জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৭ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সকালের নিরবতার মাঝে পাখির কিচিরমিচির শব্দ দিনের শুরুটা আরও মিষ্টি করে দেয়। রোদের মৃদু আলো ইতিমধ্যেই চারপাশে ছড়িয়ে পরেছে। প্রকৃতিও যেন নতুন সকালকে স্বাগত জানাচ্ছে। বেশ লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো রিখিয়া। হালকা গোলাপি রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। এমনিতে শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকলেও আজ অদ্ভুতরকম ভালোলাগা কাজ করছে। চুল মুছতে মুছতে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা বিহানের দিকে একপলক তাকাল। উন্মুক্ত শরীরের অর্ধেকটা চাদরের বাইরে বেড়িয়ে আছে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সে।

ঘুমানোরই কথা, প্রায় ভোর রাতের দিকেই ঘুমিয়েছে দুজন। রিখিয়ারও ঘুম হয়নি। কিন্তু অভ্যেস না থাকায় বিহানের মত পরে পরে ঘুমাতে পারছেনা। দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। এখন বিহানকে জাগাতে হবে। ও টাওয়েল টা রেখে বিছানায় বসে আলতো গলায় কয়েকবার ডাকল বিহানকে। কিন্তু বিহান নড়লোও না। রিখিয়া ভ্রু কুচকে ফেলল। এতো ঘুম কেন লোকটার? বড্ড অলস। ও এবার বিহানকে হালকা ঝাকিয়ে একটু জোরে ডাকল। বিহান এবার একটু নড়ে উঠল। আরও দু-বার ডাকার পর বিহান ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

” রিখু আরেকটু ঘুমাতে দেওতো। সারারাত জাগিয়ে রেখেছো।”
রিখিয়া অবাক হয়ে গেল। ও জাগিয়ে রেখেছে? কী অনায়াসে নিজের দোষটা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আস্ত বাটপার! ও এবার আরও জোরে ঝাকিয়ে বলল,
” উঠুন। একদম নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাবেন না। একটু পর সৌহার্দ্যরা ডাকতে চলে আসবে। উঠুন না?”
কিন্তু বিহানের কোন হেলদোলই নেই। রিখিয়া কোনভাবেই না পেরে এবার পাশের গ্লাস থেকে জল নিয়ে সোজা বিহানের মুখে মেরে দিল। বিহান এক ঝটকায় উঠে বসে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে বোকার মত রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” এটা কী হল?”
রিখিয়া হেসে দিয়ে বলল,
” আপনাকে ঘুম থেকে তোলার স্পেশাল টেকনিক ইউস করা হল। সৌহার্দ্য শিখিয়েছেন। একদম ঠিক কাজে দিয়েছে।”
বিহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোমাকে তো…”
কিন্তু ও ধরার আগেই রিখিয়া দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। বিহান হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পরল। হঠাৎ রিখিয়া দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
” দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিন। ওখানে যেতে হবে আবার।”
বলে আবার চলে গেল। বিহান মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। ওর ভাইও অবশেষে ওর সাথে ষড়যন্ত্র করল? রিখিয়াকে এসব শিখিয়ে দিয়েছে? ওকে ঘুম থেকে তোলার টেকনিক? বাহ! কোন ব্যাপারনা। ওরও দিন আসবে। এসব ভেবে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো বিহান।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছোট করেই বিহান আর রিখিয়ার রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। বিহানের ফ্লাটে তেমন স্পেস নেই তাই কমিউনিটি সেন্টারেই সকল আয়োজন করা হয়েছে। খুব বেশি মানুষ ডাকেনি। কাছের কিছু লোকজনদেরই ডাকা হয়েছে। ফরিদকে ইনভাইট করেছিল বিহান। কিন্তু এতো অল্প সময়ে ও এসে পৌঁছতে পারবেনা তাই পরে একদিন আসবে বলেছে। সকলেই চলে এসছে ইতিমধ্যে। সবটা দেখে নিয়ে সৌহার্দ্য আর শাফিন নিজেরাও রেডি হয়ে এলো। শাফিনকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে যে মেয়েটার রিসিপশনে ও এভাবে কাজ করছে, এতো আনন্দ করছে, গতকাল সকাল অবধি সে মেয়েটার ওর বউ হওয়ার কথা ছিল। সৌহার্দ্য, তুর্বী ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কিছু বলছেনা।

এখন কী-বা বলা যায়? বরং সবার মাঝে থেকে যদি ওর মনটা একটু ভালো থাকে সেটাই ভালো। এরমধ্যে বিহানও তৈরী হয়ে গেছে। তুর্বী আর নুসরাত মিলে রিখিয়াকে সাজিয়েছে আজ। নুসরাত গতকাল রাতেই চলে এসছে। রিখিয়াকে নিয়ে আসা হলো। বিহান তো রিখিয়াকে দেখে আহত-নিহত হচ্ছে। যেদিন থেকে এই মেয়ের প্রেমে পরেছে ওর প্রত্যেক রূপেই ঘায়েল হয়ে চলেছে বিহান। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল একটু। লোকটার সত্যিই লজ্জা নেই সবার সামনে কীভাবে হা করে তাকিয়ে আছে! রিখিয়ার চোখ শাফিনের ওপর পরতেই দেখল শাফিন তাকিয়ে আছে রিখিয়ার দিকে। রিখিয়ার সাথে চোখাচোখি হওয়াতে শাফিন মুচকি একটা হাসি দিল।

উত্তরের রিখিয়াও একটু হাসল। তুর্বী রিখিয়াকে নিয়ে এসে বসিয়ে সৌহার্দ্যর কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই সামনে তাকিয়ে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কারণ দোলাও এসেছে। সৌহার্দ্য যেখানে আসে সে ওখানেই আছে। যদিও সাথে শাফিন, নুসরাত বাকিরাও আছে। কিন্তু দোলার উপস্থিতি মোটেও ভালোলাগছে না তুর্বীর। সৌহার্দ্য নিশ্চয়ই ওকে এখন আর বিয়ে করবে না। তাহলে ওকে নিমন্ত্রন করার কী দরকার ছিলো? এখন আবার কী সুন্দর হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে ওর সাথে। তুর্বী আর গেলোই না সৌহার্দ্যর কাছে। চুপচাপ রিখিয়ার কাছে বসে রইল।

সৌহার্দ্য চোখ তুর্বীর দিকে পরতেই ও হেসে ইশারা করে ওকে কাছে আসতে বলল। উত্তরে তুর্বীও মেকী হেসে ইশারায় জবাব দিল যে ও ওখানেই ঠিক আছে। তারপর একটা ভেংচি কাটলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ফেলল। এই মেয়ের আবার কী হল? কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে ও আবার অতিথিদের সাথে কথা বলায় মনোযোগ দিল। তুর্বী বারবার আড়চোখে সৌহার্দ্যকে দেখছে আর রাগে ফুঁসছে। এরমধ্যেই গ্রাম থেকে রিখিয়ার পরিবারের লোকেরাও চলে এসছে। নিজের মা-বাবাকে দেখে রিখিয়া উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল দুজনকেই। বিহানও এসে ওনাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। অতিথিরাও সবাই খাওয়ার জায়গায় চলে গেছে।

অনেক্ষণ পর ওরা সবাই একজায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তখনই গেইটের দিকে তাকিয়ে ওদের চোখ আটকে গেল। কারণ বিহনের বাবা-মা, সৌহার্দ্যর বাবা-মা সবাই এসছে। হঠাৎ ওনাদের দেখে সবাই অবাক হয়েছে। বিহান ভ্রু কুচকে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” এরা এখানে কী করছে?”
সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আমি ডেকেছি ওদের। দেখ বিহান ওনারা যাই করে থাকুক। সবচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে ওনারা আমাদের বাবা-মা। বাবা-মা, বাবা-মাই হয়। আজকের মত একটা দিনে ওনারা থাকবেন না?”

বিহান কিছু না বলে হাত ভাজ ভ্রু কুচকে করে দাঁড়িয়ে রইল। অতিথিদের সামনে কোনরকম সিনক্রিয়েট করার চেয়ে আপাতত চুপ থাকাই ভালো। ওনারা ভেতরে আসার পরে সবার আগে বিহানের দিকেই তাকাল। কিন্তু বিহান তাকায়নি। প্রচন্ড অভিমানের মেঘ আজও ওর মনকে ডেকে রেখেছে । শফিক রায়হান এগিয়ে এসছিলেন বিহানের সাথে কথা বলার জন্যে। কিন্তু ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে বিহান নিজেই দূরে সরে গেছে। শফিক রায়হান বিহানের ব্যবহারে বেশ আহত হলেন। যে ছেলে মামা বলতে পাগল ছিল একসময়, সে আজ এভাবে মুখ ঘুরিয়ে সরে যাচ্ছে? কিন্তু এরকম ব্যবহারটাই হয়তো প্রাপ্য ছিল। বিহানের চোখমুখ দেখে ওর বাবা-মা আর কথা বলতে এগোনোর সাহসই পেল না। দূরে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। ছেলের প্রতি ওনাদের আর কোন রাগ নেই।

একটা অন্যায়ের শাস্তিতো কম দেয়নি ছেলেটাকে। হয়তো আরও অনেক আগেই ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু বিহানের শোধরানোর পরিবর্তে আরও উশৃঙ্খল হয়ে যাওয়াটাই ওনারা মানতে পারেন নি। কিন্তু যখন জেনেছেন যে বান্দারবান যাওয়ার পর বিহান সম্পূর্ণ বদলে গেছে তখন আর কোনরকম রাগ বা ক্ষোভ ছিলোনা ওনাদের। আর আজ বিহানের বিয়ের খবর শুনে আর নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারেন নি ছুটে চলে এসছেন। নিজের সন্তানকে দূরে রাখাটা কোন বাবা-মার পক্ষেই কম কষ্টের হয়না। বিহানকে দূরে সরিয়ে রেখে ওনারাও শান্তিতে ছিলেন না। ওনাদের মনেও এখন মাঝেমাঝে প্রশ্ন ওঠে বিহান কী সেদিন সত্যিই বলেছিল? ওনারাই কী ঠিকভাবে যাচাই করেনি?

নুসরাত গিয়ে রিখিয়াকে ওনাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওনাদের সবারই বেশ পছন্দ হয়েছে রিখিয়াকে। রিখিয়া যেহেতু এসব পারিবারিক দন্দ্বের মধ্যে ছিলোনা তাই ও হাসিমুখেই ওনাদের সালাম দিয়ে নিজের শশুর বাড়ির লোকেদের সাথে পরিচিত হল। আসমা রিখিয়ার কপালে চুমু দিয়ে একটা হার পরিয়ে দিলেন ওর গলায়। উনি সবসময়ই বিহানের জন্যে এমন টাইপ মেয়েই চাইতেন। এরপর রিখিয়ার বাবা-মার সাথেও ওনাদের পরিচয় করিয়ে দিল। দুই পরিবারের মিলবন্ধনটা বেশ ভালোই হল।
রিসিপশনের পর এখান থেকে আবার রিখিয়াদের বাড়ি যাবে বিহান-রিখিয়া। এটাই নিয়ম। সঙ্গে সৌহার্দ্য আর তুর্বী যাচ্ছে। কিন্তু এই পুরোটা সময় বিহান একবারও ওর বাবা-মায়ের বা মামার কাছে আসেনি। ওনাদের কিছুই করার ছিলোনা, বিহানের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।

সবার কাছে বিদায় নিয়ে ওরা আবার গ্রামের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরল। এক গাড়িতে রিখিয়ার বাবা-মা, ভাই-ভাবি আর বাকি আত্মীয়রা আছে। শাফিন ঘন্টাখানেক আগেই বেড়িয়ে গেছে কাজ আছে তাই। সৌহার্দ্য-তুর্বী, রিখিয়া-বিহান আরেক গাড়িতে। সৌহার্দ্য ড্রাইভ করছে, ফ্রন্ট সিটে তুর্বী বসে আছে। পেছনে বিহান আর রিখিয়া। রিখিয়া চাপা আওয়াজে বিহানকে বলল,
” বাবা-মার সাথে একটু কথাতো বলতে পারতেন?”
বিহান সোজাসাপ্টাভাবে বলল,
” ইচ্ছে করেনি।”
রিখিয়া আর কথা বাড়ায় নি। কারণ এখন এ ব্যাপারে কথা বাড়ালে বিহানের মুড নষ্ট হয়ে যাবে। যেটা এখন ও চাইছেনা। এদিকে সৌহার্দ্য ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তুর্বীকে দেখছে। ম্যাডাম অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই ওর সাথে কথা বলছেনা। ঠিক করে তাকাচ্ছেও না। ব্যাপারটা কী হল? ও আবার কী করল? ও একটু গলা ঝেড়ে তুর্বীর দৃষ্টি আর্কষণের চেষ্টা করল। তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সৌহার্দ্য বোকা বনে গেল তুর্বীর এমন আচরণে।

রাত সাড়ে এগারোটার মত বাজে। রিখিয়াদের বাড়ির সামনের রাস্তাটায় তুর্বী পায়চারী করছে। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে রাগে। আসলে সৌহার্দ্যর ওপর রেগে আছে ঠিকই, কিন্তু সেই রাগ দেখাতে না পেরে আরও রেগে আছে। মাচাটাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে ও। সৌহার্দ্য তুর্বীকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে দেখে ম্যাডাম এখানে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে। ও একটু হেসে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে আলতো করে ওর পেট জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
” এতো রাগ কীসের মিস ভয়ংকরী?”
তুর্বী সঙ্গে সঙ্গে একঝটকায় সৌহার্দ্যকে ছাড়িয়ে নিল। সৌহার্দ্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
” বাপড়ে! মাথা এতো গরম? তাওয়ায় করে ভাঙা ডিম রাখলে হয়তো অমলেট হয়ে যেত।”

তুর্বী কটমটে চোখ তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য হালকা ভয় পেল। তাই সাথেসাথেই মুখটা স্বাভাবিক করে পেলল। তারপর এগিয়ে তুর্বীকে ছুঁতে গেলেই তুর্বী ঝাঝালো গলায় বলল,
” ঢং করতে আসবেনা একদম। আমার কাছে এসেছো কেন এখন। যাও না তোমার ঐ দোলার কাছে। ওর সাথে আঠার মত চিপকে থাকো গিয়ে। আমার কাছে আসবে না।”
এতক্ষণে সৌহার্দ্যর ব্যাপারটা বোধগম্য হল। এইজন্যই তাহলে মিস ভয়ংকরী এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে আছে? জেলাসি? ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগল সৌহার্দ্যর। ওর আরেকটু জালাতে ইচ্ছে করল তুর্বীকে। তাছাড়াও অনেকদিন তুর্বীর সেই চঞ্চল রূপ দেখা হয়না। এই সুযোগে সেটাও হয়ে যাবে। থুতনিতে হাত রেখে ঠ‍োঁট চেপে একটু হেসে এসব চিন্তা করে স‍‍ৌহার্দ্য আগুনে একটু ঘি ঢালার মত করে বলল,
” হ্যাঁ তো হয়েছেটা কী? আমার হবু বউ হয় দোলা। আমার সাথেতো চিপকে থাকবেই। বিয়ের আগে একটু চেনা-জানার ব্যাপার আছে না? বুঝতেই পারছ__”

আর কিছু বলার আগেই তুর্বী হুট করেই সৌহার্দ্যর কলার চেপে ধরল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” বোঝাচ্ছি আমি। খুন করে ফেলব তোকে আমি। তোর হবু বউ হয় ও? চেনা-জানা লাগবে? তাহলে আমি কে হই তোর? বল, আমি কে?”
সৌহার্দ্য চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। তুর্বী রিঅ্যাক্ট করবে জানতো ও। কিন্তু সোজা ‘তুই’ তে চলে যাবে সেটা ভাবতে পারেনি। কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে সৌহার্দ্য মেকি হেসে বলল,
” তুমিতো আমার এক্সপিরিমেন্টাল গার্লফ্রেন্ড।”
এটা শুনে তুর্বী সৌহার্দ্যর কলার ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
” তুমি এখনো ওসব ভুলতে পারোনি তাইনা?”

সৌহার্দ্য বুঝতে পারল যে মজাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। এভাবে বলা উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ তুর্বীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই দুহাতে কোমর ধরে একটানে কাছে নিয়ে এলো। তুর্বী এখনো তাকায়নি সৌহার্দ্যর দিকে। ছলছলে চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য তুর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরে বলল,
” তোমার কী মনে হয়? দু-বছর অনেকবার চেষ্টা করেও যার জায়গায় অন্যকাউকে কল্পনাও করতে পারিনি। দুদিনেই দোলাকে সেই জায়গা দিয়ে দেব?”
সৌহার্দ্যর কথা শুনে তুর্বী অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। যদি তাই হয় তাহলে যে ওদের বিয়ের কথা চলছিল? সেটা কী? সৌহার্দ্য তুর্বীকে আর না জ্বালিয়ে দোলার পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। সবটা শুনেও তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,
” তাহলে ও তোমার সাথে এভাবে চিপকে থাকে কেন? আর তোমার সাথেসাথে ঘোরে কেন?”
সৌহার্দ্য হেসে ফেলল। এই মেয়েটাকে এতোটা হিংসুটে হতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি ও। সৌহার্দ্য তুর্বীর নাক টেনে দিয়ে বলল,

” আরে পাগলী বাবা-মাই বারবার আমার সাথে পাঠাতো ওকে। যাতে ওর সাথে এটাচড হতে পারি তাই। আর ও খুব মিশুক তাই ওতো ফ্রাংকলি কথা বলত আমার সাথে। ওতো কিছু ভেবে করত না।”
” খুব চিনে ফেলেছ দেখছি?”
” এখনো সন্দেহ করবে?”
” কথাই বলব না।”
” কেন?”
তুর্বী একটু ভাবুক হয়ে বলল,
” বলতে পারি এক শর্তে।”
সৌহার্দ্য বেশ ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল,
” দেখো তুর। একদম উল্টোপাল্টা কিছু করাবেনা আমাকে দিয়ে।”
তুর্বী কোমরে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” আমি সবসময় উল্টোপাল্টা কাজ করাই?”
” হ্যাঁ। আই মিন না। কিন্তু এবার করিও না প্লিজ।”

অসহায় গলায় বলল সৌহার্দ্য। তুর্বীর বেশ হাসি পেল। তবুও হাসিটা চেপে রেখে বলল,
” আরে ভয় পেওনা শোন, তোমাকে আবার ‘প্রভাতের আলো’ শো’টা হোস্ট করতে হবে। আগের মত।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর বায়না শুনে বেশ অবাক হল ঠিকই। কিন্তু পরে একটু হেসে বলল,
” আমার অভ্যেস নেই অনেকদিন।”
কিন্তু তুর্বী শোনার পাত্রী নয়। ও সাফ বলে দিল রাজি না হলে কথা বলবে না। তুর্বীর জেদের কাছে হার মেনে অবশেষে সৌহার্দ্য বলল,
” আচ্ছা। তবে নেক্সট মান্হ থেকে। আগে আমাকে কথা বলে নিতে হবে। অনেক ঝামেলা আছে। তবে করব। এবার হ্যাপি?”
তুর্বী হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে সৌহার্দ্যর বুকে মুখ গুজে দিল। স‍ৌহার্দ্য ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমু দিলো। তুর্বীর মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। জীবনে কাউকে ভালোবাসবে সেটা কল্পণাও করেনি ও। কিন্তু যখন বাসল তখন এতোটাই ভালোবাসলো যে তাকে ছাড়ার কথা ভাবলেই ওর বুক কেঁপে ওঠে। যার জীবনটা সমস্ত খুশিতে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই এক সপ্তাহে বিহানের বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছেন ওকে ফিরিয়ে নেওয়ার কিন্তু বিহান যায়নি। ঠিকভাবে কথাও বলেনি ওনাদের সাথে। তবে রিখিয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয় তাদের। সেটা বিহান জানে কিন্তু কোন আপত্তি করেনা। সৌহার্দ্যর কথাতেই তুর্বীর সিলেটের ঐ জবটা ছেড়ে দিয়েছে। দু-মাস পর সৌহার্দ্যদের কম্পানিতেই জয়েন করবে ও। কারণ দু-মাস পরেই পোস্ট খালি হতে চলেছে। এরমধ্যেই শফিক রায়হান একদিন সৌহার্দ্যকে ডেকে বললেন,
” বিহানের বিয়ে তো হয়ে গেছে। এবার তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানাও। দোলার বাবা-মার সাথে কথা বলব?”
সৌহার্দ্য বলল,
” না বাবা। আমি দোলাকে বিয়ে করব না। মেয়ে হিসেবে ও ভালো। তবে লাইফ পার্টনার হিসেবে আই ডোন্ট লাইক হার।”
” তাহলে কী সারাজীবন এভাবেই থাকার ইচ্ছে না-কি?”

” সেটা কখন বললাম। আমি বিয়ে করব। মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছি। তুমি চেনো তাকে।”
শফিক রায়হান বেশ অবাক হলেন সৌহার্দ্যর মুখে এসব শুনে। যে ছেলেকে এই দুই বছরে এতো চেষ্টা করেও বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি সে এসব বলছে? আর যখন জানল যে মেয়েটা তুর্বী তখন উনি বেশ খুশিই হল। কারণ তুর্বীকে সেই অফিসের সময় থেকেই ওনার বেশ ভালো লাগে। ওনার এমন গুরুগম্ভীর ছেলের জন্যে এমন মেয়েই ঠিক আছে। পারিবারিক ভাবে আলোচনার পর পরবর্তীমাসেই সৌহার্দ্য আর তুর্বীর এনগেইজমেন্টের ব্যবস্থা করা হল। বিয়ের কথা চলছিল। কিন্তু তুর্বী তখন অদ্ভুত বায়না করে বসল। ও চায় রিখিয়া আর ওর ম্যারেজ এনিভার্সিরি এক দিনেই হোক। তাই ও পরের বছর রিখিয়ার এনিভার্সিরির দিনই বিয়ে করতে চায়। প্রথমে সবাই একটু ঝামেলা করলেও সৌহার্দ্য নিজেই মেনে নেয়। তুর্বীর কোন ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখতে চায়না ও।

যথাসময়ে শফিক রায়হানদের বাড়িতে বেশ জাকজমকভাবে সৌহার্দ্য আর তুর্বীর এনগেইজমেন্টের আয়োজন করা হল। সৌহার্দ্যর জন্যে বিহানও আজ এই বাড়িতে পা রেখেছে বহুবছর পর। কিন্তু মনের দিক দিয়ে এখানো ও ওর পরিবারের কাছ থেকে অনেকটাই দূরে। এই একমাসে রিখিয়া অনেকবার চেষ্টা করেছিল এদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে কিন্তু পারেনি। তুর্বী আর ওর ভাই এই একমাস বিহানের ফ্লাটেই ছিল। যদিও ও আলাদা ফ্লাট ভাড়া করেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু রিখিয়া আর বিহানের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই থেকেছে। বিয়ের আগেতো আর সৌহার্দ্যর বাড়ি গিয়ে উঠতে পারবেনা। ওদের এনগেইজমেন্টের অনুষ্ঠানে দোলাও চলে এল। কিন্তু দোলার সাথে মিরাজকে দেখে চমকে গেল তুর্বী। মিরাজ এখানে কী করছে? তুর্বী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুই এখানে?”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৬

মিরাজও তুর্বীকে দেখে একপ্রকার আকাশ থেকে পরল। ওও অবাক হয়ে বলল,
” আজ তোর এনগেইজমেন্ট?”
ওদের দুজনের রিঅ্যাকশন দেখে সৌহার্দ্য আর দোলাও বোকা বনে গেল। অবশেষে জানা গেল যে মিরাজই দোলার সেই বয়ফ্রেন্ড। যার জন্যে এতোকিছু। আসলে ওদের ওনলাইনেই রিলেশন ছিল তাই দুজন এতো দূরে থাকত। আর দোলা আর সৌহার্দ্যর জানতে পারল যে তুর্বী আর মিরাজ কলিগ ছিল। এ নিয়ে একদফা হাসাহাসিও করল ওরা। সত্যিই পৃথিবী গোল।দোলার শর্ত অনুযায়ী ওর ফ্যামিলিও মেনে নিয়েছে এখন মিরাজকে।

বেশ অানন্দের সাথেই সৌহার্দ্য আর তুর্বীর এনগেইজমেন্ট হয়ে গেল। কিন্তু এনগেইজমেন্টের পরপরই ঘটলো আরেক ঘটনা। অনুষ্ঠানের মধ্যে হঠাৎ করেই মায়ার বাবা-মা এসে হাজির হলেন। ওনাদের তো ইন্ডিয়া থাকার কথা ছিল? কিন্ত ওনাদের অনাকাঙ্খিত উপস্থিতিতে সবাই বেশ অবাক হল। কিন্তু আরও অবাক করা ব্যাপার হল, ওনাদের চোখ-মুখ মলিন আর বেশ বিষণ্ন।

জল ফড়িঙের খোঁজে শেষ পর্ব