শেহজাদী পর্ব ২৯ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ২৯
Arishan Nur
ইমান অতিব্যস্ততা দেখিয়ে রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করছে। ভীষণ অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। হাতে মুঠ করে স্মার্টফোনটা চেপে আছে। বারংবার ফোনের স্ক্রিন চেইক করছে। আর প্রতিবারই হতাশ, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হচ্ছে সে। মিরা তার ম্যাসেজ সিন করে ফেলে রেখেছে অথচ রিপ্লে দেয়নি!
সে আবারো টেক্সট পাঠালো,মিরা তুমি আমাকে ভুল গেছো? এর ম্যাসেজ ও এলো না কিন্তু সিন হলো। ইমানের আরো রাগ বেড়ে যাচ্ছে। সে পুনরায় টেক্সট পাঠালো, তুমি আমাকে ভুলে গেলেও আমি তোমাকে ভুলিনি মিরা!
ম্যাসেজ সেন্ড হওয়ার দশ মিনিট অতিবাহিত হলেও রিপ্লে তো এলো নাই না! বরং সিনও করলো না৷
তার মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বের হলো।
এরপর নিজের গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। বালিশ ছাড়াই শুয়ে পড়লো সে। ভীষণ মন খারাপ তার। মিরা নাকি বিদেশে চলে যাচ্ছে, তার উপর আজকে এতোদিন পর সে ম্যাসেজ দিচ্ছে, কিন্তু মেয়ে রিপ্লে দেয়না। ভাব কত্তো!
সে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। বহুদিন আগের কথা! মিরা তখন ক্লাস টেনে পড়ত! দুই বেনী করে স্যারদের বাসায় পড়তে যেত৷ সাইন্সে পড়ত। সারাদিন ফিক্সিজ, ক্যামিস্ট্রি, হায়ার ম্যাথ ব্যাচ করেও  ও ফিজিক্স আর হায়ার ম্যাথে ডাব্বা মারলো। খুবই হতাশাজনক রেজাল্ট। ওই সময় ইমান ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। ভাবই আলাদা তার! ইঞ্জিনিয়ারদের কদর এম্নিতেই বেশি! তার উপর সে ভালো নামি-দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। নর্থ সাউথে পড়ত সে। নর্থ সাউথের স্টুডেন্টের ভাব এক স্কেল উপরে।
ইমান সবসময়ই নিজে থেকে আয় করার চেষ্টা করত। বাবার নিজের ব্যবসা,লাখ-লাখ টাকার মালিকের ছেলে হওয়ার পরও সে মনে-প্রানে চাইত, নিজের হাত-খরচ যেন নিজেই বহন করে সে৷ এম্নিতেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রতি সেমিস্টারের ফ্রি লাখ ছুঁইছুঁই। এইজন্য রেডিওতে কাজ করার পাশাপাশি উদ্ভাসে ক্লাস নিত। এডমিশন কোচিংয়ের ক্লাস নিত। তখনই বড় মামার ডাক পড়লো মিরাকে পড়ানোর জন্য ।
ইমান নানাবাড়ির সবাইকে খুব সম্মান করে। মামার অনুরোধে মিরাকে বাসায় পড়াতে রাজী হয় ইমান। তার এভাবে হোম টিউশনি বাসায় গিয়ে গিয়ে পড়া পছন্দ না। কিন্তু মিরার অবস্থা দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হয়। নিজের কাজিন এমন খারাপ রেজাল্ট করেছে। এক্সট্রা ইফোর্ট দরকার জন্য সপ্তাহে চারদিন সাইন্সের সাবজেক্ট পড়াতে রাজী হয়। সে টাকা নিতে চায়নি তবুও মামা জোর করে বেতন ঠিক করে।
শুধু তাই না মিরাদের গাড়ি যেত তাকে নিয়ে আসতে আবার গাড়ি করেই রেখে আসত। সপ্তাহে চারদিন পড়াতে যাওয়ার প্রথম প্রথম মিরাকে ভীষণ বিরক্ত লাগতো তার। গবেট আর গাধার চেয়েও অধম মিরা! প্রথমদিন রসায়ন পড়াতে শুরু করলো! টেস্ট পেপার থেকে হলিক্রসের প্রশ্ন লিখতে দিলো। মিরার উত্তর পত্র দেখে ইমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মিরা ফ্লোরিনের প্রতীক Fl লিখে বসে আছে ! প্রথম দিনই মিরা তার কাছ থেকে যা বকা খেয়েছিল! সেখানেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়।
এতে একদম ই মায়া-দয়া হয়না ইমানের। যতো কাঁদে ততো বকা দেওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। রসায়ন তাও একটু হলেও পারত সে। পদার্থবিজ্ঞানের নিউট্রনের তিনটা সূত্রের একটাও ঠিকঠাক পারেনি!
ক্লাস টেনে উঠে এই দশায় ইমানের মেজাজ বিগড়ে যায়। সে স্কেল দিয়ে চার চারটা আঘাত দিয়েছিল মিরার হাতে। এরপর থেকে সবকিছু বদলে গেল। মিরা ভীষণ ভয় পাওয়া শুরু করলো তাকে। এমন ভয় পেতে যে তাকে দেখলে কাঁপা-কাঁপা অবস্থা!  এদিকে আরেক কান্ড ঘটলো! মিরাকে পড়াতে গিয়ে ইমান তার প্রেমে পড়ে যায়। হাইড্রোজেন  বন্ধন শেখাতে গিয়ে নিজেই মিরার প্রেম-বন্ধনে আটকা পড়ে যায়।
 প্রেমে পড়তে চাচ্ছিল না সে কিন্তু কিভাবে কিভাবে জানি ফ্লোরিনের প্রতীক Fl লেখা মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় সে। কিন্তু ততোদিনে তার আর মিরার মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। মিরা তাকে দেখলেই চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে থাকত আর চশমা ঠিক করত৷ ইমান যথেষ্ট সময় ব্যয় করত তার পিছনে। অবশেষে আট মাস টানা পড়ার পর মিরা এসএসসি দেয়৷ এইচএসসিতে এসে ইমানের কথামতো তাকে কমার্সে ট্রান্সফার করা হয়৷ মিরার সাইন্সে পড়ার কোন ইন্টারেস্ট ছিল না! তাও নাইনে উঠে ফ্রেন্ডদের দেখে  ঝোঁকের মাথায় সাইন্স নিয়ে ফেলে। এরপর এইচএসসিতে কমার্স নেয়। ততোদিনে বেশ আয়োজন করেই ইমান তার প্রেমে পড়ে গেছে।
ইমান প্রেমে পড়েছিল মিরার অংক না পারা অসহায় মুখ দেখে। টেস্ট পেপার থেকে যখন অংক সলভ করতে দিত, তখন মিরা মিনিটের পর মিনিট খাতার দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে কলম কামড়াত! কি মায়াবি মুখ তার!
আবার কখনো-সখনো চশমা ঠিক করতে করতে প্রোফেজ,  মেটাফেজ, প্রো মেটাফেজের বৈশিষ্ট্য গুলো আটকে আটকে বহু কষ্টে বলত! ইশ! বারে বারে সেই মিরার প্রেমে পড়তে মন চায় ইমানের।
আবার যখন ত্বরন, দ্যুতি, বেগের সূত্রের  মধ্যে কনফিউজড হয়ে ভুলভাল অংক করে বসে থাকত, সেই মিরা এখন কই হারিয়ে গেছে!
ইমান ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে এবং মুচকি হাসে। সেই দিনগুলো অদ্ভুত সুন্দর ছিল। কবে শনিবার হবে সেই অপেক্ষায় থাকত সে! বুধবার পড়িয়ে দিয়ে পাক্কা দুইদিন পর তার শেহজাদীর ফাংশন, লগারিদম না পারা অসহায় মুখ দেখে কি যে প্রশান্তি পেত!
ইমান ফোনটা কুড়িয়ে এনে দেখলো রিপ্লে দিয়েছে কিনা। নাহ মিরা এখনো সিন করে নি।
মিরার এসএসসির পর যখন সে কলেজে উঠল, তখন আর পড়াতে যেত না ইমান। ওই সময় সে চোখে অন্ধকার দেখলো। মিরাকে না দেখে কিভাবে থাকবে সে? কথা না বলে কিভাবে থাকবে? কিন্তু ততোদিনে সে ওলরেডি মিরার ফেইরিটেলের মতো ছোট্ট জীবনটার এক বিশাল ভয়ংকর দৈত্য! যাকে মিরা খুব ভয় পায়। যমের মতো ভয় পেতে তাকে।যার উপস্থিতি মিরাকে ঘাবড়ে তুলে আর অনুপস্থিতিতে স্বস্তি দেয়৷
তাকে  দেখলেই দূরে দূরে পালিয়ে পালিয়ে থাকত মিরা। এমন অবস্থায় ইমান যদি তাকে প্রোপোজও করে সঙ্গে সঙ্গে রিজেক্ট!
 ইমান হন্ন হয়ে মিরার সঙ্গে  কথা বলার উপায় খুঁজতে লাগে। ইমানের এক ফ্রেন্ড বুদ্ধি দিলো ফেসবুকে পটানোর চেষ্টা করার৷ মিরার তখন ফেসবুক ছিলো না। কাজেই এই আইডিয়াও জলে ভেস্তে গেল। অতঃপর কলেজে উঠার এক মাসের মাথায় মিরা ফেসবুক খুলে।এই খবর সে সোনালী আপুর কাছ থেকে পেয়েছিল।  কিন্তু ইমানের ভাগ্য এতোই ভালো যে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠানোর আগেই সার্চ ইঞ্জিনে মিরার আইডি খুঁজলে সো করেনা অর্থাৎ তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। উপায় না পেয়ে ফেইক আউডি খুলে। ব্যস! একে একে সবকিছু খুব সহজ হতে লাগলো, ফেইক আইডি দিয়ে মিরার সঙ্গে কথা হতে লাগলো। ইমান ইচ্ছা করেই ফেইক আইডিতে মিরার কলেজের লোকেশন সেট করে দেয়। মিরা যে খানিকটা বোকা,  এটা আট মাস ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রি পড়াতে গিয়ে দিব্যি বুঝে গিয়েছিল।
 এরপর ফেইক আইডি তথা আবির হাসান আইডি থেকে প্রোপোজ ও করে৷ মিরা রাজী হচ্ছিলোনা। নানান ফন্দি এঁটে রাজী করায় তাকে। এরপর বেশ কিছু দিন কেটে যায়। লকডাউন থাকায় মিরা কলেজে যেত না। এইজন্য বুঝেওনি আবির বলে তার কোন সিনিয়র নেই। এরপর হুট করে নানী অসুস্থ হলো। ক্যান্সার ধরা পড়লো। নানীর ইচ্ছা হলো ইমান যেন মিরাকে বিয়ে করে। ইমান হতভম্ব হয়ে যায়। প্রেম করছে আবির হয়ে, বিয়ে করবে ইমান হয়ে! তাতো হয়না। এরপর বিয়ের আগেরদিন ইচ্ছা করেই মিরাকে পালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয় সে।
মিরা পালিয়ে ধানমন্ডি আসলে সে ইমান হয়ে ওতো রাতে তার কাছে ধরা দেয়। মিরা বুঝতে পারেনি সেদিন। বুঝার পথ খোলা ও অবশ্য  রাখেনি সে। খুবই নিপুণ ভাবে অভিনয় করেছিল। তাছাড়া ইচ্ছা করেই ধানমন্ডি তে আসতে বলেছিল যেন ইমান হয়ে যখন তার সামনে দেখা করবে তখন যেন বিনা দ্বিধায় বলে দিতে পারে, রেডিও সোয়ের কাজে এসেছিল।
 বিয়ের আগের দিন রাতে খুব ভয়ে ছিল সে।নিজের জন্য না! মিরার জন্য! এতোরাতে মেয়েটা আসবে, সঙ্গে সঙ্গে ধরা দিলে সন্দেহ করবে। আবার কাছেও থাকা যাবেনা। দেখে ফেললে মুশকিল।  আড়ালে থাকতে হবে। ওইটুকু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়?
পরবর্তীতে সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হয়। ইমান চেয়েছিল তাদের প্রেমের সম্পর্ক আরো গভীর হলে সব সত্য জানিয়ে দিবে কিন্তু এর আগেই নানী বিয়ে করার জন্য তাড়া দিলো। সময় এতো কম ছিল যে সত্য বলার সুযোগ পায়নি। ছলনার পরিনাম যে ভালো না তা হারে হারে টের পাচ্ছে ইমান।
ইমানের পরিকল্পনা ছিল, আবির হাসান হিসেবে মিরাকে ছ্যাকা দিবে, এরপর ইমান হিসেবে বিয়ে করে, বাসররাতে সব জানিয়ে দিবে।চব্বিশ ঘন্টারই তো ব্যাপার! কে জানত ওই চব্বিশ ঘন্টায় তার জীবন বদলে যাবে৷
হলুদ ছোঁয়ার পরপরই মিরা এমন একটা কথা বলেছিল তাকে, তখন সে  প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। সে নাকি মিরাকে শারীরিক চাহিদা পূরনের জন্য বিয়ে করছে! মিরা তাকে পার্ভাট ভাবে,!
একথা শোনার জন্য সে এক তরফা ভাবে ভালোবাসেনি নিশ্চয়ই! এমনও দিন গিয়েছিল যেদিন সে মিরাকে পড়াতে গেছে কিন্তু বাসা ফাঁকা। কেউ নেই, সে আর মিরা বাদে। কই তখন তো ইমান এমন কোন আচরণ করেনি! তাহলে হলুদের দিন কেন মিরা এমন কথা বললো! সত্যি বলতে ইমান ভাবেওনি মিরা তাকে নিয়ে এমন, জঘন্য,  খারাপ চিন্তা পোষণ করে।

শেহজাদী পর্ব ২৮

মিরার অমতে তাকে চায়নি ইমান। এইজন্য বিয়ের দিন নিজ থেকে সাহায্য করে পালিয়ে যেতে। হয়তো সে ভুল ছিল। আমরা কয়জনই বা সঠিক? মানুষ সঠিকের চেয়ে ভুল কাজ বেশি করে। ইমানও পরপর বেশ কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিল।
 এতোদিন পর মিরার মুখে ভালোবাসা শব্দটা শুনে যেমন শান্তি পেয়েছে সে, তেমনই বড্ড অভিমানও হচ্ছে। অনেকে ভাবে ছেলেরা হয়তোবা অভিমান করেনা কিন্তু এটা ভুল। ছেলেদের ও অভিমান হয়! কিন্তু প্রকাশের ধরণ আলাদা!
ইমান ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। তার মাথায় নানান চিন্তা। মিরাকে সে জব্দ করবে কিভাবে?

শেহজাদী পর্ব ৩০