আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১ || লিখা: জাহান আরা

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১
লিখা: জাহান আরা

বন্ধুর প্রেমিকাকে তুলে আনতে গিয়ে ভুল করে অন্য মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছে শ্রাবণ ।
অজ্ঞান মেয়েটা শুয়ে আছে বিছানায়,পিছমোড়া করে হাত দুটো এখনো বেঁধে রাখা আছে।
টুথপিক দিয়ে শুয়ে শুয়ে দাঁত খুঁচিয়ে ভাবছে শ্রাবণ কি করা যায় এবার।মেয়েটার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তো কিছুই করা যাচ্ছে না।এই মেয়ের বাড়ি কোথায় তাও জানে না শ্রাবণ।
মেজাজ কিছুটা গরম হয়ে আছে।
শ্রাবণ ভেবে পায় না,এই মেয়েগুলো কি মাখে মুখে যে তাদের আসল চেহারাই খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় এই মেকাপের প্রলেপে।

কথা ছিলো পার্লার থেকে বের হলেই তামিমের প্রেমিকা রুবাকে নিয়ে আসবে।রুবা বের হবার সময় তামিমকে মেসেজ পাঠিয়েছে সে বের হচ্ছে।
শ্রাবণ ও ঠিক সেই সময় গাড়ি নিয়ে হাজির ছিলো,মেয়েটা বের হতেই টান দিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই। তারপর গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে মুহুর্তেই চলে আসে সবার চোখের আড়ালে।
রুবার সাথে বডিগার্ডের মতো দুই ফুফু এসেছে।বিয়েটা হচ্ছে তার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রুবার চলে আসা সম্ভব ছিলো না।রুবার বাসায় ও কড়া পাহাড়ায় আছে রুবা।এটাই শেষ সুযোগ ছিলো রুবার হাতে।
শ্রাবণ ২ দিন ধরে প্ল্যান করেছে কিভাবে রুবাকে নিয়ে আসবে।
কিন্তু নিজের প্ল্যানের বারোটা নিজেই বাজিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু শ্রাবণের কি দোষ!
রুবাকে সে একবার দেখেছে মাত্র,আর তার উপর পার্লারে ঢুকে মেয়েরা এক চেহারা নিয়ে,বের হয় অন্য চেহারায়।পার্লার থেকে বের হয়ে আসলে যেখানে মানুষ নিজের বউকেই চিনতে পারবে না সেখানে বন্ধুর বউ তো অনেক দূরে।
শালার,এই মেকাপের জন্যই তো এই গড়মিল হলো।

শ্রাবণের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তামিম,থেকে থেকে ফোঁসফোঁস করে ফুঁসছে। তামিমের মাথায় আইস ব্যাগ ধরে রেখেছে শাহেদ আর আরিফ।
ইমন আর জায়েদ হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটু পরপর।
কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তারা এতো বড় একটা ভুল শ্রাবণ কে দিয়ে হতে পারে।
শ্রাবণের মুখে কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই,কিন্তু ভিতরে ভিতরে চিন্তায় মরে যাচ্ছে শ্রাবণ। না জানি এই মেয়ের বাসায় এখন কি প্রলয় চলছে।
নিজেকে ধাতস্থ করে তামিম শ্রাবণ কে জিজ্ঞেস করলো,”এখন কি হবে?”
শ্রাবণ জবাব দিলো না,এই মুহুর্তে কোনো জবাব দিতে চায় না।মাথায় তামিমের প্রেমিকার বিষয়টা ও আছে,মেয়েটাকে বের করে আনতে হবে।কিন্তু কিভাবে করবে এটা?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জ্ঞান ফিরতেই শবনম পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো চারদিকে।তার সামনে বসে আছে ৬টি ছেলে,তাদের মধ্যে একজন মুখে ক্যাপ দিয়ে একটা ঠেলা গাড়িতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।মাথার নিচে এক হাত ভাঁজ করে রেখেছে,আরেক হাত দিয়ে টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে।
আরেকজনের মাথায় পালাক্রমে আইস ব্যাগ ধরে আছে দুজন।
বাকী দুজন একটু পর পর হাসছে।
জ্ঞান ফেরার পরেও শবনম কোনো সাড়াশব্দ করছে না।সে আগে ঘাপটি মেরে থেকে বুঝতে চায় এদের উদ্দেশ্য কী।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শবনম বুঝতে পারলো এরা ভুল করে শবনম কে তুলে নিয়ে এসেছে।সম্ভবত যেই ছেলেটার মুখে ক্যাপ দেয়া সেই তুলে এনেছে।
এবার শবনমের কনফিউশান ক্লিয়ার হয়েছে।
পুরো বিষয় টা শবনম আবার ভাবতে শুরু করেছে।
শবনমের মা শাহেদা শবনমের বিয়ে ঠিক করেছে তার চেয়ে ১৫ বছরের বড় এক বয়স্ক লোকের সাথে। বয়স্ক না বলে লোকটাকে মুরুব্বি ও বলা যায়।
শবনমের যথেষ্ট আপত্তি স্বত্ত্বেও মা বিয়ের আয়োজন করে ফেলেছে।
কয়েকবার ভেবেছে শবনম পালিয়ে যাবে কোথাও,কিন্তু কোথায় যাবে সেটা ভাবলেই পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে দেয় শবনম। তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই।

এতো বড় পৃথিবীতে মা ছাড়া শবনমের আর কেউ নেই।কিন্তু বিয়ের দিন যতোই এগিয়ে আসতেছিলো,শবনম ততই অস্থির হয়ে উঠছিলো।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠে তেমনি শবনম ও শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়ে যায় পালানোর জন্য।তাই সাহস করে শবনম প্ল্যান করেছে পালানোর। ঠিক করেছে পার্লার থেকে মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবে। তাই ব্যাগে করে বিয়ের শাড়ির সাথে তার জরুরি সব কাগজপত্র নিয়ে এসেছে। সারাজীবন অপছন্দের একটা মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে থেকে জীবন কাটানোর চাইতে রিস্ক নিয়ে পালানো উত্তম মনে হয়েছে।অন্তত বাকী জীবন আফসোস করতে হবে না তাতে তার।

কিন্ত তার পালানোর কাজটা আরো সহজ করে দিয়েছে ক্যাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা ছেলেটা। শবনমের মনে আছে প্রথমে সে প্রায় ভয়ে জমে গিয়েছে।আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার শুরু করেছে। তখনই ছেলেটা একটা রুমাল দিয়ে তার নাক চেপে ধরে। তারপর আর মনে নেই শবনমের কিছু।
“আমি পানি খাবো।”
মেয়েলি কণ্ঠ শুনে প্রথমে সবাই চমকে উঠে। পরক্ষণেই দেখতে পায় মেয়েটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।শাহেদ এক বোতল পানি এগিয়ে দেয়।
শবনম কিছুটা বিরক্ত হয়।মনে মনে একটা খারাপ গালি দেয় ছেলেটাকে।
শবনম কিছু বলার আগেই শ্রাবণ বলে উঠে,”মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলে দে,পানি খাইবো কেমনে নাইলে?”

শাহেদ হাতের বাঁধন আলগা করে দিতেই শবনম পানি খায় ঢকঢক করে। ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় দুপুর ১ টা।
শ্রাবণ শবনমের সামনে এসে বসে।তারপর কিছুটা অপরাধীর মতো বলে,”দেখেন,যা ঘটেছে পুরোটাই ভুল বুঝাবুঝি। আমি তামিমের গার্লফ্রেন্ডকে তুলে আনতে গিয়ে আপনাকে নিয়ে এসেছি।
আপনার বাসা কোথায় আমাকে বলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো আপনাকে।”
শবনমের গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলো মুহূর্তেই এই কথা শুনে।
বলে কী এই ব্যাটা?
যেই নরক থেকে সে পালিয়ে এসেছে আবারও কি-না তাকে সেই নরকে রেখে আসবে!
শবনম কে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রাবণ আবারও জিজ্ঞেস করলো।

ভাবনা চিন্তা করে শবনম জবাব দিলো,”আমি বাসায় যাবো না।হয়তো ভুল করে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি,কিন্তু তারজন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।আমি নিজেই পালাতাম। আপনি তো আমার কাজটা আরো সহজ করে দিয়েছেন।”
সবাই হা হয়ে তাকিয়ে রইলো শবনমের দিকে।
শ্রাবণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। শবনম মুচকি হেসে বললো,”আমাকে নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না।আমি আপনাদের বিপদে ফেলতে চাই না।আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নিবো।আপনারা বরং যাকে তুলে নিয়ে আসতে চেয়েছেন তাকে নিয়ে আসেন।”
রুবার কথা মনে পড়ে গেলো আবারও শ্রাবণের। কিন্তু মাথায় কোনো প্ল্যান কাজ করছে না।সময় ও বসে নেই।হয়তো একটু পরেই বিয়ে হয়ে যাবে রুবার।

ঠিক সেই মুহূর্তেই তামিমের ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠলো রুবার নামটা।
উচ্ছ্বসিত হয়ে তামিম ফোন রিসিভ করলো।ও পাশ থেকে রুবার কান্না ছাড়া কিছুই শুনতে পেলো না।কান্না থামিয়ে রুবা যা বললো তার সারসংক্ষেপ হলো,”আমি যখন বের হচ্ছি বলে তোমাকে মেসেজ দিয়েছি ঠিক তখনই ফুফু এসে আমার হাত টেনে ধরে আমাকে আটকায়।তারপর আমাকে বসে থাকতে বলে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে যায়।বাবা ফুফুকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলো যে পার্লার থেকে বের হওয়ার সময় হয়তো আমি পালিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করতে পারি।তাই বাবা নিজেই আসবেন আমাদের নিতে।

আমি তাই বের হচ্ছি বলেও আর বেরুতে পারি নি।বাবা এসে তারপর আমাকে নিয়ে আসে।এই মাত্র আমি আমার ফোন হাতে পেয়েছি।
বরপক্ষ বাসারকিন্তু এখন আমি কি করবো?”
তামিম কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ফোনের লাউডস্পিকার অন থাকায় সবাই শুনতে পাচ্ছিলো রুবার কথা।
ওপাশে কারো আসার শব্দ পেয়ে রুবা ফোন রেখে দিলো।তামিমের মুখে পরাজয়ের চাপ ফুটে উঠেছে।

রুবার মা রাবেয়া রহমানের মনটা আজ অস্থির হয়ে আছে। তিনি ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। পেন্ডুলামের মতো তার মন দুলছে দুদিকে।রুবার বাবা আশরাফুল হক সমাজের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি।অর্থবিত্তের অভাব না থাকলেও লোকটার মধ্যে বিচক্ষণতার যথেষ্ট অভাব আছে।নয়তো মেয়ের বিয়ে ঠিক করতেন না নিজের বোনের ছেলের সাথে।যেখানে ছেলেটা আগে এক বিয়ে করেছে।

রুবা দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে। তিনি গিয়ে রুবার কাঁধে হাত রাখলেন।রুবা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলেন মেয়ের চোখ টলমল করছে। মা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুবা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বসে গেলো।
মেয়ের কান্না আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি।সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যা হবার হবে,তবু মেয়ের মনে কষ্ট দিবেন না।রুমের দরজা বন্ধ করে রুবাকে বললেন,”তামিমকে কল দে,৫ মিনিটের মধ্যে যেনো বাসার সামনে চলে আসে।তুই বিয়ের শাড়ি খুলে একটা ড্রেস পরে নে,আমার বোরকা এনে দিচ্ছি তোকে,সেটা পরে নিস জলদি।”

মায়ের কথা শুনে রুবা হা হয়ে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না তার।মা সত্যি সত্যি তাকে….!
কিন্তু প্রশ্ন না করে জলদি তামিমকে ফোন দিলো।তারপর তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে গেলো থ্রিপিস পড়ে।

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ২