আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ৩
লিখা: জাহান আরা
ফজরের আজান শুনে রাহেলা বানু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন।মনে যেটুকু সন্দেহ ছিলো সেটাও ক্লিয়ার হয়ে গেছে এখন।
তিনি ভেবেছিলেন শ্রাবণ আর মেয়েটার মধ্যে যদি কোনো সম্পর্ক থাকে,রাতে নিশ্চয় শ্রাবণ একবার হলেও মেয়েটার কাছে যাবে।
অল্পবয়সী আবেগ তার ভালোই জানা আছে।
কিন্তু সারারাত জেগে থেকেও তেমন কিছুই দেখলেন না।না শ্রাবণ রুম থেকে বের হয়েছে,না শবনম বের হয়েছে।
ওদের মধ্যে আসলেই যে কোনো সম্পর্ক নেই সেই ব্যাপারে এবার সম্পূর্ণ নিশ্চিত তিনি।
সকালে শবনমের ঘুম ভাঙ্গলো দুটি বাচ্চার চিৎকার চেচামেচি শুনে।কি তারস্বরে চিৎকার করছে ওরা।শবনম বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলো বাচ্চাদের কাছে।
শবনম কে দেখে বাচ্চারা চুপ হয়ে গেলো।অচেনা মানুষের সামনে ওরা যথেষ্ট ভদ্র হয়ে থাকে।
শবনম কে দেখে রাহেলা বানু এগিয়ে এলেন।হাসি মুখে বললেন,”এই দুজনেই তোমার ছাত্রী,এদেরকেই পড়াতে হবে তোমার। ”
মিষ্টি হেসে শবনম জিজ্ঞেস করলো,”কি নাম তোমাদের? ”
“আমি অশ্রু আর ও বিন্দু।”
শবনম রাহেলা বানুকে জিজ্ঞেস করলো,”ওদের মা কোথায়?”
রাহেলা বানুর মুখ কালো হয়ে গেলো এই প্রশ্ন শুনে।জবাব না দিয়ে চলে গেলো।
শবনম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রাহেলা বানুর গমন পথের দিকে।এদের সবকিছুই কেমন খাপছাড়া লাগছে শবনমের কাছে।
কিছুক্ষণ পর রাহেলা বানু আবার ফিরে এলেন,তারপর শবনমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন একটা রুমের দিকে।
একটা আলমারির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,”এই আলমারিতে যা আছে,জামাকাপড়,কসমেটিকস সব কিছুই তোমার।এই রুমটাও তোমার।আর যদি তোমার আপত্তি না থাকে তবে তুমি আমার কাছেই থাকবে। অন্য কোথাও থাকার দরকার নেই তোমার।”
শবনম কিছুটা অবাক হলো শুনে।তবুও কিছু বললো না।সব কিছুরই একটা উপযুক্ত সময় লাগে,তাই খালাকে আর অযথা প্রশ্ন করে বিব্রত করতে ওর মন সায় দিলো না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রাহেলা বানু চলে যেতে শবনম রুমটা দেখতে লাগলো।বিরাট একটা রুম,সামনে বিশাল বারান্দা।বারান্দায় অনেকগুলো খালি টব পড়ে আছে।শবনম বুঝতে পারলো এক সময় এই রুমে কেউ একজন থাকতো যে এই টবে থাকা গাছের যত্ম নিতো।কিন্তু সেই মানুষটির অনুপস্থিতিতে সব শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।
আলমারি খুলে দেখলো আলমারি বোঝাই জামাকাপড়। ১০ বছর ধরে ব্যবহার করলেও শেষ হবে না এসব।
দেখে শুনে শবনম একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি বের করলো।তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো গোসল করতে।সকালে গোসল না করলে শবনমের সারা দিন কেমন অস্বস্তিতে কাটে।নিজেকে কেমন অপরিচ্ছন্ন মনে হয়।
শ্রাবণ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে এলো।সোফায় পা তুলে দিয়ে বসে চিৎকার করে বললো,”মর্জিনা আপা,এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।”
ভিতর থেকে মর্জিনা জবাব দিলো,”আরো আগে কইতে পারস নাই চা খাবি যে?
পারুম না আমি অখন,চায়ের কেটলি নামাইয়া রাখছি,আমি তরকারি কাটতেছি,হাত খালি হইলে চা পাবি।আমি অখন বিরাট বিজি।”
শ্রাবণের গলার স্বর শুনতে পেয়ে অশ্রু,বিন্দু দুজনেই ছুটে এলো ড্রয়িং রুমের দিকে। শ্রাবণ কিছু বুঝে উঠার আগে ঝাঁপিয়ে পড়লো দুজনেই।
দুজনকেই শ্রাবণ জড়িয়ে ধরলো দুই হাতে,এদের কাছে পেলে শ্রাবণের বুকের ভিতর কিসের যেনো ভাঙচুর শুরু হয়ে যায়।কি সুন্দর দুটি বাচ্চা অথচ মা বাবা কেউ নেই।
বিন্দু বললো,”তুমি দাঁত ব্রাশ করেছো মামা চা খেতে চাচ্ছো যে?”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে বললো,ব্রাশ করে নি।
জ্ঞানী মানুষের মতো মাথা নেড়ে দুই বোন সমস্বরে বললো,”ছিঃ মামা,তুমি জানো না,সকালে আর রাত দাঁত ব্রাশ না করলে জার্মস হয়?”
শ্রাবণ বললো,”আল্লাহর দেয়া কতো জার্মস পেটের ভিতর নিয়া ঘুরতেছি,আর তোরা আসছস এখন দাঁতে জার্মসের খবর নিয়ে?”
অশ্রু বললো,”মামা,তুমি এতোদিন এলে না কেনো?
তুমি জানো না তোমাকে আমরা কতো মিস করি?”
শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,”কতো মিস করো? ”
বিন্দু দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দেখালো,এতো মিস করি।কিন্তু তারপর নিজেই নিজের উপর সন্তুষ্ট হতে না পেরে অশ্রুর হাত ধরলো নিজের বাম হাত দিয়ে,তারপর আবার দুজন দুজনের হাত প্রসারিত করে বললো,”এই যে দেখো,এতো বেশি মিস করি।”
শ্রাবণ দুজনকে কোলে তুলে নিলো।
বিন্দু অভিযোগের সুরে বললো,”তুমি ও নেই,প্রলয় মামা ও নেই,আমাদের ভাল্লাগেনা কিছু।কেউ আমাদের নিয়ে খেলে না।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে জবাব দিলো,”এজন্যই তো তোমাদের জন্য এক নতুন এক আন্টি নিয়ে এসেছি আমি,সে তোমাদের পড়াবে,তোমাদের সাথে খেলবে।”
পড়ার কথা শুনে দুই বোনেই বিরক্ত হলো,ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,”না মামা,আমরা পড়বো না।আমরা শুধু খেলবো।”
“ওকে ওকে,আজকের জন্য পড়া বন্ধ,আজকে আমি তোমাদের স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে দিলাম।”
দুজনে এতোটাই খুশি হলো স্কুল বন্ধের কথা শুনে যে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
শ্রাবণের দুই গালে দুই চুমু দিয়ে দুই বোন ছুটলো নিজেদের রুমের দিকে।
গোসল শেষ করে শবনম রুমে থেকে বের হতে গিয়ে শুনলো শ্রাবণ চিৎকার করে মর্জিনাকে বলছে,”মর্জিনা আপা,তুমি নিজেকে কি মনে করো হ্যাঁ?
তুমি কি ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি হ্যাঁ?
তোমার থেকে চা পেতে হলে আমাকে আগে এপয়েন্টমেন্ট করিয়ে রাখতে হবে?
খেলাম না তোমার চা,ফুডপান্ডাতে অর্ডার দিলে এক কাপ কেনো,বালতি বালতি চা এনে দিবে।আমি এখনই ফুডপান্ডায় চা অর্ডার দিচ্ছি।
আর খালাকে বলে তোমার চাকরি আমি নট করে দিবো,তুমি এই শ্রাবণের লগে হাঙ্কিপাঙ্কি করছো মর্জিনা আপা।”
ভিতর থেকে মর্জিনা জবাব দিলো,”শ্রাবইন্নার বাইচ্চা,তুই খালার কাছে যা মন চায় তা ক গিয়া যা,আর বালতি ক্যান,তুই দরকার হইলে ড্রামে ড্রামে চা অর্ডার কইরা আন,চায়ের মইধ্যে গিয়ে ডুব দে,এই মর্জিনা তোর হুমকি রে ভয় খায় না।”
শ্রাবণ বুঝলো এভাবে কাজ হবে না।তাই কণ্ঠে যথেষ্ট মধু ঢেলে বললো,”কি যে বলো মর্জিনা বুবু,কোথায় তোমার হাতের চা আর কোথায় ফুডপান্ডার চা,দেখা গেলো আমি অর্ডার দিলাম এখন,চা আসবে ভোররাতে। আর তোমার হাতের চায়ের সাথে কি তুলনা করা চলে?
তোমার হাতের দুধ চায়ের যেই টেস্ট!
আহা!
কি বলবো আর!
অসাধারণ,অমৃত যেনো!
আমি তো ঠিক করেছি খালার বাসার নিচে একটা চায়ের দোকান দিবো,তুমি আর আমি শেয়ারে,আমি মোটামুটি শিওর এক বছরের মাথায় আমরা লাখপতি হয়ে যাবো।তুমি চা বানাবে আমি ধরো ওয়েটারের কাজ করলাম,দোকানের নাম হবে “মর্জিনা টি স্টোর”
আমি স্পষ্ট দেখতেছি আমাদের দোকানের চা খেতে মানুষের ভীড় লেগে যাবে।”
লম্বা ভাষণ দিয়েও কোনো লাভ হলো না।মর্জিনা চা নিয়ে এলো না।শবনম রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে গেলো,তারপর দুইকাপ চা বানিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
শ্রাবণ পেপার পড়ছে আর মর্জিনার কাছে অনুনয় বিনয় করছে এক কাপ চা দিতে।
শবনম গিয়ে চায়ের কাপ টেবিলে রাখতেই শ্রাবণ কাপ টেনে নিলো।
এক চুমুক খেয়েই বললো,”আহ!
কি টেস্ট! ”
আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ২
পত্রিকার পাতা থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো সামনের সোফায় শবনম বসে চা খাচ্ছে,শবনম কে দেখে শ্রাবণ থতমত খেয়ে গেলো ।
শবনম কে দেখে মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ সকাল যেনো,কেমন কোমল আর পবিত্র লাগছে মেয়েটাকে।নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামের বিন্দুগুলো যেনো ঘাসের বুকে জমে থাকা ভোরের শিশির। সবুজ রঙের শাড়িতে শবনম কে লাগছে প্রতিমার মতো। কি সুন্দর কাজল কালো দুটো চোখ,গায়ে একটা লাল রঙের চাদর।
নিজের দিকে তাকালো শ্রাবণ,তারপর চায়ের কাপ ফেলে রেখে এক দৌড় দিলো রুমের দিকে।রাতে লুঙ্গি পরে শুয়েছিলো,সেই লুঙ্গি পরা অবস্থায় সে সোফায় গিয়ে বসেছিলো এতোক্ষণ।
রুমে এসে শ্রাবণ তাড়াতাড়ি প্যান্ট পরে নিলো।
ভিতর থেকে কে যেনো ফিসফিস করে বলে উঠলো,”প্রেমে পড়ে গেছো শ্রাবণ,কঠিন প্রেমে পড়েছো তুমি।”