ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৬ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৬
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

আব্বু যে আমায় শাস্তি সরূপ বিয়ের কথা বলতে পারে, তা আমার মাথায় একদমই আসে নি। আমি প্রচুর ভেঙ্গে পড়লাম। কি করবো তা নিয়ে পড়লাম দোটানায়। আমার মন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক দিকে মন বলছে আব্বুর শর্ত মেনে নিতে, আরেকদিকে আমার মন , মনে করিয়ে দিচ্ছে ধূসরের প্রতি আমার ভালোবাসার কথা। আমার আবেগ বলছে,
” সন্ধ্যা তোর ভালোবাসা কি এতোই ঠুকনো যে একটা অপরিচিত নারীর কথায় ধূসর কে ছেড়ে দিবি? এতো সহজেই কি ভালোবাসা ভুলানো যায়? কোনো কিছুই একদিক থেকে বিচার করা ঠিক না। তোর উচিৎ ধূসরের সাথে কথা বলা। ঘটনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা।
অপরদিকে আমার বিবেক বলেছে,

” সন্ধ্যা ২ বছরের সম্পর্কে জন্য কি তুই তোর পিতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবি। অলরেডি, তোর বাবার সাথে, তোর সম্পর্ক নাই নাই অবস্থা ৷ এরপর যেই সুযোগ পেলি, তাও হাত ছাড়া করতে চাইছিস? একবার চিন্তা করে দেখ ধূসর বিবাহিত। এই সম্পর্কে তোকে কিছুই জানায় নি ধূসর। ধূসরও তোর ব্যাপারে কখনোই তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে নি এবং কি নিজের ছোট বোনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয় নি, ছবিটা পর্যন্ত তোকে দেখায় নি । শোন সন্ধ্যা আজ তুই নিজের বাবার মন ভেঙ্গে দিয়ে দুদিন বাদে ধূসরের সাথে সংসার করবি ঠিকই কিন্তু মনে রাখিস বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো সন্তানই সুখি হতে পারে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধূসরের সাথে তোর জুড়ি লিখে নাই, তাই ধূসর তোর পাশে নেই। বিয়ের আগে প্রেম, ভালোবাসা হারাম।
এতোক্ষণ আমি নিজের সাথেই বোঝাপড়া করছিলাম। খালামনির কথা কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরলাম। খালামনি বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-সন্ধ্যা শুনো আমরা তোর থেকে বয়সে অনেক বড়, আমরা তোর থেকে বেশি দুনিয়াটা দেখেছি। তাই বলবো আবেগ দিয়ে নয়, বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নাও। আমরা বড়রা কখনোই তোমার ক্ষতি চাইবো না। কয়েক দিনকার মোহের টানে নিজের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করে বসো না। আবেগ, বিবেক দুটো দিয়ে চিন্তা করো যেটার যুক্তি বেশি হবে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নাও । তারপরও বলবো বিবেকের দিকটা একটু বেশি গুরুত্ব দিও। বিবেক দিয়ে চিন্তা করে তুমি কখনোই ঠকবে না।

খালামনি মন্তব্য অনুযায়ী আমার আবেগের থেকে বিবেকরে যুক্তি অনেক বেশি। যদি আমি আজ আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেই তাহলে হয়তো আমি আমার জীবনের অনেক কাছের মানুষকে হারাবো, ধূসরকে পেলেও পেতে পারি। এখানে একটা কিন্তু রয়েই যায় তাহলো, যদি ধূসরের বিয়ে না হয় তাহলে ধূসরকে আমি নিজের করে পাবো। আমি আবার এতো উদার মনের মানুষ না যে নিজের স্বামীর ভাগ অন্যজনকে দিতে পারবো। আর রইলো বিবেক যদি বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নেই তাহলে আমি আমার জীবনে ধূসর করে হারাবো কিন্তু আমার উপর থেকে পরিবার নামক বটবৃক্ষের ছাঁয়া থাকবে আমৃত্যু। হয়তো কয়েক বছর ধূসরের স্মৃতি আমার হৃদয় বড্ড পুরাবে, কিন্তু একসময় ঠিকই আমি ধূসর কে ভুলে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবো।

উপর দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে আব্বু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশ কি মায়া মাখা সেই চেহারা। আব্বুর মুখে একটুও বয়েসের ছাপ পড়ে নি। ওনার যে একটা ২১ বছরের মেয়ে আছে, তাকে দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না। আব্বু আমার আর খালামনির দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। আমার কন্ঠনালীতে শব্দ ফুরিয়ে গেছে । নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য ঢোক গিলাম। বহু কষ্টে বললাম,
– আব্বু তোমার দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিবো। তুমি যে ছেলেকে বিয়ে করতে বলবে আমি করবো।
আব্বু বললেন,
– বুঝে বলছো তো, নাকি আগের বারের মতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাবা?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– না, যাবো না।
আব্বু তার ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

– আমায় ছুঁয়ে বলবো বিয়ে করবে পরশু আমার পছন্দের পাত্রের সাথে?
আমি আমার কম্পনরত ডান হাত দিয়ে আব্বুকে ছুঁয়ে বহু কষ্টে বললাম,
-আব্বু তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম আমি পরশু বিয়ে করবো,তোমার পছন্দের পাত্রের সাথে।
বলার পরই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
আব্বু হাতে করে নিয়া আসা খাবারগুলো অতিযত্নের সাথে আমাকে খাইয়ে দিলো।আব্বুর মন রাখবার জন্য চুপচাপ খাবারগুলো খেয়ে নিলাম কিন্তু আমার কান্না যে আর কোনো বাঁধাই মানছিলো না। আব্বু খাবার খাইয়ে দেওয়ার পর চলে গেলেন।

কাল সারা রাত চোখ একমিনিটের জন্য বন্ধ করি নি। আমার হৃদয় পুরে ছারখার হয়ে যে ব্যথা সৃষ্টি হয়েছে তা এই বাড়ী কেন, এই দুনিয়ায় কোন ব্যক্তিই অনুভব করলো না। এই ব্যথার এতো যন্ত্রণা যা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। যার যন্ত্রণা একান্ত সে নিজেই বুঝে। দোয়া করি এই যন্ত্রণা যেনো আমার শত্রুর ও ভোগ না করতে হয়। কাল সারা রাত নিঘুম কাটিয়েছি। আমার মনে পড়ে না, ভুলেও কি আমি চোখ বন্ধ করেছি কিনা।আব্বু চলে যাওয়ার পর চিৎকার করে কান্না ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমি নিজের হাতে আমার ভালোবাসার গলা টিপে হত্যা করেছি।যদি কখনো ধূসর আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করে তাকে ত্যাগ করবার কারণ তখন আমি কি জবাব দিবো? যদি জিজ্ঞেস করে, আমি কি তার জন্য অপেক্ষা করলাম না । রাতে বহু কষ্টে খালামনি আমাকে সামলিয়েছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে খালামনি ঘুমিয়ে পড়েছে। ফজরের নামাজের মোনাজাতে আমি বলেছি।

” ইয়া আল্লাহ আমাকে নিজের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া শক্তি দাও এবং ধূসরকেও শক্তি দাও আমার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার।
এখন আমি বসে আছি আমার রুমের বারান্দার দোলনায়, দোলনায় বসে ঝুল বারান্দা দিয়ে বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর অশ্রু বিসর্জন করছি। একটু আগে আম্মু সকালে নাস্তা নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে নিচে চলে গেছে। খাবার খাওয়ার সময় তুফসা আপুর কল এলে, সে নাকি একটু আগে স্টেশনে এসে নেমেছে। কাউকে যেনো পাঠাই তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবার জন্য। আম্মুকে বলার পর সে বললো কায়েফ কে পাঠাবে, স্টেশনে তুফসা আপুকে নিয়ে আসবার জন্য । একটু পর কুহু আর রুবি এলো রুমে আমাকে না পেয়ে বারান্দায় এলো। এসে আমার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে দুজনই আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো। দু’জনই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমার এই অবস্থার কারণ কি জানতে চাইলো।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৫

আমি আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ঘনটা দুইজনে খুলে বললাম।
সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে দুইজনই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো হয়তো ওরা কখনোই আশা করে নি। আমাদের এতো গভীর ভালোবাসা কখনো বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হবে। এখন আমাদের তিনজনকে যদি কেউ একত্রিত দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না, আমাদের মাঝে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই তা।
এখন বেলা ১২ বাজতে চললো। কুহু আর আমাকে গোসল করবার পর, দু’জনকে মেহেদী রঙ্গে দুটো শাড়ী পড়িয়ে ছাঁদে তৈরীকৃত স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, মেহদী অনুষ্ঠানের জন্য। কুহুকে একজন মেহদী আর্টিস হাত মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।

আরেক জন মেহদী আর্টিস আমার পায়ের মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে । আমাদের বিপরীত পাশে আরেকজন মেহদী আর্টিস বাকিদের মেহেদী দিয়ে দিচ্ছি। আশেপাশে প্রচুর মানুষ। একটু আগে খালামনি এসে জিজ্ঞেস করে গেলো কিছু লাগবে কিনা? মাকে এর মাঝে আর দেখি নি। একজন একজন করে আমায় দেখে যাচ্ছে কেউ আবার আমার পাশে বসে মেহেদী ডিজাইন দেখছে সাথে কুশলাদি বিনিময়ও করছে। অনিচ্ছা শর্তেও সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে হচ্ছে। একটুপর একটা মেয়ে এসে আমার এসে বসে বললো,
– আসসালামু আলাইকুম৷ ভাবি কেমন আছো?

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৭