অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৮

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৮
ইরিন নাজ

রাত প্রায় সাড়ে বারোটার কাছাকাছি সময়ে বাড়ি ফিরলো আদ্রিশ আয়ানা। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হওয়ায় অনেকটাই ভিজে গেছে দুজন। কোনোমতে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকেছে তারা। আদ্রিশ কে তার ভেজা চুল ঝাড়তে দেখে নিজের মাথায় হাত দিলো আয়ানা। মাথায় ওড়না থাকায় সেটাই ভিজেছে তার। তাই সে মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে রুমের সামনে আসলো। যেইমাত্র রুমের দরজা খুলতে যাবে ওমনি পেছন থেকে আয়ানার চোখ চেপে ধরলো আদ্রিশ। আয়ানা চমকে উঠে বললো,

— “এই, এই কি করছেন?”
আদ্রিশ আয়ানার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
— “হুঁশ, জোরে কথা বলে না। আমার সাথে এসো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদ্রিশের কথায় চুপ হয়ে গেলো আয়ানা। কিছুদূর এগোনোর পর থেমে গেলো আদ্রিশ। আয়ানার চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো সে। ধীরে ধীরে চোখ মেললো আয়ানা। সামনের দৃশ্য দেখে মুখ টা হা হয়ে গেলো তার। ফেইরি লাইটের ঝলমলে আলোয় তাদের বেডরুম টা স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে। আয়ানার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে, কোনো স্বপ্নের রাজ্যে চলে এসেছে। দুই হাতে ভালো করে চোখ ডললো সে। পুনরায় চোখ মেলে একই দৃশ্য দেখে বিশ্বাস হলো সে যা দেখছে তা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আনন্দে চোখ জোড়া চিকচিক করতে লাগলো আয়ানার। চকচকে দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চাইলো সে। আদ্রিশ হেসে শুধালো,

— “পছন্দ হয়েছে?”
মাথা ঝাকালো আয়ানা। খুশিতে চোখে জল চলে আসলো তার। ভাঙা স্বরে প্রশ্ন করলো,
— “আপনি কি করে জানলেন…”
— “দ্বীপদের বাড়িতে দেখেছি এসবের প্রতি তোমার এট্রাকশন। তাই ভাবলাম আমাদের রুমটাও এগুলো দিয়ে সাজিয়ে ফেলি। বউয়ের জন্য রুমে এতটুকু চেঞ্জ আনাই যায়।”

আদ্রিশ কথা শেষ করতে না করতেই তাকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো আয়ানা। ফুঁপিয়ে কেঁ’দে উঠলো সে। তবে এটা ক’ষ্টে’র নয় বরং সুখের কান্না, প্রাপ্তির কান্না। আয়ানা কে হঠাৎ এভাবে কাঁ’দ’তে দেখে ভড়কালো আদ্রিশ। মাথায় হাত রেখে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,

— “আয়ানা, কাঁ’দ’ছো কেনো বউ?”
আয়ানা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,
— “এই সব কিছু আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে ডাক্তার সাহেব। এতো ভালো কেনো আপনি? আমার সকল পছন্দ অপছন্দের দিকে আপনার নজর থাকে। এতো কিছু কেনো করছেন আমার জন্য?”
— “ভালোবাসি তাই….”

আদ্রিশের অকপট, সরল স্বীকারোক্তিতে কেঁ’পে উঠলো আয়ানা। মনে হলো ভুল কিছু শুনেছে। বুক থেকে মুখ উঠিয়ে অশ্রুশিক্ত চোখে আদ্রিশের দিকে চাইলো সে। চোখে চোখ রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
— “একটু আগে যা বলেছেন তা আরেকবার বলবেন ডাক্তার সাহেব?”
আদ্রিশ বুঝতে পারলো আয়ানার মনের অবস্থা। আলতো হাতে আয়ানার চোখের পানি মুছে দিলো সে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে স্লো ভয়েসে বললো,

— “জানো, কখনো ভাবি নি প্রেম, ভালোবাসা আসবে আমার জীবনে। #অতঃপর_প্রেমের_আগমন ঘটলো আমার লাইফে। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছি আমি, প্রতিনিয়ত নিজের স্ত্রীর প্রেমে পড়েছি এবং এখনো প্রতিনিয়ত তার প্রেমে পড়েই চলেছি। জানি না এই প্রেমে পড়ার অন্ত কোথায়। প্রথম বার যখন তাকে দেখেছিলাম ঠিক তখন ই হয়তো জীবনে প্রথম বারের মতো কারোর প্রেমে পড়েছিলাম।

গোলগাল আদুরে মুখশ্রী, ফুলো ফুলো দুটো গাল, ভ’য়া’র্ত চাহনি, চেহারায় স্পষ্ট বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছিল। বিয়ের লাল শাড়িতে তাকে দেখে প্রথম বারের মতো অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল, যেই অনুভূতির সাথে আমি মোটেও পরিচিত ছিলাম না। কিন্তু বিষয় টা মানতে পারি নি আমি। যেখানে বিয়েতেই আমার মত ছিলো না সেখানে অনুভূতি!

আবার সে বয়সে আমার তুলনায় অনেক ছোট। তার সাথে বার বার ক’ঠো’র হতে চেয়েছি। কিন্তু পারি নি। ধীরে ধীরে সেই অজানা অনুভূতি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো। এক সময় মানতে বাধ্য হলাম প্রেমে পড়েছি আমি, প্রেম এসেছে আমার জীবনে, সে আমার জীবনে প্রেম নিয়ে এসেছে।

তার আচার-আচরণ, কথা বলার ধরণ সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। তার হাসি হৃদয় শীতল করে তুলে, তার চোখের জল মন কে করে তুলে অস্থির। আমার জীবনে হঠাৎ আগমন নেওয়া প্রেম সময়ের ব্যবধানে ভালোবাসায় রূপ নেয়, কঠিন ভালোবাসা। তাকে ছাড়া আমি যেনো অচল, সে যেনো আমার ভালো থাকার ঔষধে পরিণত হয়েছে।”

থামলো আদ্রিশ। আয়ানার কপালে অধর চেপে সময় নিয়ে চুমু খেলো। চোখে চোখ রেখে বললো,
— “আমার সেই ভালো থাকার ঔষধ টা তুমি। আই লাভ ইউ মিসেস আয়ানা রহমান। ভীষণ ভালোবাসি আমি তোমাকে। সম্পর্কের শুরুতে সব টা দায়িত্ব থেকে করলেও এখন যা কিছু করি সবটাই ভালোবেসে করি। তোমার অধরে লেপ্টে থাকা হাসিটুকুই আমার প্রাপ্তি। এই হাসিটুকু দেখার জন্য আজকাল অসাধ্যকেও সাধন করতে ইচ্ছে হয়।”

মুগ্ধ চোখে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলো আয়ানা। ফাইনালি আজ আদ্রিশ তাকে নিজের মনের কথা জানিয়েছে, ‘ভালোবাসি’ বলেছে। সে ও তো ভীষণ ভালোবাসে আদ্রিশ কে। সে ও আজ আদ্রিশ কে নিজের মনের কথা জানিয়ে দিবে, আদ্রিশ কে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিবে। নিজের অব্যক্ত অনুভূতি ব্যক্ত করবে। জোরে শ্বাস নিলো আয়ানা। সকল দ্বি’ধাদ্ব’ন্দ্ব কা’টি’য়ে বলে উঠলো,

— “আমিও আপনাকে ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব, ভীষণ ভালোবাসি। হাজারো নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা নিয়ে বাধ্য হয়ে বিয়ে টা করেছিলাম। ছোট বেলায় শ্বশুর বাড়িতে আম্মু কে অনেক ক’ষ্ট পেতে দেখেছি। কারণটা আমার দাদি ছিলো। উনি আম্মু কে একেবারেই পছন্দ করতেন না জানেন ই তো। এরপর আব্বু আমাদের একা করে চলে গেলো। আম্মুর দ্বিতীয় বার বিয়ে হওয়ার পরও শান্তি পায় নি আম্মু।

চোখের সামনে আম্মু কে অ’ত্যা’চা’রিত হতে দেখেছি, নিজে অ’ত্যা’চা’রিত হয়েছি। এরপর রিয়ার কাছে তার বিবাহিত জীবনের কথা শুনেছি। সবকিছু মিলিয়ে ভ’য় পেতাম বিয়ে জিনিসটাকে। কবুল বলার সময় বারবার ভাবছিলাম আমার স্বামী যদি ভালো না হয়! শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যদি ভালো না হয়! মনের মাঝে হাজারো আ’শ’ঙ্কা নিয়ে কবুল বলেছিলাম, এসেছিলাম আমার নতুন ঠিকানায়।

বিয়ের রাতে যখন আপনি জানালেন বিয়েতে আপনার মত ছিলো না, আমাকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন, মেনে নাও নিতে পারেন তখন ভেবেছিলাম সুখ জিনিস টা বুঝি আমার জন্য নয়। কিন্তু আমার এই ভাবনা পরের দিন থেকেই ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করলো। বিয়ের পরের দিন থেকে প্রতি টা মুহূর্তে নিজেকে লাকি মনে হয়েছে আমার। বারবার মনে হয়েছে আমি কোনো এক সুখমহলে চলে এসেছি। যেখানে শুধু সুখ আর ভালোবাসা।

প্রথম প্রথম গম্ভীর আপনিটাকে ভ’য় পেলেও ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আমার ধারণার থেকে ব্যতিক্রম। ভরসা করতে শুরু করলাম আপনাকে। এক সময় এই গম্ভীর আপনিটাকেই ভালো লাগতে লাগলো। আপনার গম্ভীরতা, দায়িত্ববোধ, যত্ন নেয়া, রা’গ দেখানো সবকিছুতে মুগ্ধ হতাম। আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগতো। যখন আপনার কাছাকাছি থাকতাম তখন অদ্ভুত অনুভূতি হতো।

আপনার প্রতি জন্ম নেয়া মুগ্ধতা কখন ভালোবাসায় পরিণত হলো জানা নেই আমার। দ্বীপের কাজিন যখন আপনার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তখন আমার কি পরিমান রা’গ হচ্ছিলো জানেন! আপনার দিকে অন্য মেয়ে ওভাবে তাকিয়ে ছিলো, ব্যাপার টা মোটেও সহ্য হয় নি আমার। আর যখন সারাপু আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো, তখন রা’গ তো হয়েছিল ই কিন্তু,, কিন্তু অন্য কেউ আপনাকে স্পর্শ করেছিলো দেখে ক’ষ্টে বুক টা ফে’টে যাচ্ছিলো।”

শেষের কথাটুকু বলতে কণ্ঠ কেঁ’পে উঠলো আয়ানার। আদ্রিশ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুজলো সে। আদ্রিশ ও বুকের মাঝে পুরে রাখলো আয়ানা কে। চুলের ভাঁজে চুমু খেয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আদ্রিশের আদুরে স্পর্শে ধীরে ধীরে শান্ত হলো আয়ানা। খানিকটা সময় অতিবাহিত হবার পর বুক থেকে মুখ তুলে আদ্রিশের দিকে চাইলো সে। ঠোঁটে লাজুক হাসি ঝুলিয়ে বললো,

— “আজকের রাত টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত হয়ে থাকবে। আপনাকে ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব আমাকে এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেয়ার জন্য।”
হাসলো আদ্রিশ। আয়ানার নাকে নাক ঘষে নেশালো কণ্ঠে বললো,

— “উহুম। এখানেই তো শেষ নয় বউ। আমি তো রাতটাকে আরেকটু স্পেশাল করতে চাই। অনুমতি পাবো কি?”
আদ্রিশের নেশালো কণ্ঠে কেঁ’পে উঠলো আয়ানা। দৃষ্টি অন্যত্র সরালো। কিন্তু আদ্রিশ তো থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। আয়ানার কপোলে কপোল ছোঁয়ালো সে। আদ্রিশের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে শিউরে উঠলো আয়ানা। চোখ বন্ধ হয়ে আসলো আপনাআপনি। আদ্রিশ আয়ানার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে পুনরায় বলে উঠলো,

— “আজ আমরা একে অপর কে নিজেদের মনের কথা জানিয়ে দিয়েছে। আমি চাই না আমাদের মাঝে আর কোনো দূরত্ব থাকুক। এই সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিতে চাই আমি, আজ তোমাকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করে চাই। অনুমতি আছে কি বউ?”

আদ্রিশের কণ্ঠ কেমন ব্যাকুল শোনালো আয়ানার নিকট। আদ্রিশ যে তাকে খুব করে চায় তা তার কণ্ঠে স্পষ্ট। আয়ানা ও তো চায় আদ্রিশের ভালোবাসা। কিন্তু চেয়েও আদ্রিশের কথার জবাব দিতে পারলো না সে। চোখে চোখ রেখে শুধু বুঝিয়ে দিতে চাইলো সে ও চায় আদ্রিশের ভালোবাসা। আদ্রিশ যেনো বুঝতে পারলো আয়ানার চোখের ভাষা। মুহূর্তেই আয়ানার অধরে অধর ছোঁয়ালো সে। গভীর ভাবে চুম্বন করতে লাগলো। আদ্রিশের গভীর স্পর্শে ক্ষণে ক্ষণে কেঁ’পে উঠতে লাগলো আয়ানা। খা’ম’চে ধরলো আদ্রিশের পিঠ।

অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার পর আয়ানার অধর ছেড়ে সরে আসলো আদ্রিশ। চোখ বন্ধ করেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো আয়ানা। আয়ানার লাজে রাঙা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কা’ম’ড়ে হাসলো আদ্রিশ। ঝট করে কোলে তুলে নিলো আয়ানা কে। হঠাৎ এভাবে কোলে তোলায় চমকালো আয়ানা। পরোক্ষনেই সামলে নিলো নিজেকে। দুই হাতে আদ্রিশের গলা জড়িয়ে ধরলো, সঁপে দিলো নিজেকে আদ্রিশের কাছে।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৭

বাহিরে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে, ঝ’ড়ো হাওয়া বইছে। খোলা জানালা দিয়ে সেই হাওয়া ঘরে প্রবেশ করে ঘর কে শীতল করে তুলেছে। ক্ষণে ক্ষণে বাতাসের কারণে দুলে উঠছে জানালার পর্দা। খোলা জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করে রুমের একাংশ ভিজিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেসবের দিকে আপাতত কোনো খেয়াল নেই রুমে বসবাসরত কপোত-কপোতীর। তারা তো একে অপরের মাঝে মত্ত, তাদের পবিত্র সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দেয়ায় ব্যস্ত।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৯