ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৭ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৭
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ে আমার ডান পাশে বসে আছে। পরনে মেহদী রঙ্গা লং ফ্রক, মাথা সবুজ হিজাব, হাতে সবুজ রঙের চুড়ি। ফর্সা দুটো গাল গরমে লাল হয়ে আছে। হাসি মুখ নিয়ে বসে আছে আমার ডান পাশে। মেয়েটার নাকটা ধূসরের মতো, একটাই তফাৎ তাহলে ধূসরের নাকে ডগায় তিল আছে যা এই মেয়েটার নাকের ডগায় নেই। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা আবারও বললো,

– আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।
আমি অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হাসি মুখে বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, তোমাকে তো চিনলাম না?
মেয়েটা মিষ্টি কন্ঠে বললো,
-আমি তোমার ছোট ননদ, তাবিয়া হোসেন।
সামান্য হেসে বললাম ,
– কেমন আছো? বাসার সবাই ভালো আছে?
মেয়েটা বললো,
-আলহামদুলিল্লাহ, বাসার সবাই ভালো আছে তুমি কেমন আছে? তুমি বলে একটু অসুস্থ আঙ্কেল বললো।
আমি সেই মিথ্যে হাসি নিয়েই বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– তে তেমন কিছু না, হঠাৎ জার্নি করার জন্য একটু অসুস্থ হয়ে গেছিলাম।
মেয়েটা বড্ড মিশুক একয়েক মুহূর্তে আমার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এমন একটা ননদ পাবো ভাবতে মনটা ক্ষণিকের জন্য ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু আমার স্বামীর সাথে কি আর পাঁচটা সাধারণ দম্পতিদের মতো সম্পর্কটা কি সহজ হবে? নাকি তাকে আমি তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবো নিজেরই অজান্তে ।এই ভেবেই মনের উঠনে মেঘ জমে গেলো। এখানে অধিকার বলতে শারীরিক সম্পর্কে কথা বলি নি৷ শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও দাম্পত্য জীবনে অনেক অধিকার থাকে যেমনঃ বিয়ের পর প্রত্যেকটা স্বামী চায় তার অর্ধাঙ্গিনী তাকে মন প্রান উজার করে ভালোবাসুক কিন্তু আমি? আমি তো ধূসরের প্রেমে মগ্ন। আমার হৃদয় কুটিরে ধূসর ব্যতিত অন্য কারো স্থান হবার নয়।

বাবা শর্ত মেনে নেওয়ার পর আমার বাইরে আবরণ টাই হাস্যজ্জল, কিন্তু ভিতরের আবরণ কয়লার ন্যায় আঙ্গার ।
একটু একটু করে কখন যে পায়ের মেহদী দেওয়া শেষ হয়ে গেছে সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। তাবিয়ার সাথে কথা বলতে থাকার জন্য। আমার শশুর বাড়ি থেকে সব মুরুব্বীরা এসেছে ছোটদের মাঝে শুধু তাবিয়া এসেছে। মুরুব্বীরা সবাই নিচে বসে কথা বলছে। তাই তাবিয়া উপরে চলে এসেছিলো।

একটু পর দুপুরে খাবার খাবারে জন্য ডাকা হলো সবাইকে। বিপত্তি ঘটলা এইখানেই কারণ আমার ডান হাতে মেহেদী দেওয়া, বাম হাতেরটা প্রায়ই শেষে দিকে। নিচে অতিথিদের জন্য সবাই ব্যস্ত। তাবিয়াকে দেখলাম নিচে যেতে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি কায়েফ ভাইয়া কুহুকে অতি যত্নের সহিত খাইয়ে দিচ্ছে। হবু দম্পতি এমন দৃশ্য দেখে সবারই ভালো লাগবে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তা আবার পছন্দ হয় না। তার মধ্যে আমার ফুপ্পি একজন তার সামনে এই ঘটনা ঘটলে, সে নাক, মুখ কুঁচকে কালো করে বললবে,

-যত্তসব আদিক্ষেতা। এই সব নাটক, সিনেমায় মানায় বাপু । বাস্তবে এই সব যত্ন কয়েকমাসের জন্য থাকে৷ এরপর একে অপরকে সহ্য না।
একটু পর আমার ধ্যান ফিরলো তাবিয়ার ডাকে। তাবিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে প্লেটে খাবার নিয়ে এসেছে। তাবিয়া বললো,
-ভাবী হা করতো, আমি তোমাকে খাইয়ে দেই। সবাই তো ব্যস্ত।
আমি তাবিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে ফেললাম।

আমাকে এমন করতে দেখে বেচারা ভয় পেয়ে গেছে। তাবিয়ার এমন ভীতু মুখ দেখে আমি শব্দ করে হেসে দিলাম, আমার হাসি দেখে তাবিয়াও শব্দ করে হেসে ফেলো ৷ এরপর তাবিয়া খুব যত্নে সাথে আমাকে খাইয়ে দিলো। ভুলেও তার ভাই মানে আমার হবু বরের সম্পর্কে টু শব্দ করলো না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে তা নিপুণতার সাথে এড়িয়ে গেলো।যা আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি। বিকাল চারটার দিকে তাবিয়া চলে গেলো।যাওয়ার সময় বললো,
– নিজের একটু যত্ন নিও ভাবি।

তাবিয়ারা চলে যাওয়ার পর আমি একদমই চুপ হয়ে গেলাম।
প্রয়োজন ছাড়া কেউর সাথে কোনো বাক্য বিনিময় করলাম না। হাতের মেহেদী শুকিয়ে গেছে সেইক্ষণ। আমার রুমের মেঝেতে দুইটা লাগেজ পরে আছে। এই লাগেজ গুলো নাকি আমার শশুর বাড়িতে দিয়ে গেছে। একদৃষ্টিতে লাগেজ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। একটু পর মা,ছোটখালামনি, মামী, চাচীরা সবাই আমার রুমে দল বেঁধে এলেন। তাদের সাথে কুহু আর রুবিকেও দেখলাম। তাদের দেখে আমি সবাইকে বললাম খাটে বসতে। তাদের কে বসতে দিয়ে আমি ফ্লোরে বসে পড়লাম আমার ডান পাশে কুহু আর বামপাশে রুবি এসে ফ্লোরে বসে পরলো।

তারপর খালামনি লাগেজের চাবি দিয়ে একটা লাগেজ খুলো। তার ভেতর থেকে ৪ টা সুতির শাড়ী বের করলেন, ৫টা সেলোয়ার-কামিজ, ২ টা জামদানী শাড়ী, একজোড়া স্লিপার জুতা, একজোড়া বাসায় পড়ার জুতা, একজোড়া হিল, আরেক জোড়া সু বের করলেন। আরেক লাগেজ খুলে তার থেকে একটা কালো খয়েরী রঙের একটা ঘের ওয়ালা লেহেঙ্গা বের করলো।
আমার এইসব আর ভালো লাগছে না। রুবি হাতে থেকে ওর ফোনটা নিয়ে কুহুকে মেসেজ দিলাম,
” বোইন যেমনে পারস আমারে এই পরিস্থিতিতে থেকে বের কর। এই নাটক আর পছন্দ হইতাছে না। বোইন তোর পায়ে পড়ি।”

মেসেজ সেন্ড করে কুহুর দিকে তাকালাম , ও তখন খালামনির দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি ডান হাতের কনুই দিয়ে একটা খোঁচা দিলাম কুহুকে। কুহু আমার দিকে তাকালো তখন ওকে ইশারায় বললাম ফোন চেক করতে।
ও ফোন চেক করার পর খালামনিকে বললো,
-খালামনি এখনো তো সাড়ে ৫টা বাজতে চললো, আমাদের তো পার্লারে যাওয়ার জন্য এখনই বের হওয়া দরকার নইলে আমাদের পরে লেইট হবে বাসায় আসতে “।

কুহুর কথা শুনে খালামনি আমার দিকে তাকালো আমি খালামনিকে চোখ টিপুন দিলাম।
খালামনি ব্যাপার বুঝতে পেরে, কুহুর কথায় সম্মতি প্রকাশ করলেন। এর পর খালামনি রুবি, কুহু আর আমাকে একটা কাপড়ের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” এই ব্যাগে তোদের তিন জনের হলুদের কাপড় আছে, সাথে এক সেট হলুদের আর্টিফিশিয়াল গয়না আছে রুবির জন্য, আর কাঁচা ফুলের গয়নাগুলো কুহু আর সন্ধ্যার জন্য। তিনজনের জন্যই তিনজোড়া জুতো আছে। নিচে ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৬

বলেই খালামনি আবার ব্যস্ত হয়ে গেলেন ও বাড়ি থেকে দেওয়া জিনিস পত্র দেখতে।
তিনজনই নিচে নেমে এলাম, গাড়ীর সামনে আসতেই আব্বু পিছন থেকে ডাক দিলেন, বললেন,
– সন্ধ্যা শোনে যাও তো।
আমি লক্ষী মেয়ের মতো বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, আব্বু আমার ডান হাত টা ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,

– মা তুই কি এবারও পালিয়ে যাবি? যদি এমন কিছু করিস, তাহলে এটা আমাদের শেষ দেখা মনে রাখিস। তুই যদি এবারও পালিয়ে চলে যাস, এরপর ফিরে এসে আমার মরা মুখ দেখবি সন্ধ্যা।
বলেই বাবা পাঞ্জাবির বাম হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিলেন,
আমি বাবার মুখে এমন কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম, হঠাৎ বাবাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– আব্বু এবার আর তোমার মেয়ে পালিয়ে যাবে না। তোমার মেয়ে তোমার ইচ্ছে অনুসারে বিয়ে করবে ইনশাআল্লাহ।

বলেই আমি বাবাকে ছেড়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম,।এরপর বহুকষ্টে ড্রাইভারকে বললাম,
গাড়ী ছাড়তে। এরপরই চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম, কুহু কে জড়িয়ে ধরে। কুহুর ফোনটা একটু পর পর বেজে উঠছিলো। তাই বাধ্য হয়ে কুহুকে জিজ্ঞেস করলাম কে কল দিয়েছে। কুহু চুপ করে রইলে মিনিট পাঁচেক। এরপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,
– ধূসর ভাইয়া কল দিচ্ছে। সে তোর সাথে কথা বলতে চায়৷ খুব করে অনুরোধ করেছে আমাকে। তোর সাথে একবার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৮