ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৪ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৪
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি দু’বছর হতে চললো। এর মাঝে বাবা ভুলেও আমার সাথে ১ মিনিটের জন্যও কথা বলে নি। বাড়ী যাই না দু’বছর। মা এসে প্রায়ই থাকে আমার সাথে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ” তোমার বাবা তোমার উপর বড্ড রেগে আছে। ওনি ঠিক করেছে এই জীবনে তোমার মুখ দর্শন করবে না।” বাবার এমন ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারছি না। অনেকবার চেষ্টা করেও মা’কে ধূসরে কথা বলতে পারি নি। কোন মুখে বললো। তাদের মন আমি একবার নয় দুই বার ভেঙ্গেছি।

এই দু’বছর অনেক কিছু পাল্টিয়ে গেছে। ধূসরের একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরী হয়েছে। চাকরিতে জয়েন করেছে ৬ মাসের মতো হবে। ও বলেছে এদিকটা একটু গুচ্ছিয়ে নিয়ে, তারপর ওর বাসায় আমার কথা জানাবে। কিন্তু জানাবে জানাবপ বলে আর ধূসর তার পরিবারকে আমার কথা জানায় নি। এই দু’বছর বাসায় থেকে বিয়ের জন্য কোন চাপ দেওয়া হয় নি আমাকে। হয়তো আগের ঘটনা গুলোর ছাপ এখনো বাবা মা’র মনে রয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুবি ও জুবায়ের বাড়ী থেকে তাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে তাদের এনগেজডমেন্টও হয়ে গেছে৷ ৩ দিন পর কুহুরও বিয়ে হয়ে যাবে কায়েফ ভাইয়ার সাথে। বাবা সাথে কুহুর ভালোই ভাব হয়ে গেছে এই কয় বছরে। কুহুকেও নিজের মেয়ের মতো আদর করে। এই সকল তথ্য আমার মা নিজেই আমাকে বলেছে। আম্মুর মুখে থেকে যখন এই কথা গুলো শুনলাম , ঠিক তারপর রুমে গিয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছি। পরশুদিন রাতের বেলা শুনতে পারলাম কুহুর বিয়ে নাকি আমাদের চট্টগ্রামের বাড়ী থেকে দেওয়া হবে।

এদিকে কায়েফ ভাইয়ারও বাবা মা নেই। সেই সুবাদে দুজনে একসাথে হলুদ দেওয়া কথার বলেছিলো খালামনি। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি করে আমার বাবা, তিনি বলেছিলেন, কুহু আর কায়েফ কে চট্টগ্রামের নিয়ে আসতে একই বাড়ীতে বিয়ের সকল আয়োজন করা হবে। এই সব শুনে খুশি হলেও কোথাও একটা খারাপ লাগছিলো আমার। কারণ বাবা আমার থেকে কুহুকে বেশিই প্রাধান্য দেয়। এই কথা মাথায় আসতেই আমার মনে হলো,আমার মাথার উপর থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া সরে গেছে।

আরেক দিকে নিজের মনকে নিজে শাসালাম এই বলে, ” ছিঃ সন্ধ্যা তোমার তো একটা পরিবারে আছে। সেই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ তোমাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু কুহু তার পরিবার থাকতেও তাকে কেউ ভালোবাসে না। তুমি কিনা তার সাথে হিংসে করছো।” এখন আসি মূল কথায় এইসব আকাশ কুসুম ভাবার কারণ কি জানেন? কারণ হলো একটু আগে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে বাবার কলে। ঘুম আচ্ছন্ন চোখে যখন দেখলাম বাবার নাম্বারটা থেকে আমাকে কল দেওয়া হয়েছে। ঠিক তখনই আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

ফোনটা বাজতে বাজতে প্রথম বার কেটে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় বার আবার ফোনটা বেজে উঠলো।তখনই আমি নিশ্চিত হতে পারলাম যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না।কাঁপা কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করলাম, ফোনটা কানে কাছে নিয়ে শুনতে পেলাম বাবার কন্ঠ। কত দিন পর বাবার কন্ঠ শুনতে পেলাম। আমি খুশিতে শব্দ করে কান্না শুরু করলাম ওপাশ থেকে বাবা বলেন,

– কান্না শুনার জন্য কল দিয়েছি আমি?
আমি কান্নায় কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। বহু কষ্টে বললাম,
– না, কেমন আছো আব্বু?
আব্বু বলেন,
– তুমি যেই পরিস্থিতিতে ফেলে চলে এসেছো তারপরও কিভাবে জিজ্ঞেস করো? আমি কেমন আছি?
আমি কান্নারত কন্ঠে বললাম,
– আব্বু আমার ভুল হয়ে গেছে , শেষবারের মতো মাফ করে দাও। আর কখনো এমন করবো না প্রমিস আব্বু।
আব্বু একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

– মাফ চাইলে কি সব ভুল মাফ করা যায় সন্ধ্যা?
এই প্রথম বাবা আমাকে নাম ধরে ডাকলেন। আমার জ্ঞান হবার পর কখনোই শুনি নি, বাবা আমাকে নাম ধরে ডেকেছে। সবসময় আম্মু অথবা মা বলে ডেকেছে। আব্বু কতটা অভিমান করেছে তার কথায় স্পষ্ট বুঝা যায়। আমার কান্নার গতি বেরে গেলো। অনেক কষ্টে বললাম,
– আব্বু তুমি রাগ করে থেকো না।আমাকে না হয় শাস্তি দাও তারপরও রাগ করে থেকো না।
এর বাবা বলেন,
– তুমি এখন কোথায় আছো?
আমি বললাম,
– বাসায়,
কেন?
তিনি বলেন,

– শুনো আজকে কুহু সাথে চট্টগ্রামে চলে আসো। তারপর না হয় তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় তা চিন্তা করবো কেমন?
আব্বুর কথায় যেনো আমি আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। খুশিতে চিৎকার করে বললাম,
-আব্বু আজকেই চট্টগ্রামে আসছি।
ওনি বলেন,
-কুহুর কাছে তোমার টিকিট আছে, সাবধানে বাড়ী এসো রাখছি।
বলেই ফোন কেটে দিলো। আমি খুশিতে দৌড়ে গিয়ে রুবি আর কুহুকে জড়িয়ে ধরলাম। দুইজনই ঘুমাছিলো।

ধূসর চট্টগ্রাম গিয়েছে গত কাল রাতে, ওর আম্মুর শরীর হঠাৎই প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেছে। তাই অফিস থেকে জরুরি ভিক্তিতে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছে । যাওয়ার আগে আমাকে মেসেজ দিয়ে বাসে করেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধূসরের মেসেজ এমন ছিলো,
“শুনো আম্মুর শরীর হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেছে। মাত্রই তুবা ফোন করে জানালো। তাই আমি অফিস থেকে জরুরি ভিক্তিতে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছি , নিজের খেয়াল রেখো বউ”।

ধূসরের এই মেসেজ আমি বিকেল ৫টায় দেখলাম। খুশির চোটে সারাদিন ধূসরের কথা মাথা থেকে একদমই বেরিয়ে গেয়েছিলো। একটু পরই ফ্লাইট আমাদের চট্টগ্রামের । বাবা আমাদের জন্য প্লেনের টিকিট কেটে দিয়ে ছিলো। প্লেনে উঠার আগে ঠিক করলাম ধূসর কে কল দিয়ে বলবো চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে আমাকে এসে রিসিভ করতে। এই পরিকল্পনা নিয়েই ধূসর কে কল দিলাম, একবার নয় পাঁচ বার কল দেওয়ার পরও ধূসর কল রিসিভ করলো না।

মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেলো। একটু পর চিন্তা করলাম হয়তো ও ওর মাকে নিয়ে ব্যস্ত তাই কলটা রিসিভ করে নি। তাই আর কল দিলাম না। প্লেনে উঠে বসলাম। আমাদের সাথে খালামনি, কায়েফ, কুহু, রুবি, জুবায়ের ভাইয়া ও চট্টগ্রামে যাচ্ছে। বেশি না হয়তো ১ কি ২ মাস আগেই খালামনির কথায় আমরা সকলেই ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট তৈরী করি। ভ্যাগিস তখন পাসপোর্ট বানিয়ে ছিলাম নইলে আজকে আর প্লেনে করে চট্টগ্রামে যাওয়া হতো না। এই কথা চিন্তা করছিলাম আর মুচকি হাসছিলাম, আমার হাসি দেখে খালামনি আমাকে জিজ্ঞেস করলে,

– কি ব্যাপার সন্ধ্যা , একটু বেশি খুশি মনে হচ্ছে?
আমি হাসি মুখেই বললাম,
– কত দিন পর আব্বুকে দেখবো সামনে থেকে তাই তো খুশি।
খালামনিও মুচকি হেসে বললেন,
– পাগলি একটা।
তারপর আমি জানলা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম । বাহিরে দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সেদিকে আমার কোনো খেয়াল ছিলো। খালামনির ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। খালামনি বলেন,
-উঠ আর কত ঘুমাবি ১০ মিনিট পর চট্টগ্রামে চলে আসবো।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৩

এর মাঝে আমি আধ ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে নিয়েছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমি প্রথম বাবাকে কল দিয়ে বললাম আমরা চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ী পৌঁছে যাবো। এর পর ধূসরকে কল দিলাম। প্রথম বার কল রিসিভ করলো না। দ্বিতীয় বার কল দিলাম।এই বার কলটা রিসিভ হলো। ফোন ঐপাশ থেকে একটা নারী কন্ঠ ভেসে আসলো সে বললো,

– আসসালামু আলাইকুম কে?
অপরিচিত একটা মেয়ে কন্ঠ শুনো আমি প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো ধূসরের বোন তুবা কল রিসিভ করেছে। এর পর বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, কে তুবা? তোমার ভাইয়া কোথায়?
ঐপাশ থেকে আবার সে অপরিচিত নারী কন্ঠে শুনা গেলো সে বললো,
– আমি তুবা নই, আমি ধূসরে স্ত্রী। ধূসর বাসায় নেই কোনো দরকার ধূসর কে?

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৫