ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১১ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১১
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

শীতের প্রকোপ প্রচন্ড বেশি কয়দিন ধরে৷ ১ম সেমিস্টার পরীক্ষার জন্য দিন দুনিয়া ভুলে পড়ার মাঝে ডুবে ছিলাম পরীক্ষার আগে থেকেই। এর মাঝে মাও এসে কয়েকদিন থেকে গেলো।সময় চলেছে তার আপন গতিতে, আমার জন্য বা আপনার জন্য সময় থেমে থাকে নি। আমার না মাঝে মাঝে ঘড়ির কাটা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। নিজের জন্য , নিজের আপন জনের জন্য। নিজের ইচ্ছে মতো সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। আমি জানি আমায় কথাগুলো নিছকই খামখেয়ালি ।

পরীক্ষার সময় যখন রাত জেগে আমি পড়তাম, হঠাৎই ইচ্ছে করলে বাইক নিয়ে চলে যেতাম বহু দূর যেখানে কেউ নেই। আছে শুধু একটা ল্যামপোষ্ট। সেই ল্যামপোষ্টের আলোয় আমি ভোর পর্যন্ত ফুটপাতে বসে পাঠ্য বই পড়েছি। এই সব আমার জন্য নতুন কিছু না।এমন একটুআধটু পাগলামি আমি রোজই করি। কথায় আছে না, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।

আমার এই পাগলামির কিছু কিছু সাক্ষী রুবি আর কুহু। এই যে ধরুন এখন রাত১০ টা বাজে আর আমার এখন ইচ্ছে করছে বারবিকিউ চিকেন খেতে তাওবা হোম মেইড। আগতো এই রাতে আমার প্রাণ প্রিয় সখীগণ আমার মনোবাসনা পূরণ করবার প্রস্তুতি করছে। এতো দিন পড়ার চাপে নিজেকে ধূসরের থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু, তা আর সম্ভব হয় নি। প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবে ধূসরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমার মনে হয় ও ইচ্ছে করেই আমার সামনে এসে পড়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইতিমধ্যে তুফসা আপু, জুবায়ের ভাইয়া জেনে গেছে আমাদের একে আপরের প্রতি অনুভূতি সম্পর্কে। আজকে আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করতে পারলাম। জুবায়ের ভাইয়ার কাছ থেকে তাহলো, তার এবং রুবির মাঝে একটি সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। যা আমাদের রুবি কিছুই বলে নি। আজ যদি জুবায়ের ভাইয়া না বলত, ব্যাপারটা তাহলে রুবি কথা সম্পূর্ণ ভাবে কথাটা লুকিয়ে রাখতো। হয়তো কখনো বলতোই না কথাটা আমাদের । এই নিয়ে আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেছে । কারণ রুবি আমাকে আপন কেউ মনে করে না, তাই আমাকে ওদের সম্পর্কের কথা কিছুই বলি নি। এই কথা যখন ভাবছিলাম তখন আমার চোখ জ্বলজ্বল করছিলো যা হয়তো রুবি দেখতে পেয়ে আমার কাছে ছুটে এলো এবং আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

– আরে পাগল কান্না করিস কেন? আমি নিজেই তো আজকে জুবায়ের থেকে সিউর হলাম আমার প্রতি তার ফিলিংস। আমি নিশ্চিত না হয়ে তোদের কিভাবে বলি বল?
এমন কি হয়েছে কখনো,আমি তোদের কাছে কিছু লুকিয়েছি? আমি সবসময় তোদের জন্য ছিলাম খোলা ডায়রির মতো এখনো আছি।আমাকে যখন তখন তোরা পড়তে পারবি। বিশ্বাস কর বোন আমি সত্যিই তোদের আজকে রাতে বলতাম। প্লিজ কান্না থামা প্লিজ।

রুবি কথায় আমি আস্তে আস্তে কান্নার গতি কমিয়ে দিলাম। রুবিকে ছেঁড়ে চোখ মুখ মুছে যখন সামনের দিকে তাকালাম ঠিক তখনই আমি আবিস্কার করলাম আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। কারণ মাত্রই ছাঁদে ধূসর এসে দাঁড়িয়েছে।
আচ্ছা এই ছেলেটার চোখের দৃষ্টি এতো মাদকা কেন? তাকে আর কত বলবো এমনভাবে চলা ফেরা না করতে। কালকেই মার্কেট থেকে একটা সানগ্লাস কিনে আনবো, একেবারে কুচকুচে কালো রঙ্গের যাতে কেউই তার এমন মাদকা নয়ন না দেখতে পায়।

ছাঁদে এসে দেখি বারবিকিউ চিকেনের প্রস্তুতি চলছে। আমি কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছি। এসেই বিছানায় টানটান হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। !যখন চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হাজির হলো ঠিক তখনই সন্ধ্যার মোবাইল থেকে একটা ছোট মেসেজ এলো,
– এই জনাব শুনছেন? এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাসায় এসে পড়েছেন। তাহলে এক কাজ করুন না, অলসতা বাদ দিয়ে নিচে গিয়ে দোকান থেকে ৩ লিটার কোকাকোলা নিয়ে আসুন তো ছাঁদে।
ইতি আপনার,,,,,,,,,,

সন্ধ্যার এমন মেসেজ আজকে নতুন না প্রায় রাতের বেলায় উল্টা পাল্টা আবদার করে বাচ্চাদের মতো। এতো কয়দিন আগে রাত ২ টা কল দিয়ে বললো, তার এখন নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাসায় নুডলস শেষ । নুডলস না খেলে নাকি ওর পড়া হবে না। কি আর করার নিজের পড়া বাদ দিয়ে তার জন্য রান্না ঘরে গিয়ে নুডলস রান্না করেছিলাম। তা চুপিচুপি ওদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে রেখে, ওকে কল দিয়ে বলেছিলাম দরজা খুলে দেখো। দরজা খুলে যখন দেখলো দরজায় সামনে এক বোল নুডলস রাখা।খুশিতে সে লাফঝাঁপ শুরু করে দিয়ে ছিলো তখন। আমি দরজার আড়ালে তা দেখেছিলাম সম্পূর্ণটা।

নিচে থেকে কোকাকোলা নিয়ে ছাঁদে এসে দাঁড়িয়ে দেখি সন্ধ্যার চোখ ফোলা। সরু নাকটা টকটকে লাল হয়ে আছে। চোখ অশ্রুসিক্ত এবং লালচে। ওর পরনে, কালো ফতুয়া, জিন্স, গায়ে চাদর। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। সন্ধ্যা এমন অবস্থা দেখে আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। আমি কি কোনো ভুল করেছি? নাকি আমার কোনো ব্যবহারে ও কষ্ট পেয়েছে? কুহুর কাছে কোকের বোতল গুলো দিয়ে আমি সন্ধ্যার কাছে গেলাম। আমাকে দেখে সে ছাঁদে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। আমাকে সেদিক টায় যেতে দেখে পিছন থেকে জুবায়ের বলে উঠলো,

– আহারে বাবু, প্রেমিকা রাগ করছে? যাও, যাও প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাও।
জুবায়ের এমন কথায় সবাই অট্টহাসিতে হাসতে লাগলো। আমি পিছন ফেরে জোরেই বললাম,
– প্রেমিকা না, বউ অভিমান করছে।
আমার উত্তর শুনে সবাই চিৎকার দিয়ে বললো,
– ওরে বাব্বাহ কি ভালোবাসা।
আমি আর এর উত্তরে কিছুই বললাম না, মুচকি হেসে সন্ধ্যার কাছে গেলাম।
গিয়ে দেখি সে রেলিং ভর দিয়ে রাস্তার চলন্ত যানবাহন দেখছে। আমি নিঃশব্দে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, ওর পাশে যে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তাই আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও একসময় বলে উঠলো,

– এতো কি দেখছেন আমাকে একটু বলবেন? রুমে গিয়ে আয়নায় আমিও দেখবো।
ওর কথায় আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল । এখন কথা বললে এই রকম সুন্দর মুহূর্ত আর কখনোই আমার জীবনে ফিরে আসবে না। আকাশে আজকে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত সমগ্র পৃথিবী। সেই চাঁদের আলো এসে পড়েছে সন্ধ্যার মুখমন্ডলে। সন্ধ্যার নাকে সাদা পাথরে নাকফুলটা চাঁদে আলোয় চিকচিক করছে। সন্ধ্যার শরীর থেকে সুগন্ধি ভেসে আসছে। এটা কোনো পারফিউমের সুগন্ধি নয়, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। কারণ আমি যতবারই সন্ধ্যার কাছে এসেছি, কখনই পারফিউমে ঘ্রাণ পায় নি।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১০

বরং বর্তমানের এই একই সুগন্ধির ঘ্রাণ পেয়েছি। ও মনে হয় আজকে চোখে কাজল দিয়েছিলো৷ ওর লালচে দুচোখ কাজল রাঙ্গা। আমি আমার হাত দিয়ে ওর খোঁপা করা চুলগুলো কে উন্মুক্ত করে দিলাম ওর পিঠে। আমার এমন কাজে আমার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকালো ও চোখ বড় করে। ও কিছু একটা বলতে চাইছিলো তার আগে আমি আমার হাতের আঙ্গুল ওর ঠোঁটের উপর আলতো করে রেখে বললাম।

– একটু চুপ করে থাকা যায় না? কিছু মুহূর্ত কি চুপ থেকে অনুভুব করতে পারো না। নিজে তো করো না অন্যকেও করতে দাও না।
ও আমার আঙ্গুলে হুট করে কামর দিয়ে বসলো। আমি আমার হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখি, আঙ্গুলে ওর দাঁতের দাগ বসে গেছে। আমি চোখ ছোট করে সন্ধ্যার দিকে তাকালাম । তখন ও আমায় বললো,
– একটু আগে জুবায়ের ভাইয়াকে বলেন না , বউ অভিমান করেছে তার শাস্তি সরূপ এই কামর টা নিতান্তই তুচ্ছ।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১২