ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৫
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার
ফোনের ঐপাশের অপরিচিত নারীর একটু আগে বলা কথা শুনে আমার হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পরে গেলো। ফোনটা মাটিতে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। আমার দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। ধপ করে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলাম। আমার চিৎকারে শব্দ শুনে খালামনিসহ বাকিরা ছুটে এলো, আশেপাশে মানুষজন আমার দিকে কৌতুহলের নজরে তাকিয়ে আছে। খালামনি আমাকে নিচ থেকে তুলে ততক্ষণে জরিয়ে ধরেছে।কুহু এক বোতল পানি আমার দিকে এগিয়ে দিলো। খালামনি বোতলটা থেকে একটু পানি আমার মাথায় দিয়ে দিলো। খালামনির হাত থেকে আমি পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে নিলাম। এক বোতল পানি পান করেও আমার তৃষ্ণা মিটছে না। রুবি খবরের কাগজ দিয়ে আমাকে বাতাস করছে। নিরবতা ভেঙ্গে খালামনিকে বললাম,
– ছোট আম্মু আমি বাসায় যাবো।”
আমার কথা হয়তো খালামনি কিছু বুঝতে পারলো মনে হয়। কায়েফকে বললো ড্রাইভারকে কল করতে। কারণ বাবা একটু আগে ফোন করে জানিয়েছে তিনি নাকি আমাদের জন্য গাড়ী পাঠিয়েছে। কায়েফ কল করার একটু পরই ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে হাজির। রুবি চোখ হঠাৎই আমার ফোনের দিকে গেলো ঠিক তখনই আমি বলে উঠলাম ও কিছু বলার আগে
– রুবি ফোনটা নিয়ে আয় তো।
বলেই খালামনির সাথে গাড়ীতে উঠে বসলাম।
একটুপর রুবি গাড়ীতে উঠলো একে একে সবাই। এরপরই ড্রাইভার গাড়ী চালাতে শুরু করলো। ৩০ মিনিট পর আমরা আমাদের বাড়ীতে এসে পৌঁচ্ছালাম। ঠিক ২ বছর আগে আমি এই বাড়ী থেকে বেরিয়ে ছিলাম ঐ বলে যে,
– আমি পার্লারে যাচ্ছি সাজতে ।
সেদিন ঠিকই বউ সেজেছি কিন্তু বউ সেজে এ বাড়ীতে আর ফিরে আসি নি। আজও বাড়ীটা বিয়ে বাড়ীর সাজে সজ্জিত , সেদিনও ঠিক একই সাজে সজ্জিত ছিলো। সেদিন আমার বিয়ে হবার কথা ছিলো কিন্তু এখন এই বাড়ীতে কুহুর বিয়ে হবে। আচ্ছা আমি যদি সেদিন বাড়ীতে থেকে না পালাতাম তাহলে আমার জীবনে কখনো ধূসর, কুহু,জুবায়ের নামে কেউ থাকতো না। তখন আমার জীবনে থাকতো স্বামী, কি জানো নামটা তার ঠিক এই মুহূর্তে মনে পরছে। সেদিন যদি বিয়েটা হতো তাহলে আব্বুও আমার প্রতি ২ টা বছর এতো রাগ করে থাকতো না৷ জীবন খুবই বিচিত্র।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এই জীবনে প্রতিটা পদে পদে আপনি নতুন নতুন মুখের সাথে পরিচিত হবেন। আবার এদেরকে হঠাৎই আপনার জীবন থেকে উধাও হয়ে যাতে দেখবেন। এরাতো চলে যাবে ঠিকই, কিন্তু রেখে যাবে কিছু স্মৃতি যা আপনাকে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত করবে। বাড়ীর মূল ফটকে প্রবেশ করার পর দেখলাম আমার দাদা বাড়ী আত্নীয়স্বজন ও উপস্থিত। সবাই আমাকে দেখে ভূত দেখবার নেয় তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকবে না কেন বলুন। আমাকে খালামনি ধরে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে এসেছে। আমার এমন অবস্তা দেখে মা কোথায় থেকে দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরলো। সবাই যখন আমাকে কেন্দ্র করে ভিড় তৈরী করলো ঠিক তখনই বাবার কন্ঠ শুনতে পেলাম। বাবা কিছুটা ধমক দিয়ে বলেন,
– হচ্ছে টা কি? এভাবে জটলা পাকিয়ে না দাঁড়িয়ে, ওর থেকে একটু সরে দাঁড়াও।
আব্বুর কথায়ই কাজ হয়েছে। একে সবাই আমার থেকে দূরে গিয়ে অবস্থান করলো। এর খালামনি একটু উচ্চস্বরে বলেন।
– ভাইয়া, সন্ধ্যার হঠাৎই প্রেসার লো হয়ে গেছে। ওর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
বাবা মাকে বলেন আমাকে উপরে নিয়ে ।
এরপরই বাবা বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলন। আব্বুর এতো রাগ, ওনি এখন পর্যন্ত আমার সাথে একটা কথাও বলেন না এবং কি আমারে দিকে একটি বারের জন্য তাকালেনও না। বাড়ী থেকে বের হওয়ার আগে ঠিকই কুহু সাথে হেঁসে কথা বলে গেলেন। আব্বুর এমন অবহেলা এবং ধূসরের করা প্রতারণা আমি আর সহ্য করতে পারলাম না সেখানেই খালামনির গায়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম। নিজের রুমের খাটে। আমার মাথার ডান পাশে খালামনি বসে আছে চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরে। আমি বহু কষ্টে উঠে বসলাম, এতোক্ষণে খালামনি চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো। এরপর পরম মমতায় আমার মাথাটা ওনার বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। একটুপর বলেন,
“এখন তোর শরীর কেমন লাগছে?
আমি আস্তে করে বললাম,
-ভালো।
এরপর খালামনি বলেন,
– তখন কি হয়েছিলো, এয়ারপোর্টে এমন করলি কেন?
খালামনির কথায় আমি হুহু করে কান্না শুরু করে দিলাম, অনেক কষ্টে খালামনিকে বললাম,
– ধূসর আমার সাথে বেঈমানী করেছে।
আমার কথা শুনে খালামনি চোখ বড়কে তাকিয়ে আছে। তারপর বলনে,
– মানে?
আমি খালামনিকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললাম, সবটা শুনে ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– দেখ মা জীবনটা ছেলেখেলা না। পঁচা সামুকে কেটে শুধু শুধু পা’টা নষ্ট করিস না। আল্লাহ চাইলে ধূসরের থেকে ভালো কাউকে তুই তোর জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে পারিস। এখনো সময় আছে। তুই নিজেও তো বলেছিলিস, তুই ধূসরকে প্রথমবার যখন দেখেছিস তখন নতুন বরের সাজে সজ্জিত ছিলো। এই ব্যাপারে কখনো ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিস?
আমি ডুকরে কেঁদে বললাম,
– জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু তখন বলতো ও নাকি চট্টগ্রামে বিয়ে করে, সেদিন বউ রেখে ঢাকায় আসছিলো ট্রেনে করে। আমি তো ওর এই কথা দুষ্টুমি মনে করেছি তখন।
এরপর খালামনি বলেন,
– দেখ মা ধূসর তোর অকপটে তোকে সব সময় সত্যিটা’ই বলে এসেছে। এখন তুই ওর এই কথাটা কিভাবে নিয়েছিস এটা সম্পূর্ণ তোর ব্যাপার৷। আমাকে ও তো কখনো ধূসরের সাথে দেখা করতে নিয়েও গিলা না। ছবিও দেখালি না।
এরপর আমি বলাম,
– তুমি দেখবে ওর ছবি? আমার ফোনেই ছবি আছে৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি যখন ফোন পেলাম না ঠিক তখনই খালামনি বলেন,
– তোর ফোন আজকে তুই নিজেই ভেঙ্গেছি। তোর ফোন এখন রুবির কাছে।
আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম একটু পর খালামনিকে বললাম,
-এখন আমি কি করবো? আমি যে ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
খালামনি বলেন,
– দেখ আমি কিন্তু ৬ টা বছর তোর খালুর সাথে সংসার করার পর, ডিভোর্স দিয়ে তাকে ভুলেই জীবন যাপন করছি। তোর খালুর জন্য কি আমার জীবন থেমে গিয়েছে? আমিও তো আগে তোর খালুকে ছাড়া থাকতে পারতাম না এক মুহূর্ত । দেখ ১৮ টা বছর তোর খালুকে ছাড়া আমি একটাই আছি। তোর তো ধূসরের সাথে সম্পর্ক মাত্র দু’বছেরর । শুন মা বিয়ের আগে প্রেম, ভালোবাসা হারাম।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আব্বু রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন। খাটের কাছে এসে খালামনির হাতে খাবারে প্লেট দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৪
– কি অবস্থা এখন ওর?
খালামনি কিছু আগেই, আমি খালামনিকে ছেঁড়ে আব্বু কে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– আব্বু প্লিজ আর রাগ করে থেকো না। আমার প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তোমার করা রাগে। আমাকে মাফ করে দাও প্লীজ।
আব্বু একটু সময় নিয়ে বললেন,
– ক্ষমা চাইলেই কি ক্ষমা করা যায় সন্ধ্যা?
কান্নায় আমার গলায় কথা আটকিয়ে যাচ্ছে। বহু কষ্টে বললাম,
– তুমি আমায় শাস্তি দাও, তাও রাগ করে থেকো না। একটু কথা বলো আব্বু।
এরপর আব্বু আমায় বলেন,
– আমি যে শাস্তি দিবো তুমি মেনে নিবা?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
এরপর আব্বু আমাকে বললেন,
– আমায় ছুঁয়ে কসম কেটে বলো তুমি আমার দেওয়া শাস্তি মেনে নিবে?
আমি ঝটপট আব্বুকে ছুঁয়ে বললাম,
– তুমি যা শাস্তি দিবে, আমি মাথা পেতে মেনে নিবো। একটা টু শব্দও করবো না। তবুও তুমি রাগ করে থেকো না আব্বু।
এরপর আব্বু যা শাস্তিস্বরূপ বললেন, তা আমি কখনো আশা করি নি। তিনি বললেন,
– পরশু কুহু সাথে তোমারও বিয়ে হবে। তবে তা আমার পছন্দ মতো পাত্রের সাথে এটাই হবে তোমার শাস্তি।