শেহজাদী পর্ব ১৮ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ১৮
Arishan Nur

পার্কিং লটে ইমান হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। তার পিছু পিছু মিরাও প্রায় দৌঁড়ে হাঁটছে।
মিরা তার সঙ্গে তাল সামলাতে পারছে না। সে আস্তে আস্তে বলে, এতো জোরে হাঁটিস কেন রে বাপ? একটু আস্তে হাঁটলে কি হয়? হুহ!
গাড়ির কাছে এসে ইমান গাড়ির চাবি বের করলো। এরপর লক খুলে দিয়ে সে যে কিছু বলবে তার আগেই মিরা পেছনের সিটে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। ইমান এক ধ্যানে মিনিট এক মিরার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এতে কোন ভাবান্তর নেই মিরার। সে নিজের মতো বসে আছে পেছনের সিটে।

ইমান গাড়িতে না উঠে, শুধু ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে, পেছনের জানালা খুলে দিয়ে, বেশ শব্দ করে দরজা লাগিয়ে, মিরার সামনে এগিয়ে এসে বলে, হ্যালো ম্যাডাম? আমি কি আপনার ড্রাইভার কিনা?
মিরা ভ্রু যুগল কুচকে বলে, ড্রাইভার কেন হবেন?
— আপনি পিছনে এভাবে লাট সাহেবার মতো বসে থাকলে যে-কেউ আমাকে ড্রাইভার ভাব্বে। সামনে এসে বসুন ।
— আশ্চর্য! আপনার জামা-কাপড় দেখেই বোঝা যায় আপনি কে? কেউ আপনাকে ড্রাইভার ভাববেনা।

মিরা এরপর আস্তে করে বলে, তাছাড়া ড্রাইভার এতো হ্যান্ডসাম হয় না।
মিরার শেষের কথা ইমানের কানে এলোনা। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে নিজের দুই হাত আড়া-আড়িভাবে বন্ধনে আবদ্ধ করে বলে, এতোকিছু জানি না। হয় আপনি সামনের সিটে বসবেন নাহলে নেমে যাবেন। চুজ অনলি ওয়ান অপশন!
মিরা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, বসে পড়েছি তো। আবার,,,,,,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমান পেছনের দরজা খুলে দিলো। এবারে মিরা আর ঝামেলা করলোনা। নেমে পড়লো গাড়ি থেকে ।
ইমান ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে পড়ে। কাজেই তাকেও বাধ্য হয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসতে হলো।
বসামাত্র ইমান থমথমে গলায় বলে, সিটবেল্ট পড়ো।
মিরা সিটবেল্ট পড়ার জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু কেন যেন নাগাল পাচ্ছে না সে।বেল্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো সে তাও লাভ হচ্ছেনা।
ইমান বিরক্ত হয়ে বলে, আবার কি হলো?

— বেল্ট লাগে না কেন?
— লাগে না নাকি লাগাতে জানো না?
মিরা ঝাঁঝ গলায় বলে, আমাদের ও গাড়ি আছে।ছোট্ট বেলা থেকেই আমি গাড়িতে উঠি।
— তারপরও গাড়ির সিটবেল্ট লাগাতে জানো না?
— পারি। কিন্তু এখন কেন যেন হচ্ছে না। সিটবেল্ট না পড়েই যাই। সমস্যা হবেনা ।
— অবশ্যই সমস্যা হবে। ট্রাফিক পুলিশ আটকালে কি বলব? মিরা ম্যাডামের সিটবেল্ট পড়তে ভালো লাগেনা জন্য পড়েনি?

— ভালো লাগেনা কখন বললাম? লাগানো যাচ্ছে না।
এটুকু বলেই মিরা থেমে গেল এরপর উত্তেজিত হয়ে বলে, আপনার গাড়িতেই কোন সমস্যা আছে জন্য সিটবেল্ট লাগাতে পারছি না।
— আমার গাড়িতে কোন সমস্যা নাই।
— আছে। আছে। ত্রুটি আছে গাড়িতে।

ইমান মিরার দিকে তাকালো এবার। এরপর হালকা করে হেসে বলে, এই ত্রুটিপূর্ণ গাড়িতেই তো উঠলা। এক কাজ করতে, ত্রুটিহীন গাড়িতে করে ভ্রমণ করতে, আমার গাড়িতে কেন এলে?
— দেখুন আপনি শুধু শুধু ঝগড়া লাগাচ্ছেন। ঝগড়া না করে গাড়ি চালু করুন। রাতে আমাদের আবার রওনা দিতে হবে৷
— আমি মোটেও ঝগড়া করছি না। বরং তুমি ছুতায় আছো ঝগড়া করার।
— ঝগড়া করা আমার স্বভাব না।
ইমান বলে, হাত উপরে উঠাও।
— সর‍্যি?
— হাত উঠাতে বলেছি। বাংলা ভাষা বুঝো না?

মিরা কিছুই বুঝে পাচ্ছে না। সে বেশ বিচলিত হয়ে নিজের হাত উঁচু করে। এই ছেলের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে!
ইমান কিছুটা ঝুঁকে এলো তার দিকে। মিরা ভয় পেয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে, কি করতে চান আপনি?
ইমান বেশ জোড়েই সিটবেল্টটা টান মারলো এবং লাগিয়েও দিল। কাজটা করতে ইমান মাত্র দুই মিনিট সময় নিলো।

এই দুই মিনিটেই মিরার অবস্থা যায় যায়। সে নিশ্বাস অব্দি নেয়নি। ইমানের গায়ের কড়া পারফিউম নাকে আসতেই সে মাতালের মতো হয়ে গেল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইল।
গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলছে। মিরা বার বার আড় চোখে ইমানের দিলে তাকাচ্ছে।
ইমান তা টের পেল। সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলে, এর আগে কোনদিন সুদর্শন যুবক দেখোনি? আমাকে এভাবে লুকিয়ে দেখে কি মজাটা পাচ্ছো শুনি?

মিরা একথা শুনে চোখ বড় বড় করে ফেলে। সে যে ইমানকে আড়চোখে পরখ করে যাচ্ছিল এটা উনি কিভাবে টের পেল?
মিতা তোতলিয়ে বলে, সোনালী আপুর জন্য খাবার কিনতে হবে৷
ইমান ড্রাইভ করতে করতে বলে, অন্য আরেকদিন কিনিও। আজ সম্ভব না।
মিরা বলে, আজ কেন সম্ভব না? হুয়াই নট টুডে?
— আমি কি তোমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট? যা বলবে তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করব?
মিরা একথা শুনে মনে মনে বলে, স্বামীরা বউয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, এসিস্ট্যান্টরা না!

মিরা খাবার নিয়েই বাড়ি ফিরে। শেষ মুহূর্তে ইমান গাড়ি ঘুরিয়ে খাবার কিনে দিয়েছে। খাবারের প্যাকেট গুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে সে সময় নষ্ট না করে জামা-কাপড় গুছাতে গেল। দুটো শাড়ি, চারটে সালোয়ার কামিজ এবং একটা স্কার্ট সুন্দর করে গুছিয়ে নিল।
ব্যাগে কাপড় গুছাতে দেখে সুপ্তি বেগম অবাক হয়ে বলে, তুই কি সিডনি চলে যাচ্ছিস নাকি?
মিরা শব্দ করে হেসে বলে, না মা। আমরা অফিস থেকে কুয়াকাটা যাচ্ছি।

— তোর বাবা যেতে দিবে?
মিরা বলে উঠে, বাবার আর বড় আব্বুর সাথে কথা বলে নিব। যেতে তো হবেই। অফিসের কাজ বলে কথা!
— কখন যাবি তোরা?
— রাতেই রওনা দিব।
— সেকি রাতে কেন?দিনে যা। রাতে জার্নি করা আমার পছন্দ না।
মিরা মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা করে হেসে বলে, কালকে থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। মা এক কাজ করো তো, ইরাকেও বলো আমার সঙ্গে যেতে। ও মজা পাবে। ঘুরাঘুরি করলে ভালো লাগবে।দুই বোন একসঙ্গে গেলে নিশ্চয়ই তোমার চিন্তা থাকবে না। যদিও বা আমি একা একা সব ম্যানেজ করে নিতে পারি।

সুপ্তি বেগম বলে, ইরা মনে হয় না যাবে।
— তুমি বলে দেখো! না গেলে জোর করোনা।
— আচ্ছা।
সুপ্তি বেগম বেরিয়ে যান মেয়ের রুম থেকে। ইরা বারান্দায় বসে ছিল। মাকে আসতে দেখে নড়েচড়ে বসে সে।
সুপ্তি বেগম বলে উঠে,মিরা নাকি কুয়াকাটা যাচ্ছে। তুই যাবি ওর সাথে?
ইরা কি যেন একটা ভাবলো। এরপর সংক্ষেপে বলে, যাব।
সুপ্তি বেগম ভারী অবাক হলেন। ইরা কিছুটা ঘরকোনে স্বভাবের। সারাদিন নিজের রুমে বসে থাকবে। সেই মেয়ে ঘুরতে যেতে এককথায় কিভাবে রাজী হলো?

ইরা বলে উঠে, আমি যেতে চাচ্ছি জন্য বোধহয় তুমি খুশি হওনি। তাইলে থাক। তুমি অখুশি হও, এমন কিছুই আমি করব না৷
— তুই বড্ড ভুল বুঝিস আমাকে। আমি কেন খুশি হবো না? তোর ব্যাগ আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তুই খেয়ে রেডি হ।
— ঠিক আছে।
সুপ্তি বেগম ইরার ব্যাগে গুছাতে রুমে চলে গেলেও ইরা বারান্দায় বসে রইল।

রাত নয়টায় মিরা আর ইরা বের হলো বাসা থেকে। বড় আব্বু নিজ থেকে তাদের বিদায় জানাতে নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসলেন। দুইজনের হাতে পাঁচ হাজার করে গুজে দিয়ে বলে, তোমরা এখন বড় হয়ে গেছো। নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে শিখেছো। সাবধানে থাকবে।
মিরা সালাম জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।

শেহজাদী পর্ব ১৭

মিরা আর ইরা গাড়ি করে বাসস্ট্যান্ডে যেতে লাগলো। ইরা জানালার কাঁচ ঘেঁষে বসে আছে৷ মিরা এখনো ইমানের কথা তাকে জানায়নি। সরাসরি নিজের চোখেই দেখে নিবে।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে মিরা গাড়ি থেকে নামলো। তার চোখ আটকে গেল বাস টার্মিনালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো শার্ট পড়া ইমানের দিকে। অফিসের পড়া শার্টটা সে বদলায়নি! আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

মিরা হেঁটে হেঁটে তার পাশে গিয়ে মৃদ্যু আওয়াজে বলে, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থের জন্য ভালো না। ফুসফুস নষ্ট করে দেয় সিগারেট।
মিরার ককণ্ঠস্বর শুনে সে খানিকটা ভড়কেও আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
“মন পুড়ে যায় কেউ খবর রাখেনি আর এতো সামান্য ফুসফুস বৈকি!”
কথাটা মিরার কানে হূলের ন্যায় বিঁধলো। সে বলে উঠে, আপনি কি কোনদিন আমাকে ভালোবেসেছিলেন?

মিরার প্রশ্নটা শোনামাত্র ইমানের সারা শরীর অভিমানের দগ্ধে ঝলসে যেতে লাগলো। সে ভরাট কণ্ঠে বলে, একটা পুরাতন বাংলা গানের লাইন আছে, কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল! আমি সেই ভুলটাই করে বসেছি। ভুল যেহেতু করেছি পস্তাতে তো হবেই৷
— ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে না বলে সরাসরি প্রশ্নটির উত্তর দেন!
ইমান আলস্য ভঙ্গিতে বলে, না। আমি কাউকে ভালোবাসি না৷

শেহজাদী পর্ব ১৯