জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৬ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে আছে। সবকিছুই কেমন স্হির। আকাশের গোল চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। তার সামনে দিয়ে মাঝেমাঝে ভেসে যাচ্ছে হালকা মেঘের দল। হঠাৎ হঠাৎ নিশাচরের ডাক শোনা যাচ্ছে। রিখিয়া ব্যালকনির রেলিং এর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে রিখিয়া। পরনে লাল বেনারসি, গায়ে কিছু গহনা আছে আর কিছু খুলে রেখেছে, চুল খুলে দিয়েছে। সত্যিই একমুহূর্তই যথেষ্ট সবকিছু বদলে দেওয়ার জন্যে। ওরও জীবনের সবকিছু বদলে একদিনেই। এখন বিবাহিত। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ওর জীবন জুড়ে গেছে অন্যকারো সাথে। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিখিয়া। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একজোড়া হাত ওকে জড়িয়ে ধরে কাধ থুতনি রাখল। রিখিয়া কেঁপে উঠল হালকা। পরক্ষণেই বুঝতে পারল যে ওকে জড়িয়ে সে ওর স্বামী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিখিয়া নিচু কন্ঠে বলল,
” এতো দেরী করলেন যে?”
” ওই বাঁদরগুলো আটকে রেখেছিল। অনেক করে কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এসছি। জানো আমি ভাবতেও পারিনি আজকের রাতটা আমার জীবনে আসবে। সত্যিই তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে যাবে।”
রিখিয়া হাতদুটো থেকে নিজেকে মুক্ত করে পেছন ঘুরে বলল,
” আমরা স্বার্থপর হয়ে গেলাম, বিহান?”
বিহান রিখিয়ার চোখের দিকে কিচুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি এক হাসি দিল। এরপর ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল,
” আমারও প্রথমে সেটাই মনে হচ্ছিল। গিল্টি ফিলও করছিলাম প্রচুর। কিন্তু শাফিনের সাথে কথা বলার পর বুঝতে পারলাম যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, সবার জন্যে।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” শাফিন ভাইর সাথে কথা হয়েছে তোমার?”
বিহান পকেট থেকে একটা কাগজ বেড় করতে করতে বলল,
” হ্যাঁ। তোমার জন্যে একটা চিঠি আছে। শাফিন দিয়েছে।”
বলে ভাজ করা একটা কাগজ রিখিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। রিখিয়া অবাক হয়েই কাগজটা নিয়ে আস্তে করে ভাজ খুলে পড়তে শুরু করল;
‘রিখিয়া
প্রথমে তোমার কাছে ক্ষমা চাইঙছি। ভালোবাসার মানুষটার চোখের জলের কারণ হওয়া মস্ত বড় অন্যায়। আমার জন্যে তোমাকে এতোটা কাঁদতে হবে সেটা কখনও ভাবতেই পারিনি। সত্যিই অন্যায় করে ফেলেছি। তবে এটা ঠিক যে তোমাকে সত্যিই  ভালোবেসেছি। কিন্তু তোমার ভালোবাসার পাল্লা সবসময়ই ভারি ছিল। আমারই ভুল ছিল যে তোমার মন পড়তে দেরী করে ফেলেছি। বিহান তোমাকে মাত্র দুবছর যাবত ভালোবাসলেও ওর ভালোবাসা একদম খাটি। আমি তোমাকে মন থেকে অনেকটা সময় ধরে ভালোবাসলেও আমার ভালোবাসায় কিছুটা হলেও খুঁত ছিল। তোমার মনে প্রশ্ন উঠত না? তোমার ভাই কেন আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতে এতো ইন্টারেস্টেড ছিল?
তুমি হয়তো জানোনা আমি তোমার বড় ভাইকে বড় মাপের এমাউন্ট অফার করেছিলাম তোমাকে যেকোন মূল্যে রাজি করানোর জন্যে। আমার মনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য না থাকলেও আমার বেছে নেওয়া পদ্ধতি ভুল ছিল। আমি তোমাকে পাওয়ার মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম, কিন্তু বিহান তা কখনও পারত না। ও তোমাকে এতোটা ভালোবাসার পরেও বিন্দুমাত্র ইমোশনাল প্রেশার ক্রিয়েট করেনি তোমার ওপর। তুমি যাতে দোটানায় না ভোগো, কষ্ট না নাও তাই তোমার কাছে নিজের ভালোবাসার প্রকাশটুকু করতে চায়নি। কী ভাবছ? আমি কীকরে জানলাম? কাল রাতে বিহানকে বাড়িতে  খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে বেড়িয়েছিলাম ওকে।
আর তোমাদের ওভাবে দেখে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে বিহানই তোমাদের সেই ভালোবাসা। তোমাদের কথপোকথন আর কান্না দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কতবড় ব্লান্ডার হতে যাচ্ছিল। আর বাড়ি ফিরে আসার পর সৌহার্দ্য আর বিহানের কিছু কথাও শুনেছি আমি। আমি জানি তুমি সবার কথা ভাবো কিন্তু নিজের কথা না। তুমি জানতে আমার বাবা এমপি। আর আজ আমার বিয়ে তোমার সাথে না হলে আমার বাবার সম্মান নষ্ট হবে। ফ্যামিলির রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে। তাই কত অনায়াসে নিজের সব সুখ ত্যাগ করে দিচ্ছিলে।
আর তোমার পাগল প্রেমিকও। কিন্তু আমি কীকরে এতো স্বার্থপর হই বলোতো? যাকে ভালোবেসেছি তার সারাজীবনের কষ্টের কারণ কীকরে হই? তাই যেটা করেছি একদম ঠিক করেছি। ভালো থাকবে তুমি। বিহান তোমাকে আমার চেয়েও ভালোরাখবে। তবে ভেবোনা তোমার বিরহে আমি সারাজীবনে কষ্টে মরব। এতোগুলোদিন আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এইজন্য নয় যে আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। কারো জন্যে কেউ মরে যায়না। আমি এইজন্যই অপেক্ষায় ছিলাম যাতে পরে আমাকে আফসোস করেতে না হয় যে আমি অপেক্ষা করিনি।
কিন্তু আজ আমার কোন অফসোস নেই। আমি নিজের মনকে এখন বোঝাতে পারব যে আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভাগ্যে ছিলেনা। আর ভাগ্যের ওপর কারো হাত থাকেনা। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। এতে কারো দোষ নেই। তাই যদি মন থেকে কখনও আমায় বন্ধু ভেবে থাকো একফোটাও অপরাধবোধে ভুগবে না। প্রমিস রইল কিন্তু। বিহানকে ভালো রেখো। অনেক অনেক শুভকামনা তোমার জন্যে।
ইতি
তোমার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী”
চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিখিয়া। সত্যিই শাফিন ওর অন্যতম একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আজ শাফিন ওর জন্যে যা করেছে তার ঋণ ও কোনদিন শোধ করতে পারবেনা। করতে চায়ও না। কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতে ভালোলাগে। আজ সকাল থেকেই রিখিয়ার বিয়ের তোরজোড় চলছিল। তুর্বী আর সৌহার্দ্য দুজনেই হতাশ হয়েছিল। ভেবেই নিয়েছিল আর কিছুই সম্ভব নয়। রিখিয়া আর বিহান গত রাতেই নিজেদের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে একেওপরের থেকে অনেক দূরে সরে এসছিল, অনুভূতিহীন হয়ে পরেছিল। রিখিয়াকে গোসল করাতে নেবে তখনই হল সমস্যা। শাফিন রিখিয়াদের বাড়ি এসে সোজসাপ্টাভাবেই বলে দিল ও রিখিয়াকে বিয়ে করবে না। সবাই বেশ অবাক হয়েছিল শাফিনের এমন কথায়।
 উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। পেছন পেছন শাফিনের পরিবারও এসছে। সবাই কানাঘুষা করছে। কেউ কেউ শাফিনকে নানারকম প্রশ্ন করেছে। শাফিন এরপর ওর রিখিয়া আর ওর পরিবারকে সবার আড়ালে করে বসিয়ে।সবাইকে শান্ত করে এরপর সত্যি সত্যি সবটাই খুলে বলে দিলো। রিখিয়া-বিহান, সৌহার্দ্য তুর্বী চারজনই ভীষণ অবাক হয়েছে। শাফিন সবটা কীকরে জানলো কীকরে? সবটা শোনার পর রিখিয়ার বাবা-মা প্রচন্ড আফসোস করলেন। রিখিয়াকে বকলেনও। নিজের এরকম ক্ষতি কেউ করে? রিখিয়ার বাবা তো বলেই দিলেন, ওনার মেয়ের খুশিই ওনার জন্যে সব। ওনার মেয়ের বিয়ে বিহানের সাথেই হবে।
 শাফিনের বাবা নিজের মানসম্মানের কথা ভেবে একটু ঝামেলা করেছিলেন কিন্তু শাফিনের জেদের সাথে পেরে উঠলেন না। অনেক তর্ক আর আলোচনার পর অবশেষে এটাই ঠিক হল যে আজ রিখিয়া আর বিহানের বিয়ে হবে। সৌহার্দ্য আর তুর্বীর বুক থেকে একপ্রকার পাথর নেমে গেল। সৌহার্দ্য তো শাফিনকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। তুর্বীও রিখায়াকে জড়িয়ে ধরে হেসে দিয়েছিল। কিন্তু রিখিয়া আর বিহান তখনও ঘোরের মধ্যে ছিলো। ওদের কাছে সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আর যখন ওরা স্বাভাবিক হল, তখন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও একটা গিল্টি ফিলিংও হচ্ছিল শাফিনের জন্যে। এরপর বেশ আনন্দের সাথেই রিখিয়া আর বিহানের বিয়েটা হয়ে যায়। পুরোটা সময় শাফিন বেশ হাসিমুখেই ছিল। সেই হাসির পেছনে হয়ত একবুক কষ্টও ছিল। তবে বিহান রিখিয়ার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা মিরাকল। ওরা কখনও ভাবেনি ওদের সাথে হঠাৎ  এমন কিছু হতে পারে। বিদায়ের পর রিখিয়াকে নিয়ে ওরা বিহানের ফ্লাটেই এসে উঠেছে। সাথে সৌহার্দ্য তুর্বীসহ শাফিন আর আরও কিছু বন্ধু বান্ধবী এসছে।
বিহানের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে রিখিয়া। বিহান রিখিয়ার কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,
” মন খারাপ করোনা। আজ যদি তোমার বিয়েটা  শাফিনের সাথে হয়ে যেতো। না তুমি ভালো থাকতে না শাফিন। সেটা শাফিনের কথায় আজ বুঝেছি আমি। শুধু আমরা উইশ করতে পারি, যাতে ওর জীবনে এমন কেউ চলে আসে যে ওকে ভীষণ ভালোবাসবে আর ভালোরাখবে।”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। বিহান বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমার কাছে এখনো সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে জানো? কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। তুমি আমার স্ত্রী। যেখানে কাল অবধি আমি তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। গুমরে মরছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে__”
রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,
” আল্লাহ যা করেন সবার ভালোর জন্যে করেন। হয়তো আমাদের দুজনের এই কষ্ট পাওয়াটা দরকার ছিল। এই কষ্টটাই হয়তো আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা একে ওপরকে কতটা চাই। তাই দেখুন, ভুল করে হলেও আমার হাতে আপনার নামের মেহেদীই পরেছি।”
বিহান রিখিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে রিখিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক কাঁদিয়েছি তোমাকে। অনেকটা কষ্ট দিয়েছি।”
রিখিয়া মুখ হালকা ফুলিয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর কখনও কষ্ট দেবেন না তো?”
” কখনও না। কথা দিচ্ছি সারাজীবন বুকে আগলে রাখব।”
” জানেন আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যে মরে__”
বিহান সাথেসাথেই  রিখিয়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,
” চুপ! আজকের রাতে এসব কথা একদম বলবেনা। আজকের রাতটা আমাদের জন্যে অনেক স্পেশাল। অনেকটা সাধনার পর পেয়েছি একে ওপরকে। তাই এই রাতটা বিশেষ হওয়া খুব জরুরি, খুব।”
শেষের কথাটা রিখিয়ার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল বিহান। রিখিয়া লজ্জা পেয়ে গেল হঠাৎ করেই। সাথেসাথেই বিহানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। বিহানও শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল নিজের প্রিয়তমাকে। আজ মনের সব দুঃখকে মুছে ফেলে আজ এক হওয়ার পালা। নতুন যাত্রা শুরু করার পালা।
অনেকটাই রাত হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিহান আর রিখিয়ার বিয়েটা এভাবে হয়ে যাওয়াতে ও ভীষণ খুশি হয়েছে। অবশেষে ওর ভাইটার জীবনে কেউ তো এসছে, যে ওকে ভালো রাখবে। কিন্তু এইমুহূর্তে মন খারাপও কম হচ্ছেনা। আজ সারাদিন এত আনন্দের মধ্যেও তুর্বীর ফ্যাকাশে মুখটা ওর সহ্য হচ্ছিলো না। যতই অভিমান থাকুক, ওতো ভালোবাসে মেয়েটাকে। মেয়েটা যে কতটা কষ্ট আছে সেটা ও জানে। ও বুঝে গেছে এবার তুর্বীর অনুভূতিগুলো একদম খাঁটি। আচ্ছা? অভিমানটা আর না করলে হয়না? এতে কার লাভ হচ্ছে? ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। জীবনকে তো আরো একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। তাইনা? এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী এসে দাঁড়াল ওর পাশে। কিন্তু সৌহার্দ্যর দিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সৌহার্দ্য আড়চোখে একবার তাকিয়ে থেকে বলল,
” ঘুমাও নি?”
তুর্বী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ঘুম আসছিল না।”
সৌহার্দ্য কিছুই বলল না। তুর্বী নিজেই বলল,
” আজ সত্যিই মিরাকল হল তাইনা? সত্যিই ভাবিনি রিখু আর বিহানের বিয়েটা এভাবে হয়ে যাবে। সবটাই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।”
সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,
” সবটাই শাফিনের জন্যে হয়েছে। ওই ছেলেটার কাছে আমরা সবাই ঋণী। তবে সত্যি বলতে ওরা একে ওপরের ভাগ্যে লেখা ছিল। তাই শেষ মুহূর্তে এসে সবটা বদলে গেল।”
তুর্বীর সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর আমরা?”
সৌহার্দ্য হালকা চমকে উঠল। কী বলবে ও? ওর মনতো চাইছে তুর্বীকে। কিন্তু বলতে পারছেনা। তারওপর কালকে ওসব কথা বলার জন্যে মনে মনে গিল্টি ফিলিংস ও হচ্ছে ওর। সৌহার্দ্যকে চুপ থাকতে দেখে তুর্বীর মন আবার কেঁদে উঠল। ও কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
” সৌহার্দ্য আমি জানি আমাদের সম্পর্ক চলাকালীন ঐ ছ-মাস আমি তোমাকে অনেক আঘাত করেছি। কিন্তু আমাকে কী আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কখনও ওমন ছেলেমানুষী করব না। তোমাকে কষ্টও দেবোনা। আই লাভ ইউ সৌহার্দ্য।”
সৌহার্দ্য রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওর গলা কাঁপছে। কিন্তু কিছুই বলল না। বেশ অনেকক্ষণ সৌহার্দ্যর কাছে কোন উত্তর না পেয়ে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন দেখতাম মা-বাবার মধ্যে দারুন বন্ডিং ছিল। এমন মনে হতো যেন একে ওপরের প্রাণ। একদম মেড ফর ইচ আদার ইউ নো। কিন্তু মা মারা যাওয়ার ঠিক একসপ্তাহ পর বাবা আরেকজন মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে এলেন। তার সাথে একটা বাচ্চা। মজার ব্যাপার ছিল যে ঐ ছেলে আমার বাবারই ছিল। মানে উনি আমার মা জীবিত থাকতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। সব বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সেদিনই চলে গেল। সেদিন প্রথম মনে হয়েছিল যে ভালোবাসা বলে কিছুই হয়না। সবটাই সাময়িক আবেগ। কাউকেই বিশ্বাস করা যায়না। সবাই ঠকায়। তাই আবেগ জিনিসটা বিসর্জন দিয়েছিলাম। সেটাই করতাম যা ভালোলাগত। কোন কিছু শুরু করার আগে এক্সপিরিমেন্ট করে দেখলাম যে সেটা আমার জন্যে কেমন হবে। ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হল। কিন্তু তুমি আমায় বুঝিয়েছ যে ভালোবাসা কী হয়, বিশ্বাস কী হয়, সম্পর্ক কী হয়। আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে মাঝরাস্তায় এভাবে একা ফেলে যেওনা সৌহার্দ্য। আমি নিতে পারব না।”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৫

সৌহার্দ্য স্তব্ধ হয়ে শুনছিল এতক্ষণ। মেয়েটার মনেও যে এরকম একটা ক্ষত আছে ও জানতোই না। সত্যিই একটা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ থাকে।অনেকটা সময় হয়ে গেল কেউ কিছুই বলছে না। দুজনের মনই ছটফট করছে। সৌহার্দ্যর দিক থেকে কোন উত্তর না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুর্বী চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য হাত ধরে ফেলল। তুর্বী অবাক চোখে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” আমি তোমাকে এক্সেপ্ট করতে পারব না।”
তুর্বীর দৃষ্টি অসহায় হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে জল পরবে ভাব। সৌহার্দ্য বলল,
” আমি সেই তুর্বীকেই চাই। যেই তুর্বীর অদ্ভুত কথা শুনে আমার মন ভালো হয়ে যেত। যে কাউকে পরোয়া করতো না। যে সারাদিন হেসে খেলে বেড়াতো। আমি আমার সেই মিস ভয়ংকরীকে চাই।”
তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,
” তো মিস তুর্বী?  উইল ইউ বি মাই মিসেস ভয়ংকরী?”
তুর্বী চোখের জল ছেড়ে দিল। হেসে সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই সৌহার্দ্য হাত দিয়ে বাধা দিয়ে বলল,
” আ..আ। আরেকটা কথা। এসব এক্সপিরিমেন্ট করা আর চলবে না। এটা জীবন, সাইন্স ল্যাবরেটরি না।”
তুর্বী হেসে দিয়ে সৌহার্দ্য বুকে কিল মারল। সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। তুর্বীর মনে হল ওর সকল না পাওয়া পাওয়ায় পরিণত হল। এখানেই ওর চির শান্তি।
বিচ্ছেদ, বিরহ, কষ্ট, যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে পুড়ে ওদের চারজনের ভালোবাসা আজ খাঁটি হয়ে গেল। জীবনের লড়াইয়ের চারজনকই পেল জলফড়িঙের খোঁজ।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৭