জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২২ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

কিছু কিছু মানুষের বাইরের রূপের সাথে ভেতরেও সুপ্ত একটা রূপ থাকে। যেটা সে সবাইকে দেখাতে চায় না। সকলের আড়ালে রাখতে চায়। রিখিয়াও আজ বিহানকে আলাদাভাবে আবিষ্কার করল। রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভেতরে এলো। বিহান অনেকগুলো বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে। বিহান নিজের চোখ বেঁধে রেখেছে আর বাচ্চাগোলোকে খুঁজছে। বাচ্চাগুলোও মজা করে যাচ্ছে বিহানের সাথে। রিখিয়া বিষ্মিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই বিহানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগোতে এগোতে ওর খেয়ালই নেই কখন বিহানের কাছে চলে গেছে। হঠাৎ করেই বিহান রিখিয়াকে বাচ্চা ভেবে ধরে ফেলল। ঘটনার আকষ্মিতায় রিখিয়া চমকে উঠল। সব বাচ্চারাও থেমে গেল। বিহান সাথেসাথেই বুঝতে পারল এটা কোন বাচ্চা না। একহাতে রিখিয়াকে ধরে রেখেই আরেক হাত দিয়ে চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে রিখিয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রিখিয়া এখানে চলে আসবে ও বুঝতে পারেনি। এখানে কেন আসল মেয়েটা। ও দ্রুত রিখিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

” তুমি এখানে?”
রিখিয়া কানের পিঠে চুলগুলো গুজে নিয়ে বলল,
” আসলে আপনার সাথেই দেখা করতে এসছিলাম।”
বিহান বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা তাকিয়ে আছে। বিহান মুচকি হেসে বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে বাচ্চাদের ভেতরে যেতে বলল। আর এটাও বলল যে ওদের জন্যে খাবার চলে আসছে তাড়াতাড়ি। বাচ্চাগুলো হাসিমুখে ভেতরে চলে গেল। বাচ্চারা ভেতরে যেতেই বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” হঠাৎ এখানে দেখা করতে এলে যে?”
” আপনি বলেছিলেন প্রতি রবিবার বিকেলে এখানে আসেন তাই..”
” কিছু বলবে?”

” আমার সেদিনের বিহেভিয়ারের জন্যে রেগে আছেন তাইনা?”
বিহান ঠোঁট চেপে একটু হাসল তারপর রিখিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” সেটা ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট ইজ আমার যদি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক থেকেও থাকে তাতে তোমার কেন এত রাগ হচ্ছিল? তোমার কী যায় আসে?”
রিখিয়া একটু অস্বস্তিতে পরল। কী উত্তর দেবে ও? উত্তরটাতো ওর নিজেরই অজানা। তাই মাথা নিচু করে ওড়নায় আঙ্গুল পেচাচ্ছে। বিহান রিখিয়ার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলল,
” বাই এনি চান্স তুমি আমায় ভালো-টালো বেসে ফেলোনি তো?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান গলা ঝেড়ে বলল,
” নাহ পরতেই পারো। আফটার অল এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে য‍দি আশেপাশে থাকে তো প্রেমে পরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং না পরাটাই অস্বাভাবিক।”
রিখিয়া হাত ভাজ করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” তাইনা?”
বিহান নিজের কলারটা ঠিকভাবে সেট করে বলল,
” হ্যাঁ তাইতো।”
রিখিয়া হেসে দিয়ে বিহানের বাহুতে একটা ধাক্কা মারল। বিহানও হাসল। হাসিটা থামিয়ে রিখিয়া বলল,
” এখানে কী করতে আসেন?”
” আসলে এখানে বাচ্চাগুলো খুব প্রিয় আমার। ওদের সাথে খেলতে, মজা করতে, খাওয়াতে। তাই প্রতি রবিবার এখানে আসি। ওদের সাথে খেলি, খাওয়াই, মাঝেমাঝে ওদের নিয়ে শপিং করতেও যাই।”
রিখিয়ার মনে পরল আগে একবার বিহানকে দেখেছিল শপিংমলে বাচ্চাদের সাথে। ও একটু না, অনেকটাই অবাক হল। বিহানের এমন রূপে ও সত্যিই ভীষনরকম অবাক হয়েছে। বিহানের যে এরকম একটা রূপ আছে সেটা ও জানতোই না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” আচ্ছা। আপনি ওদের এত ভালোবাসেন কেন? কোন বিশেষ কারণ?”
বিহান মলিন হেসে বলল,
” হয়তো ওদের সাথে আমার বিশেষ মিল আছে তাই।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” কী মিল?”
” ওরাও এতিম। আমিও কোথাও না কোথাও এতিম। ওদের বাবা-মা নেই তাই এতিম। আমার থেকেও নেই তাই আমি এতিম।”
রিখিয়া বিহানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা। বাবা-মা থাকতেও রিখিয়া নিজেকে এতিম বলছে কেন? রিখিয়া কিছু বলবে তার আগেই একটা লোক বড় বড় দুটো বক্স নিয়ে এলো যার মধ্যে খাবার এলো। বিহান একগাল হেসে বলল,

” চল ওদের খাবার দিয়ে দেই। তুমিও হেল্প কর আমাকে।”
রিখিয়া মাথা নেড়ে উঠে গেল। ভেতরে গিয়ে সব বাচ্চাদের খাবার দিল দুজন মিলে। এই এতিম বাচ্চাদের নিজের হাতে খাবার দিতে পেরে আর ওদের এই হাসি মুখটা দেখে তৃপ্তিতে দুচোখ ভরে যাচ্ছে রিখিয়ার। এক অদ্ভুত শান্তি। এরজন্যে সারাজীবন বিহানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে ও। এর মধ্যে রিখিয়ার সাথেও বাচ্চাদের ভালো বন্ডিং হয়ে গেল। কারণ রিখিয়া খুব ভালোবেসে মিশেছে ওদের সাথে। একটা বাচ্চাতো বলেই বিহানকে বলেই ফেলল,
” ভাইয়া এই আপুটা কী আমাদের ভাবী হন?”

কথাটা শুনে রিখিয়া চমকে গেল। চরম অস্বস্তিতে পরে গেল ও। বিহান ঠোঁটে কামড়ে হেসে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল,
” কেন? ভাবী হিসেবে মানাচ্ছে না?”
বাচ্চাটা বোকলা দাঁতে হেসে বলল,
” পার্ফেক্ট আছে।”
রিখিয়া চরম অবাক হল। আজকালকার বাচ্চাগুলো কী বিচ্ছু। খাওয়া শেষে আবারও খেলল ওরা। এবার রিখিয়াও যোগ দিল। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা দিন কাটলো রিখিয়ার। আজ বিহানকে সে নতুনভাবে দেখল। নতুনভাবে চিনল। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে বিহানের প্রতি যা আগে কখনও হয়নি।

স‍ৌহার্দ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। এখন ওর প্রেজেন্টশন দেওয়ার পালা। যেখানে ও ওর প্লানটা সবার সামনে দেখাবে। মনে মনে ভীষণ ভয় করছে ওর। কারণ ওর লাইফের প্রথম প্রেজেন্টেশন এটা। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তুর্বীকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
” স্টার্ট কর।”
তুর্বী একটু গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” আপনি ঠিকই বলেছিলেন স্যার। কাজের জায়গাটা মজা করার জায়গা না। সেরকম করা উচিতও না।”
এটুকু বলে একটু থামল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” কিন্তু, যদি কাজের জায়গাটায় আমরা নিজেদের জন্যে কমফরটেবল করে তুলতে পারি দেন আই থিংক ইটস গুড ফর আস। কারণ তাহলে প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের মত করে আনন্দ নিয়ে কাজ করতে পারবে। কারণ কাজের প্রেশার বা একটানা কাজ করা যেকারো জন্যেই বোরিং। সো যদি প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের কাজের মধ্যে রিলাক্স করার বা নিজেকে কমফরটেবল রাখার একটা সুযোগ পায় তাহলে তারা কাজটা যেমন ভালোভাবে করতে পারবে একইসাথে তাদের ওপর স্ট্রেসটাও কম পরবে।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর বচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেছে। কে বলবে এই মেয়েটা এতটা ইনফরমাল, ছটফটে। তুর্বী স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২১

” সো, যদি আমাদের আগের প্লানের স্টাফ রুমে কোওয়ার্কিং স্পেসটা আরেকটু বাড়াতে পারি। তাহলে সেটা যেমন স্টাফদের কমফর্ট জোন দেবে। স্টাফদের লম্বা সময় অফিসে কাজ করতে ইচ্ছা হবে। দে উইল এনজয় দেয়ার অফিস। ভিসিটরদের ভিসিট করতেও সুবিধা হবে। ”
একজন কলিগ বলল,
” কিন্তু এতটা জায়গা তো নেই।”
আরেকজন বলল,
” এনড হোয়াট এবাউট বাজেট?”
তুর্বী আবার স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

” যদি আমরা আমাদের আগের প্লানে রাখা মাঝখানের এই পার্টিশনটা বাদ দিতে পারি। তাহলে অনেকটা জায়গা বেঁচে যাবে। আর সেইজায়গাটাকেই আমরা ইউস করতে পারি লাইক দিস।”
বলে তুর্বী পরের স্লাইডে ওর বানানো মডেলটা দেখালো আর সেই মডেলের বেসিকটা ব্যাখা করে বলল,
” হ্যাঁ এতে করে বাজেট একটু বেড়ে যাবে ঠিকই কিন্তু যদি আমরা একটু ভালো করে দেখি তাহলে এখানকার কোওয়ার্কিং স্পেস এন্ড চাহিদা দুটোই বাড়বে। এন্ড উইথ দ্যাট উই ক্যান কভার আপ। এতে আমাদের লস হবেনা। কজ উইস্টান চার্চিল সেইড, ‘ We shape our building, and thereafter they shape us”
সবাই হাততালি দিয়ে উঠল তুর্বীর অসাধারন প্রেজেন্টেশন দেখে। অথচ কালকে তারাই ওর ওপর হাসছিল। সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে দেখছে তুর্বীকে। তুর্বী একপলক সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আই থিংক আপনারা এটা ভেবে দেখবেন।”
বলে তুর্বী চলে গেল। সৌহার্দ্য মুচকি হাসল। আজ প্রথমবার ও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ওর একটুও আফসোস হচ্ছেনা। বরং ভালো লাগছে। যেন এটাই চাইছিল ও। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,
” সি ইজ ইম্প্রেসিভ!”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৩