ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১২ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১২
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

কালকে রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিলো। তাই কুহু আর রুবিকে না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে ছিলাম এনজিও তে যাওয়ার জন্য৷ এনজিও তে আজকে একটা নতুন মেয়ে এসেছে। সেও একজন ধর্ষিতা। আমার কেন জানি মনে হতো আমার চেয়ে করুন অবস্থায় কেউ নি। এখন অবশ্যই এই ধারণা আমার পাল্টে গেছে এই এনজিওতে আসবার পর। এই এনজিওতে আমি এমনও মেয়ে পেয়েছি যারা নিজের আত্মীয় স্বজন দিও ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে।

আচ্ছা এদের কি একটুও খারাপ লাগে না? ওদের তো খারাপ লাগে না বরং নিজের শারীরিক সুখের জন্যই তো আমাদের মতো অবলা মেয়েদের বেঁচে নেয়। নিজের চাহিদা মিটবার পর আমাদের কথা ওদের মাথায় আশে তখন। যদি আমার বলে দেই পুলিশের কাছে ধর্ষেক নাম ও ঠিকানা, পরিচয় তখন অনেক সমস্যা হলেও হতে পারে।এই কথা চিন্তা করে কে জানেন? এই কথা অবশ্য বড়লোকের একমাত্র আদরের দুলালরা চিন্তা করে না। কারণ তারা তাদের পিতার অর্থ সম্পদ দিয়ে সমাজের মুখ বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু এখন মনে প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কে এই কথা চিন্তা করে?

এই কথা চিন্তা করে সেই ধর্ষকের পরিবার। এবং এই কথা চিন্তা করেই তাদের পরিবার অর্থ দিয়ে সমাজের মুখ বন্ধ করে ফেলে। পরে কি হয় জানেন অনেক ধর্ষিতারা সমাজের ভয় মুখ বুঝে এই কলঙ্ক আজীবন বয়ে চলে। যদি কোনো ধর্ষিতা তার প্রতিবাদ করে তখন সমাজ, সেই ধর্ষিতার দিকে আঙ্গুল তুলে। এবং বলে নিশ্চয়ই তুমি তখন অশ্লীল পোশাক পড়ে ছিলে, নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো দোষ ছিলো নইলে এক হাতে তালি বাজে না,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেয়ে মানুষ একা বাসার বাইরে কেন গেয়েছিলো না গেলো তো এসব কিছুই হতো না ইত্যাদি। এইসব ভাবতে ভাবতে বাস থেমে গেলো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে। যার জন্য আমাকে আমার কল্পনা থেকে বাস্তবতায় ফিরতে হলো । বাসের গেটের সামনে কন্টেকদার চিলিয়ে চিলিয়ে বলছে
মীরপুর ১২!!! মীরপুর ১২!!!
নামবেন কেউ?

আমি আমার পার্সটা হাতে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। আর মাত্র কয়েক মিনিট হাটে গেলেউ বাসায় পৌছিয়ে যাবো। তাই হাটতে শুরু করলাম। আমি বারবার বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছিলাম আমার ভাবনাগুলেতে। আজকের আসা নতুন মেয়েটি এনজিওতে, আমার ভাববার মূল কারণ । আমি না চাইতেও হাটতে হাটতে আমার অতীত এবং আজকের মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাটছিলাম।

হাটতে হাটতে কখন যে আমি বেখেয়ালে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিলাম তার আমার খেয়াল ছিলো না। হঠাৎই একজন দৌড়ে এসে আমাকে রাস্তার কিনারে টেনে নিয়ে আসে। আচমকা এমন হওয়ায় আমি ভারসাম্য হারিয়ে অপরিচিত ব্যক্তির বুকের উপর পরলাম। এতোক্ষণ আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম আমার আশেপাশের কোনো শব্দই আমার কানে তখন পৌঁছাচ্ছিলো না। হঠাৎই একটি মিষ্টি কন্ঠ শুনতে পেলাম। এই মিষ্টি কন্ঠে উৎস কি তা দেখবার জন্য আমি আমার চোখ মেলে সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি সেই অপরিচিত ব্যক্তিরই এই মিষ্টি কন্ঠ। সেই অপরিচিত ব্যক্তি আবারও বলেন,

– আপনি ঠিক আছেন তো? কোথাও লাগে নি তো?
অপরিচিত ব্যক্তিটার কথা শুনে আমি হুস ফিরলে। তড়িৎ করে ওনার বুকের থেকে সরে পরলাম। আমার এই কাজে ওনি যে লজ্জা পেয়েছে তা আমি বুঝতে পারলাম যখন ওনি আমার করা কাজে মাটির দিকে তাকিয়ে ফেলেন। তারপর আমি বললাম,

– আমি ঠিক আছি। কোথাও লাগে নি।ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার উছিলায় আজকে বেঁচে গেলাম ধন্যবাদ।
অপরিচিত ব্যক্তিটি আমার দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনি কি এখানেই থাকেন?
আমি পানির বোতলটা নিয়ে একটু পানি পান করে বললাম,
– হ্যাঁ।
ওনি একটা কাগজ বের করে বললো এই ঠিকানাটা কোথায় একটু বলতে পারবেন কি?
ওনার দেওয়া কাগজটা দেখে আমি চোখ বড় করে ফেলালম কারণ কাগজের ঠিকানাটা আমার বর্তমান বাড়ীর ঠিকানা।

আজকারে আকাশ বেশ সুন্দর । একদম ধূসর রঙ্গের মেঘের ছাড়া ছড়ি আকাশের বুকে। আমি আর ধূসর দুপুর বেলায় বাসা থেকে বেড়িয়েছি, আজকে একসাথে দুপুরে খাবো বলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ধূসর আমাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো পদ্ম রিসোর্টে। সেখানে বিকেলটা কাটিয়েছি। একটু আগে ট্রলারে উঠেছি রিসোর্ট থেকে নদী ভ্রমণ করবো বলে। এই দিকটায় আসার পর প্রচন্ড শীত লাগছে আমার।

আমি জানতাম না যে মাওয়া আসবো তাহলে আমি গরম কাপড় একটা বাসায় থেকে নিয়ে আসতাম। অবশ্য আমার পরিধানে গরম কাপড় আছে কিন্তু সেটায় শীত মানাচ্ছে না। ট্রলারে উঠার পর ধূসর একদমই চুপ হয়ে গেছে। একমনে চুপচাপ নদীর জল দেখছে। ও কে আজ অত্যন্ত সুদর্শন লাগছে। এমনিতে ও মাশাল্লাহ ভালোই সুদর্শন কিন্তু আজকে একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে। ধূসর আজকে ডার্ক ব্লু টি-শার্ট পরেছে,কালো জিন্স, ডান হাতে সালমান খানের ব্রেসলেটের মতো ব্রেসলেট, বাম হাতে রোলেক্সের ঘড়ি, কালো সান গ্লাস, চাপ দাঁড়িতে এক প্রকার আকর্ষণ সৃষ্টি করছে ।

সবচেয়ে যে জিনিসটা বেশি আমাকে আকর্ষণ করছে তাহলো ওর সরু নাকের ডাগায় তিলটা। শীতের কারণে ধূসরের ফর্সা গাল,নাক দুটোই লাল হয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে পদ্মা নদী পানির দিকে তাকিয়ে আছে। এখন ধূসরকে দেখলে যে কেউই বলতে পারবে ও হয়তো কিছু একটা নিয়ে নিজের মাঝেই বোঝাপড়া করছে।
আমিও চুপচাপ পরিবেশ টা উপভোগ করছি। আসলেই ধূসরের বলা কালকের রাতের কথা সত্য মনে হচ্ছে। ও আমায় কালকে রাতে বলেছিলো,

-“একটু চুপ করে থাকা যায় না? কিছু মুহূর্ত কি চুপ থেকে অনুভুব করতে পারো না। নিজে তো করো না অন্যকেও করতে দাও না।”
কালকে রাতে অবশ্য ওর এই কথা মনের মনে একটু কালো মেঘ জমেছিলো। তা আজকে আর নেই এই মুহূর্ত থেকে কারণ ও কালকে সত্য কথাই বলেছিলো৷ কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে অনুভব করা যায়। এখন যদি আমি বা ও কথা বলি তাহলে, কিন্তু ও আর আমি এই অপরূপ সুন্দর পরিবেশ টাকে উপভোগ করতে পারবো না। সূর্য প্রায় ডুবে যাবে যাবে এমন অবস্থা। আমি এর আগে কখন এভাবে সূর্য অস্ত যেতে দেখি নি। বিক্রমপুরের মেয়ে হলে কি হবে। আমি কখনো মাঝ নদীতে ট্রলারে বসে এভাবে সূর্য অস্ত যেতে দেখি নি। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবে গেলো ঠিক তখনই আমি ধূসর কে বললাম,

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১১

– ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।
আমার কথায় ও আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ওর এমন মাদকা চাহুনি আমার হৃদয় মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করলো। আমি না চাইতেও বলে ফেললাম,
– শুনো তুমি সব সময় সান গ্লাস পরবা।
ও একটু হেসে বললো,
-কেন?
আমি আমার গাল বাচ্চাদের মতো ফুলিয়ে বললাম,
– তোমার চোখ শুধু আমিই দেখবো আর কেউই না।
এবার ধূসর মুচকি হেসে বললো,
– চোখ আমার আমি যাকে খুশি তাকে তাকিয়ে দেখবো।
তারপর আমি বললাম,
– শুনো তুমি আমার, তাই তোমার চোখও আমার । আমার পারমিশন ছাড়া তুমি কেউর দিকে তাকাবা না।

আমার কথা শুনে ধূসর এবার শব্দ করে হাসতে লাগলো। আমি মুগ্ধ নয়নে ওর হাস্যজ্জল মুখ দেখছিলাম ঠিক তখনই ধূসর বললে,
– ভালেবাসি সন্ধ্যা । নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে শেষ বললাম,
– আমিও বাসি।
ও বললো,
– কি?
তারপর আমি বললাম,
– ভালোবাসি তোমায় আমি।
ও আমার কথা শুনে হুট করে বললো,
– চলো বিয়ে করে ফেলি।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১৩