জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৬ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

শব্দহীন রুমটাতে শুধু ল্যাপটপের কিবোর্ড প্রেস করার আওয়াজটাই আসছে। তুর্বী সমস্ত মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে। যেনো এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তুর্বী আগেও ওর কাজ নিয়ে সিরিয়াস ছিল কিন্তু এখন প্রচন্ড বেশিই সিরিয়াস হয়ে গেছে। মাত্র দুবছরে এতো বড় পোস্টে প্রমশন সেটারই প্রমাণ। তখন মিরাজ দরজায় নক করে বলল,
” আসব ম্যাডাম?”
তুর্বী ওর পুরো মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে রেখেই বলল
” চলে আয়।”

মিরাজ ভেতরে এসে দেখে তুর্বী খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। এইমুহূর্তে ওকে জ্বালানো মানেই নিজের জন্যে একটা ফ্রি ধমক বরাদ্দ করা। কাজের সময় ডিস্টার্বেন্স তুর্বী মোটেও পছন্দ করেনা। তাই মিরাজ চেয়ার টেনে বসে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দেখছে। তুর্বীর এটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ও ওর মত কাজ করে যাচ্ছে যেন রুমে কেউ নেই। মেয়েটার এরকম অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য মিরাজকে বরাবরই বেশ ভাবায়। সৃষ্টিকর্তা যেন বিশেষ কিছু গুন দিয়ে রেখেছে ওর মধ্যে। যার কারণে ও নিজেকে সবার থেকে এতোটা আলাদা করে তুলতে পারে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর তুর্বী ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কিছু বলবি?”
মিরাজ সোজা হয়ে বসে বলল,
” বলছিলাম যে আজ তো আর আমাদের তেমন বিশেষ কোন কাজ নেই। অফিসে আজ শুধুশুধুই বসে আছি।”
” হ্যাঁ তো!”
তুর্বীর এরকম ভাবে ‘ হ্যাঁ তো’ বলাতে আরও দমে গেল মিরাজ। যেটুকু সাহস করেছিল সেটুকুও শেষ হয়ে গেল। এই মেয়ে কখন না জানি আবার ধমকে বসে। অথচ আজ অবধি তুর্বী কাউকেই বকা বা ধমক দেয়নি। এমনকি ওর জুনিয়রদেরও না। তবুও অদ্ভুত কারণেই সবাই ওকে একটু ভয় পায়। হয়ত এটা ওর এরকম এটিটিউট এর জন্যেই। তুর্বী একগাদা বিরক্তি নিয়ে বলল,
” কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সবসময় অর্ধেক বলে আটকে থাকার তোর এই রোগটা ঠিক কতটা বিরক্তিকর তুই জানিস। ক্লিয়ারকাট কথা বল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিরাজ একটুখানি গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
” যেহেতু কোন কাজ নেই চল আজ চলে যাই।”
তুর্বী ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল,
” কেন গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিট করবি না-কি? করলে যা। আমাকে টানছিস কেন?”
” ধূর তোর গার্লফ্রেন্ড! আমি গার্লফ্রেন্ডের কথা বলছিনা। আমি তোর কথা বলছি। চল আজ একটু ঘুরে আসি। রাস্তা দিয়ে হাটাহাটি করব। এই অফিসের একগাদা কাজ করতে করতে বোর হয়ে গেছি। আর তুইও গম্ভীর মুডে বসে থাকিস। জাস্ট নেওয়া যায়না এসব।”

তুর্বীর হঠাৎই রিখিয়াকে মনে পরল। ছুটি পেলেই দুজন ঘুরতে বেড়িয়ে যেত। ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়া, সিনেমা দেখা কত কী করত। ওসব ভাবা বাদ দিয়ে তুর্বী মিরাজের দিকে একটু গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়। মিরাজ অনেকটা হকচকিয়ে গিয়েই বলল,
” আরে আমিতো জাস্ট এমনিই বলছিলাম ইয়ার! ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। তোর ইচ্ছে হলে যাবি না হলে যাবিনা। এতে কার কী করার থাকতে পারে বল? তোকে জোর করবে কার ঘাড়ে কটা মাথা শুনি?”
তুর্বী আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে মিরাজের দিকে। মিরাজ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোকে কে যেতে বলেছে বল? আমি শুধুই আমার কথা বলছিলাম। এইযে চলে যাচ্ছি। টাটা।”
তুর্বী এবার ফিক করে হেসে দিল। মিরাজ বোকার মত তাকিয়ে আছে। তুর্বী হাসি মুখেই ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,

” চল। দেখি কোথায় নিয়ে যাস।”
মিরাজ বিশ্বজয় করা এক হাসি দিয়ে বলল,
” তুই সত্যি যাবি?”
” কানে শুনতে পাস না?”
” কিছুক্ষণ আগে ডাউট ছিল। এখন ক্লিয়ার হয়ে গেছি। চল! চল!”
তুর্বী আবারও হাসল ছেলেটার পাগলামী দেখে। ছেলেটার এরকম পাগলামো স্বভাব আর মিশুক হওয়ার জন্যেই অফিসের একমাত্র ওর সাথেই তুর্বীর একটা বন্ডিং তৈরী হয়েছে। তুর্বীকে এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখে সবাই মোটামুটি একটা ঝটকা খেল। কারণ এই মেয়েকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখা আর হ্যালির ধুমকেতু দেখা অনেকটাই একরকমই।

সিলেটের পাহাড়ি ঢালু রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাটছে তুর্বী আর মিরাজ। বৃষ্টিভেজা রাস্তা, ভেজা সবুজ প্রকৃতি, দূরে দেখতে পাওয়া পাহাড়, আকাশের মেঘ সবমিলিয়ে প্রকৃতি আজ বেশ সুন্দর করেই সেজেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তুর্বীর কপালের মুক্ত ছোট চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। মিরাজ বলল,
” কি? ভালো লাখছে তো? তুইতো বেড় হতেই চাস না।”
তুর্বী চারপাশে আরেকবার তাকাল। সত্যিই খুব ভালোলাগছে ওর। কিন্তু সেই ভালোলাগাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” হুম ঠিক আছে।”

হঠাৎ করে মিরাজ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওই, বুটভাজা খাবি? ঐ দেখ যাচ্ছে।”
তুর্বী হালকা চমকে উঠল। সৌহার্দ্যর সঙ্গে যখন ঘুরতে যেত। তখন বুটভাজা দেখে তুর্বী এভাবেই চেঁচিয়ে উঠত। সৌহার্দ্য কিনে দিত ঠিকই কিন্তু বাচ্চা বলে টিজও করত। কিন্তু তুর্বী খাওয়ার সময় ঠিকই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখত। তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ তাতে এভাবে চেঁচানোর কী আছে? খেলে খা।”
” তুই খাবিনা?”
” আমি এসব খাইনা।”
মিরাজ আর কিছু বলল না। বুটভাজা কিনে ওখানেরই নিচু একটা দালানের ওপর পা ঝুলিয়ে বসল দুজন। মিরাজ বলল,
” পরশু ট্রেনিং এ যাচ্ছি জানিসতো।”
তুর্বী বাইরে দেখতে দেখতে বলল,
” হু, বস বলল তো। বান্দরবান যাচ্ছি তাই তো?”
মিরাজ একটু উৎসাহি হয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ভালোই হবে। এবার বান্দরবানও ঘোরা হয়ে যাবে।”
কিন্তু তুর্বীর মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। যেনো সবটাই স্বাভাবিক। মিরাজ শুধু ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই মেয়েটাকে নিয়ে ও সত্যিই পারেনা। এতো অদ্ভুত কেন?

ব্যাংককে রাত বারোটা ছাব্বিশ বাছে। প্রায় ফাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সৌহার্দ্য। কোথায় যাচ্ছেনা। এমনিই চালাচ্ছে। মাঝেমাঝেই এরকম করে। একা একাই রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে। লং ড্রাইভে যাওয়া, খোলা মাঠে আড্ডা দেওয়া। কীভাবে বিহান আধমাতাল হয়ে পরে থাকত। ভুলভাল বকতো। নিজের মনের সব অভিযোগ, অভিমান, কষ্ট সৌহার্দ্যর কাছে প্রকাশ করত। অনেক কষ্টে ওকে সামলে ধরে এনে গাড়িতে তুলে বাড়ি আনতে হত। সবটা ভাবলে আনমনেই হেসে ওঠে সৌহার্দ্য। খুব মিস করে নিজের ভাইটাকে।

বিহানও নিশ্চয়ই করে! কিন্তু কোথায় ছেলেটা। এতো অভিমান! হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলেটাকে এভাবে একা ফেলে চলে আসাটা ওর জীবনের বড় ভুলগুলোর মধ্যে একটা ছিলো। কী করত? বাবাকে কথা দিয়েছিল, তারওপর বিহানের ওপর রেগেও ছিল। কিন্তু ছেলেটা যে অভিমানে এভাবে গুটিয়ে যাবে সেটা কে জানতো? বিহানযে সুইসাইড করবেনা সেটা জানে সৌহার্দ্য। কারণ যেই বিহানকে ও ছেড়ে এসছে সাত বছর আগের বিহান নয়। পরিচ্ছন্ন, যত্ন করে বানানো একটা বিশাল গ্রাউন্ডের একপাশে গিয়ে বসল সৌহার্দ্য। কিছুই ভালো লাগেনা এখন আর। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,

” কোথায় আছিস বিহান?”
তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। এমন সময় ফোন বেজে ওঠাতে ভ্রু কুচকে ফোনটা বেড় করে দেখে ওর মা মিসেস নাহার ফোন করেছেন। হঠাৎ এইসময় ওনার কল দেখে একটু অবাক হল সৌহার্দ্য। রিসিভ করে ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মিসেস নাহার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন,
” সৌহার্দ্য…তোর বাবা..”
বলে আবারও কেঁদে উঠলেন। সৌহার্দ্য খানিকটা ঘাবড়ে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” মা কাঁদছো কেন? কী হয়েছে বাবার?”
কিন্তু উনা কেঁদেই যাচ্ছেন। সৌহার্দ্য অধৈর্য হয়ে বলল,
” মা তোমার পাশে কে আছে তাকে ফোনটা দাও।”
তখন ওপাশ থেকে নুসরাত বলে উঠল,
” হ্যালো ভাই!”

” আপু! মা কাঁদছে কেনো? কী হয়েছে বাবার?”
নুসরাত ভাঙা গলায় বলল,
” বাবার হার্টঅ‍্যাটাক হয়েছিল। আমরা এনে হসপিটালে ভর্তি করেছি। তুই টেনশন করবি তাই তোকে আগে জানাই নি।”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বলল,
” এখন কেমন আছেন?”
” একটু ভালো। তবে ডক্টর ফলেচে অবস্থা বেশি ভালো নয়। তোকে দেখতে চাইছে বারবার। প্লিজ ভাই এবার চলে আয় দেশে।”
” কিন্তু আপু..”
” কোন কিন্তু না। অনেক তো হল। আর জেদ করিস না ভাই, প্লিজ!”
নুসরাতের কাছ থেকে ফোন নিয়ে মিসেস নাহার বললেন,
” তোকে আসতে হবেনা। তুই ওখানেই থাক। থাক তোর জেদ নিয়ে। মরে যাক তোর বাবা। আমিও বাঁচবোনা আর বেশিদিন। আমরা মরে গেলেও আসবিনা বলে দিলাম।”
সৌহার্দ্য আহত গলায় বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৫

” মা..”
” কী মা হ্যাঁ? কী মা? কবে কী হয়েছে সেই নিয়ে এখনও জেদ ধরে বসে আছে। কে হই আমরা? আমাদের কোন মূল্যই নেই তোর কাছে। কী চাস তুই আমরা মরে যাই!”
বলেই কেঁদে দিলেন উনি। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর গম্ভীর স্বরে বলল,
” নেক্সট ফ্লাইটেই আমি আসছি। বাবার খেয়াল রেখো।”
মিসেস নাহার উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন,
” সত্যি?”

সৌহার্দ্য উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিল। এরপর ওর এসিসটেন্টকে ফোন করে বলল বাংলাদেশের নেক্সট ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখতে। সবকিছু ঠিক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। অবশেষে দুবছর পর দেশে ফিরতে চলেছে ও। ওখানে গিয়ে কী তুর্বীর সাথে আবার দেখা হবে। ও আছে এখনও ওই শহরে? নিশ্চয়ই আছে। কোথায় আর যাবে? কীকরে মুখোমুখি হবে ওর? কী জানি কী আছে ওর ভাগ্যে।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৭