ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৩ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৩
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেলো, আমি আমার বাবা মাকে ছেড়ে এসেছি তার। ভাবতেই বড় কষ্ট লাগে এই দুই বছরে তারা কেউই আমার খোঁজ খবর নেয় নি। কিন্তু আমি তাদের খোঁজ খরব ঠিকিই রেখেছি কোনোনা কোনো ভাবে।আজকে মঙ্গলবার খালামনি সাধারণত আজকে বাসায় থাকে না। কিন্তু খালামনি আজকে বাসায় আছে এবং আমাকে জরুরি ভিত্তিতে তার বাসায় আসবার জন্য নির্দেশ করছে ফোনে । খালামনি যখন কল দিয়ে ছিলো তখন আমি এনজিও তে গিয়ে মাত্র আমার কেবিনে বসেছি।

আগত সকল কাজ কর্ম নতুন মেনেজার বুঝিয়ে খালামনি বাসায় যাবার জন্য রওনা হলাম। এক মজার বিষয় কি জানে না। ঐই যে আমাকে রাস্তায় গাড়ীর নিচে পড়ার থেকে বাঁচিয়ে ছিলো। সেই আমাদের এনজিওর নতুন মেনেজার। নতুন বললে ভুল হবে, কারণ ওনি চাকরিতে জয়েন করেছে একবছরের বেশি হতে চললো। তারপরও আমি কেন জানি ওনাকে নতুন মেনেজার বলে সম্মোধন করি। ওনি প্রচন্ড শান্তশিষ্ট একজন মানুষ। এই বছর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করছেন। ওনার নাম, কায়েফ রহমান। এইসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমি পৌঁছে গেলাম খালামনির ফ্ল্যাটে। এনজিও থেকে খালামনির বাড়ী আসতে সময় লাগে ২৫ মিনিট কিন্তু রিক্সায় আসলে সময় লাগে ১০ মিনিট। লিফটে উঠলাম ৮ তলায় যাওয়ার জন্য।

আমার প্রচুর ভয় লাগছে কারণ খালামনি আমাকে কখনো আগে এভাবে তলব করে নি। একপ্রকার ভয়ে ভয়ে খালামনির ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজালাম। একটু পরই দরজা খুলে গেলো। দরজা যে খুলেছে তাকে দেখে আমার চোখ ছোট হয়ে গেলো, কারণ দরজা যে খুলেছে সে আর কেউই না সয়ং সন্ধ্যা । এই মেয়েটাকে আমি ঘন্টাখানেক আগে মিরপুরের ফ্ল্যাটে ঘুমে মগ্ন অবস্থায় রেখে, বাসায় থেকে বেরিয়েছি এনজিও তে যাওয়ার জন্য । আর ও কি না খালামনির বাসায় এখন।নিশ্চই কোনো গন্ডগোল আছে। সন্ধ্যা আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” সরবি? দরজা থেকে নাকি এভাবেই দাঁত কেলাবি?”,ভেংচি কেটে বললাম আমি সন্ধ্যাকে।
ও কিছু না বলে দাঁত কেলিয়ে ভেতরে ঢুকবার জায়গা করে দিলো।
ড্রাইং রুমে প্রবেশ করে দেখি খালামনি খুব মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজ পড়ছে।
আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে, ওনি খবর কাগজ থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
– কি খবর?
– “আলহামদুলিল্লাহ,তোমার? “, আমি বললাম।
খালামনি ওনার পাশে আমাকে বসার জন্য ইশারা করলেন। আমি লক্ষী মেয়ের মতো ওনার পাশে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ের পর ওনি হঠাৎ করে বলেন,

– ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু পরিকল্পনা করেছো?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
– না তেমন কিছু ভাবিনি। আমার আর কিসের ভবিষ্যৎ?
ওনি আমার বলেন,
– বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছো?
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
– যে কলঙ্ক আমার গায়ে লেগেছে তা জেনে কে-ই বা আমায় করবে বিয়ে। বিয়ে নিয়ে কিছু চিন্তা করা তা যে আমার জন্য স্বপ্ন ছোট আম্মু।
ওনি আমার ডান হাতটা ওনার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,

-এই কলঙ্কের জন্য কি তোর জীবন থেমে গিয়েছে? শুন তুইও আমার কাছে মেয়ের মতো। ঠিক সন্ধ্যা যেমন আমার মেয়ে তুইও আমার মেয়ে। প্রত্যেকটা মা’ই চায় তার মেয়ের একদিন সাজানো-গোছানো সংসার হোক। শুন মেয়েরা বড় হলে বিয়ে দিতে হয়, মেয়েরা পরের বাড়ীর সম্পদ। আমি চাই তুই বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার কর।
আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে খালামনির দিকে তাকিয়ে বললাম,
– কিন্তু সব সত্যি জেনে কে-ই বা আমাকে বিয়ে করবে?
ওনি বললেন,
– বিয়ে করবি কি না বল?
আমি খালামনির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না, মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলাম নিরবে। ১০/১৫ মিনিট পর খালামনি বলেন,

-কিরে হ্যাঁ না কিছু তো একটা বল?
আমার কন্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না। অনেক কষ্টে খালামনিকে বললাম,
– সব সত্যি জেনে, যদি কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয় এবং পাত্র যদি ছোট আম্মু, তোমার পছন্দ মতো হয় তাহলে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
খালামনি আমার কথা শুনে হেঁসে বললেন,
– শুন এনজিওর নতুন মেনেজার কে তোর কেমন লাগে? আমি ওকে তোর জন্য পাত্র হিসেবে ঠিক করেছি। ও তোর ব্যাপারে সব জানে। এমনে ও মানুষ হিসেবে কিন্তু খুবই ভালো। এখন তুই কি বলিস? ওর সাথে আমার কথা হয়েছে ওর কোনো আপত্তি নেই বিয়েতে। তোর সিদ্ধান্ত জানতে বলেছে।
আমি একটু সময় নিয়ে খালামনিকে বললাম,

– যদি ওনাকে তোমার মনে হয় আমার জন্য যোগ্য পাত্র, তাহলে এই বিয়ে তে আমারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ওনার সাথে আমি বিয়ের আগে কথা বলতে চাই।
আমার কথা শুনে, খালামনি এবং সন্ধ্যা সমস্বরে বলে উঠলেন,
– আলহামদুলিল্লাহ।
এর পরই খালামনি কায়েফ কে কল দিয়ে বলেন, বিকেল সাড়ে ৬ টায় রমনা পার্কে আমার সাথে দেখা করতে।

সন্ধ্যা ৬ টা বাজে। মাত্রই আমি, সন্ধ্যা , রুবি রমনাপার্কে প্রবেশ করলাম। আমাদের সাথে একটু পর যুক্ত হবে জুবায়ের ভাইয়া ও ধূসর ভাইয়া। সোজা অফিস থেকেই রমনায় আসবে তারা। তাদের দুইজনেরই চাকরি একটা মাল্টিন ন্যাশনাল কোম্পানি হয়েছে। রুবি আর জুবায়ের ভাইয়ার সম্পর্ক তাদের বাবা মা মেনে নিয়েছে। পারিবারিক ভাবে এনগেজডমেন্টও হয়ে গেছে গত বছর। ধূসর আর সন্ধ্যা প্রেম এখন জমজমাট। দুইজন দু’জনকে চোখে হারায়। আমি যখন নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিলাম ঠিক তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখি কায়েফ কল দিয়েছে। একটু সময় নিয়ে কলটা রিসিভ করলাম।
ফোনের ঐপাশ থেকে কায়েফের মিষ্টি কন্ঠে ভেসে আসলো,

– আসসালামু আলাইকুম। কুহু?
আমি বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, জ্বি বলুন।
– তোমরা এখন কোথায়?
আমি বললাম,
– মৎস ভবনের সামনে যে গেটেটা আছে রমনার। আমরা সেই গেটের ভিতরে আছি।
ওনি বললেন,
– আচ্ছা আমি আসছি। বলেই কল কেটে দিলো।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১২

এর মাঝে ধূসর আর জুবায়ের ভাইয়া চলে এসেছে। আমি রুবি আর সন্ধ্যার কে বলে লেকের দিকে চললাম। লেকের পাশে সিমেন্টের তৈরী কতগুলো বেঞ্চ আছে। এই বেঞ্চ গুলোর মধ্যে একটা বেঞ্চ কখনোই খালি থাকে না৷ কেউনা কেউ সেই বেঞ্চটা দক্ষল করে রাখে। আজকে আমার ভাগ্য অনেক ভালো ছিলো কারণ সেই বেঞ্চ আজকে ফাঁকা । আমি এগিয়ে গিয়ে সেই বেঞ্চটায় বসলাম। এই বেঞ্চটা খালি না থাকার কারণ হলো, এই বেঞ্চটায় বসে লেকের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আর ছবি তোলার জন্য পারফেক্ট একটা জায়গা।

বেঞ্চটার একপাশে জবা ফুলের গাছ। আরেক পাশে একটা বেল গাছ। বেঞ্চটা সবুজ কচি ঘাসের উপর। ডানদিকে তাকিয়ে দেখি কায়েফ হেঁটে আসছে। ভাবতেই অবাক লাগে এই ছেলেটার সাথে আজবাদে কাল আমার বিয়ে। কায়েফের গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় ঝাকড়া চুল, চোখের মনি ব্রাউনিস, পাতলা ঠোঁট, চোখে চশমা, উচ্চতায় আমার থেকেও লম্বা হয়তো ৫ফুট৮ হবে। ওনি হয়তো বাসায় থেকেই এখানে আসছে কারণ সকালে ফর্মাল লুকে ছিলো।

এখনো সে আকাশী রঙ্গে শার্ট পরা, জিন্স প্যান্ট, হাতে একটা ঘড়ি। ওনাকে এর আগে কখনো এভাবে দেখা হয় নি। ওনি আমার পাশে এসে বসলেন। আমার দিকে একটা কাঠগোলাপ ফুলের মালা এগিয়ে দিয়ে বলেন,
আসার সময় দেখলাম একটা মেয়ে কাঠগোলাপের মালা বিক্রি করছে । আমকে অনেক অনুরোধ করে বললো একটা মালা নিতে, তাই কিনে নিয়ে আসলাম তোমার জন্য।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৪