অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২১ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২১
Ishita Rahman Sanjida

বেলকনির থাই গ্লাস খোলা। হাওয়া হুড়মুড়িয়ে রুমে ভেতরে প্রবেশ করছে। সাদা পর্দাগুলো দুলছে। সাথে সূর্যের আলো এসে পরছে সারা রুমে। চোখে আলো পরতেই চোখ কুঁচকে এলো ইশানের। ওপাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। হালকা শীত পরেছে। খুব শীঘ্রই শীতের প্রকোপ বাড়বে। বরফে ঢেকে যাবে পুরো লন্ডন শহর।

পা টিপে টিপে ইশানের রুমে প্রবেশ করলো ছোট্ট মেয়েটি। ইশানকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নাক ফুলালো সে। চোখমুখ কুঁচকে খাটের উপর উঠে বসে। এক টানে কম্বল সরিয়ে দিলো। কিন্তু ইশানের ঘুম তাতে ভাঙল না। মেয়েটি ইশানকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো,’পাপা,,,ওঠো,,,।’
ইশান মেয়েটার ছোট ছোট হাত দুটি আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করেই বলল,’কি হয়েছে আমার প্রিন্সেসের??’
মেয়েটি ঠোট উল্টে বলল,’আম্মু নেই পাপা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পাশে আম্মু নেই। আবার কোথাও চলে গেছে।’

ইশান চোখ মেলে মেয়েটির দিকে তাকালো। ওর চোখে ক্লান্তি ফুটে উঠেছে। অফিসের কাজ শেষ করে অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে। কাজের ভিশন চাপ। সবটাই একা হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে ইশানকে। ইশান উঠে বসে বলল,’ডোন্ট ওয়ারি মাই প্রিন্সেস। তোমার আম্মুকে খুঁজে পেতে আমার একটুও সময় লাগবে না। ওয়েট আমি এখুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইশান উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ছোট্ট মেয়েটি ইশানের বিছানার উপর বসে রইল। একটু পরেই তোয়ালে হাতে বের হয় ইশান। দেখলো মৌশি ওর বিছানায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা পুরোই পুতুলের মত দেখতে। যে কেউ দেখলেই আদর করতে চাইবে। অতিরিক্ত ফর্সার কারণে গাল দুটো সবসময় লাল হয়ে থাকে। কেউ ছোঁয়া দিলেই বোধহয় গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। ইশান হেসে মৌশির কাছে গিয়ে বলল,’মন খারাপ করে না। আমি তোমার আম্মুকে খুঁজে এনে দেব।’

মৌশি হাসলো এতে ইশানের মুখে ও হাসি ফুটলো। মৌশির হাত ধরে রুম থেকে বের হলো। দুজন সার্ভেন্টের কাছে মৌশিকে দিয়ে বের হয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে সে কাউকে ফোন করলো। ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। গন্তব্য হাউড পার্ক। বাকিংহাম প্যালেস থেকে একটু দূরেই হাইড পার্ক। এটা লন্ডনের সবচেয়ে বড় রয়্যাল পার্ক। পার্কের সামনে এসে গাড়ি থামায় ইশান। গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চোখ বুলায়। চারিদিকে সারি সারি বিশাল গাছ। বড় একটা মাঠও আছে। রাস্তার পাশে বসার জন্য বেঞ্চ আছে।

ইশান পার্কের ভেতরে ঢুকলো। গায়ে তার সাদা রঙের শার্ট আর জিন্স। ইশান এদিক ওদিক তাকিয়ে একজনকে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খুঁজে পেয়েও গেল। দূর থেকে সে দেখতে পেল গাঢ় সবুজ রঙের শার্টের সাথে স্কার্ট পরা মেয়েটাকে। গলায় একটা স্কার্ফ ঝোলানো। সে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। মুখে হাসি ঝুলিয়ে ইশান সেদিকে এগিয়ে গেল।

মীরা সাবরিনের সাথে কথা বলতেছিল এতক্ষণ। মীরা সাবরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসি মুখে বলল,’তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আচ্ছা তুমি কি এখানে রোজ রোজ আসো??’
সাবরিন বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’রোজ আসা হয় না তবে মাঝেমধ্যে আসি। কখনো কখনো একা আসি তো কখনো হাজবেন্ড এর সাথে আসি।’

মীরা হাসলো তখনই ইশান এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। মীরা চকিতে ইশানের দিকে তাকালো। মুখের হাসিটা তার কিন্ঞ্চিৎ সরে গেছে। মীরার চোখের দিকে তাকিয়ে ইশানের আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। সে মীরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,’হাই আমি ইশান।’
মীরা কিছুক্ষণ ইশানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বলল,’আমি মীরা।’
‘আমি কি বসতে পারি??’

মীরা সরে বসে ইশানের জন্য জায়গা করে দিয়ে বলল,’সিওর।’
ইশান বসে পড়লো। সাবরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কখন এসেছো??’
‘এই তো এখুনি।’
মীরা সাবরিন আর ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমরা দুজন দুজনকে চেনো??’
সাবরিন মাথা দুলিয়ে বলল,’হুম। আমরা দুজন খুব ভালো ফ্রেন্ড।’
‘ওহ।’ সাবরিন মীরাকে বলল,’তুমি আমাদের ফ্রেন্ড হবে??’
মীরা বুঝলো না যে সে কি বলবে??তাই সে চুপ করে রইলো। ইশান সাবরিনকে বলল,’ছেড়ে দাও সাবরিন। যে বন্ধু হতে চায় না তাকে জোর করে লাভ নেই। জোর করে বন্ধুত্ব করা যায় না।’
মীরার এবার অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। সে রাজি হয়ে গেল বন্ধু হতে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর মীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’আমি আসি!!’

ইশান মীরার কথার পিঠে বলে উঠলো, ‘কোথায় যাচ্ছো??’
ইশানের প্রশ্নে মীরা অবাক হয়।এইতো পরিচয় হলো আর এখনই প্রশ্ন করলো?? মীরার দৃষ্টি দেখে ইশান বলল,’না মানে এখন তো আমরা বন্ধু তাই তুমি কোথায় যাচ্ছ সেটা তো জানতেই পারি তাই না??’
মীরা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,’বাড়িতে যাচ্ছি।’
সাবরিন প্রশ্ন করলো,’বাড়ি কোথায় তোমার??’

সাবরিনের প্রশ্নে মীরা চমকে তাকালো। সত্যি তো ওর বাড়ি কোথায়??জানে না সে!! সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা বিছানার উপর নিজেকে আবিষ্কার করেছিল মীরা। কোন কিছু না ভেবেই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে এখানে আসে। তাহলে কি ওই বাড়িটা মীরার ছিলো?? হবে হয়তো। কিন্তু মীরার মনে পরছে না কেন??এত মন ভোলা সে কবে থেকে হলো??মাথা ভনভন করছে মীরার। সাথে প্রচন্ড ব্যথা ও শুরু হয়ে গেছে। আশেপাশের সবকিছু কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরল মীরা। মীরার এরকম অবস্থা দেখে ইশান ঘাবড়ে গেল। মীরাকে ধরে বেন্ঞ্চে বসায়। তারপর সাবরিনকে বলল,’এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করো না সাবরিন। মীরা নিতে পারে না। দেখছো না মীরা কিরকম করছে।’
সাবরিন মলিন কন্ঠে বলল,’সরি আমি ভাবতে পারিনি।’

মীরা মাথা চেপে ধরে বলল,’আমি কোথায় থাকি তা মনে পরছে না কেন??মাথাটা এতো ব্যথা করছে কেন??’
ইশান মীরার হাত ধরে বলল,’জাস্ট রিল্যাক্স মীরা। এসব ভেবো না। তোমাকে বাড়ি যেতে হবে না। চলো আমার সাথে। আমার বাড়িতে যাবে তুমি।’
মীরা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ইশানের দিকে তাকালো। ইশান বলল,’একটু আগেই তো আমরা বন্ধু হলাম তাই না??তাহলে আমার বাড়ি যেতে তোমার আপত্তি কোথায়??চলো, তোমার ভালো লাগবে এতে।’

মীরা ইশানের দিকে তাকালো তবে মাথাটা এখনো ব্যথা করছে খুব। ইশান মীরার হাত ধরে পার্ক থেকে বের হয়ে এলো। শরীর দূর্বল তাই মীরা কথা বাড়ালো না। ইশান গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাবরিনকে বিদায় দিয়ে ওরা বাড়িতে ফিরে এলো। ইশান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।যাক শেষমেশ মীরাকে বাড়িতে আনা গেল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই মীরা অবাক চোখে তাকাল। সকালে তো সে এরকম একটা বাড়ি থেকেই বের হয়েছিল। চারিদিক ঘুরে ঘুরে সে দেখতে লাগল। হঠাৎ চোখ গেল সোফায় বসে থাকা মধ্যবয়সী এক নারীর উপর। ছাই রঙা সুতি শাড়ি পরেছে সে। মীরাকে দেখেই সে তাকে কাছে ডাকলো। মীরার যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিসব ভাবতে ভাবতে মীরা সোফায় গিয়ে বসলো। পিহু মুচকি হেসে বলল,’কি খাবে মীরা?? ব্রেকফাস্ট নিশ্চয়ই করো নি??’

পিহুর কথায় মীরা অবাক হয়ে গেল। ইনি কিভাবে মীরার নাম জানলো??আর মীরা তো আজকেই দেখছে মহিলাটাকে। মীরা বলল,’আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে??আপনি কি আমাকে চেনেন??’
পিহু একপলক ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ইশান বলেছে তোমার কথা।’
মীরার মাথা এবার আরো ঘোরাতে লাগলো। বলে কি??এতো তাড়াতাড়ি ইশান কি বলল??
প্রশ্নের জটলা পাকিয়ে মীরার মাথা ঘোরাতে লাগলো। পিহু মীরার মাথায় হাত রেখে বলল,’বেশি প্রেসার নিও না। চলো??’

পিহু মীরাকে নিয়ে টেবিলে বসে। ইশান নিজের রুমে চলে গেছে। মীরাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। তারপর ওখান থেকে অফিস যাবে ইশান। মীরা খাচ্ছে তবে ওর মনটা কেমন যেন করছে। বারবার কিছু মনে করার চেষ্টা করেও সে সফল হলো না। কিছুক্ষণ বাদেই ইশান চলে আসে। মীরা পাশে নিঃশব্দে বসে পরলো। সবাই স্বাভাবিক আচরণ করছে কিন্তু মীরার অস্বস্তি হচ্ছে। একে তো বাড়িটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে পরছে না।

খাওয়া শেষে মীরাকে নিয়ে বের হয় ইশান। যেহেতু মীরার এই মুহূর্তে কিছু মনে পড়ছে না সেহেতু ইশানের সাথে যাওয়াটাই প্রধান্য দিচ্ছে মীরা। হসপিটালের সামনে গাড়ি থামালো ইশান। মীরাকে বের হতে বলে সেও বের হয়। মীরাকে ডক্টরের কেবিনে নিয়ে যেতেই দুজন নার্স এসে মীরাকে নিয়ে গেল। মীরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। ইশান ডক্টরকে বলল,’আজও মীরা সবকিছু ভুলে গেছে। প্লিজ কিছু করুন।’

ডক্টর ইশানের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বলল,’রিলাক্স ইশান। আমি দেখছি।’
ডক্টর চলে যেতেই ইশান ও চলে আসলো। এই মুহূর্তে সে মীরার সাথে দেখা করতে পারবে না। মীরাকে ওই অবস্থায় দেখলে তার খারাপ লাগবে তাই ইশান সোজা অফিসে চলে গেলো। অফিসের কাজ সারতে সারতে অনেক রাত হয়ে গেল। ইশান গাড়ি নিয়ে বের হতেই পিহুর ফোন এলো। পিহু জানালো সে হসপিটালে আছে। ‌ইশানও যেন চলে যায়। ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও ইশান হসপিটালের মুখো গাড়ি ঘোরালো।

হসপিটালের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো পিহু। বেডের উপর শুয়ে থাকা কঙ্খিত মানুষটাকে দেখে মুখে কিন্ঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল। আস্তে আস্তে পা ফেলে বেডের সামনে থাকা টুলটায় বসে পড়লো পিহু। স্নিগ্ধ হেসে তাকালো ইফাজের মুখের দিকে। পিহু ভেবে নিয়েছে সে আর মন খারাপ করে থাকবে না। কাঁদবেও না,কেঁদে কি হবে?? সবকিছু কি ঠিক হবে??পিহু সবটাই বিধাতার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

ইফাজের চোখজোড়া বন্ধ। মুখে অক্সিজেন মাস্ক হাতে ক্যানেলাসহ আরো ডাক্তারি সব জিনিসপত্র লাগানো আছে। যেসবের নাম পিহুর জানা নেই। সে শুধু ইফাজের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিদিন ই পিহু ইফাজের সাথে দেখা করতে আসে। আজকে সকালে এসেছিল ইশান চলে আসার কিছুক্ষণ পর। ইফাজকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বিধায় আবার এসেছে। এরকমটা মাঝে মধ্যে করে থাকে পিহু।

পিহু ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’জানি না কবে তুমি সুস্থ হবে??কবে তোমার সাথে কথা বলতে পারবো?? তোমাকে তো বলতেই পারলাম না যে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি ভাবতে আমার কাছে তুমি অপ্রিয়। কিন্তু তুমি যে আমার অপ্রিয় নও। শুধুই প্রিয়জন। এই কথাট না আমি বলার সুযোগ পেয়েছি না তুমি শোনার সুযোগ পেয়েছো। কিন্তু আমি অপেক্ষা করব। তোমাকে কথাগুলো বলার জন্য। আমার বিশ্বাস তুমি একদিন ঠিকই আমার কথা শুনবে।’

বলতে বলতে পিহু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। আজকে চাঁদ ওঠেনি আকাশে। উঠলেই বা কি হবে??যার সাথে চাঁদ দেখার কথা সেই তো দেখতে পারবে না। তাই শুধু শুধু এই ইচ্ছা রাখার দরকার নাই। সেদিনের পর থেকে আরো দুটো বর্ষাকাল কেটে গেছে। কেটে গেছে দুটো শীত ও বসন্ত কাল। অথচ পিহু এই দুটো বছর ইফাজের এই বন্ধ চোখজোড়ার দেখেছে। এতে পিহুর আফসোস নেই। ইফাজ জীবিত আছে এটাই অনেক।

সেদিনের এক্সিডেন্টের পর থেকেই ইফাজ কোমায় আছে। ইফাজের চিকিৎসার জন্য লন্ডন এসেছে ওরা। দুই বছর ধরেই কোমায় আছে ইফাজ। ডক্টর কিছু বলতেও পারছে না। ইফাজ পুনরায় কবে সুস্থ হবে তা বলা তাদের কাছে মুশকিল। তবে পিহুর আশা যে ইফাজ একদিন না একদিন সুস্থ হবেই। তাকে যে পিহুর না বলা কথাগুলো শুনতে হবে।

আর মীরা,,,,,,সেদিন ইফাজের সাথে মীরার অবস্থাও খারাপ ছিলো। তবে মীরার থেকে ইফাজের বেশি যখম হয়। মীরার মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার জন্য ব্রেনে সমস্যা হয়। সাতমাস হসপিটালে ছিল মীরা। তারপর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। প্রায়ই সে তার স্মৃতি গুলো ভুলে যায়। তবে কয়েকঘণ্টা পার হতেই আবার সব মনে পরে যায়। কখনো কখনো শুধু পিহুকে মনে থাকে আবার কখনো ইশানকে।

আবার অনেক সময় পিহু আর ইশান দুজনকেই ভুলে যায়। মাথায় বেশি প্রেসার দিতে বারন করেছে ডক্টর। এই ভুলে যাওয়া রোগ আবার শুরু হয় আজকে সকালে। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে একটা বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। কি সব ভেবে বাইরে আসে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে হাইড পার্কে চলে যায়। এরকম অনেক বার করেছে মীরা। তাই ইশান সবসময় মীরার উপর নজর রাখে। দুজন লোক সবসময় মীরাকে ফলো করে।

সাবরিন ও আসে মীরাকে দেখতে। তবে কোনদিন মীরা ওকে চিনতে পারে আবার কোনদিন চিনতে পারে না।
ইশান হসপিটালে পৌঁছে গেছে। ইশান জানে ওর মা ওর আব্বুর কাছে। তাই ইশান সেদিকে গেলো না। পিহুকে একা ছেড়ে দিলো। ইশান মীরার কেবিনে গেল। মীরা ঘুমিয়ে আছে। মীরার মাথায় অসংখ্য ডাক্তারি যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে। ইশান মীরার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ক্লান্ত দৃষ্টিতে মীরাকে পরখ করে বেরিয়ে আসতে নিলে কেউ একজন ওর হাত ধরে ফেললো। ইশান ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মীরা ওর হাত ধরে আছে। ইশান কোন কথা বলল না। সে বুঝতে পারছে না যে আদৌ মীরা ওকে চিনতে পারছে তো??ইশানের চাহনি দেখে মীরা হেসে বলল,’আমি আবার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম ইশান???’

মীরার কথা শুনে হাসলো ইশান। তারমানে ইশানকে চিনতে পারছে মীরা। ইশান মীরার পাশে বসে ওর হাতে চুমু খেল। মীরা বলল,’আমি বাড়িতে যাব।’
‘তুই এখনও সুস্থ না মীরা।’
‘আমি সুস্থ আছি। তোমাকে তো বলেছি আমি যতক্ষন তোমাকে মনে থাকবে ততক্ষণ আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। আমি এখানে থাকবো না।’
ইশান মাথা নাড়িয়ে বলল,’আচ্ছা আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে তোকে নিয়ে যাব।’
মীরা শান্ত দৃষ্টিতে ইশানের দিকে তাকালো বলল,’মনি’মা কোথায়??আর ভালো আব্বু??’
‘আম্মু আব্বুর কাছেই আছে। তুই যাবি??’

মীরা মাথা নাড়লো। ইশান ডক্টরের সাথে কথা বলে মীরাকে নিয়ে ইফাজের কেবিনে গেল। ওখানে কিছুক্ষণ থেকে বাড়িতে চলে এলো।পিহু নিজের রুমে গেল। মৌশি ঘুমাচ্ছে। যাওয়ার সময় মৌশিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গিয়েছিল মৌশিকে। এখনও ঘুমাচ্ছে। মৌশি ঠিক মীরার মতোই ঘুম পাগলি। পিহু হাসলো মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর মৌশির পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ইশান ফ্রেশ হয়ে এসেছে। মীরা খাটের উপর টান হয়ে শুয়ে আছে। ইশান গিয়ে মীরার পাশে শুতেই মীরা ইশানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের উপর মাথা রাখলো। ইশানও মীরাকে জড়িয়ে নিলো। মীরা বলল,’আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি তাই না ইশান??’

‘উহু একদম না।’
‘এই যে মাঝে মাঝে আমি সব ভুলে যাই। তোমাকে ও ভুলে যাই এতে তোমার কষ্ট হয় না??’
‘নাহ,তুই তো ইচ্ছে করে সব ভুলে যাস না। যতটুকু সময় তোর আমাকে মনে থাকবে ততটুকু সময় আমাকে দিস তাহলেই হবে। এতেই যথেষ্ট আমার আর কিছু চাই না। আমার শুধু মীরাকে চাই মীরার স্মৃতি না। তোর মনে থাক বা না থাক আমার তোকে মনে থাকবেই। এতেই হবে।’
মীরা আরেকটু শক্ত করে ইশানকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি চাই না তোমাকে ভুলে যেতে। আমি তোমাকে আমার স্মৃতিতে সবসময় ধরে রাখতে চাই কিন্তু পারি না।’

‘আমার জন্য সব হয়েছে। আমি সেদিন ওইখানে না গেলে এক্সিডেন্ট হতো না।’
‘নাহ,সব ভাগ্য। আমাদের ভাগ্যে ছিল এটা তাই হয়েছে। ছাড়ো পিছনের কথা। মৌশি কোথায়??’
‘আম্মুর কাছে ঘুমাচ্ছে।’
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’মৌশি ও তো কষ্ট পায় আমি যখন ওকে ভুলে যাই। শুধু শুধু ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওকে না আনলেও পারতে।’
‘মৌশি তো ওর আম্মুকে চেয়েছিল আমি দিয়েছি। তোকে কাছে পেলে মৌশি খুশি হয়। বুঝিস না??’
‘বুঝি তো।’

তারপর কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে থাকলো। ইশানেরও ঘুম আসছে না। মীরা ও জেগে আছে। মীরা এখন মৌশির কথা ভাবছে। বাংলাদেশ থাকতে একটা আশ্রম থেকে মৌশিকে দওক নেয় ইশান আর মীরা। মীরার এই অবস্থায় কনসিভ করতে ডক্টর বারন করে দিয়েছে। কখন ভুলে গিয়ে কি করে ফেলে কে জানে??ইশানের খেয়াল রাখা সত্ত্বেও অনেক বার হারিয়ে গিয়েছিল মীরা। বিপদের সম্মুখীন ও হয়েছে। তাছাড়া বেবি কনসিভ করলে শারীরিক সমস্যা ও হতে পারে। তাই ইশান এবিষয়ে কখনোই মীরার সাথে কথা বলেনি। সে শুধু মীরাকে চায়। মীরাকে নিয়ে রিক্স নিতে ইশান নারাজ। তাই বাবা মা হারা মৌশিকে নিজেদের সন্তানের স্থানে বসায়।

ইশান মীরার বিয়েটাও হুট করেই হয়। ইশান চেয়েছিল ইফাজ সুস্থ হোক তার পর বিয়ে করতে। কিন্তু পিহুর কারণে ওদের বিয়েটা করতেই হয়। মীরা আবার কখন সব ভুলে যায়??সেজন্য বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই। ইশান মীরাকে নিয়ে এভাবেই সারাজীবন কাটাতে পারবে কিন্তু ওর চিন্তা পিহু আর ইফাজকে নিয়ে। ইফাজ কবে সুস্থ হবে কবে ওর মায়ের মুখে হাসি ফুটবে??
ইশান শান্ত গলায় বলল,’মীরা,,,,’
‘হু,,,’
‘ভালোবাসা দিবি আমাকে??’

মীরা চোখ তুলে ইশানের দিকে তাকালো। ইশান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। এই দৃষ্টি মীরা কখনোই উপেক্ষা করতে পারবে না। মীরা স্নিগ্ধ হেসে ইশানের গালে গভীর চুমু খেলো। ইশান হেসে বলল,’যাক তাহলে ভালোবাসা বুঝেছিস।’
মীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’মানে??’
‘তোর কাছে তো আদর মানেই থাপ্পর মারা।’
বলেই ইশান মৃদু হাসলো। মীরা ইশানের চুল টেনে দিতেই ইশান বলল,’মারছিস কেন??এই কথাটা আমার নয় মুহিতের। মুহিত আমাকে এসব বলেছে।’
‘তুমি ওই পিচ্চিটার কথা শোন কেন?? ফাজিল একটা।’

‘মুহিতকে পিচ্চি বলিস না। এখন সে বড় হয়েছে। তিনটা গার্লফ্রেন্ড অলরেডি বানিয়ে ফেলেছে। আশা করি আরো বানাবে। তবে যেই মুহিতের মুখে সবসময় হাসি থাকতো সেই মুহিত সেদিন তোর জন্য কেঁদেছিলো খুব।’
মীরা বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’মুহিত হাসিখুশি চন্ঞ্চল স্বভাবের ছেলে। ছোট থেকে ও আমার কাছেই থেকেছে। আমাকে খুব ভালোবাসে। তাই সবসময় জ্বালাতো। এজন্য অনেক মার খেয়েছে।’
‘বাদ দে এসব। আজকে শুধু আমরা একে অপরের কথা শুনব। নাহ,ভালোবাসবো।’
মীরা হাসলো। ইশানের সাথে কাটানো ভালো লাগার মুহূর্ত গুলো কি না ভুললে হয় না?? এই সময়গুলো হাজার চাইলেও মীরা মনে রাখতে পারে না। কিন্তু মীরা এটা চায় না। মীরা জানে যখন ও সব ভুলে যায় তখন ইশানের খুব কষ্ট হয় কিন্তু তা প্রকাশ করে না।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২০

যাতে মীরা কষ্ট না পায়।
সকালে খাওয়ার টেবিলে বসে আছে সবাই। মীরা মৌশিকে খাইয়ে দিচ্ছে। কালকে সারাদিন ডক্টরের কাছে থাকার জন্য সব ঠিক আছে। এজন্য সাবরিন ও এসেছে। একাই এসেছে। সে মীরার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। ইশান দ্রুত খাচ্ছে তাকে তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে। তখনই ইশানের ফোনে কল এলো। অপর পাশের ব্যক্তির কথা শুনে থমকে যায় ইশান। ফোন কেটে দিলো। পিহু জিজ্ঞাসা করল,’কি হয়েছে ইশান??’
ইশান ছলছল নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’শেষ রাতের দিকে আব্বুর জ্ঞান ফিরেছে কথাও বলেছে।’

ইশানের কথা শেষ না হতেই পিহু দাঁড়িয়ে পড়লো। ঝড়ের বেগে ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ইশান উঠতে নিলেই মীরা ইশানের হাত ধরে ফেলে বলে,’আজকের এই খুশিটা মনি’মাকে একান্তে কাটাতে দাও। যে খুশির জন্য এতো অপেক্ষা সেই খুশিতে বিরক্ত না করাটাই ভালো। আমরা পরে যাব।’
ইশান মাথা নাড়লো। মীরার চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল। পিহুকে এই অবস্থায় দেখতে পারছিল না মীরা।

গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। পিহু বারবার ড্রাইভারকে তাড়া দিচ্ছে। অস্থিরতা পিহুর বাড়ছে। তাহলে কি ইফাজ সুস্থ হয়ে যাবে??পিহুর কথা শুনতে পারবে??পারতে ইফাজকে হবেই। বাকি বর্ষা শীত বসন্ত একসাথেই কাটাবে সে ইফাজের সাথে। এতদিন অমাবশ্যা থাকার পর পিহুর মনের আকাশে চাঁদ উঠেছে। এবার সব ভালো হতেই হবে।ইফাজকে সে সত্যি বলবে। বলবে,আমি তোমার অপ্রিয় সেই প্রিয়জন না, শুধুই প্রিয়জন। আর সারাজীবন প্রিয়জন হয়েই থাকবো। চোখের পানি মুছছে পিহু। এটা যে সুখের কান্না। শুধু দুঃখ পেলেই মানুষ কাঁদে না। সুখেও মানুষ অনেক সময় কেঁদে ফেলে। পিহুর আজকের কান্না সুখের।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন শেষ পর্ব