাও প্লিজ!”
লিলি বিষন্ন হেসে বলল,
-“চলে যাবো, আপনাকে মুক্তি দিয়ে চলে যাবো আমার ছেলের কাছে।”
ভ্রু কুঁচকে গেলো রাহাতের,”ছেলে?”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৭

আগের ১৮ নম্বর পর্ব ডিলিট করে নতুন করে লিখা হয়েছে। গত পর্ব নিয়ে অনেকের মাঝেই বি*ত*র্ক লক্ষ করা গিয়েছে। সবাই একটা ফতোয়া মানে এমন নয়। আমি শুধু উল্লেখ করেছি যারা আহলে হাদীস তারাই এটা মানে। পরবর্তী অংশে কী আছে সেটা না জেনেই কয়েকজন ইনবক্সে এসেও ত*র্ক জমাতে চেয়েছিলেন। সামনে হয়তো আরও বি*ত*র্ক সৃষ্টি হতো। সেজন্যই ডিলিট করে দিয়েছি। যারা কপি করে পোস্ট করেছেন, তাদের কাছে অনুরোধ আগের পর্বটি ডিলিট করে দেবেন।
আর কয়েকজন বলেছিলেন মাযহাবের কথা। আহলে হাদীস কোন মাযহাব নয়। আহলে হাদীসরা মাযহাব অনুসরণ করেনা। আমার উপস্থাপনায় ঘা*ট*তি ছিলো বলে অনেকেই বুঝতে পারেননি। তার জন্য আমি দুঃখিত।
আমি গল্প যেভাবে ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত সেভাবেই লিখবো। মাঝখানে ঝা*মে*লা করার জন্য আবারও দুঃখিত। আমার জন্য দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাই। হ্যাপি রিডিং।)

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৯