প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১
সুমাইয়া জাহান

কবুল বলতে যাবো ঠিক সেই সময়ই ঝড়ের গতিতে কেউ একজন এসে আমাকে বিয়ের ভরা আসর থেকে এক ঝটকায় উঠিয়ে ঠাস করে একটা চড় মারলো।মুখে চড় পরতেই মুখে হাত দিয়ে সামনে থাকা নীরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।নীর আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে চিৎকার করে বলে উঠলো,
—- তোর কলিজা এতো বড়ো হয়ে গেছে যে আমার বিদেশে থাকার সুযোগে নতুন করে বিয়ের পিরিতে বসে পরলি?আবার বিয়ের পিরিতে বসতে তোর কলিজা একবারও কাঁপলো না?
নীরের কথায় আমি সহ পুরো বিয়ে বাড়ির লোক অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।আমাদের সাথে ভাইয়ুও অবাক দৃষ্টিতে নীরের দিকে তাকিয়ে ছিলো।বাবা রেগে ভাইয়ুর দিকে তাকাতেই ভাইয়ু একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলিয়ে নীরের কাছে এসে ওর শার্টের কালার ধরে ধমকের সুরে বললো,

—- তোর এত্তো সাহস আমার বোনের গায়ে হাত দিস।আবার বিয়ের ভরা আসর থেকে ওকে উঠিয়ে নাটক করছিস!
নীর শান্ত ভঙ্গিতে ভায়ুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—- তূর্য ভাইয়া কলার টা ছাড়ো।নিজের বোনের জামাই কে সবার সামনে অপমান করলে কিন্তু তোমাদের সম্মান টাই আগে নষ্ট হবে।
ভাইয়ু রেগে নীরের কালার টা আরো শক্ত করে ধরলো।
—- বোনের জামাই মানে?তই কবে আমার বোনের জামাই হলি?আমার বোনের বিয়ে তো আজ হচ্ছে। আমার সাথে ফাইলামো পেয়েছিস?
নীর আমার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—- তুই এখনো আমাদের বিয়ের কথা বলিসনি?তা বলবি কেন বলে তো নতুন করে আবার বিয়ের পিরিতে বসতে পারতি না!
ভাইয়ু এবার শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলো,
—- নীর তুই কি বলতে চাইছিস ক্লিয়ার করে বল!বারবার কিসের বিয়ের কথা বলছিস?
—- তূর্য ভাইয়া আমার আর তূবার একবছর আগেই বিয়ে হয়েছে।তোমাদের কাছ থেকে কথাটা লুকিয়ে রেখেছি কারণ তূবা খুব ভয় পাচ্ছিলো তোমরা যদি না মানো তাই!ও বলেছিলো আস্ত আস্তে তোমাদের কে বুঝিয়ে বলবে আমাদের বিয়ের কথাটা!তাই আমাকে এতোদিন চুপ রেখেছে।কিন্তু ভাবতে পারনি ও আমার বিদেশে থাকার সুযোগ নিয়ে আবার বিয়ে করতে বসে যাবে।
আমি ওর কথা গুলো শুধু অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি। আমি এতোটাই অবাক যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হচ্ছে না।নীরের কথা শুনে ভাইয়ু কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠলেন,
—- আমাদের কে তুমি ঠিক কথাটা বোকা মনে করো নীর?তুমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবে আর আমরা তোমার গল্পকে বিশ্বাস করে এই বিয়েটা বন্ধ করে তোমার হাতে ওকে তুলে দিবো?ভাবলে কি করে এমন টা?(ভাইয়ুর দিকে তাকিয়ে) তূর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পই শুনে যাবি নাকি পুলিশকেও ফোন দিবি?এই ছেলের এতো সাহস হয়ে গেছে যে আরমান সিকদারের মেয়ের দিকে হাত বাড়াতে চায়।ইমিডিয়েটলি পুলিশকে আসতে বল।ওর শিক্ষা নাহলে ওর হবে না দেখছি!
নীর একটা ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে পাশে থাকা একটা চেয়ারে আরাম করে বসে ভাইয়ুর দিকে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- হ্যাঁ হ্যাঁ তূর্য ভাইয়া ইমিডিয়েটলি করো পুলিশকে! তাহলেই তো আমি তাড়াতাড়ি আমার বউকে নিয়ে এখান থেকে যেতে পারবো।
ভাইয়ু ফোন করতে গিয়েও নীরের কথায় থেকে গেলো।ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- বউকে নিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারবি মানে?
—- হুম তাড়াতাড়িই তো যেতে পারবো!তোমরা আমার বউকে এই একটা বছর ধরে আঁটকে রেখেছো।পুলিশ এসে তো তোমাদের হাত থেকে উদ্ধার করে আমার বউকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে।তাই যত তাড়াতাড়ি পুলিশ আসবে ততো তাড়াতাড়িই তো আমি বউকে নিয়ে যেতে পারবো।তোমরা না করতে পারলে আমাকে বলো আমি করেছি।তাড়াতাড়ি যেতে হবে তো!আমার আবার অনেক কাজ পরে আছে।
নীর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথা গুলো বলে একবার আড়চোখে বাবাকে দেখলো।বাবাও বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
—- পুলিশকেও কি মূর্খ মনে হয় তোমার।তোমার গল্প শুনে তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিবে!আরে পুলিশের কাছে কিছু বলতে হলে তো প্রমাণ প্রমাণ লাগে তা কি মনে ছিলো না এখানে আসার আগে!

বাবার কথায় নীর এবার চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে একটা রহস্যময় বাঁকা হেঁসে বলো,
—- ঠিক বলেছেন কাকু।প্রমাণ তো অবশ্যই লাগবে।আর আপনার কি মনে হয় নীর চৌধুরী এতো কাঁচা খেলোয়াড় যে প্রমাণ ছাড়া চলে আসবে?
একটা কাগজ বের করে সবার সামনে ধরলো।ওইটা একটা কাবিননামা ছিলো।যেখানে আমার আর নীরের সাইনটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার মনপ হয় আজকে অবাক হওয়ারই দিন তাই একের পর এক অবাকই হয়ে চলেছি।চোখ গোলগাল করে কাগজ টার দিকেই তাকিয়ে আছি।ভাইয়ু একটু হেসে বললো,
—- সত্যি নীর তোর আমাদের এতোই বোকা মনে হয়।একটা নকল কাবিননামা এনে আমাদের সামনে ধরবি আর আমরা বিশ্বাস করে নিবো?
—- কাজী সাহেব আপনি একটু দেখে দিন তো এটা নকল না আসল।
কথাটা বলেই নীর কাজী লোকটার দিকে পেপার টা এগিয়ে দিলো।এই সেই কাজী যে একটু আগে আমার বিয়ে পড়াচ্ছিলো।কাজী লোকটা নিজের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে কাগজ টা কে কয়েকবার ভালো করে দেখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—- আরমান সাহেব এটা আসল।আর সই গুলাও এইখানে আসল।
কাজী লোকটার কথাটা বলার সাথে সাথেই নীর পেপার টা নিয়ে নিলো।বাবার দিকে তাকিয়ে আমার হাতটা ধরে বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
—- বিশ্বাস হলো তো কাকু উফস সরি শ্বশুর বাবা এটা আমারই বউ!এবার তাহলে আমি আমার বউকে নিয়ে যাই হে!

নীরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বাবা এসে আমার মুখে আরো একটা চড় মারলো।যেই এক গাল বেঁচে ছিলো সেটাতে চড় পরলো।এবার আমি দুই গালে দুই টা হাত রেখে কাঁদো কাঁদো ভাবে বাবার দিকে তাকালাম।বাবার চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে চোখ দিয়েই আমাকে ভস্ম করে দিবে।
—- তোর উপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিলো।সেই
তুই আমার মানসম্মান সব এই ভাবে ধুলোয় মিশে দিলি?একবারও আমার কথাটা মনে পড়লো না?
হুংকার দিয়ে কথাটা বললো বাবা।এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না কাঁপা কাঁপা গলায়ই বললাম,
—- বাবা বিশ্বাস করো আমি এসবের……
আমাকে কথা না বলতে দিয়েই ভাইয়ু আমার কথার মাঝে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
—- পরি একদম চুপ!তোর থেকে আমরা আর একটাও কথা শুনতে চাই না।আমাদের সাথে এতো বড়ো একটা বিশ্বাসঘাতকতা করবি আমরা স্বপ্নে ভাবতে পারিনি।
—- ভাইয়ু বিশ্বাস করো……
ভাইয়ু আবারও আমাকে থামিয়ে দিয়ে চোখ গরম করে বললো,
—- চুপ থাকতে বলছি না তোকে?আর একটা কথা বললে আরো একটা চড় খাবি!চড় না খেতে চাইলে চুপ থাক।
চড়ের কথা শুনে মুখে আংগুল দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।দুই টা চড় খেয়েই শিক্ষা হয়ে গেছে।এখনো মুখে ভিষণ ব্যাথা করছে।আবার যদি আরো একটা খাই তাহলে এ তৃভুবনে আমাকে আর কেউ খুঁজেই পাবে না।তাই চুপ থাকাই আমার জন্য মঙ্গল। দেখি এরপর কি হয়!
—- নিয়ে যা নীর ওকে এখান থেকে।
ভাইয়ু নীরকে কথাটা বলেই অন্য দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো।আর বাবা একবার রাগী চোখে আমার আর নীরের দিকে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেলো।এতো দেখি সত্যি সত্যি এই নীরের সাথে আমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

—- ভাইয়ু কি বলছো কি তুমি? আমি নীরের সাথে কোথাও যাবো।
আমার কথা শুনে ভাইয়ু নীরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—- নীর আমি পরিকে নিয়ে যেতে বলছি না তোকে? ওকে এবাড়ির তৃসীমানায় আমি দেখতে চাইনা।এখুনি বেড়িয়ে যা তুই ওকে নিয়ে।
ভাইয়ুর কথায় নীর একটু হেসে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো।
আপনাদের তো পরিচয় টাই দেওয়া হলো না!আমি তূবা আর ভাইয়ুর আদরের পরি।অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।আমার ভাইয়ু তূর্য সিকদার আর বাবা আরমান সিকদার। আমার পরিবার বলতে আমি ভাইয়ু বাবা আর মা।
আর এতোক্ষণ যে আমার সাথে এতোকিছু করলো ও হচ্ছে নীর মানে নীর চৌধুরী।আমার বেস্টফ্রেন্ড তবে আমার সাথে পড়ে না আমার অনেক বড়ো ও।ওর বাবা আরো কয়েক বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা যায়।তখন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিজনেসও দেখাশোনা করে।কয়েকদিন আগে বিজনেস এর কাজেই বিদেশ গিয়ে ছিলো।আর তখনই আমার একটা ভালো সমন্ধ পাওয়ায় বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেন।সেইমতেই আজ আমার বিয়ে হচ্ছিলো।আর তখনই তো নীরের এন্ট্রি।বাকিটা তো আপনারা জানেন।

নীর আমাকে টানতে টানতে আমাকে বাইরে আনতেই এক ঝটকায় ওর হাত টা ছাড়িয়ে নিলাম।ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
—- ওই তুই এগুলো কি করলি?
—- কেন দেখতে পাসনি?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে নীর ভ্রু উঁচু করে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করলো।আমার রাগ এবার সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে ওর প্রশ্নে আমি এক হাত দিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে ঝাঁঝালো গলায় বললাম,
—- আমি জিজ্ঞেস করছি আমার বিয়ে ভেঙ্গে আমাকে বাড়ি ছাড়া কেন করলি?
ওর কলার থেকে আমার হাত টা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—– আমাকে দাওয়াত না দিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার জন্য এটা তোর শাস্তি। তবে আরো একটা কারণ আছে।তুই বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমি কাকে জ্বালাতাম তাই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছি।আফটার অল তুই আমার দশটা না পাঁচ টা না একটা মাত্র বেস্টফ্রেন্ড। তাই তোকে শ্বশুর বাড়ি যেতে দিতে মন চাইলো না।
আমার রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। ওকে কিছু বলতে গিয়েও বললাম না।বাড়ির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো।আমাকে কেউ একটু বিশ্বাসও করলো না।ভাইয়ু তো আমাকে সবার থেকে বেশি ভালোবাসতো।ভাইয়ু একটু বিশ্বাস করতে পারতো।আমার ভাবনার মাঝেই নীর আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
—- তোর জন্য কি সারাদিন আমি এই রাস্তাই দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?গাড়িতে উঠ বাড়ি যাবো তো।
—- যাবো না তোর সাথে আমি।
—- ওকে ফাইন।আমি যাচ্ছি তুই থাক এই রাস্তায়।

কথাটা বলেই গাড়িতে ঢুকে গাড়ি স্টাট দিলো নীর।আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে পরলাম।আমি তো এমনি রাগ করে কথাটা বলেছি।ব্যাটা বদের হাড্ডি আমাকে এই রাস্তায় ফেলেই চলে যাচ্ছিলো।আমি খুব ভালো করেই জানি শতো চেষ্টা করেও বাড়িতে আমার এখন জায়গা হবে না।পরিস্থিতি একটু শান্ত না হলে বাড়ি যেতে পারবো না।এখন এই বদের হাড্ডির সাথে না গেলে আমাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে।তাই একরম বাধ্য হয়েই ওর সাথে যাচ্ছি।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২