ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা শেষ পর্ব || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা শেষ পর্ব
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

নিজেকে এখন কোনো খেলনার বস্তুর চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। একজন, একজন করে স্টেজে এসে আমাকে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে , কেউ, কেউ দুষ্টুমি করছে। কেউ বা এসে পাশে বসে ছবি তুলছে। আমার পাশের স্টেজে কুহু আর কায়েফ বসে আছে। তাদের দুজন কে দেখলে মনটা জুড়িয়ে যায়। কপোত-কপোতী মতো একটু পর পর কায়েফ কুহুর কানে কানে কথা বলছে আর কুহু তা শুনে খিল খিল করে হেঁসে উঠছে।

আচ্ছা এমন না হলেও তো পারতো আজকে কুহুর জায়গায় আমি থাকতে পারতাম আর কায়েফের জায়গায় ধূসর৷ জীবনটা যদি উপন্যাস কিংবা গল্প হতো, তাহলে হয়তো জীবনে কষ্ট নামক কোনো শব্দ থাকতো না। লেখকরা কি সুন্দর কয়েক হাজার শব্দ দিয়ে একটা মিথ্যা গল্প বানিয়ে ফেলে, তা সকলে হৃদয় ছুঁয়ে যায়৷ কয়েক বছর বা কয়েক শতাব্দী লোক তার লেখার কথা স্মরণে রাখে। কি সুন্দর করে গল্পের উপন্যাসের চরিত্রগুলো আপন খামখেয়ালি অনুযায় সাজ্জায়। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ সেই চরিত্র মাঝে নিজেকে খোঁজে বা খুঁজে নেয়। সত্যি জীবন সুন্দর , জীবন জীবনের ন্যায় সুন্দর৷ ইহা আবার খুব বিচিত্র জিনিস যদি আপনি আপনার জীবনের প্রতি মুহুর্ত উপভোগ না করতে পারেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখন আপনার জীবন হয়ে যায় যন্ত্রণাময়, চারোদিকে থেকে তৈরি হয়ে যায় একাকিত্ব , বিষন্নতা, ইত্যাদি নামক দেওয়াল৷ তখন আপনি কিংবা আমি চাইলেও জীবনটাকে শান্তিতে উপভোগ করতে পারবো না। ঠিক তেমনই ভালোবাসা, চার অক্ষরের একটি শব্দ কিন্তু তার অর্থ খুবই কঠিন৷ এই শব্দের সঠিক অর্থ খুঁজতে গিয়ে কতো মানুষই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে আমাদের আশে পাশে অবস্থান করছে। আবার কেউ কেউ এই ভালোবাসার আরেক অর্থ ত্যাগ মনে করে। তাদের দশা ঠিক আমার মতোই করুন হয়। যখন ভালোবাসার পরীক্ষা দেওয়ার সময় হয় তখন আমার মতো কিছু মেয়ে নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করে।

পরিবারের কথা মতো অন্য একজনের হাত ধরে নিজের বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য৷ সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত ব্যক্তির সাথে। আমি নিজেকে ধূসরের কি বলে দাবি করবো? ধূসর প্রাক্তন ? বিশ্বাস করুন আমি তা কখনোই হতে চাই নি। আমি বারংবার ধূসর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে দাবি করতে চেয়েছিলাম সমাজের কাছে। আর আজকে এই সমাজের জন্যই বাবা আমাকে বিয়ে দিবার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে । সমাজ নামে যদি কোনো শব্দ দুনিয়াতে না থাকতো তাহলে মেয়েদের জন্য জীবনটা আরো সহজ হতো। কি বা করার আমার বাবা মায়ের তো সমাজ নিয়ে চলতে হবে। এই সমাজের জন্য না হয় আমিকেই বলি দেওয়া হলো। সমাজে জন্য আমার মতো হাজারো মেয়ে নিজের ভালোবাসা ছেড়ে বলি হচ্ছে।

আমার এই সকল ভাবনার মাঝে তাবিয়া কোথায় থেকে এসে আমার গালে টুপ করে হলুদ লাগিয়ে দিলো। মেয়েটাকে আজকে ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে । লাল জামদানী শাড়ী, হলুদ টিস্যু কাপড়ের ব্লাউজ। মাথায় লাল হিজাব। হিজাবের উপর হলুদ গোলাপের মালা। কি সুন্দর লাগছে তাবিয়াকে। প্রচন্ড অভোগক্তির সাথে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হলো আমার।

এখন ভোর চারটা বাজে একটু আগেই গান বাজনা বন্ধ করে কাজিন গুলো ঘুমিয়ে পরেছে, এক রুমে সব গাদাগাদি করে। আমার রুমে আপাতত রুবি, কুহু, আর আমিই রয়েছি। ওরা দুইজন বিছানার শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার অবাধ্য নয়নে ঘুম নেই, ধূসরের সাথে দেখা করার পর আমার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ২ বছর আগে যখন ধূসর বিয়ের করার কথা বলেছিলো। তখন যদি আমি ধূসরের কথায় রাজিয়ে হয়ে, বিয়েটা করে নিতাম তাহলে আজকে আমাকে জীবন মরন পরীক্ষা দিতে হতো না। কথায় আছে না, চোর গেলে বুদ্ধি হয়, আমার দশা ঠিক তেমনই হয়েছে। ধূসরের বলা একটা কথা আমার কানে বারংবার বাজছে তা হলো

” এই ছিলো তোমার ভালোবাসা আমার জন্য? ”
ধূসর কি পারবে আমাকে ক্ষমা করে, নিজের জীবনকে গুচ্ছিয়ে নিতে?
৪৩,
ভোর বেলা ধূসরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তা আমার খেয়াল নেই। ৮ টার দিকে খালামনির ডাকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠতে হলো। এর ফাঁকে রুবি আমাকে আর কুহুকে চট করে সকালের খাবার খাইয়ে দিলো। ১২টার দিকে পার্লার থেকে ৩ জন লোক আসলো কুহু, রুবি আর আমাকে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য । অতি যত্নে আমাদের তারা সাজিয়ে দিলো। ৪ টার দিকে আমার আর কুহুর সাজ সম্পূর্ণ হলো। একটুপর খালামনি রুমে এসে আমাদের দেখে একদম চুপ হয়ে গেলো।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে, সেখান থেকে ব্রাউন রঙ্গের লেন্স নিয়ে এসে আমাকে পরিয়ে দিলো সাথে একটা হিরের পেইন্ডেন । এর আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
– মাশাল্লাহ, এখন সুন্দর লাগছে।
কুহুরও সামনে গিয়ে কপালে চুমু খেয়ে, একটা হিরের লেকলেস পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
– মাশাল্লাহ , আমার মেয়েটাকে কোনো রাজ কন্যার থেকে কম লাগছে না।
বলেই কোনো রকম রুম থেকে পালিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন,
-রুবি আমার সাথে আয় তো।
একটুপর খালামনি খাবার নিয়ে আসলেন কুহু আর আমাকে একসাথে খাইয়ে দিলেন। বার বার খালামনি চোখ নিজের হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুচ্ছিলো।

সন্ধ্যা ৬ টা আমার কাজিন গুলোর কন্ঠ ভেসে আসছে, তারা জোরে জোরে বলছে বর এসেছে বর এসেছে। আমার হাত পা অবস হয়ে আসছে, এবং তা কাপচ্ছে। আমার হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ আমি নিজে কানে শুনতে পারছি। অশ্ররা যেনো আজ আমার কোনো বাঁধা মানতে নারাজ। প্রচন্ড শীত লাগছে। আমার রুমে এখন আপাতত কেউ নেই। রুবির ফোন আমার সামনে পরে আছে। শেষ বার কি ধূসরের সাথে কথা বলতে পারবো না? নাকি কালই আমাদের শেষ কথা হয়ে গিয়েছিলো। নিজের আবাঁধ্য মনকে নিজে এই বলে বুঝালাম যে,

” দেখ সন্ধ্যা, এখন যদি তুই ধূসরের সাথে কথা বলিস, তখন ধূসরও তোর প্রতি দূর্বল হয়ে যাবে সাথে তুই ও। তখন ঐই দূর্বলতাকে কেন্দ্র করেই তুই তোর বাবার দেওয়ার কথার খেলাফ করবি।”
একটু পর রুমে প্রবেশ করলো আমার শশুড় বাড়ীর লোকজন। তাবিয়া এসে আমার পাশে বসে বললো,
– ভাবি তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ভাইয়া তো তোমাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না।
তাবিয়ার কথা রুমের সকলে অট্টহাসিতে হাঁসতে লাগলো।
অনিচ্ছা থাকা পরও তাবিয়ার কথা একটু মুচকি হাসতে হলো।
একজন, একজন মুরুব্বি এসে আমার সাথে পরিচিত হচ্ছে । তাদের সাথে জোরপূর্বক হাসি মুখে কথা বলতে হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে আমার রুমে আব্বুর সাথে কাজীসহ কয়েকজন সাদা পাঞ্জাবি পড়া মুরুব্বি প্রবেশ করলেন। তাদের কে বসার জায়গা করে দিলেন সবাই সরে গিয়ে।
আব্বুর চোখ প্রচন্ড লাল, মেজু মামারও ঠিক একই অবস্থা, বড় চাচা কাজীর সাথে বসে কথা বলছেন।

একটুপর কাজী সাহেব কি জানি পড়তে শুরু করলেন, কান্নার জন্য আমার আর সেই দিকে কোনো খেয়াল ছিলো না, কান্নার সাথে প্রচন্ড হাত, পা কাপচ্ছিলো। একটুপর কাজী সাহেব আমাকে বললেন,
– বলো মা আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।
কাজীর কথা শুনে আমি উপরের দিকে তাকালাম। এতোক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আমাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা পাকিয়ে গেছে। এই ভিড়ের মধ্যে আমি ধূসরকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ধূসর তো নেই, সাথে ধূসরের কোনো চিহ্নটুকুও নেই। কোথায় থেকে খালামনি এসে আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে, কানে কানে বললেন,
– মা কবুল বল, বিশ্বাস কর, তোর জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকেই আজকের পর থেকে সবসময় তোর পাশে পাবি।

আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে খালামনির দিকে তাকালাম,খালামনি ইশারায় মাথা নাড়ালেন।
আমি একটু সময় নিয়ে, বেশ শব্দ করেই বললাম,
– আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
তার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
আমার কথা শুনে কাজী সাহেব বললেন,
– উপস্থিত সবাই শুনেছেন তো?
রুমে সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো,
– জ্বি শুনেছি।
সব শেষ , আজকে থেকে আমার জীবনে ধূসরের কোনো অধিকার থাকবে না। আজকে থেকে আমার জীবনের সকল অধিকার একজন মানুষের নামে একটু আগে সীল মোহর লাগিয়ে দেওয়া হলো। আজকের পর থেকে যদি আমি ধূসরের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখি তখন সমাজের চোখে তা পরকীয়া হিসেবে গণ্য করা হবে।

কোনো একটা কারণ বশত আমাকে বররে কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এটা বলে চৌধুরী পরিবারের নিয়ম। বিয়ের পর নতুন বর, বউ একেবারে বাসর ঘরে একে অপরকে দেখতে পারে এর আগে না। এমনেও আমার বর কে দেখবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই। যার জন্য এই কথা শুনার পর আমার মনের মেঘ একটু হলেও কমেছে। আস্তে আস্তে বিদায়ের সময় চলে এলো দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১০ বাজে। আমাকে ধরে রুবি নিচে নামিয়ে আনলো। সবাই কান্নার করছে, আম্মু মুখে শাড়ীর আঁচল গুঁজে এক কোনায় দাঁড়িয়ে কান্না করছিলো আমাকে দেখে সে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো।আব্বু এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মেজু মামা আর বড় চাচা মিলে গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। একটুপর তাবিয়া এসে আমার মাথার উপর একটা গাড়ো সবুজ রঙ্গের নেটের ওরনা এনে আমার মুখ সম্পূর্ণ ঢেকে দিলো। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। বাবা আমার হাত ধরে আমার বরের হাতে হাত দিয়ে বললেন,

– আমার কলিজার টুকরাকে তোমাকে দিলাম বাবা, ওর যত্ন নিও। আমি ওকে রাজকন্যার মতো করে রেখেছি। তুমি ওর অযত্ন করো না। ও একটু বাচ্চা টাইপের। ওর ভুল গুলা মাফ করে দিও।
কোথা থেকে রুবি এসে কানে কানে বললো,
-আগের তোর যার সাথে বিয়ে হবার কথা ছিলো, তার সাথেই আজকে তোর বিয়ে হয়েছে।
রুবির এই কথা শুনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না সেইখানেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত রুমে। রুমের চারদিক লাল গোলাপ দিয়ে সাজ্জানো। বহু কষ্টে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১১ টা ৫৬ বাজে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সম্পূর্ণ ফ্লোর সাদা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। ঝুলবারান্দা দিকে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সরু একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। একটু পর দরজায় খোলার শব্দে আমি নড়ে বসলাম,

১ মিনিট পর একটা কন্ঠ স্বর শুনতে পেলাম। সেই কন্ঠটা আর কেউরই না ধূসরের সামনে তাকিয়ে দেখি বর সাজে ধূসর দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে বললাম,
-তুমি?
ধূসর আমার পাশে এসে বললো,
– শুভ জন্মদিন বউ।
ওর কথায় আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। তখন ও বললো,
– তোমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো?
আমি তখনও হা করে তাকিয়ে আছি।
তারপর ধূসর বললো,

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৮

– শুনো তোমার আর আমার কথা আমি চট্টগ্রামে এসে সবাইকে বলেছি। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে। বিশ্বাস না হলে তোমার হাতের মেহেদীর দিকে তাকিয়ে দেখো, কার নাম লেখা?
আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি,
– ডান হাতে ছোট্ট করে ধূসর লিখা ইংরেজিতে।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে ধূসর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আজকের পর থেকে সন্ধ্যা একান্ত আমার এবং আমার ব্যক্তিগত, আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার আদরের বউ।

৬ বছর পর ধূসর আর সন্ধ্যা রুমের ঝুল বারান্দায় বসে আছে সাথে তাদের ২ বছরের কন্যা রঙ্গন।
রঙ্গন ধূসরের কোলে বসে আছে। সন্ধ্যা রঙ্গনের কাছে ডাকে এনে কোলে বসালো তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধূসর রঙ্গের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এই কন্যাই একদিন আমার কোল আলো করে পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলো।
এই কন্যাই আমার কোলে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ করবার জন্য চিৎকার করে কেঁদে ছিলো।
সেই কন্যা যে আমার আরেক রূপ তা প্রমাণ করতে প্রকৃতিরা ও বাধ্য।
জীবন সুন্দর, জীবন জীবনের ন্যায় সুন্দর।?
এই সুন্দর মুহুর্তটাকে ধূসর তার ক্যামেরায় টুপ করে বন্দী করে রাখলো।

সমাপ্ত