প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬ ( শেষ অংশ )

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬ ( শেষ অংশ ) 
Writer Mahfuza Akter

নিজের ঘরে অরুণীর আগমনে বেশ অবাক হয়েছে প্রহর। বিস্মিত চোখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে,
“অরুণী, তুই?”

‘তুই’ সম্বোধনে অবাক হলো না অরুণী। বরং হাসলো। সৌহার্দ্য বিদেশে যাওয়ার আগেও প্রহর এই গ্রামে এসেছিলো। তখন অরুণী বেশ ছোট ছিল। অরুণীকে সে সময় থেকেই বেশ অপছন্দ করতো প্রহর। এর কারণ অরুণী বুঝে উঠতে পারে না। হয়তো অরুণীর সৌহার্দ্যের পিছু পিছু সবসময় লেগে থাকার ব্যাপারটা প্রহরের পছন্দ না।
“আগের মতো এখনও তুইতোকারি করছো? একটু তো ফরমাল হতে পারো! আগের মতো ছোট তো এখন আর নেই আমি!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রহর নিজের ভ্রুদ্বয় একত্রিত করে তাকালো। বললো,
“কিন্তু ছোটবেলার মতো ছ্যাঁচড়া তো এখনো রয়ে গিয়েছিস! কত বড় হয়ে গেলি! সামনে বড় ডাক্তার হবি। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে তোর মধ্যে আত্মসম্মানের ছিটেফোঁটাও তৈরি হলো না।”
অরুণী মলিন মুখে হাসলো। তার চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। প্রহর সেটা দেখলো। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ সরিয়ে নিলো সে। অরুণী চোখের কোণে আঙুল ঘষে বললো,

“এখন কি তুমিও কথা শোনাবে নাকি?”
“তোকে কথা শোনানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার কথা শুনে তো তোর ছ্যাঁচড়ামোর মাত্রা কমে যাবে না!”
“তুমি যদি কোনোদিন কারো প্রেমে পড়ো, তাহলে বুঝবে ভালোবাসা কতটা অন্ধ!”
প্রেম জিনিসটার প্রতি প্রহরের আজন্ম অনীহা। তাই প্রহর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“সম্ভাবনা মাইনাসের ঘরে। যা-ই হোক! তুই কেন এসেছিস আমার কাছে?”
অরুণী কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
“দেখেছো! ভুলেই গিয়েছি। আমি আসলে মুগ্ধর কাছে এসেছি। মুগ্ধ কোথায়?”
“চলে গেছে।”

অরুনী হতভম্ব হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো,
“চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? এতো রাতে কই যাবে? আর তোমাকে ফেলেই চলে গেল? অসম্ভব! তুমি মিথ্যে বলছো।”
প্রহর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো,

“আশ্চর্য! তোকে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ? ঢাকা চলে গেছে মুগ্ধ। আমিও কাল চলে যাবো।”
অরুণী প্রহরের কথা শুনে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো। প্রহর সেটা খেয়াল করতেই ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী হয়েছে? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“কিছু না।”
বলেই অরুণী দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রহর সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরেছে রাত দশটার পর। রাত দশটা মানে গ্রামে নিস্তব্ধ, নিকষ রাত। সেসময় পাতার মড়মড় শব্দও কানে ঝনঝন করে বেজে ওঠে। এমন রাতে সৌহার্দ্য সাধারণত ফেরে না। সন্ধ্যার দিকেই ফিরে আসে। তাহলে আজ এতো দেরি হলো কেন? ভাবুক তরী প্রশ্নটা মুখ ফুটে করেই বসলো,

“আপনার ফিরতে এতো দেরী হলো কেন আজ?”
সৌহার্দ্য এপ্রোনটা বারান্দায় রাখতে রাখতে তরীর দিকে তাকালো। মেয়েটা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। পড়ার টেবিল থেকেও উঠে দাঁড়িয়েছে এতক্ষণে। সৌহার্দ্য এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“একদিন একটু দেরী হয়েছে বলে সন্দেহ করছো?”

তরী হতভম্ব হয়ে বললো,
“সন্দেহ? কিসের সন্দেহ? আমি তো আপনাকে এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম!”
“সন্দেহ করলেও সমস্যা নেই। বউরা একটু সন্দিগ্ধ না হলে কেমন যেন রসকষহীন লাগে। মাঝে মাঝে জেরা করবে আমাকে, হু?”

বলেই সৌহার্দ্য ভ্রু নাচালো। তরী অবুঝের মতো তাকিয়ে বললো,
“মানে?”
“মানে হলো আজকের মতো রোজ আমায় প্রশ্ন করবে। আই লাইক ইট।”
তরী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ?”

সৌহার্দ্য তরীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। হাত ঘড়ি খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় ভেসে ওঠা তরীর প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজকে এমার্জেন্সি সার্জারি পড়ে গিয়েছিল। তাই আসতে একটু লেইট হয়ে গেছে। আগে তো এরকম হলে হসপিটালেই থেকে যেতাম! কিন্তু আজ থাকতে পারলাম না।”
“কেন?”

সৌহার্দ্য আয়নার মধ্যেই তরীর উৎসুক চোখের দিকে তাকালো। মেয়েটার আগ্রহ দেখতে সে ভীষণ পছন্দ করে। হয়তো তরী সেটা জানে না! জানলে কি সে আগ্রহ দেখানো বন্ধ করে দেবে? সৌহার্দ্য ঘুরে দাড়ালো। বললো,
“আগে তো আমার ঘরে বউ ছিল না! এখন আমার ঘরে বউ আছে।”

তরী তাৎক্ষণিক বলার মতো কিছু পেল না। তাই চুপচাপ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য এগোচ্ছে। কিন্তু তরী পেছাচ্ছে না। তরীর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্য চওড়া হাসি দিলো। ফিসফিস গলায় বললো,
“আসলে বিয়ের পর বউয়ের গায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুম আসে না।”
তরী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,

“আপনি আমার গায়ের গন্ধ কিভাবে পেলেন?”
সৌহার্দ্য তরীকে কাছে টেনে বুকে আগলে নিলো। তরীর কানের কাছের চুলে নাক ডুবিয়ে বললো,
“এভাবে।”
ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, তরী কোনো প্রতিক্রিয়া করতেই ভুলে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। তার হাত অজান্তেই সৌহার্দ্যের পিঠে চলে গেল। সৌহার্দ্যের হাসি আরো প্রসারিত হলো। সে ধীর গলায় বললো,

“আমি এগোচ্ছিলাম, কিন্তু তুমি পেছাচ্ছিলে না কেন? এই, তুমি কি সিনেমা দেখো না? সিনেমায় দেখোনি ছেলেরা এগুতে থাকলে মেয়েরা পেছায়? তারপর মেয়েদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় এন্ড ব্লা ব্লা ব্লা। তুমি তো দেখি যুগ-যুগান্তরের কাহিনী-ই বদলে দিলে!”
তরী কম্পিত কণ্ঠে বললো,

“মানুষ যখন ভয় পায়, তখন পেছায়। আমি তো আপনাকে ভয় পাই না! তাহলে পেছাবো কেন?”
সৌহার্দ্য তরীর চোখের দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আমাকে ভয় পাও না তুমি?”
তরী ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। সৌহার্দ্য আবার প্রশ্ন করলো,
“কেন?”

“যাকে ভরসা করা যায়, তাকে ভয় পাওয়া যায় না।”
সৌহার্দ্য হৃষ্টচিত্তে হাসলো। তরীকে আরেক ধাপ কাছে টেনে বললো,
“এতোটা বিশ্বাস করো আমাকে?”

“বিশ্বাস না করলে বিয়ে করতাম না।”
সৌহার্দ্য আর কিছু বললো না। তরীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তরী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার চোখ দুটো বন্ধ। তরীও নীরব রইলো। নীরবতা ভেঙে সৌহার্দ্য বললো,
“চাঁদ!”
তরী চমকে উঠে বললো,
“হুম।”

সৌহার্দ্য চোখ মেলেছে। তরীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশ্ন করলো,
“আমার সাথে কি তুমি এখনো কমফোর্টেবল না?”
তরী কিছু না বুঝতে পেরে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছেন?”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বললো,
“যেটা প্রশ্ন করেছি, তার উত্তর দাও। প্লিজ!”
তরী ঘন ঘন পলক ফেলে বললো,

“অবশ্যই কমফোর্টেবল।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“আর ইউ শিয়র?”
“হুম।”
“আমার ছোঁয়া তোমার বিরক্ত লাগে?”

“না।”
“আমার স্পর্শে দমবন্ধ লাগছে, অস্বস্তি হচ্ছে?”
“না তো!”
“এই যে আমার গায় লেপ্টে আছো! তোমার খারাপ লাগছে না?”
তরী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“আমার খারাপ লাগছে না। আপনি আমায় এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
সৌহার্দ্য তরীর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। উল্টো তরীকে আরো কাছে টেনে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। তরীর মাথায় অজস্রবার অধর স্পর্শ করিয়ে বললো,

“আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি তুমি। অনেক আদরের। অনেক সাধনার পর ওপরওয়ালা তোমায় আমার নামে লিখে দিয়েছেন। তোমায় আজীবন নিজের বুকে আগলে রাখতে চাই আমি। সবসময় আমার সাথে লেপ্টে থেকো। কথা দিচ্ছি, পৃথিবীর সকল যত্ন, সুখ ও সম্মান তোমার পায়ের সামনে এনে দেব।”
তরী দু’হাত সৌহার্দ্যের পিঠে রাখলো। তরীর মাথা ঠেকেছে সৌহার্দ্যপর বুকে। সৌহার্দ্যের হৃৎস্পন্দন দ্রুত গতিতে চলছে। তরীর চোখ অজান্তেই বুজে গেল। পৃথিবীর সকল শান্তি বোধ হয় শুধু এই বুকেই জমে ছিল তার জন্য। অথচ সে জানতোই না!

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬ 

পরদিন সকালে সুজাতা অরুণীর ঘরে সকালের নাস্তা নিয়ে গেলেন প্রতিদিনের মতো। কিন্তু পুরো ঘর ফাঁকা দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন। ওয়াশরুমও ফাঁকা। সুজাতা চিন্তিত ভঙ্গিতে ছাদ আর বাগানেও খুঁজলেন। শেষমেশ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
“অরুণী মা তো কাল রাইতে-ই চইলা গেছে! ঢাকায় যাওয়া নাকি তার বহুত দরকার। আমি আটকালেও শুনে নাই।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৭