প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৫
Writer Mahfuza Akter

ইদানীং অরুণীর ঘরে সুজাতার আনাগোনা বেশ বেড়েছে। ব্যাপারটা নজরে আসার পর থেকেই প্রচন্ড চিন্তায় পড়েছে মালিহা। সুজাতার মতিগতি বুঝতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। তরীকে যেহেতু মেনে নিতে পারছে না সুজাতা, তাই অরুণীকে ব্যবহার করে সৌহার্দ্যের জীবন থেকে তরীকে সরানোর চিন্তা-ভাবনা করাটা অযৌক্তিক নয়। তবে সুজাতা এতোটা নীচ-মানসিকতার কাজ কীভাবে করতে পারছে, ভেবে পাচ্ছে না মালিহা।

অরুণী সকালে জানালার পাশে বসে ভোরে হাওয়া উপভোগ করছে আর একটা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখছিলো। আজ থেকে পড়ায় আগের মতোই মনযোগ দেবে সে। এতোদিন অনিয়ম করায় বেশ পড়া জমেছে। অন্য দিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ ঘরে কারো আগমন বুঝতে পেরে পেছন ঘুরে দরজার দিকে তাকালো অরুণী। সুজাতা এসেছে। হাতে খাবারের বড় ট্রে। অরুণী অবাক হলো না। বেশ কয়েকদিন যাবৎ নিজের প্রতি সুজাতার মাত্রাতিরিক্ত যত্ন-আত্তি দেখে অবাকে হতে হতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এসব কী বড়মা?”
“তোর সকালের খাবার নিয়ে এলাম। তুই তো এখন সবার সাথে একসাথে বসে খাবার খাস না!”
অরুণী শ্লেষের হাসি হেসে বললো,
“ভেতরটা বড্ড জ্বলে, বড়মা! সৌহার্দ্য আর তরীকে একসাথে দেখে সহ্য করতে পারবো না আমি।”
সুজাতা বিরক্তি নিয়ে বলল,

“তো তোকে সহ্য করতে বলেছে কে? ঐ মেয়েকে তো আমি আমার ছেলের সাথে সারাজীবন সংসার করতে দেবোই না! কী যোগ্যতা আছে ওর? শুধু দেখতে সুন্দরী। আর ঐ সৌন্দর্য্যে-ই আঁটকে গেছে আমার ছেলে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য-ও ওর গায়ে লাগা কলঙ্কে ঢাকা পড়ে গেছে। একটা সুযোগ শুধু হাতে আসুক আমার! সৌহার্দ্যের জীবন থেকে ওকে আজীবনের জন্য সরিয়ে দেবো আমি। আমার ছেলের পাশে তোর মতো মেয়েকেই শুধু মানায়!”

মালিহার কথাগুলো অরুণীর কানে ঢুকেও ঢুকলো না যেন! সে অসহায় গলায় প্রশ্ন করলো,
“সৌহার্দ্য আমায় কেন ভালোবাসলো না, বড় মা? তরীকে-ই কেন ভালোবাসলো ও? কী কমতি আছে আমার মধ্যে? সৌহার্দ্য কেন আমায় ভালোবাসলো না? কেন অবহেলা করে গেল সারাজীবন? ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা কি দেখতে পায়নি সৌহার্দ্য?”

অরুণীর গলা কেঁপে উঠছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। সুজাতার বড্ড মায়া লাগলো অরুণীকে দেখে। কিন্তু কিছু বলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পেল না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
অরুণীর ঘর থেকে বের হতেই মালিহা সুজাতার সামনে এসে দাঁড়ালো। সুজাতা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বললো,
“এভাবে পথ আগলে দাঁড়িয়েছো কেন? আশ্চর্য!”
সুজাতা চোয়াল শক্ত করে বললো,

“যতই ফন্দি আঁটো না কেন, আপা! আমার চাঁদের কোনো ক্ষতি করতে হলে আগে আমায় ভেদ করে যেতে হবে তোমায়! আর আমায় ভেদ করার মতো অসাধ্য সাধনের ক্ষমতা কারো নেই। সেটা তো তুমি বেশ ভালো করেই জানো।”
মালিহা র*ক্তচক্ষু মেলে কিছুক্ষণ সুজাতার দিকে তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সুজাতা মালিহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। মালিহাকে সে চেনে। বেশ ভালো করেই চেনে। ওর দ্বারা কিছু-ই অসম্ভব নয়!

ঘুম ভাঙতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো তরী। বিছানার একপ্রান্তে নিজেকে আঁটসাঁট হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো বেশ। সে তো গত রাতে টেবিলে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল! তাহলে বিছানায় এলো কী করে? পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সব এলোমেলো বইগুলো এক সাইডে গুছিয়ে রাখা। নিশ্চয়ই এটা সৌহার্দ্যের কাজ!
ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্যকে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতে দেখলো তরী। তরীকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে সৌহার্দ্য বললো,

“জেগে গেছো? আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে!”
তরী সন্দিগ্ধ চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি আমায় বিছানায় কীভাবে নিয়ে এসেছেন রাতে?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তোমায় কে বললো যে, আমি তোমায় বিছানায় নিয়ে শুইয়েছি?”

“আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি পড়ার টেবিল থেকে উঠে ঘুমাতে যাইনি। নিশ্চয়ই টেবিলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”
“হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলে টেবিলেই! নিজেই হয়তো ঘুমের ঘোরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছো। হতে পারে তোমার মনে নেই।”

“আমি এতো বোকা না। ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস আমার নেই। এসব আজেবাজে কথা বলা বাদ দিয়ে কাজের কথা বলুন। কীভাবে বিছানায় নিয়ে গেছেন আমায়?”
সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তরীর সামনে গিয়ে বসে বললো,
“এতো কিছু জেনে তোমার কী কাজ? রাতে টেবিলে ঘুমানোর আগে মনে ছিল না এতো কিছু? এখন এভাবে জেরা কেন করছো?”

তরী চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘনঘন পলক ফেলে বললো,
“তার মানে আমি যেটা ভাবছি সেটাই ঠিক? আপনি আমায় কোলে নিয়ে……”
“হ্যাঁ, সেটাই ঠিক। তাছাড়া আর কী করতাম আমি? বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি আমায় কোনো ভাবে সন্দেহ করছো?” বলেই সৌহার্দ্য সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো।

তরী কী বলবে, ভেবে পেল না! তাই ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না, না! আপনাকে সন্দেহ কেন করবো? কিন্তু…. ”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কিন্তু? কিন্তু কী?”

তরী কিছু বলবে, তার আগেই নিচ থেকে মালিহার ডাক শোনা গেল। তরী কিছু না বলে সৌহার্দ্যের দিকে একবার তাকিয়েই চলে গেল। সৌহার্দ্য তরীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো চিন্তিত ভঙ্গিতে। তরী কি তাকে ভুল বুঝলো? শুধু মাত্র মাঝরাতে ওকে একটু কোলে নিয়েছে বলে, ছুঁয়েছে বলে অস্বস্তিতে পড়ে গেল? এতোগুলো রাত একসাথে থেকেও তরী তাকে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না! ব্যাপারটা সৌহার্দ্যকে প্রচন্ড আঘাত করলো। একরাশ অভিমান মনে পুষে কাউকে কিছু না বলেই হসপিটালে চলে গেল সে।

রায়হান সাহেব আর আফনাদ হকের ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায়, তারা আজ-ই শহরে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবেন। তারা দু’জনই এক গাড়িতে যাবেন। তাই রায়হান সাহেবের সাথে তরী আফনাদ হকের সাথে দেখা করতে এসেছে। তরীকে দেখে আফনাদ হক এগিয়ে এসে নিজের বুকে আগলে নিলেন। তরী কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

“তোমায় অনেক মিস করবো, বাবা!!”
আফনাদ হক নিজের চোখের জল আড়াল করে সহাস্যে বললেন,
“আমার মেয়েকে আমিও অনেক মিস করবো। আমাকে ক্ষমা করে দিস, মা। আমি ভেবেছিলাম তোকে রাজকন্যা বানিয়ে রাখবো। সব বাবার-ই স্বপ্ন থাকে নিজের মেয়েকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দেওয়ার। কিন্তু এই দিক দিয়ে আমি ব্যর্থ।”

“তুমি ব্যর্থ নও, বাবা! তুমি সারাজীবন আমায় অনেক ভালোবাসা দিয়েছো। আমার জীবনে ভালোবাসার প্রচন্ড অভাব!”
আফনাদ হক তরীর মাথায় চুমু দিলেন। রায়হান সাহেবও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“নিজের খেয়াল রাখিস, মা। পড়াশোনা মনযোগ দিয়ে করিস!”
তরী মাথা নাড়ালো। রায়হান সাহেব আর আফনাদ হক সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বিকেলে অরুণী ছাদে বসে বসে কফি খাচ্ছে আর পড়ছে। সারাদিন এক ঘরে বন্দী থাকার পর বিকেলের এই খোলা হাওয়াটা খুব প্রয়োজন মনে হয় তার।
“যাক! ফাইনালি আপনি সব কিছু সাইডে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছেন।”
আকস্মিক এমন কথায় চমকে পেছনে তাকালো অরুণী। কিন্তু পেছনে মুগ্ধকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো মুহুর্তেই। মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বললো,

“তুমি আজও এসে গেছো আমায় ডিস্টার্ব করতে?”
“ডিস্টার্ব করতে আসিনি। আপনাকে কোম্পানি দিতে এসেছি। একা একা নিশ্চয়ই বোর হচ্ছেন!”
“আমি একাই ঠিক আছি। বোরডম কাটানোর জন্য তোমার সঙ্গ লাগবে না আমার!”
মুগ্ধ এগিয়ে এসে অরুণীর পাশের চেয়ারে বসে বললো,
“কিন্তু পড়ায় তো মনযোগ নেই আপনার!”

অরুণী উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মন খারাপ থাকলে কোনো কিছুতেই মনযোগ থাকে না। আর মন ভাঙলে পুরো পৃথিবীটাই রঙহীন লাগে। আজকাল পুরো পৃথিবীটা-ই আমার কাছে রঙহীন, বিষাক্ত মনে হয়।”
মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আপনি আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবেন? নিজেকে নিয়ে ভাবুন! নিজেকে সময় দিন! অতীত নিয়ে ভাবনা চিন্তা না করে মুভ অন করার চেষ্টা করুন।”

অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“পারবো না আমি মুভ অন করতে। এতোদিন অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সৌহার্দ্যকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না আমি।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে? কী করতে চাইছেন আপনি এখন?”
অরুণী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“বড় মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। তরীকে তাঁর পছন্দ না। তাই তরীর সাথে সৌহার্দ্যের এই সংসার খুব শীঘ্রই ভেঙে যাবে।”

“আর যদি না ভাঙে?”
“তাহলে আমি ভাঙার ব্যবস্থা করবো।”
এমন কথা শুনে মুগ্ধ অকস্মাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অরুণী মুগ্ধর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো, রাগে মুগ্ধর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। অরুণী হতভম্ব হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো নিজেও। মুগ্ধ রাগী গলায় বললো,
“আমি ভাবতেও পারছি না আপনি এইরকম কিছু করার কথা চিন্তা করতে পারেন। নিজের স্বার্থের জন্য দু’টো মানুষের সংসার ভাঙার কথা কীভাবে ভাবতে পারেন আপনি?”
অরুণী স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

“ভালোবাসা পেতে হলে একটু স্বার্থপর হতেই হয়। কথায় আছে না! এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার।”
“এইসব কথার আবিষ্কারক আপনাদের মতো ব্যর্থ, স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক মানুষরাই! ‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার’ ভেবে আপনারা যে আনফেয়ার কাজগুলো করেন, সেটার ফলাফল একদমই সুখকর হয় না। আপনারা শুধু নিজেদের কথাই ভাবেন।

এই ভাবে যে সৌহার্দ্য ভাইয়ার সংসার নষ্ট করার কথা ভাবছেন, আপনার কী মনে হয় আপনি সফল হবেন কোনো দিন? সৌহার্দ্য শুধু তরীকে ভালোবাসে! তরীর জায়গা আপনি কোনোদিনও পাবেন না। আর যদি কখনো তরীকে সৌহার্দ্য ভাইয়ের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে সফলও হন, আপনাকে উনি কখনও গ্রহন করবে না। আপনাকে আমি অনেক আত্মসম্মানপূর্ণ মেয়ে ভেবেছিলাম, অরুণী।

কিন্তু আপনি আমায় প্রচন্ড হতাশ করলেন! আপনার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করিনি আমি। আপনাদের মতো নীচু মেন্টালিটির মেয়েদের কোনো ভালো ছেলে ডিজার্ভ-ই করে না।”
মুগ্ধ চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে সে ছাদ থেকে চলে গেল। অরুণী পাথুরে চোখে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর যাওয়ার দিকে।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৪ শেষ অংশ 

(পরবর্তী পর্ব রবিবার দিবো ইনশাআল্লাহ। এখন থেকে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করবো 🖤)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৬