এক চিলতে রোদ পর্ব ৫৩ || Nondini Nila

এক চিলতে রোদ পর্ব ৫৩
Nondini Nila

চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ছারলাম। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে আমাকে শক্ত করে ধরে চাচি বসে আছে। আর হাসি হাসি মুখ করে সবার সাথে কথা বলছে। তাদের মেয়ে পছন্দ হয়ছে এবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমার ছেলে পছন্দ হয়েছে কিনা।

তারপর তারা বিয়ের কাজ শুরু করে দেবে‌। ভাইয়া আমায় সমস্ত বিপদ আপদে আগলে রেখেছে। আজ ও তিনি ঠিক আমাকে উদ্ধার করবে। সেই আশায় বসে ছিলাম। কিন্তু না ভাইয়া এলো না সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমি মাথা একবারের জন্য ও উঁচু করিনি। সবার জিজ্ঞেস করেছে আমার ছেলে পছন্দ হয়েছে কিনা। কিন্তু আমি উত্তরে একটা কথা ও বলিনি‌। চোখ তুলে তাকায় ও নি‌। যে ছেলেটাকে নিয়ে কথা হচ্ছে একবার ও তার দিকে তাকায় নি। আর তাকানোর ইচ্ছে ও নাই। সবাই আমার এসব দেখে অবাক হয়েছে। তা দেখে চাচি আমাকে দাঁত চেপে বলেছে,

‘ বিয়ে তো আজ দেবোই।’
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলেছে,
‘ লজ্জা পাচ্ছে। খুব লাজুক আমাদের ঊষা। ওর খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু মুখে বলবে না। লজ্জায় তো তাকাতে পারছে না বলবে কি করে?’
পাশথেকে কেউ বললো, ‘ এতো লজ্জা পেলে চলবে। আমরা তো আপন মানুষ হয়ে যাচ্ছি। একদম আমাদের লজ্জা পাবে না।’
আমি ফুঁপিয়ে কাঁদছি নিরবে। ভাইয়া আসছে না। তাহলে কি আজ ভাইয়া আসবে না।আমি কিভাবে এসব আটকাবো। নিরবে সব মেনে নেবো? কিন্তু কিভাবে এই বিয়ে করাতো সম্ভব না।আমি কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করবো। আমার জীবন তো ভাইয়ার সাথে জুড়ে গেছে। তাকে ছেড়ে অন্যত্র আমি বিয়ে করে নেবো।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

ভাইয়া নেই তাহলে কে আটকাবে এসব। কে রক্ষা করবে আমাকে। কারো আশা করা উচিত না। আমার নিজেকে নিজে‌ই হেফাজত করতে হবে। করতেই হবে। আমি কি করে একজন এর স্ত্রী থাকার পর ও আবার ও বিয়ে করবো। এসব ভাইয়া আগেই বলতে চেয়েছিলো আমি বলতে দেয়নি। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি।
আমার উপর সব থেকে অধিকার ভাইয়ার। তার জন্য হলেও আমাকে এর প্রতিবাদ করতে হবে। মুখ খুলতেই হবে।
সব সময় সব সহ্য করলেও এটা মানা টা অন্যায় হবে। সব সময় ভাইয়াকে কেন আমার আগলাতে হবে‌ আমার ও তো কিছু দায়িত্ব থাকে।
আমি চোখ বন্ধ করে সেই দিনটা কল্পনা করলাম।
তিন্নি আপুর বিয়ের দিন রাতে।

একেতে রাতের অন্ধকার তার উপর ঝড়ের কবলে পরেছি। দমকা হাওয়া এসে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। ভাইয়ার হাত খামচে ধরে ভয়ে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যাচ্ছে। চিকন সুরু রাস্তা দিয়ে। এই ঝড়ের মধ্যে ও আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পরি একটা জায়গায়। হালকা আলো জ্বলছে।আর সেখানে বসে আছে পাঁচ ছয় জন মধ্য বয়স্ক লোক‌। তাদের থেকে এক বাজে গন্ধ নাকে এসে লাগল। আমি হাত বাড়িয়ে নাক মুখ চেপে ধরে ভাইয়াকে বললাম,
‘ কি বাজে গন্ধ! এটা কিসের গন্ধ ভাইয়া?’
ভাইয়া কিছু বললো না। আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,,’ চল এখানে থেকে।’
আমি চোখ ছোট করে ওইদিকে তাকিয়ে আছি। একপা সামনে এগুতেই তীব্র আলো এসে পরলো আমাদের দিকে।সাথে ককর্শ গলায় আওয়াজ‌।
ভাইয়া পেছনে তাকালো না। আমাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। আমি বললাম,

‘ আমাদের ডাকছে কেন?’
‘ জানিনা‌’
‘ কথা না বলে যাচ্ছেন কেন?’
‘ এরা ভালো লোক না।এদের সাথে কথা বলার দরকার নাই‌’
আমরা থামছি না দেখে তাদের হাঁটার আওয়াজ পেলাম আর একটা বাজে কথা যা শুনে ইহান রেগে গেলো।
পেছনে থেকে বলেছে,’ কে রে তুই মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে এসেছিস নাকি? ভালো আমাগো ও সাথে নে একা কেন করবি।’

ইহান রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো কিন্তু থামলো না বরং হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। এরা মাতাল হয়ে আছে এদের সাথে টক্কর নিয়ে লাভ নেই সাথে অনেক জন এত জনের সাথে ভাইয়া পারবেও না একা‌।তাই এখানে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে তর্ক না করে সরে পড়াটাই বেটার মনে করছে।
কিন্তু আমরা যা চাই তা কি হয় লোক গুলো এক প্রকার ছুটে এসে ঘিরে ধরলো আর টর্চ জ্বেলে আমাদের মুখে ধরলো। তারপর একজন বললো,
‘ এদের কে তো শহরের লোক মনে হচ্ছে।’
বলে সবাই কথা বলতে লাগলো। ভাইয়াকে বললো আমি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কিনা‌। ভাইয়া না বলে খুব ভদ্র ভাবে তাদের বললো,

‘ আমাদের যেতে দিন আমরা একটা বিপদে পড়ে এদিকে ঘুরছি। আমাদের গাড়িতে তেল শেষ হ‌ওয়ায় আমরা তার সন্ধান করছি। তার উপর ঝড়ের বেগে বেড়ে চলেছে। আপনারা আমাদের ভুল….
ভাইয়ার কথা শেষ করতে দিলো না। একজন বলে উঠল,,,
‘আমাগো এইসব বলার দরকার নাই। আমরা জানি এমন কতো দেখলাম। সবাই এইসব‌ই বলে।’
‘ কে কি বললো আই ডোন্ট কেয়ার। আমি সত্যি বলছি।আর ও আমার গার্লফ্রেন্ড না হবু বউ।’
‘ এই আরেকটা মিথ্যা কথা।’
শুরু হলো তর্কাতর্কি হঠাৎ একটা লোক আমার কাছে এসে হাত ধরতে চাইলো। আমি ভয়ে ভাইয়াকে আরেকটু শক্ত করে ধরলাম।

ভাইয়া এটা দেখে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিলো। মাতাল লোকটা ভাইয়া ধাক্কা খেয়ে উল্টো হয়ে পরে গেছে। দুজন তাকে টেনে তুলতে গেলো আরেকজন ভাইয়ার সাথে লাগতে এলো। ভাইয়া নিচু হয়ে আমাকে ধরে দৌড় দিলো আমি ও দিলাম।
পেছনের লোক গুলোও আসছে। হুট করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আমাদের গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তখন পেছনে ধপাস করে পরার আওয়াজ পেয়ে থেমে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। একটা লোক পরে গেছে। আমার পেট ফেটে হাসি আসছে আমি হাসছি ভাইয়া বললো,
‘ হাসা অফ করে তারাতাড়ি চল এখানে বিপদ।’
বলে এগালো। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। তখন ভাইয়া একটা টিনের ছোট একটা বাসার মাটির উঠনে উঠে পরলো। অন্ধকার বাসা ঘরে থেকে একটু একটু আবসা আলো আসছে। বিদ্যুৎ নাই এই বাসায় বুঝা যাচ্ছে‌। আমাদের আওয়াজ হয়েছে সেটা শুনে ভেতরে থেকে কেউ কে কে বলে বেরিয়ে এলো। আর আমাদের অন্ধকারে ছায়ার মতো দেখে চোর বলে চিৎকার করে উঠল।

আমি আর ভাইয়া ভড়কে গেলাম। কিছু বলার আগেই পাশের বাসা থেকে দুজন পুরুষ মহিলা ছাতা হাতে লাইট নিয়ে এগিয়ে এলো। আর আমাদের দিকে ধরে বললো,
‘ আপনারা কে?’
বয়স্ক মহিলা চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে ওনাদের সব খুলে বলার জন্য এগিয়ে গেলো।
তখন বৃষ্টিতে ভিজে সেই ছয়জনের আগমন ঘটে ওইখানে। ভাইয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে। তারা আজেবাজে কথা বলতে লাগে। ছিঃ কি নোংরা কথা না বলে। আর একটা লোক এগিয়ে নিজের লুঙ্গি হাঁটু তে উঠিয়ে কাটা দেখায়। ভাইয়া নাকি ধরা পরে তাদের মেরেছে। ভাইয়া আর আমার নাকি আপনারাই বুঝে নেন। একটা ছেলে মেয়েকে নিয়ে কি বাজে কথা বলতে পারে।লোক গুলোর কথায় তারাও আমাদের ভুল বুঝে।

একজন মহিলা বলে,’ তোমাদের দেখে তো ভদ্র ঘরের লাগছে তা এই সব ছিঃ। শহরের ছেলে মেয়ে গুলো এই রকম‌ই খারাপ। এই মেয়ের তোমার গার্জেন কেমন হ্যা রাতে একা ছেড়েছে।’
লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। শীতে কাঁপছি একেতে তার উপর এসব। ভাইয়া তাদের অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে আর এটাও বলে আমাদের ইনগেজমেন্ট হয়েছে। আমরা কাজিন সব কিন্তু তারা মানছে না। বাজে কথা বলছে আবার পুলিশের কথা বলছে ভাইয়া বলে,

‘ ডাকেন পুলিশ। আমি ওর কাজিন। ওর হবু বর। এটাই সত্যি। কিন্তু আপনারা বিলিভ করছেন না। এই মাতাল দের বাজে কথা শুনে। ও তো আমার বাড়ি থাকে চাইলে সেখানেই সব করতে পারি এখানে আসার কি দরকার।’
ভাইয়া যুক্তি কানে নিলো না তাদের কথা আমাদের বিয়ে করতে হবে। একজন বলে,,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। পরে যেহেতু বিয়ে হবেই। তাহলে আজকে করলে কি সমস্যা?একটা ছেলে মেয়ে রাতে একসাথে চলাফেরা করলে এমন বাজে কথা ওঠেই। আর তোমাদের মত শহরের ছেলেমেয়েরা আগে ধরা পড়েছে। তোমরা সত্যি মিথ্যা যাই বলোনা কেন বিয়ে যদি করো তাহলে এসব নিয়ে জলটা বেশি দূরে আর গড়াবে না।’
ভাইয়া বলে,,,

‘ আমি বিয়ে করতে রাজি শুধু ওর আঠারো বছর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আপনারা যদি চান আমাকে আজকে ওকে বিয়ে করতে। আমার কোন সমস্যা নাই।একবার কেন হাজার বার বিয়ে করলেও আমার সমস্যা নাই এই একজন মানুষকে আমি হাজার বার বিয়ে করতে রাজি আছি।’
ভাই এত তাড়াতাড়ি রাজি হতে দেখে মাতাল লোক গুলো ভীতু হয়ে গেলো। তারা চেয়েছিল ভাইয়াকে শাস্তি দেবে কিন্তু তা হলো না। বৃষ্টি কমে এগারোটার দিকে। তারপর আমাদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয় এক হুজুর এর মাধ্যমে। পাশের বাসার সেই মহিলাটা আমাকে তার একটা শাড়ী দিয়েছিল পড়ার জন্য কারন আমার ড্রেসটা ভিজে গিয়েছিল। সারারাত তাদের বাসায় থাকতে হয়েছে।সারারাত আমি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই আমার মাথায় ঢুকলো না যেন। ভাইয়ের কোনো হেলদোল নেই সেই নিজের মতো আছে। পরদিন সকাল হতেই আমরা আবার নিজেদের ড্রেস পরে গাড়িতে আসি আর তারাই আমাদের গাড়ির তেল এর ব্যবস্থা করে দেয়। কিছুটা দূরে থেকে তেল সংগ্রহ করে আনে।

আমার হাত কেউ স্পর্শ করতেই চমকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম।
একটা মহিলা হাতে স্বর্নের বালা আমার হাতে পড়াতে চাইছে। আমি চমকে উঠলাম। আর কিছু না ভেবে আমি দাঁড়িয়ে পরলাম। আর চেঁচিয়ে বললাম,
‘ আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।’
আমার চেঁচিয়ে উঠা শুনে সবাই ভড়কে যায়। নতুন লোকগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে এতোক্ষণ চুপ করে থাকা আমি হঠাৎ এমন বজ্র কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠা দেখে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। চাচি চাচা দাঁড়িয়ে গেছে। চাচি আমাকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে। ফারিয়া রেগে তাকিয়ে আছে।এখানে লতা, ভাইয়া আর দিহান নাই‌। এতো কিছু হচ্ছে ছেলেটার পাত্তা নাই‌‌। আমি চাচির চোখ রাঙানি দেখেও থামলাম না। বলেই গেলাম।
চাচি সবার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আমার কাছে এসে বললো,
‘ কি হচ্ছে এমন সিনক্রিয়েট করছিস কেন? চুপচাপ বসে পর।’

এক চিলতে রোদ পর্ব ৫২

আমি জীবনের প্রথম চাচির সাথে উঁচু গলায় কথা বললাম। তার হাত আমার কব্জি থেকে ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললাম,
‘ চাচীঃ আমি বিয়ে করতে পারবো না জোর করে আমাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো না প্লিজ।আমি তোমার সব কথা শুনব কিন্তু এই কথাটা আমি কিছুতেই শুনতে পারব না মরে গেলেও না।’

এবার চাচির পেছনে চাচা এস আমাকে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের সুরে শাসাতে লাগলো। কিন্তু আমি থেমে গেলাম না সবার মুখের উপর কড়া কড়া কথা বলতে লাগলাম। চেচাতে লাগলাম। আমি বিয়ে কিছুতেই করবো না।আমার এমন সবার সামনে চেচানো দেখে। দেখতে আসা ছেলের বাড়ির লোক গুলো নাক মুখ কুঁচকে অপমান করে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।আমি একটা অভদ্র মেয়ে। আবার আমার অমতে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে এসব বল চাচিকে বকলো। তারপর তারা গটগট করে বাসা ছেড়ে থমথম মুখে চলে গেল। সেটা দেখেই চাচা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সোফায়। অপমানে তার মুখটা লাল হয়ে গেছে। ফারিয়া আমাকে না না কথা বল বকতে লাগলো। চাচি রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে গাল বরাবর ঠাস করে চড় মেরে বসলো।এতটাই জোরে চর দিয়েছিল যে আমি সোফার পাশে দাঁড়ানো ছিলাম বাম কাত হয়ে পড়ে সোফার হ্যান্ডেল এ বাড়ি গেলাম কপালে।

এক চিলতে রোদ পর্ব ৫৪