আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ৯ || লিখা: জাহান আরা

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ৯
লিখা: জাহান আরা

শবনম কিছু বলার আগেই প্রলয় বললো,”আমার বোন বন্যার কবর এটা।তুমি যেই রুমে থাকো,তা আপার রুম।”
শবনম বুঝতে পারলো খালার এভাবে রিয়েক্ট করার কারন কি সেদিনের।
বসুন্ধরাতে গিয়ে প্রলয় শবনম কে জিজ্ঞেস করলো,”কি কি পছন্দ নাও তুমি”
শবনম জবাব দিলো,”আমার কিছু লাগবে না।”
প্রলয় আর কথা বাড়ালো না।নিজের পছন্দ অনুযায়ী শবনমের জন্য ৪টা শাড়ি নিলো,শ্রাবণীর জন্য দুটো নিলো।

কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো দুজন।
শবনম কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে প্রলয় কে দেখছে।
আবার চোখাচোখি হবার ভয়ে চোখ নামিয়ে রাখছে।
প্রলয় সবই খেয়াল করলো।একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো প্রলয়ের ঠোঁটে।

শ্রাবণী খালার রুমে গিয়ে দেখে খালা কেমন ঝিম মেরে বসে আছে।খালার এভাবে বসে থাকার কারন কি হতে পারে শ্রাবণী খুঁজে পেলো না।
কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর শ্রাবণী বুঝতে পারলো,প্রলয় ভাই হয়তো বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে তাই খালার মন খারাপ।
প্রলয় ভাইকে নিজের করতে পারে নি বলে শ্রাবণী যে কষ্ট পেলো তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেলো খালাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে।

ভীষণ রাগ হলো শ্রাবণীর প্রলয় ভাইয়ের উপর।
খালার তো একটা মাত্র ছেলে,অথচ সেও কি-না মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করেছে।
অথচ শ্রাবণী ভাবতো প্রলয় ভাই অত্যন্ত ভদ্র,মায়ের জন্য প্রলয় ভাইয়ের মনে অনেক ভালোবাসা।
কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে তার ভাবনা ভুল ছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেই দিন গুলো শ্রাবণীর চোখে এখনো ভেসে উঠে,এক্সিডেন্টে খালুর মৃত্যু,খালুর গড়ে তোলা ব্যবসায় কে খালার একা হাতে সামলানো।প্রলয় ভাই তখন সবে মেট্রিক দিয়েছে।আর শ্রাবণী সবে ক্লাস সিক্সে।খালুর মৃত্যুর পর আপা নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলে।প্রলয় ভাই তখন পাগলের মতাও হয়ে যায়।সারাক্ষণ গিয়ে পড়ে থাকতো শ্রাবণীদের বাসায়।প্রলয় ভাই কাঠালের আঠার মতো লেগে থাকতো তার সাথে।প্রলয় সারাক্ষণ ঝগড়া,রাগারাগি করতো।শ্রাবণী তো তখনই খুন হয়ে যায়।
ভালোবেসে ফেলে প্রলয় কে।কখনো বলতে পারে নি প্রলয় কে।
আর বন্যা আপা সেই বছরেই….

ঝাপসা হয়ে এলো শ্রাবণীর চোখ।খালাকে জড়িয়ে ধরে কাঠ হয়ে বসে রইলো।
রাহেলা বানু এতোক্ষন যেই কষ্ট দম চেপে সহ্য করে ছিলেন সেই কষ্ট তার সহ্যের বাহিরে চলে গেলো।শ্রাবণী কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
শ্রাবণী মূর্তির মতো হয়ে রইলো।
রাহেলা বানুর কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর শ্রাবণী বুঝতে পারলো আসল কারন কি।
আজকে বন্যা আপার মৃত্যুদিবস।

গাড়িতে চুপচাপ সময় কাটছে।শবনমের এই মৌনতা সহ্য হলো না।নিরবতা ভঙ্গ করতেই শবনম জিজ্ঞেস করলো,”আপনার আপা এতো অল্প বয়সে মারা গেলো!”
“মারা যায় নি,আপা আত্মহত্যা করেছে।”
শবনম যেনো ১০০০ ভোল্টের শক খেলো।
স্তব্ধ হয়ে গেলো শবনম এই কথা শুনে।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,”কেনো এরকম করলো উনি?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রলয় বলতে লাগলো,”আপা মেট্রিকে থাকাকালীন একটা ছেলের প্রেমে পড়লো,আপার ২ ব্যাচ সিনিয়র ছিলো ছেলে।আ
আমার আপা ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মেয়ে।যদি বোকামিতে কোনো এওয়ার্ড থাকতো তবে আমার আপা-ই পেতো সেই এওয়ার্ড।জানেন তো,সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়।
আমার সেই বোকা আপা ছিলো কলেজের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী।
আমার বোকা আপা ছেলেটার ইমোশনাল কথার ফাঁদে পড়ে গেলো।
৪ মাস প্রেম করার পর আপা বুঝতে পারলো জানোয়ার টা ছাড়া আপার আর কেউ নেই।
প্রেমের সময়টা অতিরিক্ত মধুর হয় বলেই হয়তো আমার আপার কাছে সেই ছেলেটার চেয়ে বড় আর কেউই ছিলো না।

আমার বাবার আমদানি রপ্তানির ব্যবসায় ছিলো।বাবা কখনো আমাদের কোনো আবদার অপূর্ণ রাখে নি।ছেলেটা আপার থেকে সেই সুযোগ নিয়েছে।যখন তখন আপার থেকে টাকা চাইতো।আর আপা বাবাকে বলা মাত্রই বাবা দিয়ে দিতো।
আপা ছিলো বাবার চোখের মনি।
মাঝেমাঝে আমি ভীষণ রেগে যেতাম বাবা আমাকে আদর কম করে বলে।
এক সময় আপা দেখতে পেলো ছেলেটা আপাকে ইগনোর করছে।আপার সহ্য হলো না।আমার বোকা আপা গিয়ে ছেলেটার পায়ে পড়লো।
আপার দুর্বলতার সুযোগ নিলো ছেলেটা।আপাকে ফিজিক্যাল রিলেশনের জন্য চাপ দিলো।
আপা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লো শুনে।

শেষ পর্যন্ত আপা পারলো না,আপার অদম্য ভালোবাসার কাছে ব্যর্থ হলো নিজের সতীত্ব,নিজের সম্মান,পরিবারের সম্মান সবকিছু।
ছেলেটা আপাকে আশ্বাস দিলো বিয়ে করার।আপা সেটাকে বিশ্বাস করে সব শপে দিলো।
তারপর আর কি।
আর দশটা মেয়ের জীবনের মতো আপার সাথে ও হলো।ছেলেটা অস্বীকার করলো তার ভালোবাসা যখন জানতে পারলো আপা প্রেগন্যান্ট।
বাবা সেদিন আমাদের জন্য টিকিট কাটতে গেলো। পরের সপ্তাহে আমরা ব্যাংকক যাবো ঘুরতে।
মা যখন বাবাকে ফোন করে জানালো আপার কথা বাবা নির্বাক হয়ে গেলো। মেইন রোডে গাড়ির কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললো বাবা।
এক্সিডেন্ট করে বসলো বাবা।

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ৮

হাসপাতালে নেয়ার আগেই বাবা মারা গেলো।
আপা রুম থেকে বের হলো না সেদিন থেকে।কি অপরাধবোধ আপাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিলো তা আল্লাহ জানে আর আমার আপা জানে।
হাজারবার চেষ্টা করেও আমরা আপাকে আনতে পারি নি বাবাকে শেষ বার দেখার জন্য।
এই দরজা আপা আর খুললো না।
দরজার নিচ দিয়ে আপাকে খাবার দেওয়া হতো।
আমি আর আপা ছিলাম টম এন্ড জেরি।সারাক্ষণ লেগে থাকতাম আপার সাথে আমি।আমি তখন মেট্রিক দিছি সবেমাত্র।

আপার এভাবে চুপ হয়ে যাওয়া আমার সহ্য হলো না।আমার তো আপা ছাড়া আর কেউ নেই।
অশ্রু আর বন্যা যেদিন হলো,আপা সেদিন রাতে সবার অলক্ষ্যে ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তারপর থেকে বাসায় আমার মন টিকতো না।পড়ে থাকতাম খালাদের বাসায়।শ্রাবণ আর শ্রাবণীর সাথে দিন কেটে যেতো আমার।
শ্রাবণী কে আমি ছোট বোনের মতো দেখতাম তখন।
আমি ছোট ছিলাম বলে আমার আপাকে রক্ষা করতে পারি নি,কিন্তু শ্রাবণীর সাথে ছায়ার মতো ছিলাম।আমার আরেকটা বোনকে আমি ভুল পথে পা বাড়াতে দিতে চাই নি।
আজ সকালে যে মেয়েটা এসেছে সেই আমাদের শ্রাবণী।

আমি তোমার গল্প হবো পর্ব ১০