রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ৮ || লেখিকা : স্বর্ণা সাহা

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ৮
লেখিকা : স্বর্ণা সাহা

দিশানী ফোন হাতে নিয়ে ভাবলো,,
—এতো রাতে আমাকে আবার কে ফোন করলো? কারো কিছু হয়েছে নাকি? দিশানী একবার নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝর একবার ঘুমোলে ওর আর কোনোদিকে হুশ থাকে না। দিশানী ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো।

—হ্যালো দিশানী বলছো কি?
গলার আওয়াজ শুনে ফোনের ওপাশে কে আছে তা বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হলো না দিশানীর। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললো,,
—হ্যাঁ আমি দিশানী বলছি, কিন্তু আপনি কে, আর আমাকে এতো রাতে ফোনই বা করেছেন কেনো?
ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর এলো,

—আমি নীলাদ্রি বলছি, ডক্টর নীলাদ্রি সেনগুপ্ত, এবার চিনতে পেরেছো নিশ্চই?
—হুমম চিনতে পেরেছি, কিন্তু আপনি এতো রাতে কেনো আমাকে ফোন দিয়েছেন?
—তোমার সাথে কিছু দরকারি কথা ছিলো সেজন্য, কিন্তু এই কথাগুলো আমি ফোনে বলতে পারবো না, তাই বলছিলাম তুমি কি কালকে সন্ধ্যায় একবার আমার চেম্বারে আসতে পারবে?
—আপনার সাথে আমার কি এমন দরকারি কথা থাকতে পারে যার জন্য আপনি আমাকে চেম্বারে ডাকছেন।
নীলাদ্রি হালকা নিচু গলায় বললো,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—দেখো আমি বুঝতে পারছি যে তোমাকে আমার এভাবে ডাকা টা তোমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে, কিন্তু বিশ্বাস করো এই কথাগুলো আমার জন্য অত্যধিক জরুরি তাই বলছিলাম যদি, আমাকে তোমার বন্ধু মনে করেই না হয় বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসো।
নীলাদ্রির কথায় দিশানীর মায়া হলো তাই বললো,,
—আচ্ছা ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করবো আসার কিন্তু আমি আপনাকে শিউরিটি দিতে পারবো না।
—আচ্ছা তাহলে এখন রাখি, গুড নাইট!
—হুমম গুড নাইট!

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নির্ঝর দিশানী কে বললো,,
—ব্রেকফাস্ট শেষ করে রেডি হয়ে নিও!
দিশানী নির্ঝরের কথায় উত্তর দিলো,
—কেনো, রেডি হবো কেনো?
—আমার সাথে কোর্টে যাবে তাই, আমি কালকে উকিলের সাথে কথা বলেছি, আজকে আমাদের দুজনকেই কোর্টে যেতে হবে, বুঝেছো?
দিশানী দুই দিকে ঘাড় নেড়ে জবাব দিলো যার অর্থ হ্যাঁ।
নির্ঝর দিশানীকে থ্রেট দিয়ে বললো,,
—শোনো ওখানে যেয়ে কোনো সীনক্রিয়েট করবে না বুঝেছো? আর কোনো কথা বাড়িয়ে বলতে যেও না, ঠিকাছে?
দিশানী মুচকি হেসে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,,

—তোমাদের মতো বাড়িয়ে কোনো কথা বলার অভ্যেস আমার নেই, ওই ধরণের কাজ শুধুমাত্র তোমাদের দ্বারাই সম্ভব!
নিরা দিশানী কে রাগ দেখিয়ে বললো,,
—আবার তুমি এসব ধরণের কথা শুরু করেছো? খবরদার আমার সামনে তুমি এই ধরণের কথা বলবে না।
দিশানী উত্তর দিলো,,
—আরে আরে, নিরা তুমি চেতে যাচ্ছো কেনো? আমি কোনো একজনকে মিন করে বলিনি, তাহলে তুমি একা এভাবে ক্ষেপছো কেনো? ওওও এবার বুঝতে পেরেছি, “বললে কথা সবার মাঝে যার কথা তার গায়ে বাজে”
নিরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্ঝর আর সুজাতা নিরাকে থামার জন্য ইশারা করলো। আর নিরাও চুপ করে গেলো।

কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী তিনমাস ওদের দুজনকে সময় দেওয়া হয়, যদি ওরা মত পরিবর্তন করতে চায় সেজন্য।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায় নির্ঝর আর দিশানীর।ওদের দুজনকে ফিরতে দেখে সুজাতা আর নিরা ওদের দিকে এগিয়ে এলো।সুজাতা হাসিমুখে নির্ঝরকে জিজ্ঞেস করলো,,
—কিরে তোদের ডিভোর্স হয়ে গেছে?
নিরা বিরক্তি নিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,
—মা এতো জলদি ডিভোর্স হয় নাকি? কোর্ট ওদের তিনমাস সময় দিয়েছে, তিনমাস গেলে ওদের ডিভোর্স হবে, বুঝেছো?
সুজাতা অবাক হয়ে বললো,,
—কি তিনমাস? আরো তিনমাস এই মেয়েটাকে সহ্য করতে হবে?

দিশানীর এতো কথা ভালো লাগছে না। ও ওখান থেকে চলে এলো, ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকতেই চোখ গেলো ওয়াশরুমের আয়নায়, দিশানী আয়নায় নিজেকে দেখছে।খুব নিখুঁতভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নিজেকে, কতদিন এভাবে নিজেকে দেখেনা দিশানী, নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে দুফোটা জল দিশানীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো, আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে, আসলে স্বামী যেমনই হোক না কেনো,একজন স্বামী যখন তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয় তখন সেই স্ত্রীর মনের অবস্থা একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

সন্ধ্যাবেলা দিশানী বের হতে নেবে তখনি সুজাতা দিশানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
—এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় যাচ্ছো তুমি?
দিশানী উত্তর দেয়,
—আমার একটু কাজ আছে তাই বাইরে যাচ্ছি!
—কিসের এতো কাজ আছে তোমার যে বাইরে যেতে হবে, আজকে তো সন্ধ্যার জলখাবারও বানাওনি দেখছি, এসব কাজ ছেড়ে যাচ্ছো কোথায়?
—মা আমি যখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো তখন কি করবেন আপনি? এখন থেকে নিজের কাজগুলো তো নিজে করুন, নাকি ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীকে দিয়েও এভাবে কাজ করানোর ইচ্ছা আছে আপনার?

—আবার মুখে মুখে তর্ক শুরু করে দিলে?
—সত্যি কথাগুলো তর্ক বলে মনে করা যদি আপনাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে থাকে তাহলে সত্যিই আমার কিছুই বলার নেই, আসছি!
দিশানী বের হয়ে চলে গেলো।

দিশানী নীলাদ্রির চেম্বারে পৌঁছলো,চেম্বারের বাইরে বসে থাকা লোকটাকে বললো,
—আপনি প্লিজ একটু ভেতরে গিয়ে বলবেন যে দিশানী এসেছে, আসলে ডক্টর নীলাদ্রি আমাকে এই সময় আসতে বলেছিলেন।
লোকটি বললো,
—কিন্তু ম্যাম দিশানী নামে তো কারো সিরিয়াল দেয়া নেই
—না,না আমি ডক্টর নীলাদ্রির কোনো পেসেন্ট নেই, আমি ওনার পরিচিত, উনিই আমাকে ডেকেছেন।
লোকটি গিয়ে নীলাদ্রি কে বলতেই নীলাদ্রি দিশানী কে পাঠিয়ে দিতে বললো।
দিশানী ভেতরে ঢুকলো,নীলাদ্রি দিশানী কে দেখে বললো,

—প্লিজ সিট্
দিশানী চেয়ারে বসতেই নীলাদ্রি আর দিশানীর আগের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেলো।একের পর এক স্মৃতি দুজনের চোখের সামনে ভাসতে শুরু করলো।অতীতে ভেসে গেলো দিশানী আর নীলাদ্রি দুজনেই।
ইন্টারদের নবীনবরণের পরেরদিন,
দিশানী স্কুলে এসে ব্রেঞ্চ এর ওপর উঠে বসে বসে কি যেনো একটা ভাবছে, আর দিশানীর বন্ধুরা এক কথায় একটা গ্যাং দিশানীর চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দিশানী কে অনেক্ষন ধরে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে দিশানীর বেস্ট ফ্রেন্ড মেঘা বিরক্তি নিয়ে দিশানীকে বললো,,
—এই তুই আর কতক্ষন এভাবে চুপ করে বসে থাকবি বলতো? কি এতো ভাবছিস তুই?বিশ্বাস কর,তোকে এভাবে দেখে আমার এখন বিরক্তি লাগছে।
দিশানী মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,

—দেখিস না আমায়,চোখে কাপড় বাঁধ, নয়তো ক্লাস থেকে বের হয়ে যা, আমি কি তোকে আমাকে দেখার জন্য জোর করেছি?
—-আহ, ক্ষেপছিস কেনো?কি হয়েছে তোর বলনা, কি এতো ভাবছিস তখন থেকে?
—আমাকে ইন্টারের একজন ফাজিল মেয়ে বলেছে তার বদলা নিতে হবে
—সেকি কথা, তোকে একটা ফাজিল মেয়ে বলেছে এটাও নিজের কানে শুনতে হলো আমার ?
—চুপ একদম নাটক করবি না মেঘা, তবে আমাকে ফাজিল মেয়ে বলা ছেলেটাকে পরে দেখে নেবো তার আগে একটা সিরিয়াস কেস সামলে নেই, একজনকে শাস্তি দিতে হবে, বুঝলি?
—কাকে শাস্তি দিবি তুই?

—ইন্টারের একটা নিউ স্টুডেন্ট কে, আমি ওদের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি, আমাকে লাভ লেটার দিয়েছে, আর নিচে লিখেছে লেটারটা নাকি রক্ত দিয়ে লেখা।
—কার রক্ত দিয়ে লেখা?
—বলেছে তো ওর নিজের রক্ত দিয়েই লেখা, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি, আমি সিউর কোনো মুরগি বা ছাগলের রক্ত দিয়ে লিখেছে।
—কোন ছেলে রে এটা?

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ৭

—আরে মেঘা বুঝতে পারলি না কে,আমাদের পাড়ার পাগলের ডাক্তার থুক্কু সাইক্রিয়াটিস্ট কাকুর ছেলে রবি, ওর মতো পাগল ছাড়া কে এই কাজ করবে? সাইক্রিয়াটিস্ট কাকু সবার মাথা খারাপের চিকিৎসা করে বেড়ায় আর এইদিকে তার ছেলে যে একটা বদ্ধ পাগল সেটা কাকু বোঝে না।
দিশানীর অন্য এক বান্ধবী বললো,
—রক্ত দিয়ে লাভ লেটার লিখেছে তাই ওকে পাগল বলছিস
দিশানী চোখ ছোটো ছোটো করে ওর বান্ধবীকে বললো,,

—আমরা ওকে পাগল বলেছি তাতে তোর এতো বাঁধছে কেনো?
—আজব তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম, আমার বাঁধতে যাবে কেনো?
—না রে, এই কাজের জন্য পাগল বলছিনা, ওর প্রত্যেকটা কাজই এইরকম পাগল টাইপ,তাই আমাদের পাড়ার সকলেই ওকে পাগল, মাথা খারাপ এসব বলে ডাকে।কিন্তু আমার কাছে ওই বদ রবিটাকে পাগল কম শয়তান বেশি লাগে।

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ৯