প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৪ শেষ অংশ 

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৪ শেষ অংশ 
Writer Mahfuza Akter

তরীর চোখের কোলে মোটা জলবিন্দু! বারংবার কেঁপে উঠছে তার সর্বাঙ্গ। সৌহার্দ্য চোখ বুজেই তরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে এখনও। হঠাৎ কপালে উষ্ণ জলকণার স্পর্শে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে গভীর পড়লো তার। হাত দ্বারা কপাল স্পর্শ করে পিটপিট করে মেলতে থাকা চোখের সামনে মেলে ধরলো সৌহার্দ্য। বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝড়ের গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো,

“চাঁদ! তুমি কাঁদছো কেন? চাঁদ, কান্না থামাও এক্ষুনি!”
তরী নাক টানলো। ঢোক গিলে ওড়নার শেষাংশ দিয়ে চোখ মুছতে গেলে সৌহার্দ্য বাধা দিলো। নিজে হাত বাড়িয়ে সযত্নে তরীর চোখ ও গাল মুছে দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুমি একটা কাহিনী শুনে এখন কাঁদছো? যে কিনা এতো ঝড় সহ্য করেও সামান্য হেলে পড়েনি, সেই মেয়েটা আমার চোখের সামনে এভাবে কান্না করছে! আমি অবাক না হয়ে পারছি না! তোমার মতো সাহসী মেয়ের চোখে জল মানায় না। কান্না মানুষের কষ্ট কতটা হালকা করে, আমার জানা নেই! কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো? কান্না মানুষকে প্রচন্ড দূর্বল করে ফেলে। আর আমি আমার চাঁদকে দূর্বল দেখতে চাই না।”

তরী শীতল চোখে কিছুক্ষণ সৌহার্দ্যে দিকে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য সবসময় তরীর অনুভূতিহীন চোখ দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু আজ তরীর চাহনি ভিন্ন লাগছে। তরীর অপলক চোখ দুটো কেমন অদ্ভুত ঠেকছে! যেন চোখ-ই অনেক কথা বলছে, যা সৌহার্দ্য বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ তরী নিঃসংকোচ এক আবদার করে বসলো,

“আমার যখন কান্না পেত, তখন বাবার বুকে মুখ গুঁজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবসময় আমি আমার বাবাকে কাছে পাইনি। আজও আমার পাশে উনি নেই। আপনার বুকে মাথা রাখলে কি আপনি রাগ করবেন? আমি কথা দিচ্ছি, কান্না নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আমি সাথে সাথে আপনার থেকে দূরে সরে যাবো।”

কথাটা বলতে দেরী হলেও সৌহার্দ্যের তরীকে এক টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে দেরী হলো না। গভীর আলিঙ্গনে তরীর কান্না মুহূর্তেই থেমে গেল, দম আঁটকে এলো, সর্বাঙ্গ অসার হয়ে এলো। এই প্রথম কোনো পুরুষের এতো নিকটবর্তী হয়েছে সে। আবেগে আবদারটা করে বসলেও এখন তো সৌহার্দ্যের হৃদকম্পন শুনে নিজের সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। সৌহার্দ্যের গা থেকে একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ নাকে লাগছে তরীর। মুহুর্তেই চোখ বুঁজে এলো তার।
সৌহার্দ্য তরীর মাথায় ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো,

“নিজেকে থেকে তোমার কাছে আসবো না বলেছিলাম। কিন্তু তুমি কাছে টানলে আমাকে আঁটকাতে পারবে না, চাঁদ! আমি কিন্তু তখন কোনো বাঁধা মানবো না।”
তরী সৌহার্দ্যের কথা শুনে তাড়াতাড়ি সৌহার্দ্যের থেকে দূরে সরে বসলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তরী সৌহার্দ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তরীর এমন আচরণে সৌহার্দ্য না হেসে পারলো না।

সন্ধ্যার ম্লান আলোয় চারিদিক কিছুটা অস্পষ্ট হলেও মুগ্ধর চোখে অরুণীর মলিন মুখটা স্পষ্ট-ই দেখা যাচ্ছে। ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা দু’জন। অরুণীর দৃষ্টি সামনের দিকে হয়তো কোনো এক শূন্য ঠিকানায়! আর তার-ই পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত।
আঁধার ঘনিয়ে আসতেই অরুণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“নিজের ঘরে যাবে না? রাত হয়ে এসেছে তো!”
অরুণীর কথা যেন মুগ্ধর কানে পৌছালো-ই না! সে একইভাবে, একই ভঙ্গিতে এখনও তাকিয়ে আছে। অরুণী কপাল কুঁচকে মুগ্ধর দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। বিরক্ত হয়ে বললো,
“আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে? এখন কিন্তু অসহ্য লাগছে আমার!”

মুগ্ধর ঘোর ভাঙলো। ঈষৎ চকিত দৃষ্টিতে তাকালো অরুণীর দিকে। ঘনঘন পলক ফেলে আশেপাশে তাকালো। অন্ধকার হয়ে এসেছে। ছাদে হলদেটে আলোর একটা নিয়নের বাতি ঝুলছে। অরুণী ভ্রু কুঁচকে মুগ্ধকে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হাবেভাবে, আচার-আচরণে ছেলেটা নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে। ম্যাচুউরিটির লেভেল শূন্যের কাছাকাছি-ই বলতে গেলে। আর এই ছেলে কিনা তার সামনে বারবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়ায়! এতো সাহস কোথা থেকে পায় ছেলেটা?

“রাত হয়ে গেছে! আমি তো খেয়াল-ই করিনি!”
অরুণী মুগ্ধর থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। বিরস কন্ঠে বললো,
“খেয়াল কোথায় ছিল তোমার? এতো বেখেয়ালি হওয়া ঠিক না!”
মুগ্ধ প্রাণ খোলা এক হাসি দিয়ে বললো,
“হয়তো! কিন্তু আপনি নিজেও তো মাঝেমধ্যে বেখেয়ালি আচরণ করেন! করেন না?”

“তাতে তোমার কী?”
“আমার-ই তো সব!”
“আজেবাজে কথা বলবে না একদম। তোমার গাঁজাখুরি কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন।”
“আমার হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি, আর আপনার কাছে আজেবাজে কথা মনে হচ্ছে?”
অরুণী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মুগ্ধর দিকে তাকালো। হাতে হাত ভাজ করে বললো,
“হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করার মতো ম্যাচিউরিটি আসেনি তোমার মধ্যে এখনো। আমার চোখে নিতান্তই বাচ্চা ছেলে তুমি!”

মুগ্ধ হতভম্ব হয়ে বললো,
“হোয়াট? আমি বাচ্চা? আপনার থেকে মাত্র এগারো মাসের ছোট আমি! আর আমার হাইট দেখেছেন আপনি? আপনার মাথা আমার বুকে ঠেকে! এই যে এতো মুখ উঁচিয়ে কথা বলছেন এখন আমার সাথে। দেখে মনে হচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। আর আমাকে বলছেন, আমি বাচ্চা? কোন এঙ্গেলে আমাকে বাচ্চা মনে হয় আপনার?”
অরুনী দাঁতে দাঁত চেপে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমাকে কিছু বলা-ই বেকার! যত্তসব!”
মুগ্ধ সশব্দে হেসে বললো,
“তা ঠিক!”
অরুণী রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গটগট করে ছাদ থেকে নেমে গেল। মুগ্ধ অরুণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বিরবির করে বললো,
“রেগে লাল হয়ে গেছে মেয়েটা! আজ যদি একটু অধিকার থাকতো, তাহলে আমি যে বাচ্চা না, সেটা প্রমান করে দিতাম!”

তরী ইদানীং পড়াশোনায় বেশ ব্যস্ত। এডমিশনের আর মাত্র একমাসের মতো সময় বাকি! পড়াশোনার মাঝে বেশ লম্বা একটা গ্যাপ পড়ায় এখন সব কিছুই নতুন লাগছে। তাই দিনরাত এক করে পড়েও দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাচ্ছে না তরী। রাতের বেশিরভাগ সময়ই বইয়ের পাতায় ডুবে থাকে সে। কিন্তু তরীর এই জেগে থাকা রাতগুলোয় একটু একা মনে হয় না। কারণটা হলো সৌহার্দ্য।

“আপনি ঘুমাবেন না?”
সৌহার্দ্য ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বললো,
“ঘুম আসছে না!”
তরী মুখ ভার করে বললো,
“আমি জানি, আমি রাত জেগে পড়াশোনা করি বলেই আপনি রাতে ঘুমান না।”

সৌহার্দ্য হেসে ফেললো তরীর কথা শুনে। ল্যাপটপ অফ করে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,
“আমার রাতের বেশিরভাগ সময় নির্ঘুম-ই কেটেছে এতো বছর। তোমার জন্য কয়েকদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছি। কিন্তু আসলে আমি রাতে তেমন ঘুমাই না। সারাদিন সময় না পাওয়ায় মেডিক্যাল রিসার্চের কাজগুলো রাতেই করতে হয়, বুঝেছো?”

তরী কিছু বললো না। হাই তুলে মুখ গোমড়া করেই আবার পড়ায় মনযোগ দিলো। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে হাতে একটা মগ নিয়ে এসে তরীর পড়ার টেবিলের ওপর রেখে বললো,
“কফিটা খেয়ে নাও। তাহলে আর ঘন্টাখানেক পড়তে পারবে। আর ঘুম পেলে শুয়ে পড়ো। আমি এখন একটু ঘুমাবো। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নাও। ঘরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছি।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৪

সৌহার্দ্য আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। তরী ল্যাম্পের আলোয় ধোঁয়া ছড়ানো কফিটার দিকে একবার তাকিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো কি তাকে সৌহার্দ্যের প্রতি দূর্বল করে ফেলবে? এই একটু যত্নে একটা মেয়ের মন এতো খুশি কেন হয়? ভেবেই অবাক হয় তরী।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৫