প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২
সুমাইয়া জাহান

পুরো ঘর জুড়ে পিন পিন নিরবতা বিরাজ করছে।কারো মুখে কোনো কথা নেই।শুধু আমিই মামনীর কাঁধে মাথা রেখে ন্যাকা কান্না কেঁদে যাচ্ছি।মামনী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গরম চোখে বার বার নীরের দিকে তাকাচ্ছে।মামনি হচ্ছে নীরের মা আমি উনাকে মামনী বলে ডাকি।উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।বলতে গেলে নীরের থেকে মামনী আমাকে বেশি ভালোবাসে।আমিও মামনীকে খুব ভালোবাসি।আমার সব আবদার আমার ভাইয়ু আর মামনী এই দুজন মানুষের কাছেই করি।এক কথায় মামনী আমার মা।হয়তো আমার নিজের মা বেঁচে থাকলে যা করতেন তার থেকেও বেশি কিছু করে মামনী আমার জন্য।
একটু আগে এ বাড়ি মানে নীরের বাড়িতে এসেছি।মামনী তো আমাকে প্রথমে দেখে অবাক।অবাক হওয়ারই কথা আজ আমার বিয়ে ছিলো তা তো মামনী জানতো।ইভেন মামনীরও আমার বিয়েতে থাকার কথা ছিলো।মামনীর শরীরটা একদম ভালো ছিলো না তাই যেতে পারেনি। অবাক চোখেই মামনী জিজ্ঞেস করলো,

—- তূবা তুই এখানে?আজ না তোর বিয়ে?
আমি মামনী কে জড়িয়ে ধরে তখনকার সব ঘটনা বলি।মামনী তো সব শুনে নীরকে অনেক বকাঝকা করছে।তখন থেকেই মামনীর কাঁধে মাথা রেখে ন্যাকা কান্না করে যাচ্ছি। আর মামনী আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর নীরের দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে। আমার তো এই দৃশ্য টা দারুন লাগছে।তবে নীরের এতে কিছুই হচ্ছে না ও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।কিছুক্ষণ এভাবেই থাকার পর নীরবতার চাদর ভেঙ্গে নীর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,
—- মা তুমি থাকো তোমার এই ন্যাকা মেয়েকে নিয়ে। আমি যাচ্ছি আমার রুমে।তোমাদের কান্নাকাটির পর্ব শেষ হলে আমার জন্য কিছু খাবার দিও আমার খুব খিদে পেয়েছে।
কথাটা বলেই বসা থেকে উঠে একটু এগিয়েই কি মনে করে আবার ফিরে এলো।এসেই আমার দিকে কয়েকবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মামনী কে উদ্দেশ্য করে আবার বললো,
—- তোমার এই ছিঁচকাঁদুনে ন্যাকা মেয়েকেও কিছু খেতে দিও।বেচারি কে বিয়ের জন্য মনে হয় কিছু খেতেও দেয়নি।দেখে তো মনে হচ্ছে তিন চার দিন না খাওয়া কেমন মুখ টা শুকিয়ে গেছে।আহারে চিন্তা করিস না আমরা খুব ভালো মানুষ তোকে না খাইয়ে রাখবো না।পেট ভরে খেতে দিবো।
শেষের কথা গুলো ইনোসেন্ট মুখ করে আমাকে বললো।ওর কথা শুনে রেগে গিয়ে সোফার কয়েকটা কুশন ওর দিকে ছুঁড়ে মারলাম।এতে ব্যাথা না পেয়েও ব্যাথা পাওয়ার ভান করে আহ আহ শব্দ করতে করতে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- এই জন্য বলে লোকের ভালো করতে নেই।খেতে দিতে চাইলে মারতে আসে?কি দিনকাল পরলো!
এগুলো বলতে বলতেই সিড়ি বয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।মামনী ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আমার দিকে ফিরে বললো,
—- ওর কথা একদম গাঁয়ে মাখবি না।তুই আমার মেয়ে আর এ বাড়িটা তোরই তাই এখানে তুই যা খুশি তাই করবি।তবে ও এটা কিন্তু ঠিকই বলেছে সত্যি তোর মুখ টা অনেক টা শুকিয়ে গেছে।হয়তো বিয়ের কারণে সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।
আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম।যার অর্থ সত্যিই বিয়ের ঝামেলার কারণে কিছু খাওয়া হয়নি।মামনী আমার উত্তরে একটু মুচকি হেসে আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—- তুই এখানে দু’মিনিট বস আমি এখুনি আসছি।

তারপর মামনী চলে গেলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসলো একটা প্লেট হাতে নিয়ে। এসেই আমার পাশে এসে বসে খাবার মেখে হাতে খাবার নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরলো।আমিও হাসি মুখে খাবার খেয়ে নিলাম।আমার যখনই মন খারাপ থাকে তখনই মামনী আমাকে নিজের হাতে এইভাবে খাইয়ে দেয়।মামনীর হাতে খেয়ে নিমিষেই আমার সব মন খারাপ ভালো হয়ে যায়।আজও তেমনই এতো মন খারাপের ভিতরে মামনীর হাতে খেয়ে মন খারাপ অনেক দূরে চলে গেছে।তবে আমার মন খারাপ এই জন্য না যে আমার বিয়েটা ভেঙ্গেছে! আমি তো ভিষন খুশি বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য। আমি নিজেই বিয়েটা করতে চাইনি।যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছিলো ওই লোকটাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি।দেখতে সুন্দর হলেও সবসময় মুখ টা একদম গম্ভীর থাকে।আর কারো সাথে সহজে কথাও বলে না।আমার আবার এমন মানুষজন একদম পছন্দ না।আমি তো সবসময় হাসি খুশি থাকতে পছন্দ করি।তাই বিয়ে ভাঙ্গার কারনে আমি ভিষণ খুশি। আমার মন খারাপ তো এই কারনে যে বাবা আর ভাইয়ু আমার উপর এতোটা রেগে আছে। যে ভাইয়ু আমার সাথে কোনোদিন একটু জোরেও কথা বলেনি সেই ভাইয়ু আজ আমাকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেছে।কতোটা কষ্টই না পেয়েছে ভাইয়ু। ভেবেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো।আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পরই আমি মামনী আমার থাকার জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা করতে বললাম।আসলে এ বাড়িতে আগে অনেক বার আসলেও কখনো রাতে থাকা হয়নি। আর যতক্ষন থাকতাম মামনীর সাথে হাসিঠাট্টা করেই চলে যেতাম। তাই কখনো কোনো রুমের প্রয়োজন হয়নি।কিন্তু এখন তো এখানে বেশ কিছুদিন থাকতেই হবে।বাড়ির পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত তো আর বাড়িতে ঢুকতে পারবো না!

মামনী আমার জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা করলো।রুমটা নীরের রুমের পাশেই।আমি আর কিছু না ভেবেই রুমে গিয়ে ফ্রেস গেলাম।আমার গায়ে এখনো বিয়ের ভারি লেহেঙ্গা আর জুয়েলারিতে ভরপুর।নিজের দিকে তাকাতেই মনে পরলো আমি তো এখানে কোনো জামা কাপড় নিয়ে আসিনি। তাহলে এখন কি পরবো?এই ভারি লেহেঙ্গা পরেই কি থাকতে হবে আমাকে সারাদিন?না না না আমি কিছুতেই পারবো না।তাড়াতাড়ি ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম।বেরিয়েও কোনো লাভ হয়নি এতোক্ষণে মামনী চলে গেছে।এখন আমার কি হবে?মনমরা হয়ে মুখে দুই হাত দিয়ে খাটের উপর বসে পরলাম।তখনই কেউ একজন আমার সামনে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ ধরলো।ওইদিকে ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলাম নীর শপিং ব্যাগ গুলো আমার সামনে ধরে আছে।ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম,

—- দেখ নীর আমি এখন তোর সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই। বাড়ি থেকে আসার সময় একটাও জামা কাপড় নিয়ে আসিনি।এই ভারি লেহেঙ্গা পরে আমার থাকতে ভিষণ ক্লান্ত হয়ে গেছি।তাই প্লিজ তুই পরে আয় তখন ঝগড়া করবো।এখন আমার একদম ভালো লাগছে না।প্লিজ যা এখান থেকে।
—- ঠিক বলছিস তো আমি চলে যাবো?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—- এতে ভাবার কি আছে?
—- ওকে আমি চলেই যাচ্ছি।আর ডাকলে কিন্তু আসবো না।আর এই জামা কাপড় গুলোও পাবি না হুম!
কথাটা বলেই নীর বেরিয়ে যাচ্ছিলো।ও কিসের জামাকাপড়ের কথা বলছে ?আমি ভ্রু কুঁচকে পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
—- কিসের জামাকাপড়ের কথা বলছিস?
আমার দিকে একটু ঘুরে বললো,
—- তোর জামাকাপড়ের কথাই বলছি।
আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললাম,
—- ভাইয়ু তোর কাছে আমার জন্য জামাকাপড় পাঠিয়েছে?তারমানে ভাইয়ু এখন আর আমার উপর রেগে নেই?
—- আগগে না আপনার ভাইয়ু আপনার উপর রেগে আছে না রেগে নেই তা আমি জানি না।আর এগুলো তূর্য ভাইয়া পাঠায়নি এগুলো আমি কিনেছি আপনার জন্য।
মন টা আবার খারাপ হয়ে গেলো।তাহলে ভাইয়ু পাঠানি!কিছু একটা ভেবেই চোখ ছোটো ছোটো করে নীরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—- তুই কখন শপিংয়ে গেলি? তুই তো আমার সাথেই সারাক্ষণ ছিলি।কোথাও নামতে একবারও দেখলাম না।দুই মিনিট আমি রুমে আসতেই শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে হাতে নিয়ে হাজির হয়ে গেলি কি কর?
আমার কথায় নীর অনেক টা থতমত খেয়ে গেলো।আমতা আমতা করে বললো,
—- এগুলো কি আমি আজ কিনেছি নাকি?আমি জানতাম তোর এগুলো লাগবে তাই আগেই কিনে রেখেছিলাম।আমায় কোথায় ধন্যবাদ দিবি তা না একের পর এক জেরা করে যাচ্ছিস!এটা কিন্তু ঠিক না!
আমি কোমরে দুই হাত দিয়ে অগ্নি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী গলায় বললাম,
—- তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করার প্লান তোর আরো আগে থেকেই ছিলো!দাঁড়া তোর একদিন কি আমার যতোদিন লাগে লাগুক তোকে তো আজ আমি ছাড়বো না।
আমি ওর দিকে এগুতেই ব্যাগ গুলো রেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেলো।আমিও আর ক্লান্ত শরীরে ওকে ধরতে গেলাম না।শপিং ব্যাগ গুলো থেকে একটা নীল রঙের একটা থ্রি-পিস নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলাম।ফ্রেস হয়ে এসে শরীর টাকে বিছানায় ক্লান শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম।আর সাথে সাথেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভীড় করলো।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১

ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বাজতেই আমার অতি আরামে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে নিয়ে বললাম,
—- ফোন করার আর সময় পান না অন্যের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ফোনটা কেন দিতে হলো?
—- পরি তুই ঘুমাচ্ছিলি ?ইস আমি তোর ঘুমটা ভেঙ্গে দিলাম।
ওপাস থেকে ভায়ুর কন্ঠ শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,
—- ভাইয়ু তুমি আমাকে ফোন দিয়েছো আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!আমি জানতাম তুমি আমার উপর রাগ করে থাকতেই পারবে না।তুমি তো আমার বেস্ট ভাইয়ু।
আমার বলার সাথে সাথেই হঠাৎ করে ভাইয়ু রেগে জোরে জোরে বলতে লাগলো,
—- এক থাপ্পড় মারবো আমাদের মানসম্মান সব ধুলোই মিশিয়ে আরেক জনকে বিয়ে করে এখন আবার ঢং করে ক্ষমা চাইতে ফোন দিয়েছিস?নিজের স্বামী সংসার নিয়েই থাক তুই। আর কখনো যদি আমাকে ফোন করার দুঃসাহসও দেখাবি না!
আমার এবার রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছি।নিজে ফোন করে আমাকেই বলছে আমি ফোন দিয়েছি।রাগী গলায় বললাম,
—- আমি তোমায় ফোন দিয়েছি?

—– পরি আমাকে ভুল বুঝিস না।আমাকে দুই মিনিট সময় দে আমি সব বুঝিয়ে বলছি।
এবার কথা গুলো খুব করুন ভাবে বললো ভাইয়ু।প্রথমে নিজেই উল্টো পাল্টা বলে আবার বলছে ভুল বুঝতে না?আমায় কথা শুনালো না?তাই আমিও রেগে বললাম,
—- আমার এতো সময় নেই আমাকে তো আবার স্বামী সংসার নিয়ে থাকতে হয় তাই এখন আমাকে আবার স্বামী সেবা করতে হবে তোমার কথা শোনার আমার একদম সময় নেই। সো বাই!
কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই ভাইয়ুকে কিছু না বলতে দিয়েই ফোনটা কেটে দিলাম।ফোন রেখে পিছনে ফিরতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেলাম।কারণ আমার পিছনে…….

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৩