প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬
Writer Mahfuza Akter

সন্ধ্যা আসন্ন! গগনের শেষ সীমানায় হলদেটে আভার বিচরণ দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই রাত ঘনিয়ে আসবে। আঁধারের সাথে আসবে কিছু মুহুর্ত। কারো জন্য আনন্দের, কারো জন্য অশ্রুময়, কারো জন্য প্রতীক্ষার সূচনা, আবার কারো জন্য বিরক্তির সমাপ্তি।

পুকুরের পাড়ে ঘাসের ওপর এক পা ছড়িয়ে বসে আছে প্রহর। আরেক পা উঁচিয়ে সেটার ওপর কপাল ঠেকিয়ে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলছে বারবার। ফোনের ওপর ব্যর্থ দৃষ্টি মেললো আরেকবার। খোলা প্রান্তরে অদূরে কারো ডাক শোনা যাচ্ছে,
“কী গো, মাস্টার সাহেব! সৌহার্দ্য বাবার শহুরে বন্ধু না তুমি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রহর চোখ তুলে অবাক চাহনিতে তাকালো। দূর থেকে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। এক মধ্য বয়সী লোক। প্রহর স্পষ্ট দৃষ্টি মেলে তাকাতেই বুঝতে পারলো, এটা আফনা বেগমের সেই আস্থাভাজন ব্যক্তি, হুকুমের গোলাম বলা যায়! আজাদকে কাছাকাছি আসতে দেখে প্রহর উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললো,

“এখানে নেটওয়ার্ক কোথায় ভালো পাওয়া যাবে? একটা মেইল পাঠানো খুব দরকার! কয়েকটা কলও দিতে হবে!”
আজাদ পান চিবোনো তার কালচে দাঁত দেখিয়ে সহাস্যে বললো,
“দুপুরের পর বৃষ্টি হইসিলো না? আজকে সারারাত আর নেটওয়ার্ক পাইবেন না এই খানে।”

প্রহর হতাশ হলো। পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। আজাদ কাজের তাড়া দেখিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে! লোকটা অদ্ভুত! আজাদকে আপাতদৃষ্টিতে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখালেও প্রহরের কাছে তাকে কেমন যেন প্রাণহীন মনে হয়। এমনটা কেন মনে হয়? আজাদের হাসি মুখটা নিতান্তই কৃত্রিম। তাতে আনন্দের কোনো ছোঁয়া নেই। এই যে আজাদ হেঁটে যাচ্ছে। তার ঝুঁকে পড়া অবয়বটা যেন বলছে,

“কিছু কিছু মানুষের হাসির মাঝে এক বিশাল সমুদ্র লুকিয়ে থাকে। সেই সমুদ্রের তলদেশ খুঁজে পাওয়া যায় না।”
নিজের ভাবনার প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো প্রহর। দিনদিন দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে সে। সাথে সাথে গোয়েন্দাগিরিও শুরু করেছে। সাদামাটা জিনিসেও প্যাঁচ খুঁজতে ভালো লাগে এখন তার। খেয়েদেয়ে কোনো কাজ না থাকলে যা হয় আর কি! আজাদ ইতোমধ্যে দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে গেছে। প্রহর সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বিরক্তি নিয়ে নিজেই নিজেকে বললো,

“এই মুগ্ধটার জন্য আমার এখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে! নয়তো এই অজপাড়া গাঁয়ে মানুষ থাকে কীভাবে? অসহ্যকর!”
কথাটা শেষ হতে না হতেই প্রহরের চোখ গেল পুকুরের অপর প্রান্তে থাকা মেঠো পথটায়। সঙ্গে সঙ্গেই প্রহরের ভ্রুদ্বয় একত্রিত হয়ে গেল। আঁকাবাঁকা পথ ধরে একটা মেয়ে হাঁটছে। তার পাশে একটা ছেলেও হাঁটছে।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটা আর মেয়েটা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মেয়েটাকে স্পষ্টভাবে না দেখেই প্রহর বুঝতে পারছে, মেয়েটাকে সে চেনে। মেয়েটার হাঁটার ভঙ্গি প্রচন্ড অস্বাভাবিক। আচ্ছা, ঐটা মধু না? দেখে তো মধুর মতোই মনে হচ্ছে! প্রহর দাঁত কটমট করে তাকালো। প্রচন্ড রাগ লাগছে তার। রাগার অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। গ্রামে আসার পরের দিনগুলোতে একটা মুহুর্তের জন্য শান্তিতে থাকতে দেয়নি মধু তাকে।

সেদিন লুঙ্গি পরা ছবিটা শত বার বলেও ডিলিট করাতে পারেনি। মেয়েটা নাছোড়বান্দা, প্রচুর জেদি! ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ না প্রহরের। তার জীবনের সকল শান্তি গ্রাস করে নিয়ে এখন এই সব অকাজ করে বেড়াচ্ছে এই বাঁদর মেয়ে! অল্প বয়সে পেকে গেলে যা হয় আর কি! প্রহর বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে আহমেদ ভবনের দিকে চলে গেল।

আহমেদ ভবনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে একটা অদ্ভুত যুক্তি দাঁড় করালো প্রহর। আনমনে নিজেই নিজেকে বললো,
“কখনো গ্রামের কাউকে বিয়ে করা যাবে না। গ্রামের মেয়েগুলো কম বয়সেই পেকে যায়! এই যে মধু কার না কার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অরুণীও বাচ্চাকাল থেকে সৌহার্দ্য, সৌহার্দ্য করে ছ্যাঁচড়ামো করতো। তরীকেও দেখলাম অর্ণব নামের ঐ ছেলেটার জন্য কত কাহিনী করতে। এরা সবাই এরকম কেন? অদ্ভুত!”

বাড়িতে এসে নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই হতভম্ব হয়ে গেল প্রহর। মুগ্ধ আলমারি থেকে সব কাপড়চোপড় বের করে তড়িৎ গতিতে ব্যাগে গুছিয়ে রাখছে। প্রহর হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে বললো,
“এসব কী করছিস তুই, মুগ্ধ? ব্যাগ গোছাচ্ছিস কেন?”
মুগ্ধ ফুঁপিয়ে উঠলো অদ্ভুত ভঙ্গিতে। প্রহরের ভ্রু কুঁচকে গেল। ছেলেটা এভাবে ফোঁপাচ্ছে কেন? রাগে? নাকি দুঃখে? প্রহরের ভাবনার মাঝেই মুগ্ধ কাটকাট গলায় বললো,

“ঢাকা যাচ্ছি আমি।”
“হোয়াট?” প্রহরের চোখ কপালে উঠে গেল। মুগ্ধ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ব্যাগের জিপারটা টেনে নিলো।
প্রহর এগিয়ে এসে বললো,

“এভাবে হুট করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস যে? যাক ভালোই হয়েছে! এখানে থাকার ভুত তোর ঘাড় থেকে নেমেছে। আমি তো কবে থেকেই এখান থেকে চলে যেতে চাইছি! তোর জেদের জন্য যেতে পারিনি। ফাইনালি তুই যখন ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিস, তখন আর দেরি করে কাজ নেই। চল, আজ রাতের ট্রেনটা-ই ধরি আমরা।”
প্রহর নিজের ব্যাগ আলমারি থেকে বের করবে, এমনসময় মুগ্ধ বললো,

“আমি এখন একাই যাই, ভাইয়া। তুই সৌহার্দ্য ভাইয়ার সাথে দেখা করে তারপর আসিস। হুট করে দু’জন একসাথে সৌহার্দ্য ভাইয়ের সাথে দেখা না করে চলে যাওয়াটা প্রচন্ড বাজে দেখায়।”
মুগ্ধ নিজের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লম্বা শ্বাস ফেললো। প্রহরের কাঁধে হাত রেখে কয়েক সেকেন্ড ঝাপটে ধরে রাখলো ভাইকে।

পরমুহুর্তেই প্রহরকে ছেড়ে ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রহর এহেন কান্ডে একেবারেই হতবাক হয়ে গেছে। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, সে মুগ্ধকে পেছন থেকে ডাকতে পারছে না, তাকে একা যাওয়া থেকে আটকাতে পারছে না। এক ঝটকায় মনে হচ্ছে, মুগ্ধ আজ ভীষণ বড় হয়ে গেছে। কেমন অদ্ভুত গাম্ভীর্য তার মধ্যে। কিন্তু……. প্রহর নিজের শার্টের কাঁধের দিকটায় হাত স্পর্শ করলো। ভেজা ভেজা লাগছে। এখানে পানি লাগার তো কোনো কারণ নেই! তবে মুগ্ধ তাকে জড়িয়ে ধরার পর কাঁধের দিকটায় নিজের গাল ঘষেছিল।

তরী পড়ার টেবিলে বসে পড়াশোনা করছে। চেয়ারে বসে পা দুলাতে দুলাতে খাতায় কিছু একটা লিখছে সে। চুলগুলো চেয়ারের পৃষ্ঠদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। ঢেউ খেলানো সেই কুচকুচে কালো ঘন চুলগুলোতে বাতির আলোর ঝলক পড়ছে। কাঁধের এক প্রান্তে মেলে দেওয়া ওড়নাটার শেষপ্রান্ত মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তরীর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।
“কী পড়ছিস, তরী?”

কারো এমন প্রশ্নে মনযোগে ভাটা পড়লো তরীর। চমকে উঠে পেছন ঘুরে তাকালো সে। অরুণী এসেছে। তার দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। মুখে নিষ্প্রাণ এক টুকরো হাসির রেখা। তরী কী বলবে ভেবে পেল না।
অরুণী ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। বিছানায় বসে বিছানার চাদরে হাত বুলালো। পুরো ঘরে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখলো।

তার মনের কোণে বহু বছরের লালিত এক স্বপ্ন ছিল এই ঘরের মালকিন হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই ঘরের মালকিন হওয়ার জন্য যে এই ঘরের মালিকের মনে দখল নিতে হবে, সেটা বুঝতে দেরি করে ফেলেছে সে হয়তো! নাকি দেরি হয়নি? হয়তো সৌহার্দ্য-ই আগে আগে নিজের মনটা তরীর নামে লিখে দিয়েছে! অরুণীকে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগও দেয়নি।

অরুণী ম্লান মুখে হাসলো। তরীর দিকে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মেয়েটা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছে তার আগমনে। ব্যাপারটা দেখেই বুঝতে পারছে অরুণী। এমনটা হওয়া-ই স্বাভাবিক। এতোদিন তরী আর সৌহার্দ্যের মুখটাও দেখেনি সে। আজ হঠাৎ ঘর অব্দি চলে এলো! বিভ্রান্তির ব্যাপারই এটা। তরী কেমন উশখুশ করছে। অরুণী তরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার চোখ বুলালো।

মেয়েটার ঠিক কোন দিকটা দেখে সৌহার্দ্য আকৃষ্ট হয়েছে? ওর ঐ হরিণীর ন্যায় চোখ দেখে? নাকি এই চুলের ঢেউ খেলানো স্রোতে সৌহার্দ্য নিজেকে ডুবিয়ে মে*রে*ছে? নাকি তরীর ঐ সাদা গালের ওপর থাকা লালাভ অংশ সৌহার্দ্যের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে? নাকি ঐ ঠোঁট……. নাহ্!

আর ভাবা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তেই অরুণীর দমবন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এতো কিছু সৌহার্দ্য দেখলো কবে? এতো বছর তো সে বিদেশে-ই পড়ে ছিল! বিদেশ থেকে ফিরে একদেখায় ভালোবেসে ফেললো? নাকি এই প্রেমকে এতো এতো বছর নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে, যত্নে আগলে রেখেছে?

“মেডিক্যাল এডমিশনের আর এক মাসও বাকি নেই তো! তাই পড়াশোনা করছিলাম।”
তরীর স্পষ্ট কথাটা অরুণীর কানে পৌঁছেছে। অরুণী ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ফর্ম ফিল-আপ স্টার্ট হয়েছে?”
তরী ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। অরুণী শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

“সৌহার্দ্য পড়াচ্ছে তোকে, তাই না?”
“হুম।”
“সৌহার্দ্য কি তোর সাথে রাগারাগি করে?”
“মাঝে মাঝে।”
“রাগলে সৌহার্দ্যকে কেমন লাগে তোর? বেশ সুন্দর না?”

তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো অরুণীর দিকে। অরুণী হতাশ গলায় বললো,
“তরী, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“বলো।” তরীর গলারটা বেশ গম্ভীর শোনালো।
“সৌহার্দ্য তোকে এ পর্যন্ত কতবার ‘ভালোবাসি’ বলেছে?”
তরী অরুণীর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটা অধীর আগ্রহে তার উত্তরের আশায় বসে আছে। তরী নির্লিপ্ত গলায় বললো,

“একবারও না।”
“তুই বলেছিস?”
“না।”
অরুণী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“কাল আমি হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছি। তাই তোর সাথে একবার দেখা করে গেলাম।”
তরী অবাক হয়ে বললো,

“কিন্তু তোমার ছুটি শেষ হতে তো আরও দুই সপ্তাহ বাকি!”
অরুণী হেসে বললো,
“যে আশায় এতো দিন পড়ে ছিলাম, সেই আশা ফুরিয়ে গেছে।”
তরী অরুণীর কথার মানে বুঝতে পারলো না। অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অরুণী দরজা পেরিয়ে যাওয়ার সময় তরীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৫

“প্রেম প্রকাশের চেয়ে অনুভবে বেশি সুন্দর, তাই না?”
তরী কোনো উত্তর দিতে পারলো না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। অরুণী তরীর উত্তরের আশা না করেই হাসতে হাসতে চলে গেল। কিন্তু তরী স্পষ্ট চোখে দেখেছে, অরুণীর গাল ভেজা ছিল।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬ ( শেষ অংশ )