ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৮ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৮
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

আমি এখন বসে আছি পার্লারে একটুপরই বেরিয়ে যাবো। নিজেকে আয়নায় দেখে আমি একদমই অবাক হয়ে গেছি কারণ আমাকে একদমই চেনা যাচ্ছে না। মেকআপ করার কারণে আমার চেহারার নকশাই বদলে গেছে। কাঁচি হলুদের জামদানী শাড়ী, লাা সবুজের নকশা করা, ফুল হাতা সবুজ রঙ্গের ব্লাউজ। কাঁচা ফুলের গয়না। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হচ্ছে একটা আস্ত ফুলের তোড়া। কুহুকে ও ঠিক একই রকম করে সাজানো হয়েছে। কুহুর ফোনটা এতোক্ষণ বন্ধ ছিলো। আমি মাত্রই চালু করলাম। গাড়ীতে উঠার পর যখন শুনলাম ধূসর কলে করে দেখা করতে চাইছে।

তখনই কুহুকে বলেছিলাম ফোনটা বন্ধ করে রাখতে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত নয়টা ১৭ বাজে। রুবি আর কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পার্লার থেকে বাড়ীর উদ্দেশ্যে। গাড়ীর কাছে এসে দেখি ধূসর আর জুবায়ের ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে গাড়ীর সামনে। ধূরস একটা বাইকে সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ওর মুখের কথা হারিয়ে গেছে। হা করে তাকিয়ে আছে, জুবায়ের ভাইয়া সাথে কথা বলছি তখন। ধূসর নিজের হাত দিয়ে ইশারা করলো জুবায়ের ভাইয়া চুপ থাকতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জুবায়ের ভাইয়া তা আর খেয়াল করে নি।নিজের মতো করে বকবক করেই যাচ্ছে, ধূসর বিরক্ত হয়ে ঠাস্ করে জুবায়ের ভাইয়ার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো, এই সব করার সময় ধূসরে দৃষ্টি আমার দিকেই ছিলো৷ এমনে ভাবে তাকিয়ে ছিলো যেনো সে নিজের চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। আমি গাড়ীর সামনে এতোক্ষণে চলে এসেছি। গাড়ীর দরজা যখন খুলবো ঠিক তখনই একটা হাত এসে আমার ডান হাতটাকে ধরে ফেলো। এই হাতটা যে ধূসরের তা আমি নিশ্চিত। আমার দৃষ্টি এতোক্ষণ নিচের দিকে ছিলো।

উপরের দিকে চোখ তুলে যখন তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ধূসরের সেই মাদক চাহুনি, যা সব সময হৃদয় মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি কারণ। এই চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি পারি দিতে আমার সারাটা জীবন৷ এই নেশাগ্রস্ত নয়ন যে আমি নিজেই আমার নামে সীল মোহর লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এই মাদক দৃষ্টির দিকে আরেকটু তাকিয়ে থাকলে, আমি আমার বাবার দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে ফেলবো।ভাবতেই আমার হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কয়েকশ টুকরোয়। হৃদ মাঝে ধূসর কে নিয়ে যে সুপ্ত বাসনা ছিলো, তা আবার পাখির মতো পাখা ঝাপটাছে। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে । ক্ষণিকের জন্য মনে হচ্ছিলো এই যন্ত্রণার চেয়ে মরনই উত্তম।
ধূসর আমাকে বললো,

– একটু সময় কি আমাকে দেওয়া যায় না শেষ বারের মতো।
বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত করে বললাম,
– কি বলবেন, বলুন আমি শুনছি।
ধূসর জুবায়ের, রুবি আর কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললে,
– তোরা যা আমি সন্ধ্যা কে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবো।
ধূসরের কথায় কুহু, রুবি আমার দিকে অসহায়র মতো তাকিয়ে রইলো।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম,
– তোরা যা আমি আসছি, আব্বুকে বলিস চিন্তা করতে না, আমি পালিয়ে যাবো না৷ সময় মতো চলে আসবো।

আমাকে রেখে ওরা গাড়ীতে উঠে বসলো। এতক্ষণ ধূসর আমার ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। গাড়ীটা চলতে শুরু করার পর আমার হাত ধরে ধূসর বাইকের কাছে চলে এলো।
আমাকে ইশারায় বললো, বাইকে উঠে বসতে। আমি চুপ চাপ বাইকে উঠে বসলাম। এরপরই বাইকে চালানো শুরু করে দিলো, একটানে হাইওয়ের এসে বাইক থামালো। বাইক থেকে ধূসর নিমে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। এরপর বললো,
– সমস্যা কি?
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম,
– কোনো সমস্যা নাই তো?
ধূসর খুব ঠান্ডা গলায় বললো,
– তাহলে বিয়ে করছো কেন?
আমি ধূসরের দিকে তাকিয়ে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা সংক্ষিপ্ত ভাবে বললাম।
সব শুনে ধূসর বললো,
– তোমার কি মনে হয় আমি বিবাহিত?
আমি অন্য দিকে মুখ ঘুড়িয়ে বললাম,
– বিয়ে না করলে বউ আসে কোথায় থেকে তোমার?
আসমান থেকে বউ এসে হাজির হয়েছে তোমার?
ধূসর এবার শক্তগলায় বললো,

– ফাইজলামি করো? সেই দিন আমি বলেছিলাম চলো বিয়ে করে ফেলি। সেইদিন বিয়ে করে ফেললে আজকে এই দিন দেখতে হতো না আমাদের।
ধূসর আমার ডান হাত নিজের বুকের বা পাশে রেখে বললো,
– চলো এখন বিয়ে করি?বিয়ে করে অনেক দূর চলে যাবো আমরা।
নিজের হাতটাকে একটা টানে সরিয়ে নিলাম আমি ধূসর থেকে। তারপর কঠিন গলায় বললাম,
– শুনেন, আমি এমন মেয়ে না যে তার বাবা, মার দেওয়া কসম ভেঙ্গে, ২ দিনের ভালোবাসার জন্য ২১ বছরের ভালোবাসাকে ঠকাবো। দুঃখিত ধূসর আমায় তুমি মাফ করো আমি এই কাজ কখনোই করতে পারবো না।

তুমি তোমার মতো থাকো, আমি আমার মতো। তুমি চাইলে আমাকে ভুলে নিজের জীবনকে গুচ্ছিয়ে নিতে পারবে। আমাকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা একদম তোমার উপর। আমি শুধু এতোটুকুই বলবো আমার সিদ্ধান্তে সম্মান করো, দেখবে তুমিও ভালো থাকবে আমিও ভালো থাকবো। আসি নিজের যত্ন নিও, একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। আমার জন্য দোয়া করবে যাতে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারি, এতে তোমারও মঙ্গল আমারও মঙ্গল। বলেই ধূসরকে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে আসলাম। একটু পর ধূসর আমার সামনে বাইক থামিয়ে বললো,

-আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি । এখন রাত পনে ১০ টা বাজে । এইখানে থেকে তোমার বাসায় আমি পৌঁছিয়ে দেই শেষ বারের মতো আমার অনুরোধ টা রাখো।
আমি নিঃশব্দে ধূসরের বাইকে উঠে বসলাম। ১০ টা ১৫ দিকে বাড়ীর গেটে থেকে একটু দূরে ধূসর বাইক থামালো। দুজন একজনও সারাটা রাস্তা একটা টু শব্দ ও করি নি। চুপ করে ছিলাম। আমি নিঃশব্দে বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ধূসর আমার ডান হাতের পাতায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো।

এই ছিলো তোমার ভালোবাসা আমার জন্য? জানো সন্ধ্যা আজকে তোমায় একদম বউ বউ লাগছে। ভালো থেকো স্বামী , সংসার নিয়ে। ভালো থেকো। খুব খুব ভালোবাসি তোমায় সন্ধ্যা । খুব বেশীই ভালোবাসি। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে বাইক চালু করে ধূসর চলে গেলো। যতক্ষণ পর্যন্ত ধূসর দেখা যাচ্ছিলো। আমি ঠিক ততক্ষণ ধূসরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিলাম। ধূসরের বলা শেষ কথাগুলো যেনো আমাকে পাথরে রূপান্তরিত করে ফেলো।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৭

বাড়ীর গেটে কাছে এসে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমি একপা, দুপা, করে তার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম কারো উপস্থিতি বুঝতে পরে আব্বু সামনের দিকে তাকালো।
আমাকে দেখার পর আব্বুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হয়তো আব্বুর এতোক্ষণ চিন্তিত থাকবার কারণ আমি। আমি দৌঁড়িয়ে গিয়ে আব্বুকে জরিয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আব্বু অতি যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর বললেন,

– তুমি আমায় চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে মা। এইবারও যদি তুমি পালিয়ে যেতে তখন আমার মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ আর থাকতো না।
আমি বহু কষ্টে কান্না রত কন্ঠে বললাম,
– আব্বু আমি আমার সব শেষ করে দিয়ে এসেছি। আমি কখনোই তোমার কথার অবাধ্য হবো না। প্লিজ তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেও না। আমি বড্ড একা হয়ে যাবো দুনিয়াতে।
আব্বু অতি যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে,

– মা জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্যাগের মধ্যে জীবনে অনাবিল আনন্দে ভরে উঠে। আজকে তুমি যে ভালোবাসাকে ছেড়ে চলে এসেছো, প্রকৃতি তোমায় তারচেয়ে দ্বিগুণ ভালেবাসা ফেরত দিবে মা। আজকের এই কথাটা তুমি মিলেয়ে নিও।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা শেষ পর্ব