প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১৬ || bangla love story

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১৬
সুমাইয়া জাহান

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।এ আমি কাকে দেখছি?যেকিনা আমার সাথে কখনো উচ্চ সরে কথাও বলেনি সেই মানুষ আজ আমাকে সোজাসুজি চড় মেরে দিলো।হ্যাঁ সেইদিন বিয়ের আসরেও ভাইয়ু আমার সাথে রেগে কথা বলেছিলো কিন্তু সেটাতো নাটক করে বলেছিলো।কিন্তু আজ যা করলো তাতো নাটক নয়! চোখ জোড়া বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে ভাইয়ু।ভাইয়ু এই রুপের সাথে আমি পূর্বপরিচিত নই।একদৃষ্টিতে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি।নীরও বেশ অবাক হয়েছে সেও ভাইয়ুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ওরও ধারনা ছিলো না ভাইয়ু এমন কিছু করতে পারে!তাই বিস্ময় নিয়ে বললো,

—- তূর্য ভাইয়া এটা কি করলে তুমি?
ভাইয়ু এবার ফট করে চোখ খুলে রক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
—- যা করেছি তা একদমই ঠিক করেছি।ও এর থেকেও বেশি কিছু ডিজার্ভ করে।আমার উচিৎ ছিলো আরো কয়েকটা চড় মারা!কিন্তু আফসোস তা আমি করতে পারলাম না!
—- ভাইয়ু!
আমি ছলছল চোখে ভাইয়ুর দিকে তাকিয়ে বললাম।
ভাইয়ুর কথা গুলো শুনে টপটপ করে গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।ভাইয়ু অন্য দিকে ফিরে বললো,
—- খবরদার তূবা আমাকে ভাইয়ু বলে ডাকবি না।এই ডাক টা শুধু আমার পরীর।তুই তো আর আমার পরী না।আমার পরী হলে তুই কখনো এমন করতে পারতি না।আমি আমার পরীকে সেই শিক্ষা দেইনি।
—- ভাইয়ু তুমি কিচ্ছু জানো না! তুমি একবার শোনো তারপর বলবে আমি ঠিক করেছি কি-না!
—- আমাকে তুই কি জানাবি!সেই ছেলেটার ব্যাপারে যে কিনা নিঃস্বার্থ ভাবে তোকে ভালোবেসে গেছে তার ব্যাপারে?তার পরিবারের ব্যাপারে?কতোটুকু জানিস ওর ব্যাপারে?তুই নিজে জানিস ও কে?ওর পরিবার কারা?
—- ভাইয়া তুমি কিন্তু আমাকে প্রমিজ করেছো তূূবাকে তুমি কখনো এসব বলবে না!তুমি কিন্তু প্রমিজ ভাঙ্গতে পরো না!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

ভাইয়ুর কথার মাঝেই নীর এসে বললো কথাটা।ভাইয়ু রাগী চোখে নীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- এতোদিন তুই আমাকে এই প্রমিজের দোহাই দিয়ে কিচ্ছু বলতে দেস নি কিন্তু আজ আর আমি তোর কোনো কথাই শুনবো না।আমার সামনে থেকে সরে যা নীর!আমি কিন্তু একটা কথা দ্বিতীয় বলতে পছন্দ করি না তুই খুব ভালো করেই জানিস।
ভাইয়ুর রাগী চোখে কথা গুলো বলাতে নীর একরকম বাধ্য হয়ে সামনে থেকে সরে গিয়ে খাটে গিয়ে বসলো।ভাইয়ু আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বলতে লাগলো,
—- তুই যাকে মামী বলে ডাকিস মানে নীলিমা চৌধুরীর আসল পরিচয় তুই জানিস!কে সে?কি তার পরিচয়? কে হন তিনি আমাদের?
আমি মাথা ডানে বামে নারালাম যার অর্থ আমি জানি না।আমি এখন এতোটাই শকড এর মধ্যে আছি যে কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলছি।শুধু আমার সাথে ঘটেছে তা নিরব দর্শেকের মতো দেখে যাচ্ছি। ভাইয়ুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি তার পরিবর্তী কথা গুলো শোনার জন্য। ভাইয়ু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
—- এখন সময় এসে গেছে তোকে সবটা বলার।সবটা শোনার!আর সব কিছু জানতে হলে যেতে হবে আমাদের সবার সেই পুরোনো অতীতে!
অতীত……….

—- কি করছিস আশরাফ? আমি কিন্তু হাতের কাছে পেলেই পিটিয়ে ভর্তা করে খাবো!তখন বুঝবি কতো ধানে কতো চাল!
কিন্তু আশরাফ তো থামার পাত্র নয়।ও তো শার্ট হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছেই দৌড়াচ্ছে।আর বেচারা আরমান তো নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য আশরাফের পিছনে ছুটছে।আর বারবার শার্ট টা পাওয়ার জন্য নানা রকম ভাবে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু কোনো হুমকি কাজ হচ্ছে না। কোনোভাবেই শার্ট টা নিতে পারছে না।এদিকে ভার্সিটির সব ছেলেমেয়েরাই আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।বেচারার এখন ইচ্ছে করছে একদম মাটির সাথে মিশে যেতে।

আসলে একটু আগে আশরাফের লেখা একটা কবিতা শোনাচ্ছিলো আরমান কে।আশরাফ মাঝে মাঝেই কবিতা লেখে।তবে কবিতাগুলো আদো কোনো কবিতার মধ্যে পরে কিনা বলা যাবে না।একদম আলতু ফালতু। কিন্তু আশরাফ মনে করে ওর কবিতা পৃথিবীর সবথেকে ভালো কবিতা গুলোর মধ্যে একটা।এমন কি নিজেকে সে একজন বড়ো মাপের কবিও মনে করে।প্রায় প্রতিদিনই একটা দুই টা কবিতা লেখবেই লেখবে।আর সবগুলোই আরমান কে জোর করে শোনাবে।সবাইকেই ওর কবিতা গুলো শোনাতে চায় কিন্তু ওর কবিতা শোনার ভয়ে কেউ ওর কাছে আসে না।ওকে দেখলেই পালিয়ে যায়।আরমান যেহেতু আশরাফের প্রানের বন্ধ তাই বাকি সবার মতো পালিয়ে যেতে পারে না।ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হয় ওর বিখ্যাত কবিতা গুলো।তেমনি আজও ওর একটা কবিতা শোনাচ্ছিলো,

“আম গাছে জাম
জাম গাছে আম
কাঁঠাল পাতায় লেখা আছে
বন্ধু তোর আর আমার নাম”
আজ কেনো জানি আরমানের কাছে আশরাফের কবিতাটা বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে। তাই আশরাফ এইটুকু কবিতা বলার পরই ওর হাত থেকে ওর কবিতা লেখা কাগজ টা ছিড়ে ফেললো।আর এতেই আশরাফ রেগে বোম হয়ে গেলো।যেন রাগে নাক কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে ওর এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।আরমান ভেবেছিলো আশরাফ হয়তো এখন ওকে আচ্ছা মতো পিটুনি দেবে তাই নিজেকে প্রস্তুত করছিলো দৌড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমানিত করে কিছুক্ষন ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

—- সমস্যা নেই তুই তো ছিঁড়েছিস।পরে না-হয় আবার লিখে নিবো।দোস্ত আজকে না আমার ইচ্ছে করছে তোর শার্ট টা পরার!আজ তুই আমার টা পর৷ আমি তোর টা পরবো।প্লীজ না করিস না!
খুব আবদারী গলায় বললো আশরাফ। বন্ধুর এমন আবদারে আর না করতে পারলো না। তাই ছোট্ট করে “ওকে” শার্ট টা খুলে আশরাফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—- নে! এবার তোর টা খুলে আমাকে দে………
আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না আরমান তার আগেই আশরাফ শার্ট টা নিয়ে এক ভো দৌড় দিলো।আরমান তো বেকুব বনে গেলো।আর আশরাফ দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো,
—– আমার এতো ভালো কবিতাটা ছিঁড়ার জন্য আজ তুই খালি গায়েই ভার্সিটিতে থাকবি।
বাঁকা হেসে কথাগুলো বলেই আবার দৌড়াতে লাগলো।আরমানও ওর পিছনে দৌড়াতে লাগলো।তখন থেকে এভাবেই দৌড়াচ্ছে।খুব হাঁপিয়ে গিয়ে হাঁটু হাত রেখে থেকে দম নিতে নিতে আরমান বললো,
—- ভাই আশরাফ এবার শার্ট দিয়ে দে প্লীজ! পুরো ভার্সিটির সবাই আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে একবার দেখ! আমার মানসম্মান সব ধুলোই মিশে যাচ্ছে।
আশরাফ একটু থেকে চোখ টিপ মেরে বললো,
—- তোর মানসম্মান ধুলোই মিশানোর জন্যইতো শার্ট নিলাম।
—- তবে রে!

আরমান আবারও আশরাফ কে ধাওয়া করতে লাগলো।কিন্তু এবার বেঁধে গেলো এক বিপত্তি! আরমান দৌড়াতে গিয়ে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো।ধাক্কা লেগে আরমান উপুর হয়ে কাঁদার মধ্যে পরে গেলো।মুখটা একদম কাঁদা মধ্যে পরে গেলো।খুব কষ্টে একটু বসতে পেরেছে।সামনের মানুষ টাকে না দেখেই বলতে লাগলো,
—- চোখ কি সপ্তম আকাশে রেখে আসেন নাকিনা!দেখতে পেলেন না আমি দৌড়াচ্ছি!আ…….
সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই আর কিছু বলতে পারলো না আরমান।একটা নীল থ্রি-পিস পরা মেয়ে ঠোঁট কামড়ে আছে।যাকে দেখে এতোটাই আঁটকে গেছে তার মায়াবি মুখের দিকে যে জ্ঞান শূন্য হয়ে মুখে একহাত রেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ওই দিকে মেয়েটা আরমানের দিকে ভালো ভাবে তাকাতেই ফিক করে হেসে ফেললো।হেঁসেই চলেছে মেয়েটা।মেয়েটার হাসি যেন আরো বেশি করে টানছে আরমান কে।তাই একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আশরাফ হঠাৎ খেয়াল করলো আরমান আর ওর পিছনে দৌড়াচ্ছে না।তাই ও দাড়িয়ে আরমান কে খুজতে লাগলো।একটু খুঁজতেই দেখতে পেলো আরমান কাঁদার মধ্যে পরে আছে।তাই আর কিছু না ভেবে আরমানের কাছে গেলো৷ কিন্তু আরমানের সামনে গিয়ে ও নিজেই হু হা করে হাসতে লাগলো।আরমান এতোক্ষণ এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করলেও এবার আশরাফ কে হাসতে দেখে কপালে ভাজ ফেলে আশরাফ জিজ্ঞেস করলো,

—- এভাবে হাসছিস কেন?
—- পরে বলবো আগে একটু মন খুলে হেসে নেই।অনেক দিন পর এমন হাসির সুযোগ পেয়েছি।
পেট ধরে হাসতে হাসতেই বললো আশরাফ। এবার রেগে গেলো আরমান।একে তো এই কাঁদার মধ্যে পরে উঠতে পারছে না।তারউপর আবার আশরাফ এসে না উঠিয়ে হেঁসেই চলেছে।তাই রেগে বললো,
—- আমাকে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে!
—- তার থেকেও বেশি কিছু।দাঁড়া দেখাচ্ছি!
কথাটা বলেই আশরাফ আসেপাশে তাকালো।পাশেই একটা মেয়েকে দেখতে পেলো।মেয়েটাও আরমান কে দেখে হাসছে।আশরাফ একটু হেসে মেয়েটার উদ্দেশ্য বললো,
—- আপু আপনার কাছে কোনো আয়না হবে?ওকে একটু দেখাতাম আমরা কেন হাসছি।
—- হ্যাঁ ভাইয়া আছে।
মেয়েটাও হাসতে হাসতে বললো।তারপর মেয়েটা একটা ছোট্ট আয়না বের করে আশরাফের দিকে বাড়িয়ে দিলো।আশরাফও মেয়েটার থেকে আয়না টা নিয়ে আরমানের সামনে ধরলো।আরমান আয়নার দিকে তাকাতেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললো।কারণ কাঁদার মধ্যে পরে যাওয়াতে ওর মুখ টা একদম কাঁদা লেগে একাকার হয়ে গেছে।এর জন্যই ওরা দুইজন এইভাবে হাসছে।এমনিতে সমস্যা ছিলো না কিন্তু মেয়েটার সামনে এভাবে থাকতে খুব লজ্জা লাগছে আরমানের।তাই ইশারায় আশরাফ কে বললো ওকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে।কিন্তু আশরাফ হেল্প না করে উল্টো হেসেই যাচ্ছে।এতে আরমান রেগে লাল হয়ে যায়।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১৫

বাড়ি যাওয়ার পথে আরমান আশরাফের সাথে একটা কথাও বলেনা।আশরাফ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেই যাচ্ছে কথা বলার কিন্তু আরমান বলছে না।আশরাফ ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,
—- আর রাগ করে থাকিস না প্লীজ। আমি তো তোকে পরে উঠাছি বল!তখন তোকে ওইরকম দেখে না হেসে থাকতে পারলাম না তাই একটু হাসছি।প্লীজ এবারের মতো ক্ষমা করে দে।তুই যা বলবি আমি তাই করবো শুধু একবার ক্ষমা কর ভাই।
আরমান এবার কি একটা ভেবেই বাঁকা হাসি দিলো।তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- যা বলবো তা করবি?

—- হুম যা বলবি তাই! কিন্তু তুই শুধু কথা বলা বন্ধ করিস না প্লীজ!
—- তাহলে তখনকার সেই মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে করার নোর দায়িত্ব তোকে দিলাম।
আরমানের কথা শুনে আশরাফের চোখ গুলো বেরিয়ে আসার উপক্রম।চরম অবাক হয়ে বললো,
—- চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়েকে একবার দেখাতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি।আবার সেই দায়িত্ব আমাকে দিচ্ছিস!এমন ভাবে বলছিস যেন মেয়েটা আমার বোন হয় যে আমি তার ভাই হয়ে তোর হাতে তুলে দেবো।ইয়ার্কি পেয়েছিস!
—- সে আমি জানি না!আমি শুধু জানি তুই আমাকে যে করেই হোক মেয়েটার সাথে বিয়ে দিবি।আর না পারলে আমার সাথে আর কখনো কথা বলতে পারবি না।অপশন দুইটা। এখন ভেবে দেখ এখন কোনটা নিবি!

—- তুমি বাপু আমায় ইমোশনালি ব্লাকমেইল করে বিয়ে করার ধান্দা করছো!
আশরাফের কথায় পাত্তা না দিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে ভো করে চলে গেলো আরমান।ও খুব ভালো ভাবেই জানে এই বিষয়ে কিছু করতে পারলে একমাত্র আশরাফই করতে পারবে তাই ওকে এইভাবে ব্লাকমেইল করলো।আসলে আরমান বাবাকে অনেক ভয় পায় যার দরুন বাবার সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে পারবে না।তাই এই টেকনিক টা ইউজ করলো।ও জানে এতে একশো পার্সেন্ট কাজ হবেই হবে।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১৭