আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১১ || লিখা: জাহান আরা

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১১
লিখা: জাহান আরা

৬ মাস পর……
টানা চারদিন প্রলয়ের রুমের দরজা বন্ধ।শবনমের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে যেনো।কি হয়েছে মানুষটার?
একবার ও কেনো বের হচ্ছে না রুম থেকে।রাহেলা বানু মাঝেমাঝে দরজার সামনে গিয়ে ডাকেন প্রলয়,প্রলয় করে।
কিন্তু প্রলয় দরজা খোলা না।
রাহেলা বানু আগেও দেখেছেন ছেলের এরকম অভ্যাস তাই আর বেশি অস্থির হন নি।তবুও মনের মধ্যে একটা খুতখুত রয়ে গেছে।
কেনো এরকম করে প্রলয়?

শবনম এই চারদিন খাওয়া দাওয়া করতে পারে নি ঠিক মতো।
সোফায় বসে প্রলয়ের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে শবনম। রাহেলা বানু স্কুলে গিয়েছেন নাতনীদের নিয়ে।
শবনম অপলক তাকিয়ে দেখছে দরজাটা।
হঠাৎ করেই দরজা খুলে প্রলয় বের হয়ে এলো।
শবনমের দেহে যেনো প্রাণ ফিরে এলো।
ইচ্ছে করছে এক ছুটে গিয়ে প্রলয় কে জড়িয়ে ধরে।
প্রলয় ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।শবনমের দিকে ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”এক কাপ চা খাওয়াবে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিনা তর্কে শবনম উঠে গেলো।চা এনে প্রলয়ের সামনে রাখলো।
চা খেয়ে প্রলয় কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো।
তারপর শবনমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি যদি তোমাকে একটা রিকুয়েস্ট করি,তুমি কি রাখবে?”
শবনম বলে ফেললো,”আপনি আমাকে বিষ খেতে বললে আমি তাও খাবো,আপনার এক কথায় আমি প্রাণ বাজি রাখতে রাজি।বলেন আপনি।”
প্রলয় চোখ বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তারপর বললো,”শ্রাবণকে মনে আছে তোমার?”
শ্রাবণ!

শবনমের মনে পড়ে গেলো শ্রাবণের কথা।লম্বা,ফর্সা সেই ছেলেটা।যে সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকে।শবনমের জীবন যার কারনে বদলে গেছে।
মাথা নেড়ে সায় দিলো শবনম।
“শ্রাবণের সাথে যদি আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করি?”
মুহুর্তেই শবনমের মনে হলো তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে।
কি বললো প্রলয় এটা?
কিভাবে পারলো এরকম নিষ্ঠুর একটা কথা বলতে শবনমকে?
একটু কি বুক কাঁপে নি প্রলয়ের?

শবনম কাঁপাকাঁপা গলায় জবাব দিলো,”আমি তো আপনাকে….. ”
কথা শেষ করতে পারে নি শবনম।তার আগেই প্রলয় বলে উঠলো,”আমাকে শ্রাবণী ভালোবাসে,প্রচন্ড ভালোবাসে।আর আমার পক্ষে সম্ভব না কাউকে ভালোবাসা।যদি ভালোবাসতামই তবে আমি শ্রাবণী কে ভালোবাসতাম।এতো ভালোবাসা পায়ে ঠেলা যায় না।
কিন্তু ভালোবাসার উপর আমার বিশ্বাস নেই।
আমি কাউকে নিজের জীবনে আনতে চাই না।”
প্রলয়ের এরকম নিষ্ঠুর কথা শবনমের সহ্য হলো না।মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে পাষাণ মানুষটা তার সামনে বসে আছে।
কাকে ভালোবাসলো সে?
এরকম একটা নির্দয় মানুষকে?

এই মানুষটাকেই কি-না শবনম ভেবেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ!
“তোমার এতোবড় একটা উপকার করেছে যেই ছেলে তার কাছে তো তুমি ঋণী।তার ঋণ পরিশোধ করার জন্য হলেও তো তোমার উচিৎ ওর স্বপ্ন পূর্ণ করা।”
প্রলয় উঠে গেলো শবনমের সামনে থেকে।শবনম নির্বাক হয়ে বসে আছে।
এতোবড় ধাক্কা খাবে শবনম ভাবে নি?
সেদিন বিকেলেই শ্রাবণের বাবা মা এলো প্রলয়দের বাড়ি।বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।শবনম নির্বাক হয়ে বসে আছে নিজের রুমে।

শবনমের মা শাহেদা ও এসে হাজির।শাহেদা বেগম শবনমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
শবনম কিছু বললো না।সমস্ত ভাবাবেগের উর্ধ্বে চলে গেছে যেনো শবনম।
শাহেদা বেগম রাহেলা বানুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর বলছেন,”আমার মেয়ের ভাগ্য এতো ভালো হবে আমি ভাবি নি আপা।আল্লাহ আমার মেয়ের ভাগ্যে এতো বড় ঘরের বউ হওয়া রেখেছে আমার ভাবনাতে ছিলো না।
আমি মেয়ের কপালে বুঝি আল্লাহ এতো সুখ রেখেছে।”

রাহেলা বানু শাহেদা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন।তার মুখে হাসি।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শবনমের বিয়ের সব দায়িত্ব তার।সব খরচ তিনি বহন করবেন।
শ্রাবণের বাবা মা এসে রিং পরিয়ে গেলো শবনমকে।
২দিন পর শুক্রবারে বিয়ের দিন ঠিক করা হলো।
এতো দ্রুত এতোকিছু হয়ে যাবে শবনমের ভাবনাতেও ছিলো না।একদিনের মধ্যেই এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো!
তবে কি প্রলয় আগে থেকেই সব প্ল্যান করে রেখছিলো।
কাঁদলো না শবনম। কিছুতেই কাঁদবে না।
ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে,সেই ভুল মানুষের জন্য নিজের চোখের পানি ফেলবে না শবনম।
রাতে শ্রাবণ ফোন দিলো শবনমকে।

৩ বার ফোন বেজে বেজে থেমে গেলো।শবনম রিসিভ করলো না।
আবার ফোন দিলো শ্রাবণ। শবনম রিসিভ করে চুপ করে রইলো।
শ্রাবণ একদমে বলতে লাগলো,”হ্যালো,হ্যালো।শবনম, শবনম।
কথা বলো শবনম।
আজকে আমার সাথে একটু কথা বলো শবনম। ”
“বলেন।”
“একটু বারান্দায় আসবে শবনম? ”
“কেনো? ”
“আসো না,প্লিইইইইজ……”

ভীষণ বিরক্ত হলো শবনম। তবুও বিরক্তি চেপে রেখে বারান্দায় গেলো।
একটা একটা করে বেলুন উড়ছে বারান্দার সামনে। সবগুলো বেলুনে একটা একটা শব্দ লেখা।বেলুনের ভিতর লাইট জ্বলছে।
শবনম চুপ করে তাকিয়ে দেখছে,সবগুলো বেলুন একসাথ করলে লেখাটা হবে,”শবনম,ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।”
হাসি পেলো শবনমের।
কি বাচ্চামি করছে ছেলেটা!
তারপর পরই একটা সাদা পায়রা উড়ে এলো শবনমের কাছে।পায়রার পায়ে একজোড়া পায়েল বাঁধা,সাথে একটা চিরকুট।

শবনম খুলে হাতে নিলো।চিরকুটে লিখা,”শবনম,
নাকটি যেন ছোট বাঁশি। ওইটুকুন বাঁশিতে কী করে দুটো ফুটো ফুটো হয় জানি নে। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মতো লাল টুকটুকে, তবে তাতে এমন একটা শেড রয়েছে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা রুজ দিয়ে তৈরি নয়। চোখ দুটি নীল না সবুজ বুঝতে পারলুম না। পরনে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উঁচু হিলের।

আমার লিখা না এটা।সৈয়দ মুজতবা আলী তার বিখ্যাত প্রেমের উপন্যাস শবনমে,শবনমের রূপের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন এটা।আমি শুধু আশ্চর্য হচ্ছি এটা ভেবে যে,উনি কিভাবে জানলেন আমার শবনম এরকম।আমার শবনমের রূপের বর্ণনা এতো বছর আগে তিনি দিয়ে গেলেন কিভাবে তার শবনম উপন্যাসে?

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১০

তবে কি,তুমিই ছিলে তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা আর আমিই তোমার মজনুন?তুমি বলেছিলে, “বাড়িতে থেকো,আমি ফিরবো।”
আমি এতো বছর তো সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম।শবনম,এখনো কি তোমার সময় হয় নি বাড়ি ফেরার?
আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা গ্রহণ করে ফিরে আসো শবনম।
আমি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছি তোমার পানে শবনম।
আর কতো অপেক্ষায় রাখবে?”

শবনম চিঠির পালটা জবাবে লিখলো,”আর বেশিদিন থাকতে হবে না।শীঘ্রই ফিরবো।”
পায়রা উড়ে গেলো চিঠি নিয়ে।শবনমের বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো।
কোথায় যেনো পড়েছিলো,”তাকে কষ্ট দিও না,যে তোমাকে ভালোবাসে।”
কিছুতেই কষ্ট দিবে না শবনম শ্রাবণকে।
প্রলয় দেখুক কি ভীষণ ভালোবাসা শবনম দিতে পারে কাউকে।
হিংসে হোক প্রলয়ের শবনম আর শ্রাবণের ভালোবাসা দেখে। অনন্ত প্রলয় কে কষ্ট দেয়ার জন্য হলেও শবনম ভালোবাসবে শ্রাবণ কে।
ভীষণ ভালোবাসবে…….

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১২