শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪
সুমাইয়া সুলতানা

দুপুরের রান্নার তোরজোর চলছে। নতুন বউ এসেছে বাড়িতে তেমন কাউকে না জানালেও নিজেরাই ছোট্ট করে বউ ভাতের দিনটাকে উদযাপন করবে। আয়মান আজকে ভার্সিটিতে যায়নি। বাড়িতেই থাকবে। মিনা বলে দিয়েছেন বিকেলে গিয়ে যেন আগুনের ফ্ল্যাট থেকে তার সকল জিনিসত্র নিয়ে আসে। এখন তার সেখানে জায়গা নেই। ভাই, ভাবি থাকবে। আয়মান বিনা বাক্যে মায়ের কথা মেনে নিয়েছে।

দ্বিমত করেনি। বাড়ি থেকে ভার্সিটিতে যেতে তার বেশি একটা অসুবিধা হবে না। প্রয়োজনে বাইক ইউজ করবে। ময়ূরীও প্রিন্সিপালকে ফোন করে আজকের দিনটির জন্য ছুটি নিয়েছে। রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। পায়েসটা হলেই সব রান্না কমপ্লিট। ময়ূরী সালাদ কে’টে প্লেটে রাখছে। মোমকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছেন না মিনা। নতুন বউ তাকে কাজ করতে হবে না। আরো সময় আছে। মিনার পর তো সংসারের হাল তাকেই ধরতে হবে। মোম শোনে না তার কথা। পাশে দাঁড়িয়ে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। মনে মনে খুশি হয় মিনা। রান্নার কাজ শেষ। ময়ুরী, মোম মিলে খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে। প্রচন্ড গরম পড়েছে। রান্না ঘরে থাকায় ঘেমে গিয়েছে তারা। মিনা মোমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” মোম মা তুমি গিয়ে গোসল করে নাও। ঘেমে কি অবস্থা হয়েছে দেখেছ? সেজন্যই বলেছিলাম তোমার রান্না ঘরে আসার দরকার নেই। শুনলে না আমার কথা। ”
” অসুবিধা নেই। গ্রামে থাকতে মা রান্না করার সময় তাকে হেল্প করতাম। ”
” তুমি রান্না করতে পারো? ”
” অল্প অল্প। ”
মিনা মুচকি হাসে। মেয়েটার মুখটা পুরাই মায়াবী। যে কেউ দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে। মোম চলে যায়। পেছন থেকে মিনা পুনরায় ডেকে উঠেন। মোম প্রশ্নসিক্ত নয়নে তাকায় শ্বাশুরির দিকে। মিনা বললেন,
” গোসল করে থ্রি পিছ পড়ো না। ভালো দেখে একটা শাড়ি পড়ো কেমন? ”

মোম মাথা নেড়ে চলে যায়। রুমে এসে চিন্তায় পড়লো। সে তো শাড়ি পড়তে পারে না। এখন কি হবে? মনমরা হয়ে গোসল করে কোনো রকম শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়েছে। বিছানায় বসে এক পা দুলাচ্ছে আর চিন্তা করছে এই অবস্থায় রুম থেকে বের হবে কি করে? এক্ষুনি হয়তো খেতে বসবে সবাই। তাকেও ডাকা হবে। কি করবে এখন মোম? মোম আগুনের রুমটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো মতো অবলোকন করছে। রাতে এসেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠলেও না’নান চিন্তায় ডুবে ছিল। রুমটা ভালো করে দেখাই হয়নি। শুধু রুম কেন? এই পুরো বাড়িটাই তো এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবে দেখা হলো না। আগুনের রুমটা বেশ পরিপার্টি। বুঝাই যাচ্ছে অগোছালো সে পছন্দ করে না। দেয়ালে আগুনের অনেক গুলো ছবি রয়েছে।

আয়মান ময়ূরীর সাথেও কয়েকটা ছবি রয়েছে। বন্ধুদের সাথে তোলা ছবি কেবল একটি। সবাই হাসি মুখে ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে। শুধু আগুনের মুখে হাসি রেশ পর্যন্ত নেই। চেহারায় তার কেমন গম্ভীর ভাব। এই লোকটা কি হাসতে পারে না? একটু হাসলে কি হয়? খাটাশ মার্কা লোক। মনে মনে ভেঙচি কা’টে মোম। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের সামনে নজর পড়ে। আগুনের একটা ছবি রয়েছে সেখানে। এই ছবিটাতে আগুনের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি রয়েছে। বসা থেকে উঠে ছবির ফ্রেমটা হাতে তুলে নেয়। পুনরায় বিছানায় বসে।

হাত দিয়ে ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকা আগুনের মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় সে। মোমের শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। আগুনের হালকা ছাটাই করে রাখা চাপ দাঁড়ি গুলো মোমের ভীষন পছন্দ হয়েছে। হালকা গোলাপি ঠোঁট গুলো কি চমৎকার। মনে হয় ঠোঁট দুটো আর্ট করা। মোমের ভাবনায় মোম নিজেই লজ্জা পায়। ছিঃ! এসব কি ভাবছিলো সে? দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই মোমের টনক নড়ে। দ্রুত হাতে থাকা ছবিটা জায়গা মতো রেখে দরজা খুলে দেয়। ময়ূরী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ময়ূরীকে দেখে মোমের বড় বড় পাপড়ি যুক্ত নয়ন দুটো চকচক করে উঠে। আর কোনো চিন্তা নেই। ময়ূরীই এখন তাকে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিবে। মোমের মুখের দিকে তাকিয়ে ময়ূরী দুষ্টু হেসে বলল,

” কি গো ভাবি? মুচকি মুচকি হাসছো কেন? রাতে ভাইয়া একটু বেশিই ভালোবাসা দিয়েছে নাকি? ”
সহসা মোমের হাসিটা মুছে গেল। এই ননদটা এমন কেন? ভারী দুষ্টো মেয়ে। ময়ূরী ভেতরে ঢুকে বলল,
” তাড়াতাড়ি চলে। মা খেতে ডাকছে। একটু পরে ভাইয়াও চলে আসবে। জলদি এসো। ”
মোম মুখটা ছোট করে রেখেছে। অসহায় চোখে ময়ূরীর দিকে চেয়ে বলল,
” আপু আমি তো ঠিক মতো শাড়ি পড়তে পারছি না। দেখো শাড়ির কি বেহাল দশা। মা বলেছেন শাড়ি পড়তে। অনেক বার চেষ্টা করেছি। পারছি না তো। এই অবস্থায় কিভাবে নিচে যাবো? ”

” ওহ। এই ব্যাপার? আরে এত টেনশন করার কি আছে। আমি আছি না। আমি তোমাকে পড়িয়ে দিচ্ছি। ”
মোম সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ময়ূরী সুন্দর করে মোমকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। সাথে একটু সাজিয়েও দিয়েছে। মোম মানা করেছিল কিন্তু ময়ূরী তার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে হালকা ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। মোমের পড়নের শাড়িটা খয়েরি রঙের। শাড়ির পাড়ে ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল। ঠোঁটে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে খয়েরি রঙের লিপিস্টিক দেওয়া। চোখে কাজল। মুখে হালকা মেকআপ। হাতে সাদা, খয়েরি রঙের মিশ্রনের রেশমি চুড়ি। কানে বিয়েতে দেওয়া এক জোড়া ডিজাইনার স্বর্ণের দুল। মাথার চুল ভেজা। লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে সেথায় প্লাস্টিকের তৈরী বেলি ফুলের গাজড়া জড়ানো। ব্যাস মোমকে সাজানো কমপ্লিট। অল্প সাজেই মোমকে পুরো অপসরা লাগছে। নাকের ছোট পাথরের নাকফুলটা তার সৌন্দর্য যেন আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মোমের থেকে সরে এসে একটু পিছিয়ে মিষ্টি হেসে গালে হাত দিয়ে ময়ূরী বলল,
” আল্লাহ! ভাবি তোমাকে যা লাগছে না দেখো আজকে ভাইয়া তোমাকে দেখলে একেবারে ফিট খেয়ে যাবে। ”

দুপুর তিনটে বেজে গিয়েছে। আগুন এখনো বাসায় আসেনি। ওর জন্য কেউ এখন পর্যন্ত খাবার খায়নি। আয়মান তাকে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে। রিং হচ্ছে তবে রিসিভ হচ্ছে না। রাশেদ গম্ভীর মুখো পায়চারি করছেন। তিনি বারবার বলে দিয়েছেন আজকে কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে। অথচ ছেলের কান্ড দেখো! এরই মধ্যে ডোরবেল বেজে উঠল। সেলিনা গিয়ে দরজা খোলে দিলেন। ওদের বাড়িতে কাজ করেন তিনি। আগুন এসেছে। ঘেমে যুবুথুবু অবস্থা। রৌদ্র থেকে এসেছে বিধায় ফর্সা মুখশ্রী কেমন লাল হয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে রাশেদ কাছে এসে গমগম কন্ঠে বললেন,

” কি পেয়েছটা কি তুমি? আমার পছন্দের পাত্রীর সাথে বিয়ে করিয়েছি বলে যা খুশি করবে? সবাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে? কোনো আক্কেল নেই তোমার? বলেছিলাম আজকে একটু জলদি বাসায় আসতে কিন্তু তুমি! তুমিতো কাউকে পরোয়াই করো না। তোমার জন্য যে বাড়ির মানুষ গুলো না খেয়ে আছে সেদিকে খেয়াল আছে? আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তোমার বউ তার কথাটা তো একবার ভাববে? মেয়েটার কাছে এই পরিবেশটা নতুন। স্বামী হিসেবে তোমার উচিত তাকে সঙ্গ দেওয়া। তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি সেটা নজর রাখা। ”

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে লম্বা শ্বাস নিলেন রাশেদ। আগুন ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকাল। বাইরে থেকে এসেছে এখন প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। রাগারাগি করতে ইচ্ছে করছে না। কিছুটা তিরীক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল,
” আমি কি বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করতে? তোমাদের খিদে পেলে তোমরা খেয়ে নিতে। আর কলেজে গেলেই নিজের ইচ্ছে মতো চলে আসা যায় না। সবকিছুর একটা রুলস আছে। তবুও তো চেষ্টা করেছি দ্রুত ফিরে আসার। ”
রাশেদ আরো কিছু কড়া কথা শোনা’নোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। স্বামীর মনোভাব বুঝতে পেরে মিনা আগুনের কাছে এসে বললেন,

” কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যা রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। ”
আগুন চলে গেল। সবাই খাবার টেবিলে নিজেদের জায়গায় বসে পড়েছে। পাশাপাশি দুইটা চেয়ার আর একটা আলাদা ভাবে চেয়ার খালি এখনো। ময়ূরীর চেয়ারের পাশে মোম দাঁড়িয়ে আছে। আগুন তাকে খেয়াল করেনি। করবে কিভাবে? এসেই তো নিজের রাগী লুক দেখাতে ব্যস্ত তিনি। রাশেদ মোমকে বসতে বললেন। মোম বসে না। শ্বাশুরিকে রেখে সে একাএকা খাবে না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মিনা সবাইকে খাবার দিচ্ছে। চিকেনে কামড় বসিয়ে আয়মান বলল,

” ভাবি নিশ্চই ভাইয়ার জন্য ওয়েট করছে। নতুন বউ লজ্জা পাচ্ছে বলতে। ঠিক বলেছি তো ভাবি? ”
আয়মানের কথায় মোম হা হয়ে গেল। সে তো এমন কিছুই ভাবেনি। ততোক্ষণে আগুন এসে পড়েছে। পড়নে ট্রাউজার আর খয়েরি রঙের টি-শার্ট। চেয়ারে এসে বসতেই আয়মান বলল,
” কি ব্যাপার ব্রো? আজকে ভাবি আর তুমি ম্যাচিং করে সবকিছু পড়েছো দেখছি। ভালো। খুব ভালো। ম্যাচিং না হলে দুজনের রোমান্স ঠিক জমবে না। ”
বুঝতে না পেরে আগুন গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” মানে? ”
” তুমি আর ভাবি সেইম কালারের ড্রেস পড়েছো সেজন্য বলেছি। ”

আগুন নিজের দিকে নজর বুলায়। সে এই টি-শার্টটা বের করেনি। বিছানার উপরেই ছিল। তাই এটাই পড়েছে। পরপর ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মোমের দিকে। অমনি তার দৃষ্টি জোড়া মোমে তে অনড় রইল। থমকে গেল চারপাশ। বক্ষতলে অদ্ভুদ ভাবে তীরের মতো কিছু একটা বিঁধলো যেন। স্নায়ুকোষে র’ক্ত চলাচল দ্রুত গতিতে হচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতিতে বক্ষস্থলে চলছে তীব্র আন্দোলন। চোখের মণিতে কেবল মোমের মুখশ্রী আটকে রইল। কে বলবে আগুনের সম্মুখে থাকা রমণীটি পনেরো বছরের বাচ্চা! তাকে দেখতে পূর্নাঙ্গ একজন নারী লাগছে। আগুনের কাছে অতি যত্নে করা বাগানের একটি ফুল মনে হচ্ছে মোমকে। যেই ফুলটির একমাত্র মালিক সে। ময়ূরী খাবার চিবোতে চিবোতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

” ভাইয়া খাবে না? খাবার তো ঠান্ডা হয়ে যাবে। ভাবিকে এখন এত দেখো না। খাবার খেয়ে নাও আগে পড়ে যত ইচ্ছা দেখো। ভাবিকে দেখলে তো আর পেট ভরবে না। ”
আয়মান, ময়ূরীর কথায় ফোড়ন কে’টে আগুনকে খোঁচা দিয়ে বলল,
” বুঝিস না! নতুন নতুন বিয়ে করেছে। ব্রো আমাদের সামনে জোড় করে বিয়ে করিয়েছ বললে কি হবে? মনে মনে ঠিকি ভাবিকে মনে ধরেছে ভাইয়ার। নয়তো বাবা-মার সামনে এমন ছ্যাবলার মতো বউয়ের দিকে কেউ চেয়ে থাকে? ”

ময়ূরীর ফিক করে হেসে ফেলে। মোম লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। অন্য সময় হলে মজা করার জন্য রাশেদ একটা রাম ধমক দিতেন ছেলেকে কিন্তু আগুনকে খোঁচানোর জন্য কিছু বলেননি। উল্টো খুশি হলেন। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। খাবারের সময় কথা বলা তিনি পছন্দ করেন না। ওদের কথায় আগুনের হুস ফিরে। মোমের থেকে নজর ফিরিয়ে নেয়। আয়মানের দিকে চেয়ে ধমকে বলল,
” খাওয়ার সময় এত কথা কিসের? চুপ করে খাঁ। নয়তো চাপকে গাল লাল করে দিবো বে’য়া’দপ। ”
ধমকে মৃদু কেঁপে উঠে মোম। ময়ূরীও চুপ করে খাচ্ছে। ভাই রেগে গেলে খবর খারাপ আছে। রাশেদ গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন,

” ওদেরকে ধমকাচ্ছে কেন? ছোট মানুষ একটু দুষ্টো’মিতো করবেই। হুটহাট রাগ কন্ট্রোল করতে শিখো আগুন। ”
মিনা এসে ছেলেকে খাবার দিলেন। আগুন তৈলাক্ত খাবার পছন্দ করে না। মা ভালোবেসে রেঁধেছেন খেতে তো হবেই। মিনার জোড়াজুড়িতে মোমও আগুনের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়েছে। খুব খিদে পেয়েছে তার। বেলা তে কম হলোনা। মোম অল্প অল্প করে খাচ্ছে। খাবার খাওয়ার মাঝে আড়চোখে আগুনের দিকেও তাকাচ্ছে। আগুন তার দিকে তাকাচ্ছে না। প্লেটের দিকে দৃষ্টি রেখে খাচ্ছে সে। পোলাউ, মাংস যেমন তেমন খেলেও পায়েশ এক বাটি ফুল খেয়েছে আগুন। মায়ের হাতের পায়েশ সব সময়ই তার পছন্দ। ভেসিনে হাত ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। তক্ষুনি পেছন থেকে আয়মান চাপা স্বরে বলে উঠলো,
” ব্রো তুমি একটা আনরোমান্টিক বয়। ভাবি তোমার জন্য কত সুন্দর করে সেজেছে। এটলিস্ট একটু প্রশংসা’তো করতে পারতে। দেখো এই আনরোমান্টিক হওয়ার জন্য বউ না আবার তোমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে চলে যায়। ”
ঘাড় ঘুরিয়ে আগুন কিছু বলবে, তার আগেই আয়মান তার নজরের বাইরে চলে গেল।

গুটিগুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করল মোম। রুম ফাঁকা। কোথায় গেল মানুষটা? রুমেই তো থাকার কথা। বেলকনির দরজা খোলা। মোম সেদিকে পা বাড়ালো। দোলনার মতো ঝুলন্ত এক চেয়ারে বসে আছে আগুন। অনেক ধীর গতিতে চেয়ারটা সামনে পিছে দুলছে। মাথাটা পেছন দিকে কিঞ্চিৎ হেলানো। চোখ বুঝে আছে। মুখে ক্লান্তির ছাঁপ। মোমের মায়া হয়। ইচ্ছে করছে বলতে, আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? আমি কি টিপে দিবো? কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। মোম আগুনের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য হালকা গলা খাঁকারি দিল। ফট করে বন্ধ চোখ দুটো খোলে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো তার দিকে। মোম ভরকে গেল। সে কি তাকে বিরক্ত করল? মানুষটা আবার রেগে যাবে না তো? নিশ্চই এখন ধমক দিবে। সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে আমতা আমতা করে বলল,

” আপনার কি শরীর ক্লান্ত লাগছে? ভেতরে এসে রেস্ট নিন। একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো লাগবে। ”
আগুন শান্ত নজরে মোমের দিকে চেয়ে আছে। এত গরমের মধ্যেও শাড়ি পড়ে আছে। মুখের সাজটাও তরতাজা। আচ্ছা, তাকে দেখানোর জন্যই কি মেয়েটা এখনো নিজের সাজ ত্যাগ করেনি। মোম কি চায় আগুন তাকে কিছু বলুক? তক্ষুনি আয়মানের কথাটা মাথায় ঘুরপাক খায়। আগুন হাত নেড়ে ইশারায় কাছে যেতে বলে। মোমের বুকে ধক করে উঠে। কাছে কেন ডাকছেন? মা’রবেন কি? কাঁপা কাঁপা পায়ে আগুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশে জায়গা দেখিয়ে আগুন গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” বসো। ”
মোম বসে পড়ে। মাথা নিচু করে আছে। পুনরায় গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো,
” এত কাঁপা কাঁপি করো কেন? সব সময়ই করো নাকি আমার সামনে আসলেই মৃগী রুগির মতো কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে যায়? কথায় কথায় মাথা নিচু করে ফেল কেন? আমার বউয়ের মাথা কেন নিচু থাকবে? আমার বউ মাথা উঁচু করে সকলের সামনে থাকবে। আর কক্ষনো এমন করতে যেন না দেখি। মনে থাকবে? ”
মোম কি বলবে। তার লজ্জা লাগে তাই এমন করে। আর কাঁপা কাঁপি তো তার ইচ্ছেতে হয় না। মানুষটাকে দেখলে তার আশেপাশে থাকলে ওর বুকের ভেতর অদ্ভুদ ভাবে কিছু একটা হয়। মোম ছোট করে বলল,

” জ্বি থাকবে। ”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আগুন বলল,
” আজকে এভাবে সাজার কারণ? ”
” জ্বি। ওই ময়ূরী আপু জোড় করে সাজিয়ে দিয়েছে। আমি মানা করে ছিলাম। আমার কথা শুনেনি। ”
বলেই মোম মন খারাপ করে বসে রইল। ওকে দেখতে কি ভালো লাগছে না? নয়তো মানুষটা একবারো সাজ নিয়ে কিছু বললো না কেন? ওর ভাবনার মাঝেই আগুন ভরাট স্বরে বলে উঠলো,
” ময়ূরী একদম ঠিক কাজ করেছে। নতুন বউ না সাজলে চলে? তবে সেই সাজটা যেন ব্যাক্তিগত মানুষটার জন্য হয়। ”
মোম বুঝলো না। ওর আবার ব্যাক্তিগত মানুষ কে? অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো,

” জ্বি? ”
এ পর্যায়ে আগুন বিরক্ত হলো। রাগ টুকু গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,
” বুঝতে হবে না। যাও রুমে গিয়ে ভারী কাপড় ছেড়ে রেস্ট নাও। ”
মোমের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। লোকটা কি বিরক্ত হলো তার প্রতি? মোম উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার জন্য কয়েক কদম বাড়াতেই শুনতে পেল গম্ভীর পুরুষটির নিরেট স্বর।
” তোমাকে ভীষন সুন্দর লাগছে মোম। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩

থমকে গেল রমিনীটির ছোট্ট বক্ষস্থল। সেই সাথে বাড়িয়ে রাখা কদম। মুহূর্তেই পেছনে ঘুরে দৃষ্টি রাখলো স্বামীর আদলে। সে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। ছোট্ট একটি বাক্যে মোমের মনে সুখের দোলা দিয়ে উঠল। মনের গহীনে সুখ পাখিরা উড়াউড়ি করছে। ছোটাছুটি করছে কিশোরী মনের চঞ্চল সত্তা। অজান্তেই চোখ থেকে ঝরে পড়লো সুখের এক ফোঁটা নোন জল। অধরের কোনে ধরা দিল কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি। ইশশ! গম্ভীর লোকটার মুখে তার প্রশংসা শুনতে এতটা মধুর কেন লাগছে? পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ থাকা স্বামী নামক মানুষটা বলে? হয়তো তাই হবে। নয়তো গ্রামে থাকতে কতশত ছেলেরা তার রুপের প্রশংসা করতো। কোথায়? তখন তো তার এতটা ভালো লাগা কাজ করেনি? অধরের হাসি বজায় রেখে চোখ বুঝে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিল মোম।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫