অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২০ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২০
Ishita Rahman Sanjida

মীরা তার হাতের চুড়ি খোলার জন্য উদ্যত হচ্ছে। ডান হাত বা হাতের উপর দিতেই আয়নায় মুহিতের প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। মুহিত ঢোক গিলছে বারবার। মীরা মুহিতের দিকে ঘুরতেই সে দুকদম পিছিয়ে গেল। মীরা হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলল,’এদিকে আয়।’
মীরার শান্ত আওয়াজেও ঝড়ের আভাস পেয়েছে মুহিত। মীরা আবার বলল,’মারব না এদিকে আয়।’
মুহিত এবার সাহস করে মীরার সামনে গেল। মীরা বলল,’তোকে এতো সব কে বলতে বলেছে??তাও আবার সবার সামনে?ইশান বলেছে???’

‘এমা না না। আমি নিজে থেকেই বলেছি।ইশান ভাইয়া আমাকে কিছু শিখিয়ে দেয়নি।’
‘তাহলে না বললেই পারতি।’
মুহিত অসহায় মুখে বলল,’ইশান ভাইয়া খুব কষ্ট পাচ্ছিল। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে বেচারা আরো কষ্ট পেতো। তাই,,,,’
মীরা মুখে রাগি ভাব ফুটিয়ে বলল,’তাই পাকনামি করে এসব করতে গেছিস।’ মীরা কথা শেষ করতে করতে মুহিতের গাল লাল করে দিলো। মুহিত গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর আগেও সে অনেক বার মীরার হাতের থাপ্পর খেয়েছে। তবে এবারের টা বোধহয় একটু জোরে লেগেছে। মীরা বলল,’ফের যদি তোকে এমন পাকনামি করতে দেখেছি তাহলে তোকে পদ্মায় চুবাবো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুহিত গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে। আর তোমাকে আন্টি ডাকছে। কি সব কথা বলবে। ইশান ভাইয়া ও এসেছে।’
মীরার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। ইশান আবার এসেছে!!মীরা বাইরে চলে এলো। মুহিত গালে হাত দিয়ে মীরার পিছনে পিছনে আসলো। পিহু হাত বাড়িয়ে মীরাকে কাছে ডাকলো। মীরা পিহুর কাছে যেতেই পিহু মীরাকে টেনে নিজের পাশে বসালো। পিহু মাঝখানে বসা ওর দুপাশে ইশান আর মীরা। ইশান মীরার দিকে তাকায়নি। সে মীরার উপর রেগে আছে। পিহু বলে উঠলো,’এবার তোরা দুজন খোলাসা করে বল??’

মীরা চুপ করে রইলো আর ইশান ও। ইশান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। পিহু আবার বলল,’ইশান তুই কিছু বল??আর আমাকে আগে জানালি না কেন যে তুই মীরাকে পছন্দ করিস ওকে বিয়ে করতে চাস তাহলে তো আমি ওর জন্য ছেলে দেখতাম না।’
পিহুর কথা শুনে ইশান হুট করে বলে উঠলো, ‘কে বলছে আমি মীরাকে বিয়ে করতে চাই?? আমি মীরাকে বিয়ে করব না। তোমরা যার সাথে মীরার বিয়ে ঠিক করেছো তার সাথেই বিয়ে দাও মীরার। আমার কিছু যায় আসে না।’

ইশানের কথা শুনে পিহু জোরে শ্বাস ফেললো। কারণ ও বুঝেছে যে ইশান রাগের মাথায় এসব। ইফাজ বলে উঠলো,’তাহলে রাগ করেছিস কি জন্য??লন্ডন ফিরে যেতে চাইছিস কেন??’
‘আমার ইচ্ছা। আর এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’
পিহু ইশানকে শান্ত করতে বলল,’কিন্তু আমরা সবাই জানতে চাই। রাগের মাথায় এমন কিছু বলিস না বা করিস না যে পরে তার জন্য আফসোস করতে হয়।’

ইশান গলা ঝেড়ে বলল,’আমি কেন আফসোস করবো??ওকে আমি সব বলিনি? ভালো ভাবে বুঝিয়েছি পর্যন্ত। নাহ উনি কিছু বুঝবেন না। মহারানী ভিক্টোরিয়া হয়ে বসে আছে। ও নিজেকে কি ভাবে বিশ্বসুন্দরী নাকি??ওর থেকে সুন্দর কি আর কোন মেয়ে নেই?? আমার ওকে বিয়ে করতে বয়ে গেছে। ওর মতো মেয়েকে আমি কেন কেউ বিয়ে করবে না।’
ইশানের কথা শুনে মীরা দাঁড়িয়ে পড়লো। এভাবে অপমান সে মেনে নিতে পারছে না। জোর গলায় বলল,’আমি ভালো না তো আমার পিছনে পরে আছো কেন??লন্ডন যাও। হ্যা আমি নিজেকে বিশ্বসুন্দরী মন করি হয়েছে??যতসব পাগল ছাগল।’

মীরা পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,’মনি’মা তোমার ছেলে আমাকে অপমান করছে। তুমি চুপচাপ বসে আছো??’
পিছু কিছু বলার আগেই ইশান বলে উঠলো,’এই তুই আমাকে পাগল ছাগল বললি কেন??ছাগল তো তুই। আয় তোকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াই।’
মীরার রাগ আরো বাড়ল। কটমট করে তাকিয়ে বলল,’আমাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াবে মানে। অসভ্য বেয়াদব ছেলে কোথাকার??’

ইশান মীরার কাছে এগিয়ে এসে বলে,’তুই কাকে বেয়াদব বলছিস??এই শোন আমার পেছনে কত মেয়ে ঘোরে তা জানিস তুই??’
‘জানি তো। তোমার মতো মেয়েরাই তোমার পিছনে ঘোরে। রাতভর বারে গিয়ে মাতলামি করে ওয়াক থু।’
‘বেশি বাজে কথা বলবি না। তোকে বিয়ে করতে কে চেয়েছে। যা যা, আমি দেখব কোন বলদ তোকে বিয়ে করে!!’
‘তোমাকে তো বিয়ে করতে বলিনি।এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন??’
মুক্তা হয়রান ওদের ঝগড়া দেখে। সে বলল, ‘ওরে পিহু ওদের থামা।’
পিহু অসহায় হয়ে বলল,’আমি ভাবিনি আমার ছেলে এরকম হয়ে গেছে।’
পিহু ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,’তোমার জন্য ইশান এরকম হয়েছে। ঠিকমতো মানুষ করতেও পারোনি দেখছি।’

ইফাজ অবাক হয়ে গেল বলল,’এখানে আমাকে টানছো কেন??আমি তো ইশানকে মানুষ করতেই চেয়েছি।ও তো নিজেই মানুষ হতে চায়নি।’
‘তোমার দায়িত্ব ও পালন করোনি!!’
মুক্তা অবাক হয়ে বলল,’একি শুরু করেছিস তোরা। ওদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে নিজেরাই ঝগড়া করছিস থাম।’
মুক্তার কথায় পিহুর হুস ফেরে। সে জোরে ধমকে উঠে বলল,’তোরা থাম??’
ইশান মীরা চুপ করে যায়। পিহু বলল,’ঝগড়ায় পিএইচডি করেছিস নাকি তোরা??এসব বাদ দে। মীরা ইশান তোরা কি করতে চাস?? ভালো ভাবে বল। কারণ লাইফ তোদের সিদ্ধান্ত তোরাই নিবি।’
মীরা মুখ ঘুরিয়ে বলল,’আমি তোমার ছেলেকে বিয়ে করব না।’

মীরার কথায় ইশান আরো রেগে গেল। মীরার হাত চেপে ধরে বলল,’এতদিন কিছু বলিনি বলে পার পেয়ে গেছিস?? ভালো কথা কানে যায় না তোর?? সমস্যা কি এতো?? আমাকে মানতে তোর এতো প্রবলেম কেন??’
মীরা হা হয়ে গেল ইশানের কথা শুনে। এইমাত্র তো বলল সে মীরাকে বিয়ে করবে না আবার এখন এসব বলছে কেন?? মীরা ইশানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল। সবার সামনেই দরজা বন্ধ করে দিলো। মীরার এহেম কাজে ইশান খানিকটা ভড়কে গেল। মীরা দরজা বন্ধ করে ইশানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,’দেখ ইশান আর যাই হয়ে যাক না কেন আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি আমার সব ইচ্ছা অনুভূতি অনেক আগেই কবর দিয়ে দিয়েছি। তাই আর কবর খুঁড়ে সেসব বের করতে ইচ্ছে করছে না।’

বলতে বলতে মীরার চোখে পানি চলে এসেছে। হঠাৎ মীরার এরকম শান্ত কন্ঠ ইশানের বুকে আঘাত হানে। মীরা কেন ইশানকে মেনে নিতে পারছে না??ইশান বলল,’কারণটা কি জানতে পারি??’
মীরা অন্যদিকে ফিরে বলতে লাগলো, ‘কারণটা মনি’মা। মনি’মা চায় তোমার বাবার থেকে দূরে থাকতে। মনি’মা কখনো তোমার বাবাকে মেনে নেবে না। সতের বছরের কষ্টগুলো এতো সহজে ভোলা যায় না। ভালো আব্বু যতই যুক্তি দেখাক না কেন??তার দোষটাই বেশি। সে কেন এত বছর দূরে থাকার পর আবার ফিরে এলো??

তোমরা ছেলেরা সহজ ভাবে নিতে পারলেও আমরা পারি না। মনি’মা নরম মনের মানুষ ছিল। কিন্তু ভালো আব্বুকে আবার দেখে সে কঠোর হয়ে গেছে। সে তার অতীতের কথা না ভুলতে পারছে না আঁকড়ে ধরতে পারছে। কোথাও একটা পিছুটান টেনে ধরছে আমাদের। এখন যদি আমি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে প্রতিনিয়ত ভালো আব্বুর সাথে দেখা হবে।কোন না কোন ভাবে যোগাযোগ হবেই যা মনি’মায়ের পুরোনো ক্ষত তাজা করে দেবে। আমি ও এসব মানতে পারব না। তাই আমাদের মাঝে দূরত্ব থাকাটাই ভালো। দূরত্ব যদি একটা মানুষকে ভালো রাখে তাহলে সেই দূরত্ব আমি চাই।’

ইশানের রাগ গুলো সব দেবে গেছে। মীরা সিরিয়াসলি সব বলছে। কিন্তু ইশান কি আদৌ দূরে থাকতে পারবে মীরার থেকে??এতদিন দূরে ছিল। কিন্তু কাছে এসে ওর প্রতি টানটা আরো বেড়ে গেছে। এখন এই বাঁধন খোলা এতো সহজ হবে কি??ইশান শান্ত দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আস্তে আস্তে মীরার কাছে এসে বলল,’তুই আম্মুর জন্য সব কিছু করছিস বুঝলাম। আমি জানি আম্মু আর আব্বুর ভুল বোঝাবুঝি কোনদিন মিটবে না। কিন্তু তুই একটা কথা বল, আমাকে কি সত্যি তুই ভালোবাসিস না??’

মীরা তার মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইশান বলল, ‘আমি তোর কথা মেনে নিচ্ছি মীরা। তোর থেকে দূরে সরে যাবো। নাই পেলাম তোকে কিন্তু তোর মনের কথাটা তো জানতে পারি??বলবি না??’
মীরা কথা না বলে দরজা খুলে দাঁড়ালো। ইশান বুঝতে পারলো যে মীরা ইঙ্গিতে ইশানকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। ইশান আর কথা বলার সুযোগ পেল না। কিছুক্ষণ মীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল। ইশান বের হওয়ার সাথে সাথেই মীরা দরজা বন্ধ করে দিলো।

এতক্ষণ সবাই ইশান আর মীরার অপেক্ষা করছিল। ইশানকে শুকনো মুখে বের হতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। ইশান সোজা ইফাজের সামনে এসে বললো,’আব্বু আমার লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি শিঘ্রই লন্ডন ফিরব।’
ইশানের কথায় ইফাজসহ সবাই অবাক। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে ইশান পিহুর সামনে গিয়ে বলে,’মীরাকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিও আম্মু। আর আমি একেবারে জন্য যাচ্ছি না। আবার আসবো। তোমার ছেলে আবার তোমার বুকে ফিরে আসবে। মীরার বিয়েটা স্বচোখে দেখতে পারবো না। তাই চলে যাচ্ছি। আবার আসবো।’

ইশান মলিন হেসে বের হয়ে গেল। পিহু ইশানের চলে যাওয়া দেখলো। তবে কি ওদের মধ্যে কিছু ঠিক হয়নি??অবশ্য সবাই আশা করেছিল ওদের সবকিছু ঠিক হয়ে যাক। মীরা আবার ইশানকে ফিরিয়ে দিলো??ইফাজ পিহুকে বলল,’তোমার কথামতো আমি কেস তুলে নিয়েছি পিহু। তবে কি জানো তবুও তুমি বিশ্বাস করলে না যে আমি সত্যি অনুতপ্ত। তুমি আমাকে ক্ষমা না ই বা করলে কিন্তু ইশান আর মীরার জীবনটা নষ্ট করো না। মীরাকে একটু বোঝাও। নিজের কঙ্খিত জিনিসটা না পেলে ইশান পাগল হয়ে যায়। এরপর না জানি ইশান কি করবে??’

ইফাজ বের হয়ে যায়। পিহু ভেবে পায় না যে ও কি করবে??ইফাজকে সে মেনে নিতে পারবে না কোনদিন। ইফাজের দেওয়া কষ্টগুলো ভোলার নয়। কিন্তু ওদের সম্পর্কের টানাপোড়েনে ইশান মীরার সম্পর্ক নষ্ট হতে চলেছে। পিহুর কথা ভেবে মীরা এসব করছে। এটা পিহু ভালো করে বুঝতে পারছে। কিন্তু যতোই হোক পিহু ইফাজকে মানতে পারবে না। এতগুলো বছর আলাদা থেকে ইফাজের প্রতি অনিহা সৃষ্টি হয়েছে পিহুর। পিহু গুটিগুটি পায়ে মীরার রুমে যায়। মীরা খাটের উপর বসে চোখের পানি ফেলছে। পিহু গিয়ে মীরার সামনে বসতেই সে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো। পিহু বলল,’আমার জন্য নিজের পছন্দকে মাটি দিস না মীরা। আমি চাই তুই সুখি হ।’

মীরা পিহুর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘আমিও চাই তোমাকে খুশি দেখতে। আর ভালো আব্বুর কাছে ফিরে গেলে তুমি কখনো সুখি হবে না। তাই আমি ইশানের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই না।’
পিহু হাসলো বলল,’আমি আর ক’দিন বাঁচব??এই কদিনের জন্য নিজের ইচ্ছা কে বিসর্জন দিস না মীরা??’
‘তুমি যতদিন বাঁচবে ততদিন আমি এভাবেই তোমার কথা ভেবে যাব। আমি আর নিতে পারছি না। ইশানকে বলো এসবের মধ্যে না আসতে। এতে না ইশান সুখি হবে আর না তুমি আমি। তাহলে এসবের মধ্যে জড়ানোর দরকার কি?? তুমি কেন আমাকে লন্ডন পাঠালে। ওরা সবটা না জানলেই ভালো হতো। আমরা আর ওরা সুখেই থাকতাম। আমার লন্ডন যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।’

মীরার কথার জবাব দিলো না পিহু। মীরা তো সত্যি কথাই বলেছে। সবটা মিটমাট করতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছে। পিহু রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। মীরা দরজা বন্ধ করে দেয়।
হাঁপিয়ে গেছে মীরা। এসব নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওদের চারজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। প্রিয় থেকে অপ্রিয় হওয়ার প্রতিযোগিতা। কে আগে কার অপ্রিয় হয়ে উঠবে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান সবাই পাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। প্রিয় মানুষকে কি এতো সহজে অপ্রিয় করা যায়??

চোখ বন্ধ করতেই ইশানের মলিন মুখটা ভেসে ওঠে। সাথে সাথে মীরা চোখ খুলে ফেলে। ইশানকে সে মনের কথা না বলে কি সত্যি ভুল করেছে?? কিন্তু বললে যদি ইশান কোন ঝামেলা করতো??নাহ,ইশানকে কথাগুলো না বলাই ভালো হয়েছে। এতে ইশান আরো ভেঙ্গে পরতো।

দরজা ধাক্কানোর শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মীরা। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। সকাল সকাল চোখে ঘুম নেমে এসেছিল তাই একটু ঘুমিয়েছিল মীরা। দরজায় এমন আঘাত করায় চমকে ওঠে সে। গায়ের শাড়িটাও পাল্টায়নি মীরা। ওভাবেই ঘুমিয়ে ছিল। মীরা দ্রুত দরজা খুলতেই পিহুকে দেখলো। পিহুর মুখ দেখে বুঝলো সে চিন্তায় আছে। মীরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পিহু বলে উঠলো,’তোকে বলেছিলাম যে আমার কথা ভাবিস না। নিজের মনের কথা ভাব। তুই শুনলি না। এখন তোর জন্য যদি আমার ছেলের কোন ক্ষতি হয় তখন কি হবে??’

পিহুর কথার মানে মীরা বুঝলো না সে বলল,’কি বলছো তুমি??’
‘কি হয়েছে জানতে চাস??কাল রাতে ইশান বাড়িতে ফেরেনি। কোথায় গেছে কে জানে?? এখন ওকে আমরা কোথায় খুঁজব??যদি ও নিজের কোন ক্ষতি করে দেয়??আমি এতবছর পর ইশান কে পেয়ে আবার হারাব??’

মীরার বুকটা ধক করে উঠল। ইশান এমন কেন??একটু কি শান্ত থাকতে পারে না নাকি??এতো জেদ তো ভালো না। মীরা পিহুকে পাশ কাটিয়ে আসতেই দেখলো ইফাজ বসে আছে। সেও খুব চিন্তিত। ইশানের জন্য সারারাত চিন্তা করে গেছে ইফাজ। সকালে ইশানের খবর না পেয়ে ছুটে এসেছে তাই। মীরা ইফাজকে বলল,’ইশানকে ফোন করেছিলেন??’

‘করেছি কিন্তু ধরছে না।’
‘আবার করে দেখুন। আর হ্যা আপনারা যত দ্রুত সম্ভব লন্ডন ফিরে যান। আমাকে আর মনি’মাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। প্লিজ।’
ইফাজ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’আমরা চলে যাব মীরা। আর কোনদিন তোমাদের সামনে আসব না। কিন্তু ইশানকে ফিরিয়ে দিয়ে তুমি ঠিক করোনি??’
পিহু বলল,’এখন এসব বলার সময় নয়। ইশানকে কল করো।’

চোখের উপর সূর্যের আলো পড়তেই চোখ কুঁচকে যায় ইশানের। তার উপর ফোনটা বেজেই চলেছে। ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। চোখ খুলে আস্তে আস্তে উঠে বসে সে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত। কৃষকরা চাষ করছে। ইশান একটা উঁচু মাটির টিলার উপর শুয়ে আছে। কাল রাতে বার থেকে এক গাদা মদের বোতল কিনে নিয়ে এখানে এসেছে সে। আন্দাজে গাড়ি চালিয়ে কোথায় এসেছে সে নিজেও জানে না। সারারাত ধরে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল ইশান। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইফাজের কল। ইশান ফোন রিসিভ করতেই ইফাজ ব্যস্ত গলায় বলল,’কোথায় তুই ইশান?? বাড়িতে আসছিস না কেন?? আমার চিন্তা হয়না বুঝি??’

‘আমি ঠিক আছি আব্বু।’
‘কোথায় তুই বল আমাকে??আমি নিতে আসছি তোকে।’
ইশান চারিদিকে তাকালো কিন্তু বুঝতে পারলো না যে সে কোথায় আছে?? একজন কৃষককে ডেকে জায়গাটার নাম জেনে ইফাজকে বলল। ইফাজ ইশানকে অপেক্ষা করতে বলে বের হতে নিলেই পিহু বলল সেও যাবে। ইশানের জন্য পিহুর ও চিন্তা হচ্ছে। পিহুকে যেতে দেখে মীরাও সাথে গেল। পিহুকে তো একা ছাড়া যাবে না।
ড্রাইভারকে জায়গাটার নাম বলে সেখানে নিয়ে যেতে বলল।

প্রায় দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে কঙ্খিত জায়গায় ওরা পৌঁছে গেল। এখানকার রাস্তা আঁকাবাঁকা বেশি। ধীরে সুস্থে গাড়ি চালানোর জন্য দেরি হয়েছে। ইশান এমন একটা জায়গায় কিভাবে এলো??গাড়ি থেকে নেমে ইফাজ আবারো ইশানকে কল করে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পেয়েও যায় ইশানকে। মাটির টিলার উপর হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে ইশান। ইফাজ গিয়ে ইশানকে বকাবকি করলো। ইশান নেশায় ঢুলছে এখনও। পিহু এগিয়ে এসে বলে উঠলো,’এসব কি ইশান?? তুই ড্রিংকস করিস। ছিঃ।’
ইশান হেসে বলল,’এটাই আমার নিত্যদিনের সঙ্গী আম্মু। চাইছিলাম এটাকে ছাড়তে কিন্তু পারলাম কই??’

ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’তুই কেন এসেছিস??আবার কি বলবি??মারবি নাকি??’
বলেই হাসলো ইশান। মীরার রাগ হলো। মদ খাওয়া সে একদম পছন্দ করে না। ইশান সেটাই করছে। মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিল। পিহু বলল,’আগে বাড়িতে যাই তারপর এর একটা ব্যবস্থা করছি। এবার আমি যা বলব তাই হবে। তোরা কেউ কোন কথা বলবি না।’
ইশানকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসালো পিহু। মীরা গিয়ে সামনের সিটে বসে। ইশানের পাশে সে বসবে না। ড্রাইভারকে ইশানের গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলল। ইফাজ ড্রাইভিং সিটে বসলো। আর মীরা ইফাজের পাশে। পেছনের সিটে ইশান আর পিহু বসেছে।

ইফাজ ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে। রাস্তাটা বেশি ভালো না। আঁকাবাঁকা তাই গাড়ি চালানো রিস্ক। ভাগ্যিস ইশানের কোন ক্ষতি হয়নি। রাগের মাথায় কিভাবে গাড়ি চালিয়েছিল কে জানে?? তবে ইশানের কিছু হয়নি এটাই ভালো।
ইশান মাথাটা পিহুর কাঁধে এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। খুব ক্লান্ত ইশান। পিহু এবার মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেভাবেই হোক সে ইশানের হাতে মীরাকে তুলে দেবেই দেবে। এতে যা হয় হবে। ইশানের কষ্টটা সে সহ্য করতে পারছে না।

মীরা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগ পর্যন্ত ও ইশানের জন্য চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু ইশান যে মদ গিলছিল কে জানতো?? জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আবার সামনে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো মীরা। সামনে থেকে একটা মাইক্রো এসে সজোরে ধাক্কা মারে ওদের গাড়িতে। ইফাজ ভালো ভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিল। কিন্তু সামনে থেকে আসা গাড়ির চালক বোধহয় বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। ইফাজের পক্ষে একা তো সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ধাক্কা লেগে গেছে। ইফাজের গাড়ি রাস্তার পাশে বড় একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। আর দ্বিতীয় গাড়িটা পাশের খাদে পড়ে আগুন ধরে যায়।

ইফাজের গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মীরার নীল রঙের শাড়িটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে নীল শাড়িটি। মীরার সুন্দর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আছে। ইফাজের ও কোন সাড়া নেই। ইশানের মাথায় এবং হাতে চোট পেয়েছে। গাড়ির সামনের কাঁচ এবং জানালার কাচ গুলো ভেঙ্গে গেছে। পিহুর জ্ঞান আছে কিন্তু সে নড়তে পারছে না। পিহু কম চোট পেয়েছে। কারণ ইশান দুহাতে আগলে ধরেছিল পিহুকে। যার জন্য পিহু কম ব্যথা পেয়েছে। তবুও রক্তে ভেসে যাচ্ছে পিহুর গা।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৯

রাস্তার মানুষ গুলো দ্রুত এগিয়ে আসে। অন্য গাড়িতে করে সবাইকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেয়। চারজনেই গুরুতর আঘাত পেয়েছে। তাই কেউ কারো কাছে যাওয়ার সুযোগ পেল না। এখন সবাইকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে হবে।
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে ইশান। পাশেই পিহু বসে আছে। মাথায় তার ব্যান্ডেজ করা।সামির মুক্তা মুহিত ও আছে। ইশানের জ্ঞান ফিরেছে। আজ পাঁচদিন পর ইশানের জ্ঞান ফিরেছে। তিনদিন আগেই পিহুর জ্ঞান ফিরেছে। চারজনের মধ্যে পিহুই একটু কম যখম হয়েছে। বাকি তিনজনের অবস্থা খারাপ ছিল। তবে এখন ইশান ও আগের থেকে একটু সুস্থ হয়েছে। ইশান উঠে বসে চারিদিকে তাকিয়ে বলল,’আম্মু তুমি ঠিক আছো?? আব্বু কোথায়??আর মীরা??’

ইশানের কথায় পিহুর চোখজোড়া ভিজে উঠলো। কান্নারত কন্ঠে বলল,’মীরা ঠিক আছে। আর তোর আব্বু ও ঠিক আছে। চিন্তা করিস না।’
পিহুর কন্ঠ শুনে ইশানের কেমন যেন সন্দেহ হলো বলল,’আমি ওদের দেখতে যাব এখুনি।’
‘না না ইশান। তুই আগে একটু রেস্ট নে তারপর না হয় যাস। তুই তো অসুস্থ।’
‘আম্মু আমি এখুনি যাব। আমাকে আটকিও না।’
বলেই ইশান বেড থেকে নেমে পড়লো।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন  পর্ব ২১