জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
নিজের রুমে বিছানার ওপর হাটু গুটিয়ে বসে কোলে একটা বালিশ নিয়ে সেটাকে খামচে ধরে বসে আছে রিখিয়া। যেকোন মুহূর্তে কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। পাশের রুম থেকে রায়হানের চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আজকে আবার এসছে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। আজ একা আসেনি সাথে নিজের বউ নিলুকে নিয়ে এসছে। বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে আজ। কথার মাঝে জোরে জোরে কেশে উঠলেন রেজাউল ইসলাম। রিখিয়ার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলোনা। বালিশটা কোল থেকে ছুড়ে ফেলে রেখে উঠে দরজা খুলে গেল বসার ঘরে। ওকে দেখে সবাই থেমে গেল। রিখিয়া এগিয়ে গিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী শুরু করেছ তুমি? বাবা-মার সাথে চেঁচামেচি করছ কেন? বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। ওনাদের বলছ কেন?”
রায়হান কিছু বলবে তার আগেই নিলু বলল,
” দেখ রিখিয়া আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলেনা। তোমার সত্যিই মনে হয় সারাজীবন এভাবে একা কাটিয়ে দিতে পারবে?”
রায়হান তেজী গলায় বলল,
” সেটাই বোঝাও এই মেয়েকে। আমি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
” এতো ভাবতে কে বলে তোমাদের? আর তাছাড়াও তোমরা আবার আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবতে শুরু করে দিলে বলোতো? স্বার্থ ছাড়াতো তো তোমরা কিছু করোনা। আমার বিয়ে দিয়ে তোমাদের কী স্বার্থসিদ্ধি হবে?”
রায়হান রেগে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” খুব বেশি কথা শিখে গেছিস আজকাল। তোকে তো আমি..!”
বলে রিখিয়া মারতে নিলেই রেজাউল ইসলাম ধমক দিয়ে বলল,
” খবরদার! আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে আমি কিন্তু তোমাকে পুলিশে দেব।”
রায়হান অবাক কন্ঠে বলল,
” বাবা!”
রেজাউল ইসলাম ঝাঝালো কন্ঠে বললেন,
” বেড় হও এখান থেকে। বেড় হও!”
নিলু এবার নিজের আসল রং দেখিয়ে দিয়ে বলল,
” কথা এতো পেঁচাচ্ছেন কেন বাবা? সোজা কথা বলে দিন না যে এই মেয়ের রোজগারে আপনার ঘর চলে। দু-বেলা ভালোমন্দ গিলতে পারেন। এমন সোনার ডিম পাড়া হাস কেই বা ছাড়তে চায়?”
নিজের পুত্রবধুর মুখে এরকম কথা শুনে ব্যথিত হলেন রেজাউল ইসলাম। সত্যিই কী তাই? নিজের স্বার্থে সে ব্যবহার করছে নিজের মেয়েকে? নিলু বলল,
” তাই বলছি। নিজের মেয়ের জীবনটা আর নষ্ট করবেন না। পারলে__”
নিলুকে থামিয়ে দিয়ে রিখিয়া বলল,
” ভাবি প্লিজ থামো। তোমাদের মুখে এসব মানায় না। ঠিকভাবে তো খবরও নাও না এই মানুষ দুটো বেঁচে আছে কি-না মরে গেছে। আর এখন এসব বলছ? লজ্জা করছেনা একটুও?”
রায়হান একটু অপমানিত বোধ করল। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে রেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। নিলুও পেছন পেছন চলে গেলো। রিখিয়া ওখানে রাখা চেয়ারে বসে পরল। বিরক্ত লাগছে ওর কাছে সবকিছূ এখন। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে রিখিয়ার বাবা বলল,
” একটা কথা বলব, মা?”
” বিয়ে করতে বলবে এইতো?”
শান্ত গলায় কথাটা বলল রিখিয়া। জাহানারা এতোদিন চেঁচামেচি করলেও এবার নরম কন্ঠে বলল,
” দেখ তোকে জোর করব না। কিন্তু নিলু একটা কথাতো সত্যি বলেছে। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। করিম ভাইর মেয়েটা তোর কত ছোট ওরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাল। লোকেতো এবার খারাপ বলবে। এমনিতেই অনেকে অনেক কথা বলে।”
রেজাউল ইসলামও বললেন,
” আমাদের অপরাধবোধ আর বাড়াস না মা। সবকিছুর জন্যে নিজেদের দায়ী মনে হয়। আমাদের নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব। তবুও এই ভার থেকে আমাদের মুক্তি দে।”
রিখিয়া মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে বেড়িয়ে গেল। রেজাউল ইসলাম দুবার ডাকলেও কোন সাড়া দেয়নি রিখিয়া। কী করা উচিত এখন ওর? কোন দিকে যাবে? ভাগ্য বারবার ওর সাথেই এরকম কেন করে? এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে ওকেই কেন পরতে হলো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের বড় মাচাটার ওপর বসে পরল। উদাস দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই নদীরও লক্ষ্য আছে; সমুদ্র। পাহাড় থেকে নেমে সে নিরন্তর ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে পৌছানোর জন্যে। কিন্তু ওর জীবনের লক্ষ্য কী? ওয গন্তব্য কোথায়? কী আছে ওর ভাগ্যে? হঠাৎ শাফিন এসে বসল ওর পাশে। শাফিনকে দেখে দ্রুত চোখ মুছে নিল। শাফিন একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,
” আর কত লুকাবে নিজেকে? এতোটাও চাপা হওয়া ঠিক নয় রিখিয়া। অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ। ভালো জিনিসটার সাথেও যখন ‘অতিরিক্ত’ শব্দটা যুক্ত হয় সেটাও খারাপ হয়ে যায়। তো এটাই ছিল আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ?”
রিখিয়া কোন উত্তর দিলোনা। মাথা নিচু করে বসে রইল। ও বুঝতে পেরেছে আজ শাফিন বাইরে থেকে সবটাই শুনে ফেলেছে। শাফিন বলল,
” রিখিয়া বিয়ে কিন্তু শুধু দুটো মানুষের বন্ধন হয়না। দুটো পরিবারেরও হয়। তোমার আমার বিয়ে হলে তোমার বাবা-মা শুধু তোমার দায়িত্ব না, আমারও দায়িত্বও হয়ে যাবে। আর এতে ছোট হওয়ার কিচ্ছু নেই। এটা তোমার অধিকার। ওনাদের অধিকার থাকবে আমার ওপর।”
রিখিয়া একটু অবাক হয়ে তাকাল শাফিনের দিকে। শাফিন বলল,
” তবুও তোমাকে জোর করব না। সবটাই তোমার ইচ্ছা। আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো।”
কথাগুলো বলে শাফিন উঠে চলে গেল। রিখিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাফিনের যাওয়ার দিকে।
আকাশে মেঘ করেছে তাই সূর্য দেখা যাচ্ছেনা। কিছু পাখি কিচিরমিচির শব্দ করছে। বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তা, পাহাড়, মেঘলা আকাশ, সবুজ প্রকৃতি সবটাই দেখা যায় এই বাংলোর করিডরের বারান্দা থেকে। তুর্বী কফি খেতে খেতে দেখছে সবটা। তবে ওর দৃষ্টি আপাতত সামনের মাঠের বেঞ্চে বসে থাকা বিহানের ওপর। কেমন উদাসীনভাবে বসে ফোন দেখছে। এই দুদিন গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে বিহানকে। ছেলেটার মধ্যে অনেকটা বদল লক্ষ্য করেছে তুর্বী। শুধু ড্রিংক আর স্মোক করা ছাড়েনি। আর সবটাই বদলে গেছে।
আর আজ সকালে ফরিদের কাছ থেকে অদ্ভূত কথা জানতে পেরেছে ও। গত দেড় বছরে না-কি বিহান অপ্রয়োজনে কোন মেয়ের কাছেও যায়নি। ভাবা যায় এই বিহানই একসময়ের প্লে বয় ছিল? আরেকটু খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে, নেশার কথা বাদ দিলে বিহান এখন অনেকটা সেরকমই যেরকম রিখিয়া বিহানকে দেখতে চাইত। ফরিদের মুখে এটাও শুনেছে বিহানের রুমে একটা মেয়ের পেন্টিং আছে যেটা ও খুব যত্নে রাখে। কাউকে বিক্রি করেনা। ওই পেন্টিং যদি রিখিয়ার হয় তারমানে তো___ এখন অনেক কিছু ঘুরছে ওর মাথায়। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা মারতেই তুর্বী পেছনে না তাকিয়েই রাগী কন্ঠে বলল,
” মিরাজ, সবসময় ভালোলাগেনা।”
মিরাজ হেসে দিয়ে রেলিং এ ভর দিয়ে বলল,
” এতো সিরিয়াসলি কী ভাবছিস?”
তুর্বী বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আচ্ছা? কিছু মানুষকে কী সেকেন্ড চান্স দেওয়া যায়? যদি সে নিজেকে বদলাতে পারে?”
মিরাজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” উমম। গভীর প্রশ্ন। তবে একটা কথা কী জানিস? জীবন একটাই। তাই যদি কাউকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াতে আমাদের ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে একটা চান্স নিতে সমস্যা কোথায়?”
তুর্বী কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে কিছু ভেবে হেসে দিয়ে বলল,
” জীবনে প্রথম একটা কাজের কথা বললি। তবে তার আগে আমাকে আরেকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।”
কথাটা বলে তুর্বী চলে গেল। মিরাজ ওর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না। এটা নতুন কিছু না। মাঝেমাঝেই এমন হয়। এই মেয়ের কথা ওর মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে যায়।
পরেরদিন সকালে, বিহান বিছানায় হেলান দিয়ে বসে গেমস খেলছে। তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো মনোযোগ ফোনে নেই। দরজায় কেউ নক করতেই ও ভাবল ফরিদ এসছে। ও ভ্রু কুচকে খেলতে খেলতেই দরজাটা খুলে দিয়ে বলল,
” এতো সকাল সকাল যে?”
কিন্তু একটা মেয়েলী কাশির আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। বিহান একটু অবাক হয়ে বলল,
” তুমি?”
” হুম। আসলে আজ ট্রেনিং অফ আছে। আর সবাই যে যার মত ঘুরছে। আপাতত আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম তোমার সাথে এসে গল্প করি।”
বিহান একটু হেসে বলল,
” হঠাৎ আমার মত একটা খারাপ ছেলের সাথে গল্প করার ইচ্ছে হল যে?”
” চলে যাবো?”
” না, না। এসো, ভেতরে এসো।”
তুর্বী ভেতরে এসে সোফায় বসল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। অনেক পেন্টিং আছে। কিছু কিছু পেন্টিং কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিহান ওর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল,
” কী খাবে? চা না-কি কফি?”
তুর্বী যেন এই প্রশ্নটা শোনারই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত বলে দিল,
” কফি।”
” তুমি বস। আমি এখনি আসছি।”
তুর্বী মাথা নাড়ল বিহান চলে গেল কিচেনে। তুর্বী সাথেসাথেই উঠে সবগুলো পেন্টিং থেকে কাপড় সরিয়ে চেক করতে শুরু করে দিল। কিন্তু কোথাও কোন মেয়ের পেন্টিং নেই। যখন তখন বিহান চলে আসতে পারে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু একটাতেও এমন পেন্টিং পেলোনা যেখানে কোন মেয়ে আছে। কোথাও না পেয়ে ও হতাশ হয়ে বসতে যাবে তখনই ওর চোখ গেল সরাসরি দূরে রেখে দেওয়া বড় পেন্টিংটার দিকে, যেটা লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। ও দ্রুত সেখানে গিয়ে লাল রঙের কাপড়টা সরাতেই রিখিয়ার হাসিমুখের একটা পেন্টিং বেড়িয়ে এলো। তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতো নিখুঁত পেন্টিং? মনে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে না গেলে এতো নিখুঁত ছবি হয়না। ওর মনে হচ্ছে রিখিয়াই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখে সামান্য জল জমলো ওর। বিহানের আসার আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে, পেন্টিংটা ঢেকে, দ্রুত এসে সোফায় বসে পরল। বিহান ওর দিকে কফি এগিয়ে দিতেই বলল,
জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৭
” থ্যাংকস।”
” ইউ আর ওয়েলকাম।”
বলে বিহানও বসল ওর পাশে। বিহান বলল,
” তো সিনিয়র আর্কিটেক্ট তুর্বী ইসলাম। স্বপ্ন সত্যি হলো তাহলে?”
তুর্বী হেসে বলল,
” তোমার স্বপ্নও তো সত্যি হয়েছে।”
” তা হয়েছে।”
” তো আজ আমায় বান্দরবানের কিছুটা ঘুরিয়ে দেখাও যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”
” আপত্তি থাকবে কেন? এগারোটার দিকে চল তাহলে?”
” আচ্ছা!”
কিছুক্ষণ গল্প করার পর কথায় কথায় তুর্বী বলল,
” রিখায়াকে মিস কর?”
প্রশ্নটা শুনে বিহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” কী লাভ? এতোদিন হয়তো ও স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে। আমার মত একটা ছেলের ভাবনায় কী যায় আসে?”
তুর্বী কোন জবাব দিলোনা। তবে মনে মনে বলল, আমি জানি তুই ভালো নেই রিখু। আমার মন বলছে তুই ভালো নেই। তোকে যে যতই ভালোবাসুক তুই ভালো থাকবিনা। কারণ তোকে একমাত্র বিহানই ভালো রাখতে পারবে। আজ আমি ওর চোখে তোর জন্য সেই ভালোবাসা দেখেছি যেই ভালোবাসার স্বপ্ন তুই একসময় দেখতি। দুজন দুজনকে এতোটা ভালোবেসেও এতো কষ্ট পাবি সেটা হয়না। এবার আমি সেটাই করব যেটা আমার করা উচিত। তোদের আবার এক করব আমি। যেভাবেই হোক।
আরে আপু কম করে হলেও 10 টা পার্ট এক দিনে দেন না
3 অথবা 4 পার্ট পরে মজা নাই
ajke sob part dewar tai korbo
Taratari diben plss part gulo
ok
Baki part ta kbe pabo
Taratari diben plss part gulo
ok