অপ্রিয় সেই প্রিয়জন শেষ পর্ব  || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন শেষ পর্ব 
Ishita Rahman Sanjida

ফিরে দেখা~
বাংলাদেশ বিমানটি মাত্রই লন্ডন শহরে ল্যান্ডিং করলো। প্লেন থেকে যাত্রি নামছে। চোখে ব্লাক সানগ্লাস কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্লেন থেকে নামছে মুহিত। প্লেন থেকে নেমে লম্বা শ্বাস ফেলে চারিদিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার। পেছন থেকে একটা মেয়ে মুহিতকে বলে উঠলো,’এই যে,সরো সামনে থেকে।’

পেছনে তাকিয়ে মুহিতের হাসিটা আরো গাঢ় হয়। সাইড দিয়ে বলে,’আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।’
মেয়েটা হালকা রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’কিন্তু আমার ভালো লাগলো না। আশা করি তোমার মতো ছেলের সাথে যেন আর কখনো দেখা না হয়।’

মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। প্লেনে পাশাপাশি সিটে বসেছিল দুজন। বকবক করে করে মেয়েটার মাথা অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে। বাকি অর্ধেক নিয়ে যে সে ফিরতে পারছে এটাই অনেক। মেয়েটার বয়স মুহিতের থেকেও বেশি। তাই হয়তো বেশি কথা বলে ফেলেছে মুহিত। এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সিনিয়রদের জ্বালাতে ভালোই লাগে মুহিতের। আলতো হেসে মুহিত লাগেজ টেনে ইয়ারপোর্টের বাইরে এলো। এখন সে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু গাড়ি এখনও আসছে না। তাহলে কি ইশান গাড়ি পাঠায়নি??সানগ্লাসটা খুলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো মুহিত। মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করলো। মুহূর্তেই একটা গাড়ি এসে থামলো মুহিতের সামনে। গাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক বের হয়ে এলো। সে বাংলাতেই বলল,’আমাকে ইশান স্যার পাঠিয়েছে আপনাকে নিতে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুহিত বেশ অবাক হলো ইশান না এসে ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে!!মুহিত কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে উপভোগ করতে লাগলো। জানালার কাঁচ তোলা,হালকা শীত পড়েছে। বাতাসে আরো ঠান্ডা লাগবে তাই।

ইশান গাড়ি নিয়ে ছুটছে। আর একটু পর পর মাথার চুলগুলো আলতো করে ঠিক করছে বারবার। বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটা বড় পার্ক রয়েছে। সেখানে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো ইশান। পার্কের ভেতরে চিরুনি অভিযান চালিয়ে মীরাকে খুঁজে বের করলো সে। একটু আগেই সে খবর পেয়েছে মীরা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। তাই ইশান সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। পার্কের এক কোনায় গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে মীরা। আজকে সে নীল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলগুলো খোপা করে তাতে লাল গোলাপ লাগানো। দুহাত ভর্তি নীল চুড়ি। মীরাকে এই সাজে দেখে ঘাবড়ালো ইশান। বিকেল গড়িয়ে এসেছে। পার্কে অনেক বাচ্চারা এসেছে খেলতে। কিন্তু এসময় মীরা এখানে কি করছে??ইশান মীরার পাশে গিয়ে দাড়াতেই মীরা ওর উপস্থিতি টের পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ইশানের দিকে। মীরার শান্ত দৃষ্টি দেখে ইশান বুঝলো যে মীরা আবার ওকে ভুলে গেছে।

ইশান দুকদম এগিয়ে গেল মীরার দিকে। প্রায় পনেরো দিন মীরা সুস্থ ছিল। আর আজকে সব ভুলে গেছে। ইশান আবার আগের মতোই মীরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,’হাই আমি ইশান।’
মীরা কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো ইশানের দিকে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো ইশানের হাতে। আস্তে করে বলল,’আমি মীরা।’
‘এসময়ে পার্কে এসেছো কেন??মন ভালো নেই নাকি??’

মীরা হালকা হেসে বলল,’কেন মন ভালো থাকলে বুঝি কেউ আসে না এখানে??’
‘আসে তবে একা না। তুমি তো দেখছি একা একাই চলে এসেছো। তাই ভাবলাম মন খারাপ বোধহয়। এনিওয়ে মন খারাপ হতেই পারে। আমি তোমার মন ভালো করার সলিউশন দেব??’
মীরা ছোট ছোট চোখে তাকাতেই ইশান বলল,’আমার বন্ধু হবে?? তাহলে তোমার মন ভালো করে দেব।’

ইশানের কথায় মীরা হাসলো বলল,’ঠিক আছে। তো এখন আমার মন ভালো করবেন কিভাবে??’
‘চলো সামনে এগোই। আজকে লং ড্রাইভে যাই তাহলে মন ভালো হয়ে যাবে।’
মীরা মাথা নাড়লো। তারপর ইশানের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। ইশান আর মীরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই মীরা ইশানের একহাত জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে হাঁটতে লাগলো। ইশান এতে অনেকটাই অবাক হয়ে গেল। মীরা বলল,’আমি যখন সবকিছু ভুলে যাই তখন এভাবেই আমাকে মানিয়ে নাও তাই না??’

মীরার কথায় ইশান আরেক দফা অবাক হলো। তারমানে মীরা ইচ্ছে করে এসব করেছে??কিছুই ভোলেনি। এতক্ষণ ধরে নাটক করছিল??ইশান অবাক দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকালো। ইশানের কাঁধ থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে হাসলো মীরা। সে বলল,’লং ড্রাইভে যাবে না??’
ইশান মীরার হাত ছাড়িয়ে বলল,’তুই এতক্ষণ অভিনয় করছিলি??’
মীরা মাথা নাড়িয়ে বলল,’হুম।’

ইশানের রাগ হলো। মীরা কি জানে না যে ইশানের চিন্তা হয়?? মীরাকে নিয়ে সে কতখানি সিরিয়াস!! তারপরও মীরা এমন করলো কেন??ওর মন নিয়ে এমন টানা হেঁচড়া না করলেই পারতো। ইশান রেগে চলে যেতে নিলেই মীরা এক হাত টেনে ধরে ইশানের। কিন্তু ইশান পেছন ফিরে না তাকিয়ে
বলল,’হাত ছাড় আমার।’

মীরা বুঝলো যে ইশান রাগ করেছে। সে বলে উঠলো,’Happy Marriage Anniversary’
মীরার কথায় থমকে গেল ইশান। আজকে ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী!!আর ইশান সেটা ভুলে গেল কিভাবে??মীরা মনে করিয়ে না দিলে ইশানের হয়তো মনে পরতোই না। মুহূর্তেই ইশানের রাগ উবে গেলো। সে মীরার দিকে ফিরে তাকালো। মীরা মৃদু হাসছে। এইজন্যই কি মীরা আজকে সেজেছে ঠিক আগের মতো?? বিয়ের পর এই প্রথম মীরা এভাবে সেজেছে। ইশান মীরার কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,’সরি আমার মনে ছিলনা। আ’ম রেইলি সরি।’

মীরা বলল,’এটাই স্বাভাবিক ইশান। তুমি আর কতদিকে খেয়াল রাখবে!!তাই আমি মনে করিয়ে দিলাম।’
‘তবুও আমার মনে রাখা উচিত ছিল।’
মীরা ইশানকে ছেড়ে বলল,’থাক আর মনে রাখতে হবে না। আমিই মনে করিয়ে দেব।’
ইশান হেসে বলল,’তুই তো নিজেই মাঝে মাঝে সব ভুলে যাস তাহলে আমাকে মনে করিয়ে দিবি কিভাবে??’
‘আমি আর কিছু ভুলতে চাই না ইশান। আমি চেষ্টা করবো যেন সবকিছু আমার স্মৃতিতে থাকে। তাই আমি আমার রুমে তোমার আর আমার বড় একটা ছবি বাঁধাই করে টানিয়ে রেখেছি। যদি কিছু ভুলে যাই তাহলে ছবি দেখে মনে করার চেষ্টা করব।’

ইশান মুচকি হেসে মীরার হাত মুঠোবন্দী করে বলল,’এসবের দরকার নেই। আমি আমার মীরাকে নিত্য নতুন ভাবে দেখতে চাই,জানতে চাই, ভালোবাসতে চাই। তুই যখন সবকিছু ভুলে যাস তখন আমি আবার নতুন করে তোর প্রেমে পড়ি। নতুন করে তোকে আমার ভালোবাসায় ফেলতে চাই। ব্যাপারটা অন্যরকম তাই না??বউয়ের সাথে নতুন করে পরিচিত হয়ে প্রেম। আমার এটাই ভালো লাগে।’
মীরা ও এতে হেসে ফেললো। মুগ্ধ হয়ে ইশানের দিকে তাকালো সে। ইশান কি সুন্দর সব রকম পরিস্থিতিতে মীরাকে মানিয়ে নেয় তা ভাবতেই মীরার হাসিটা আরো গাঢ় হয়। মীরা বলে,’যাবে না লং ড্রাইভে??’

ইশান নিজেকে দেখিয়ে বলল,’এভাবে??নিজে তো সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছিস আর আমি অফিস ড্রেসে।’
‘তো কি হয়েছে??তোমাকে এভাবেই ভালো লাগছে আমার কাছে। চলো,,,,’
ইশানে সুট আর টাই খুলে ফেলে। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে এলো সাথে লন্ডন শহরে কৃত্রিম সৌন্দর্য দেখা গেল। আজকে ইশান মীরাকে নিয়ে পুরো লন্ডন শহর ঘুরবে। ইশান গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু মীরার মন খারাপ করে বসে আছে। ইশান মীরার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো বলল,’কি ম্যাডাম??মন খারাপ কেন?? আবার সব ভুলে গেলেন নাকি??’

মীরা ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমরা কি বেবি নিতে পারি না ইশান??’
সাথে সাথে ইশান ব্রেক কষে। ইশান মীরার দিকে তাকায়। মীরা ছলছল চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা এর আগেও অনেক বার ইশানকে একথা বলেছে কিন্তু ইশান তাতে পাত্তাও দেয়নি। ইশান রাগি দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’এসব কথা বলছিস কেন??জানিস না যে এটা পসিবল নয়?? আর তোর শাশুড়ি কি দজ্জাল??বাচ্চার জন্য তোকে চাপ দিচ্ছে?? তাহলে এসব চিন্তা মাথায় আনছিস কেন?? তোকে কতবার বলেছি আমার কাছে তুই আগে মীরা।’

মীরা কেঁদে দিল ইশানের কথায়। ইশান কি বোঝে না যে মীরা মা হতে চায়??একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে ইচ্ছা তো মা হওয়া। মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ধরে নাও বিবাহ বার্ষিকী তে এই উপহার টাই আমি চাই। প্লিজ ইশান।’
ইশান স্টেয়ারিং এর উপর দুহাত রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো। চোখ মেলে বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে আমি রাজি তবে শর্ত আছে।’
মীরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। চোখ মুছে খুশি হয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি সব শর্ত মানতে রাজি।’

ইশান বলল,’ওকে। শর্ত হলো প্রেগনেন্সির পুরো সময় তোকে হসপিটালে থাকতে হবে।’
মীরার চোখ কপালে। এরকম শর্ত দেবে তা সে ভাবতেই পারেনি। যেখানে মীরা একদিন হসপিটালে থাকতে চায় না সেখানে প্রায় দশ মাস থাকবে কিভাবে?? মীরা থম মেরে বসে রইল। ইশান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে,’জবাবের জন্য অপেক্ষা করছি।’
মীরা মুখটা গোমড়া করে বলল,’প্রেগনেন্সির শুরু থেকে না গেলে হয় না?? বাড়িতে তো মনি’মা আছে সার্ভেন্টরা আছে। আর কি চাই??’
‘আমার শুধু তোকে চাই মীরা।’
‘প্লিজ একটু ভেবে দেখো ইশান।’

‘আচ্ছা দেখবো। কিন্তু পরে,আজকে তো আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আজকে আনন্দ করি পরে ভাবা যাবে। হ্যাপি??’
মীরা মাথা নাড়িয়ে বলল,’হুম হ্যাপি।’
রাত্রি বারোটা বাজে। ইশান আর মীরা বাড়িতে ফিরলো। মীরা খুব খুশি। ইশানকে সে কিছু টা হলেও মানিয়ে নিয়েছে বেবি নেওয়ার ব্যাপারে।
রুমে ঢুকেই মীরা অবাক হয়ে গেল। কিন্তু ইশানের কোন ভাবান্তর নেই। মুহিত বিছানার উপর বসে ইশান আর মীরার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা মুহিতকে দেখে চমকালো। সে মুহিতকে এসময় আশা করেনি। তবুও অনেক অবাক হয়েছে। মীরাকে দেখেই মুহিত উঠে দাঁড়ালো। মীরার সামনে এসে বলল,’কখন থেকে তোমাদের অপেক্ষা করছি। কোথায় গিয়েছিলে?? ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেব সেখানে আমি নিজেই সারপ্রাইজড।’

মীরা ভ্রু কুঁচকে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত হাত নাড়িয়ে বলল,’কি হলো সিনিয়র বউ??’
মীরা ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’কে ও??আর আমাদের রুমে কি করছে??’
মুহিত চোখ বড়বড় করে তাকালো।একি কাণ্ড মীরা ভুলে গেছে মুহিতকে?? মুহিত কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’এটা কি বলছো??আমি মুহিত চিনতে পারছো না??’

মুহিতের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো ইশান। মীরা যে মুহিতের সাথে মজা করছে সেটা মুহিত বুঝতে পারছে না। ইশান বলল,’তুই এখন রুমে যা। মীরা এখন তোকে ভুলে গেছে কালকে মনে পড়ে যাবে।’
মুহিত মীরার দিকে একটু তাকিয়ে বলল,’সত্যি তো!!এত দূর থেকে এলাম আর মীরা আপু আমাকে ভুলে গেল!! ভেবেছিলাম আমার নতুন গার্লফ্রেন্ড এর কথা বলব!! কিন্তু মীরা আপু তো আমাকে চিনতেই পারছে না।ধ্যাত।’

মুহিত রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। মুহিত যেতেই ইশান মীরা শব্দ করে হেসে উঠলো। ইশান বলল,’দিলি বেচারার মুড নষ্ট করে। সারপ্রাইজ দিবে বলে তোকে না জানিয়ে এসেছে। অবশ্য আমি জানতাম।’
মীরা বলল,’আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এখন যদি ওকে কিছু বলতাম তাহলে বকবক করে আমার মাথা খেয়ে ফেলতো। আমি ক্লান্ত খুব। কালকে ওর সাথে কথা হবে।’
মীরা ফ্রেশ হতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মীরা বের হতেই ইশান ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লো।

সকাল হতেই মীরা ঘুম থেকে উঠে বসলো। চোখ ডলতে ডলতে আশেপাশে তাকালো। পাশেই ইশান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা ইশানের দিকে তাকাতেই সে বলল,’গুড মর্নিং।’
মীরা বলল,’বসে আছো কেন??অফিস নেই??’
ইশান বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে,’ভাবলাম আজকের সকালটা সবার সাথে কাটাই। প্রতিদিন তো সময় দিতে পারি না।’
মীরা উঠে পড়লো। কিন্তু তবুও ইশান সকালটা সবার সাথে কাটাতে পারলো না। পিহু মৌশি বাড়িতে নেই। সকাল সকাল বের হয়েছে তারা। মুহিত সোফায় বসে আছে। মীরা কে আসতে দেখে সে নড়েচড়ে বসল। মীরা কি এবার মুহিতকে চিনতে পারবে??মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না। মীরা এসে মুহিতের পাশে বসে বলল,’কি রে গার্লফ্রেন্ড কয়টা হয়েছে তোর??’

মুহিত খুশিতে চিৎকার করে উঠল। মীরার সব মনে পড়ে গেছে। মুহিত উৎফুল্ল হয়ে বলল,’থ্যাঙ্কস গড, তোমার সব মনে পড়ে গেছে। কাল খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এখন ভালো লাগছে।’
‘হুম, কিন্তু তুই হঠাৎ এলি এখানে??আঙ্কেল আন্টি আসতে দিলো??আর পড়াশোনা??’
‘রিলাক্স,সব বলছি। এখানে আসতে ইশান ভাইয়া হেল্প করেছে। মা বাবাকে ইশান ভাইয়াই বলেছে নাহলে আমাকে আসতে দিতো। পড়াশোনার দোহাই দিয়ে বসিয়ে রাখতো। তবে এসে যখন পরেছি দুই তিন মাস থেকেই যাব। লন্ডন থেকে কারি কারি গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে তবেই যাব।’
মীরা মুহিতের বাহুতে থাপ্পর দিয়ে বলল, ‘ফাজিল!!তো গার্লফ্রেন্ড কাকে বানাবি। এখানকার সব মেয়েরা জিনিয়ার মতো।’

‘জিনিয়া মানে হাফ লেডিস!! তোমার মতো মেয়ে নেই??’
‘আছে তবে চিরুনি অভিযান চালিয়ে তাদের বের করতে হবে।’
‘আমি তাই করব। মুহিত কো আটকানা নামুমকিন হ্যায়।’
মীরা হাসলো তারপর মুহিতকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলো।

হুইলচেয়ার ঠেলে সামনের দিকে এগোচ্ছে পিহু। পাশেই মৌশি বল নিয়ে লাথি দিতে দিতে এগোচ্ছে। পিহু তা দেখে মুচকি হেসে বলল,’সাবধানে মৌশি। পড়ে যেও না যেন??’
পিহুর কথা শুনে ইফাজ বলল,’আহ একটু আধটু না পড়ে গেলে মৌশি ফুটবলার হবে কিভাবে??ফুটবলার হতে হলে তো আঘাত পেতেই হবে।’
পিহু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তুমি চুপ করো।এই তুমি দিন দিন মৌশির মাথা খাচ্ছো।’
পিহুর কথা শুনে মৌশি খিলখিল করে হেসে উঠলো। বল তুলে হাতে নিয়ে বলল,’গ্র্যানি মাথা তো খাওয়া যায় না। মাথাটা যে খুব শক্ত।’

বলেই সে আবার হাসতে লাগলো। পিহু কিছু বলল না। এতক্ষণ ওরা তিনজন সূর্যদ্বয় দেখছিল। আর এখন আশেপাশে হাঁটছে। আজ প্রায় একমাস হলো ইফাজকে বাড়িতে আনা হয়েছে। বাড়িতে আসার পর থেকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে আছে সে। ইফাজের সব দেখাশোনা পিহু করে। কাউকে সে কোন কাজ করতে দেয় না।

সেদিন হসপিটালে অনেকটা সময় ইফাজের সামনে বসে কেঁদেছিল পিহু। ইফাজ শান্তনা দিয়েছিল কিন্তু পিহু শুধু কেঁদে ছিল। এতো দিন পর ইফাজকে সুস্থ দেখে সুখের কান্না করেছিল পিহু।
বাড়িতে আসার একসপ্তাহ পর ইফাজ নিজেই পিহুর কাছে বায়না ধরে চাঁদ দেখার। ছাদে যেতে পারেনি ইফাজ সেদিন তবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঠিকই চাঁদ দেখেছিল দুজন। মধ্যরাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে গল্প করেছিল দুজন। ইফাজ সেদিন বলেছিল,’আজকের পর থেকে আর কোন বর্ষা শীত বসন্ত আমরা আলাদা কাটাব না পিহু। হয়তো অনেক কম সময় এই পৃথিবীতে আছি আমরা। তাতে কি যতটুকু পারি ঠিক ততটুকু সময় একসাথে কাটিয়ে দেব।’

পিহু সেদিন চুপ করে ছিল। কিছুই বলেনি। তবে ইফাজের সাথেও সে একমত।
পিহু বলে উঠলো,’তোমার মা ফোন করেছিল। তোমার সাথে কথা বলতে চায়। আর বাবা ও।’
পিহুর কথা শুনে ইফাজ চুপ করে গেলো। পিহু আবার বলল,’আর রাগ করে থেকো না। ওনাদের বয়স হয়েছে। জীবনের শেষ সময় তো সবাই সুখি হতে চায়। আর কতোদিন বাংলাদেশে থাকবেন ওনারা?? এবার এখানে আনার ব্যবস্থা করো।’

ইফাজ বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’ভেবে দেখবো। কবে ওনাদের এখানে আনা যায়।
পিহু আর কিছু বলল না ইফাজ যে রাজি হয়েছে এটাই অনেক।
মৌশি ফুটবল হাতে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। সামনেই কতগুলো বাচ্চারা খেলছে মৌশি দৌড়ে সেদিকে গেল। বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখে ইফাজ বলে উঠলো,’একটা বাচ্চার সুখ আমার ইশান আর মীরা পাচ্ছে না পিহু।’

পিহু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’হুম তবে কিছু করার ও নেই। আমার কাছে মীরার সুস্থতা আগে।’
‘আমার কাছেও। ইশান মীরাকে নিয়ে সবসময় চিন্তা করে। দিন শেষে যখন আমার কাছে এসে বসে তখন ওর মলিন মুখটা দেখে আমার খারাপ লাগে। ইশানকে যেদিন জন্ম নেয় সেদিন আমি ওকে প্রথম কোলে তুলে নিয়েছিলাম। আমি বাচ্চা কোলে নিতে পারি না। বাবা হওয়ার আনন্দে তা ভুলে ইশানকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। তাই ইশান আর মীরার জন্য খারাপ লাগছে।’

পিহু আর কিছু বলল না। মৌশিকে ডেকে পিহু বাড়ির দিকে রওনা হলো।
মীরা তাড়াতাড়ি রেডি হচ্ছে। ইশান বাইরে গাড়ি নিয়ে ওয়েট করতেছে। কোথায় যেন সে মীরাকে নিয়ে যাবে তাই। এমনিতেই মীরা বাড়ির বাইরে যায় না ইশানের কড়া নির্দেশ। বের হলে ইশানের সাথেই বের হয়। সিড়ি দিয়ে নেমে সামনে এগোতেই ধাক্কা লাগল মুহিতের সাথে। মীরা ঘুরে তাকিয়ে বলল,’লন্ডন ঘুরে কি মাথা গেছে তোর??চোখ কোথায় থাকে??”
মুহিত মীরার দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘নাহ,তবে এবার ঘুরবে তোমার মাথা।’
‘কেন কেন??’

‘আমার একটা গার্লফ্রেন্ড হয়েছে।’
মীরা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলে,’ওহ তাই ভালো। কে সে??আর একা একা লন্ডন ঘুরে বেড়াস কিভাবে??’
‘ইশান ভাইয়ার ওই হাফ লেডিস বন্ধুটা আছে না তার সাথে। ভালো লাগলো তাকে।’
‘তাহলে ওর সাথেই বিয়ে করিয়ে দেই??’
‘এই না না। আমি আর সিনিয়রদের দিকে এখন আর নজর দেই না। তাই তো কিন্ডার গার্ডেনের মেয়ের সাথে রিলেশন শুরু করেছি।’
‘বাদর ছেলে তোর হচ্ছে। আমি বাইরে যাচ্ছি। এসে তোকে দেব। ফাজলামো করা হচ্ছে। তোকে কালই বাংলাদেশ পাঠাব।’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ২১

বলতে বলতে মীরা বের হয়ে এসেছে। ইশান গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল। মীরা গাড়িতে বসে সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলল,’কোথায় যাচ্ছি আমরা??’
ইশান বলল,’কিছুদিন আগে আপনি একটা জিনিস চেয়েছিলেন আমার কাছে। তার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।’
মীরা ইশানের কথার মানে বুঝলো না। বলল,’আমি আবার কি চাইলাম??’
‘বাহ ভুলে গেলি?? সেদিন তো কাঁদতে কাঁদতেই শেষ হয়ে যাচ্ছিলি। থাক মনে যখন নেই তখন কি আর করার??’

মীরার চোখ তখনই খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সে ইশানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’আমার মনে পড়েছে। আমি যাব। আর সত্যি তুমি আমাকে,,,,,’
‘হ্যা সত্যি। আম্মুর সাথে কথা হয়েছে। সেও তোমার সাথে একদত পোষন করেছে। তবে ডক্টরের কথা শুনতে হবে। এটা আম্মুর হুকুম।’
মীরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,’সব হুকুম মানব।’
বলেই যে গোটা দশেক চুমু খেল ইশানের গালে। মীরাকে এতো খুশি দেখে ইশানও খুশি হলো। সে বলল,’হয়েছে!! আমার গালের ছাল তুলে ফেলবি দেখছি। আগে দেখি ডক্টর কি বলে?? তোকে আগে চেকআপ করবে।’
‘নো প্রবলেম। চলো তাড়াতাড়ি।’

মীরার উৎফুল্লতা দেখে ইশান হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ওরা নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছে। জীবনটা আবার নতুন করে সাজাবে। বহু কষ্টের পর একটুখানি সুখ এসে ধরা দিয়েছে ওদের কাছে আর এইটুকু সুখ দিয়েই ওঁরা বাকি জীবন কাটাতে চায়। এইটুকু সুখ নিয়েই নতুন পথে পাড়ি জমালো ওরা।

(সমাপ্ত)

সব গল্পের শেষটা পূর্ণতা পায় না। তবুও অনেকে পূর্ণতা চেয়ে দ্বিতীয় খণ্ড আনতে বলেছিল। কিন্তু দুই এক পর্বের জন্য তো দ্বিতীয় খণ্ড আনা যায় না। তাই ফিরে দেখালাম। জানি এতেও অনেকে অপূর্ণতা খুঁজে পাবে। তবে আমার কিছু করার নেই। শেষ টা ভালো হবে না এটা আমি নিজেই বলেছি। কারণ শেষটা আমার নিজেরই মনে ধরেনি।
যাই হোক এখন নতুন গল্প নিয়ে ভাবছি। কাল অথবা পরশু নতুন গল্প দিব।
ধন্যবাদ সবাইকে