অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী গল্পের লিংক || জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

“আমাকে যখন এতই পছন্দ, তখন ছেলের বউ করে নিয়ে আসুন আন্টি।”
কথা খানা বলে হাঁসতে হাঁসতে পেছন ফিরতেই ফেঁসে গেলো তটিনী। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া এক পুরুষ অবয়ব। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো তটিনীর। লোকটি কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনেকটা অস্বস্তি হলো তটিনীর।
লোকটিকে দেখতে পেয়ে আয়েশা সুলতানা ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-“এসে গিয়েছিস! যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।”
তটিনী গোলগোল চোখে তাকিয়ে আয়েশা আন্টির সাথে মানুষটির সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করলো।
তখনই আয়েশা সুলতানার কথার প্রত্যুত্তরে গম্ভীর স্বরে মানুষটি বলল,
-“আসছি।”
এতটুকু বলেই লম্বা কদম ফেলে বসার ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল। তটিনী কপাল কুঁচকে জানতে চাইলো,
-“উনি কে ছিলেন, আন্টি?”
আয়েশা সুলতানা মিটিমিটি হেসে বললেন,
-“তুমি যার বউ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলে, উনি তিনি।”
ভ্রু কুঁচকে গেলে তটিনীর। বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“মানে!”
“মানে ও আমার ছেলে। ওর জন্যই তো আমাদের এখানে আসা।”
ভীষণ লজ্জায় পড়লো তটিনী। সে তো জানতোনা আন্টির আরেকটি ছেলে আছে। আন্টির একটি ছেলের সাথেই ওর পরিচয় হয়েছে। যে তটিনীর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তার ছোটোভাই মিঠুর সাথে একই ক্লাসে পড়ছে। সেজন্যই দুষ্টুমির ছলে এমন বেফাঁস কথা বলে ফেললো। অস্বস্তি নিয়ে নিজের সাফাই দিয়ে বলল,
-“আপনি ভুল ভাবছেন আন্টি। আমি তো উনাকে চিনি না। আমি রামির কথা বলেছি।”
আয়েশা সুলতানা হেসে ফেললেন। বললেন,

-“রামি তো এখনো ছোটো। তোমাকে ওর বউ করে আনতে আনতে আমি থুরথুরে বুড়ি হয়ে যাবো। তাছাড়া তুমি বিয়ে করার জন্য শেষমেশ আমার ওই বাঁদর ছেলেকেই পেলে?”
তটিনী করুণ গলায় বলল,
-“আমি তো আর জানতাম না আপনার আরও ছেলে আছে।”
আয়েশা সুলতানা ভীষণ মিশুক আর খোলা মনের মানুষ৷ তটিনীকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে বললেন,
-“এখানে এত লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই মেয়ে।

আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে আর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বাকি দুটোর এখনো গতি করতে পারিনি।
নিজের মেয়েটাকে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে যেখানে সেখানে মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে দেখলেই নিজের মেয়ে বানিয়ে ফেলি।”
অস্বস্তি অনেকটাই কেটে গেল। মিষ্টি করে হাসলো তটিনী। এবার লজ্জা কে*টে একটু একটু করে কৌতুহল জাগলো। জানতে চাইলো,

-“উনার জন্য এখানে এসেছেন মানে? বুঝলাম না আন্টি।”
-“তোমাদের এখানকার একটা কলেজেই চাকরি হয়েছে ওর। আমার ছেলে পেশায় একজন শিক্ষক।
একা বাসায় কিভাবে কী খাবে না খাবে! তাই আমিও ওর সাথে চলে এসেছি। বছরের খুব একটা দেরি হয়নি, তাই রামির ভর্তি নিয়েও ঝামেলা হলোনা। বড় ছেলের চাকরী আবার বাসার কাছাকাছি। তাই সে আর বউমা বাসাতেই রইলো।”
আর বেশি কিছু জানতে ইচ্ছে হলোনা তটিনীর। আয়েশা সুলতানাকে বিদায় দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আপনি তাহলে কাজ করুন আন্টি। আমি এখন আসছি। মা আবার ডাকাডাকি শুরু করবে।”
আয়েশা সুলতানা বাঁধা দিলেন না। সম্মতি দিয়ে বললেন,
-“আচ্ছা এসো।”

সিঁড়ি ঘরে এসেই বড়োসড়ো শ্বাস নিলো তটিনী। কতটা বি*শ্রী পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। জীবনে বোধহয় এমন বি*শ্রী পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়েছে।
কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। চারতলায় যাওয়ার সিঁড়িতে পা রাখলো সে।
এই চারতলা বাড়িটি তাদের। ঠিক চারতলায় তারা থাকে। বাকি তিনতলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আয়েশা সুলতানারাও তেমনি ভাড়াটিয়া। ঠিক তিনতলায় উনারা থাকেন। এখানে এসেছেন এক সপ্তাহ। এর মাঝেই বিল্ডিংয়ের সবার সাথে উনার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। উনার সাথে ছোটো ছেলে রামিকে দেখলেও আজকের লোকটিকে এতদিন দেখতে পায়নি তটিনী। রামি ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের ছেলে। এ-কদিনে সেও সবার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। রীতিমতো তাদের ঘরে মিঠুর সাথে আড্ডা চলে রামির।

ঘরে ফিরেই দেখলো মিঠু, রামি দুজনেই তার ফোনের উপর হামলে পড়ে আছে। ছোঁ মে*রে ফোন নিয়ে নিলো তটিনী। ধমকে উঠে বলল,
-“এই বয়সে ফোনের প্রতি এত আসক্ত হওয়া ভালো নয়।“
মিঠু চোখমুখ উল্টে ফেললো। ঘাড় উঁচু করে বলল,
-“এই বয়স? তুমি জানো, আমরা ক্লাস এইটে পড়ি!
এইটে পড়ুয়া ছেলে আবার ছোটো হয়?”
-“কানের নিচে দুটো পড়লে আপনাআপনি ছোটো হয়ে যাবি।”
রামি তটিনীর পাশে এসে দাঁড়ালো। আফসোসের সুরে বলল,

-“আফসোস! আজ প্রেম করার বয়সে একটা ফোন চালাতে পারছিনা। ফোন না থাকলে মেয়ে পটবে কিভাবে?”
-“তাই না?”
বলে রামির কান মলে দিলো তটিনী।
রামি ভীষণ বাঁদর ছেলে। কানমলা খেয়েও তার বাঁদরামি কমলোনা। হাসতে হাসতে বলল,
-“বাসায় এতো সুন্দরী সিনিয়র আপু থাকতে অন্য মেয়ে পটাতে যাবো কোন দুঃখে? থাকুক, ফোন আমার লাগবে না। শুধু সিনিয়র আপু হলেই চলবে। ”
মাঝখানে বাগড়া দিলো মিঠু। বিদ্রুপ করে বলল,

-”তোর মতো গরিবের কাছে বোন বিয়ে দিতে যাবো কোন দুঃখে? যার নিজেরই ফোন কেনার টাকা নেই, সে আমাকে তার একমাত্র শা*লা*কে কিভাবে ফোন কিনে দেবে?”
তটিনী দুজনের বাঁদরামো দেখে চোখ কপালে তুললো। অবাক হয়ে মিঠুর কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার মতো বলল,
-“তারমানে মিঠু তোকে ফোন কিনে দিতে পারলে আমাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতি?”
মিঠু ধূর ছাঁই করে হাত দিয়ে ময়লা ঝাড়ার অভিনয় করে বলল,
-“এমনিতেও তুমি কাজের না। যদি কাউকে এই অকাজের ঢেঁকি দান করে একটা ফোন পাই, তবে মন্দ কি?”
রামি তাল মিলিয়ে মিঠুর পিঠে চাপড় মে*রে বলল,

-“দেখিস বন্ধু, একদিন আমিও গরিব থেকে বড়লোক হবো। তখন তোকে একটা ফোন গিফট করে তোর বোনকে নিয়ে যাবো। শুধু অপেক্ষায় থাক?”
ভাবুক হয়ে জানতে চাইলো মিঠু,
-“অপেক্ষা কতদিন?””
-“সারাজীবন।”
ফিক করে হেসে ফেললো তটিনী। সত্যিই ছেলেদুটো ভীষণ দুষ্টু। মিঠু রামিকে তাড়া করতে করতে দুজনই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

ছেলেকে খাবার দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন আয়েশা সুলতানা। ছেলের চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল চালাচ্ছেন।
মাহমুদ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক মায়ের সাথে কথা বলছে। তার চরিত্র ঠিক রামির উল্টো। ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে। হুটহাট রা*গ করা তার ধাতে নেই। তবে একবার রাগ হলে তা সহজে পানি হয়না। একপর্যায়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নতুন জায়গা কেমন লাগছে, মা? বলেছিলাম আমার জন্য কষ্ট করে এখানে আসার দরকার নেই। আমি সবটা সামলে নেবো। তুমি শুনলেনা।”
আয়েশা সুলতানা প্রফুল্লচিত্তে বললেন,

-“নতুন জায়গা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এই বিল্ডিংয়ের মানুষগুলো বড্ড ভালো। বাড়িওয়ালার পরিবার কি সুন্দর মিশে গিয়েছে আমাদের সাথে। রামিটা তো বাড়িওয়ালার ছেলেকে বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে। তাদের মেয়েদুটো ভীষণ মিষ্টি। কী সুন্দর করে কথা বলে। ওই যে একটু আগে দেখলি না? সেই মেয়েটাই বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে।
এখানে সবার সাথে থেকে আমার মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তুই এত চিন্তা করিসনা।”

মাহমুদের কোন ভাবান্তর হলো না। একমনে খাবার চালিয়ে গেলো। মা ভীষণ গল্পপ্রিয় আর মিশুক স্বভাবের। সহজেই সবার সাথে মিশে গিয়ে গল্প জুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে উনার। তাই সপ্তাহ পেরোনোর আগেই সবাইকে আপন করে নিয়েছেন। এই স্বভাবের কারণে বারবার ঠ*কে যান তিনি। একবার এক ভদ্র মহিলার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ভদ্র মহিলা ঝোপ বুঝে কো*প মা*র*লে*ন।

দাওয়াতে যাওয়ার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে বেশ কিছু গয়নাগাটি নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরবর্তীতে জানা গেলো এদের কাজই হলো ধা*ন্ধা*বা*জি করা। এর আগেও অনেকের সাথে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তবুও মায়ের বোঝ হয়নি। তিনি নরম মনের সহজসরল মানুষ। সবাইকে অল্পইতেই বিশ্বাস করে ফেলেন।
চৈত্র মাসের ভ্যাপসা গরমে মানুষের মাংস সেদ্ধ করা যাবে। দুদিন যাবত প্রচন্ড গরম পড়ছে। ফ্যানের বাতাসেও গরম হাওয়া ছাড়ছে। প্রচন্ড গরম সহ্য না হওয়ায় অগত্যা দু’বার গোসল করলো তটিনী। তবুও স্যাঁতস্যাঁতে ঘামে জামা ভিজে শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে আছে। ফ্যানের নিচে নিজেকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়া চলছে। তখনই মায়ের ডাক পড়লো,

-“তটিনী একটুপর সন্ধ্যা নামবে। আজ ছাদে শুকনো কাপড় রয়ে গিয়েছে। নিয়ে আয়তো মা।”
-“যাচ্ছি।”
বলে ওড়না গায়ে জড়িয়ে সিঁড়ি ধরে এগোতে লাগলো তটিনী। সিঁড়িঘর পুরো ফাঁকা। কোথাও কারো টিকিটিও নজরে পড়ছেনা। গুণগুণ শব্দে গান ধরলো তটিনী।

❝কেন মেঘ আসে
হৃদয় – আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে, তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না!❞

ছাদের দরজায় গিয়ে থামতেই ভড়কে গেলো তটিনী। সেদিনের মানুষটি ছাদে দাঁড়িয়ে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে তার কোন সমস্যা ছিলোনা। যথারীতি সেদিনের মতো আজও অদ্ভুত শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির নড়চড় হচ্ছে না। তটিনীর অস্বস্তি হলো। একটু আগে যে সে গান গাইতে গাইতে এসেছে, লোকটি কি শুনে ফেললো! এইজন্যই কি এমনভাবে তাকিয়ে আছে? নিজে নিজে গুণগুণ করে গান গাইলেও কারো সামনে পড়ে গেলে বিব্রতবোধ করে তটিনী। তার গানের গলা খুব একটা ভালো নয়।

এখানে তো সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সামনে পড়লো। অস্বস্তি দ্বিগুণ বাড়লো। হাঁসফাঁস করে উঠলো তটিনী। দ্রুত পা চালাতে গিয়েও যেন সে এগোতে পারছেনা। কিছু একটা বারবার পা টে*নে ধরছে। এলোমেলো পায়ের ছাপ ফেলে দড়ি থেকে কাপড় তুললো। মনে হচ্ছে লোকটি এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

সিঁড়ি ঘরে এসেই বাকি পথ এক প্রকার দৌঁড়ে নেমে এলো। নিজে নিজেই কপাল চাপড়ালো। এমন অস্বস্তিকর ঘটনা কেন তার সাথেই ঘটতে হলো!
নিচে এসেই টের পেল তাড়াহুড়োয় একটা জামা ফেলে এসেছে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২