আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২৫

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

স্কুলের ক্লাসগুলো কোনমতে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে পাখি।এসেই ড্রয়িং রুমে শানকে দেখে। দু’জন ভদ্রলোক সহ সেন্টার টেবিলে রাখা পেপার টার উপর কিছু একটা লিখছে শান।তাদের দিকে এক নজর দেখে পাখি ইনায়াহ্’র হাত ধরে উপরে চলে যায়।শান সেদিকে একবার চেয়ে মুচকি হেসে আনমনে বলে,”তোমায় সোজা পথে আনার জন্যেই সারারাত বসে বসে এই উপায় বের করেছি সেদিন।দেখো কেমন নাজেহাল করেছি তোমার অবস্থা!এখন কই গেলো আমার কাছে আসার চেষ্টা?”

“কি ব্যপার শান বাবু,কি অবস্থা? মেয়েটা এখনো তোমার সাথে থাকে,দেখছি!”,পাশে বসা সোহেলের কথায় ভাবনা ভাঙ্গে শানের।সন্দিহান চোখে চেয়ে বলে,”তো?”
“না মানে, ভালোই তো চলছে তাহলে।তা আমাদেরকেও একটু সুযোগ দেবে না?”,বেশ নোংড়া চাহনীতে বলে সোহেল।
শান আর কোন কথা না বলে সোজা উঠে দাঁড়ায়। দুহাতে কলার চেপে ধরে টেনে তোলে সোহেলকে।উপস্থিত বাকিজন হতভম্ব হয়ে যায় শানের আচরনে।শানের গতিবিধি বুঝে উঠে দ্রুত ধরে ফেলে শানের হাত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ছাড়ো মিহির ভাই।ওর এতো বড় সাহস হয় কী করে এতো নোংড়া একটা কথা বলার?জিহ্ব টেনে ছিড়ে ফেলব একদম”,রাগে গজরাতে গজরাতে বলে শান।
মিহির পিছন থেকে জাপটে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে শানকে।
“এতো উত্তেজিত হয়ো না শান।একটু শান্ত হও”

“কিসের শান্ত হবো?ও কতো বড় ইঙ্গিত করেছে তোমার ধারনা আছে?চিপ, লো মাইন্ডেড কোথাকার…..এই আউট..আউট ফ্রম মাই হাউজ..রাইট নাও”,রাগে চিল্লিয়ে বলে শান।চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে শানের।ইতোমধ্যে পাখি উপর থেকে সব দেখছে।রাহেলা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে।চিন্তিত মুখে আনমনে বলে,”কবে শেষ হবে এসব? জনে জনে কতোজনের মুখ আটকাবে শানবাবা!”

“ব্যপার টা মোটেও ভালো করলে না শান।শেয়ার ক্যান্সেল। মাইন্ড ইট।আর ভুল তো কিছুই বলি নি আমি।চাইলে আমরাও মোটা অঙ্কের এমাউন্ট দেব।তোমার এতো জ্বলুনির কি আছে?”,কটাক্ষ করে বলে সোহেল।
ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি শেয়ার বিজনেসেও শানের বিচরন।আর সেই শেয়ারে অংশীদার হিসেবে যুক্ত হয়েছে সোহেল আর মিহির।

সোহেলের আবার এমন নোংড়া কথায় শান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারে না।সেন্টার টেবিলের সেন্টারে রাখা ফুলের টব টা সোহেলের দিকে তাক করে ডান পায়ে এক লাত্থি মারে।অসতর্ক হলেই আজ কিছু একটা ঘটে যেত।সোহেল তৎক্ষনাৎ সরে যায় অন্যপাশে।

“মিহির ভাই ওকে চলে যেতে বলো।”,মুখ ঘুরিয়ে বলে শান।শানের এমন কান্ডে দ্রুত নিচে নেমে আসে পাখি।অপরাধীর ন্যায় দূরে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না।উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে শান টেবিলের উপর রাখা প্রত্যেকটা কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বলে,”এটারই ভয় দেখাচ্ছিলি তো!যা আমিই ক্যান্সেল করলাম”

মিহির আর কোন কথা না বলে সোহেলকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায়।চাপা রাগ দেখিয়ে বলে,”অন্যের ব্যপারে নাক না গলালে চলে না তাই না?চরিত্রটা কি কোনদিনও ঠিক হবে না?নিজের মতো মনে করো সবাইকে?”

শান দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।পিছনের সোফায় বসে পাখির দিকে একবার তাকায়।উঠে গিয়ে দাঁড়ায় সোজা পাখির সামনে।কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”এসবই চেয়েছিলে না?দেখো, হচ্ছে।এসব চাইছো বলেই তো সিলেটের ওতো সহায় সম্পদ ছেড়ে আমার সাথে চলে আসলে,তাই না?”
শান উঠে সোজা হয়ে বলে,”আমার বদনাম করছো সাথে তোমার নিজেরও বদনাম হচ্ছে”

বলার পর পরই পাখি মাথা তুলে তাকায়।ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলে, “যে পুরুষ নিজের বউকে প্রকাশ্যে আনতে পারে না ;সে কাপুরুষ।তার চুড়ি পরে বসে থাকা উচিত।আর আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না। ”
বলেই ছলছলে চোখে উপরে চলে যায় পাখি।
“কী করে বোঝাই তোমায় পাখি আমার”,চোখ মুখ কুচকে ভাবে শান।

সে রাতে না খেয়েই ঘুমায় পাখি।রাতের গভীরতা একটু বাড়তেই শান উঠে চলে যায় পাখির ঘরে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে শান।ইনায়াহ’কে জড়িয়ে রেখে বাচ্চাদের মতো মলিন মুখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পাখি।খুব সন্তর্পনে, শব্দহীন পদধ্বনিতে শান সেদিকে এগিয়ে যায় ।পাখির পিছনে বেশ খানিক টা ফাঁকা জায়গা খালি পরে থাকে।মুচকি হেসে শান সেদিকে এগিয়ে সাবধানে বসে পরে।এরপর কাত হয়ে থাকা পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।ধীরেধীরে হাতের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে যায়।তবুও ঘুম ভাঙ্গে না পাখির।শানের ঠোঁট অনেক টা প্রসস্ত হয় হাসিতে।

“এতো গাঢ় ঘুম তোমার,যে প্রতি রাতে এভাবেই তোমার কাছে আসি অথচ তুমি বুঝতেই পারো না”,
হাসি টা অবিচল রেখে কপালে একটা চুমু দেয় শান।
চুমুর স্পর্শে ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ চলে আসে ঘুমন্ত পাখির।শান নির্বকার মনে সেদিকে চেয়ে থাকে।
পাখি একটু নড়েচড়ে শানের দিকে কাত ফিরতেই মেঝেতে সাবধানে বসে পরে শান।কিছুক্ষন কোন প্রকার নড়াচাড়া ছাড়াই ঠাঁয় বসে পাখির গতিবিধি পরোখ করার চেষ্টা করে।পাখির নিঃশ্বাস ভারি হতেই শান হাফ ছেড়ে বাঁচে।বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”আজ তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে ”

সে রাতের কথা মনে তুলে মুচকি হেসে শান আবার ফিসফিস করে,”তুমি যে এতো ভীতু আর অবিশ্বাসী ভাবা যায়!গুড নাইট জান পাখি”
কথা শেষে শান উঠে চলে যেতেই ইনায়াহ্’র কথায় থমকে যায়।
“সান সাইন, তুমি কি করছিলে এখানে?”,ঘুম জড়ানো কন্ঠে টেনে টেনে বলে ইনায়াহ্।
শান পরে যায় মহা বিপদে।দুটো শুকনো ঢোক গিলে তড়িৎগতিতে পাখির দিকে তাকায়।দেখে পাখি এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।আটকে রাখা নিঃশ্বাস টা ছেড়ে শান লম্বায় পা ফেলে দু কদম এগিয়ে আসে ইনায়াহ্’র পাশে।আতঙ্কিত চোখে শান প্রশ্ন করে,”তুমি এখনও ঘুমাও নি মাম?”

“হ্যা, ঘুমিয়েছি তো। তুমি আসলে বলে…..”
“হিসসসস,আস্তে মা আস্তে কথা বলো প্লিজ”,হাতের ইশারায় বলে শান।
“আমি তো ঘুমিয়ে গেছি।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি কেউ একজন মুন সাইনকে কি যেন করছে।পরে দেখি তুমি। কি করছিলে তুমি মুন সাইনকে বলো।তুমি আবার ঝগড়া করেছো, না?”,ঘুমকে একপাশে ঝেড়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে বলে ইনায়াহ্।
ইনায়াহ্’র কথা শুনে শানের ডান হাত আপনাআপনি কপালে চলে যায়।হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে ইনায়াহ্’র পায়ের কাছে মাথা দেয়।চোখ বন্ধ করে ভাবে,”আর রক্ষা নেই তোর শান।যা হবার হয়ে গেছে।এবার পরিস্থিতি সামলাবি কী করে?”

“তারমানে তুমিই প্রতিদিন আসো।আর আমি চোখ মুছে তাকাতেই চলে যাও”,কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন ছোড়ে ইনায়াহ্।শান এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।গা হাত পা কাঁপা শুরু হয়। কি বলবে বুঝতে পারছে না শান।তবে যে করেই হোক ইনায়াহ্’র কাছে কোন ভাবেই বোঝানো যাবে না সবটা
ঢোক গিলে বলে,”এসব কি বলছো মা?আআমি কেন…..!”
“একদম মিথ্যে বলবা না। আমি দেখছি তোমার মতো একটা মানুষ আসে আবার কিছুক্ষন পর চলে যায়।সকাল সকাল হতে হতে সবটা ভুলে যাই আমি
মুন সাইনকে আর বলতে পারি না।বলো কেন আসো তুমি?”,শেষের কথাটা বেশ গোয়েন্দা চিত্তে বলে ইনায়াহ্।

“ওকে আমরা আস্তে কথা বলি কেমন!শুনো, আমি দেখতে আসি তোমাকে বুঝেছ মা।দেখতে আসি তুমি ঘুমাইছো কিনা!”,বলেই ইনায়াহ্’র মুখের দিকে তাকায় শান।মুখ দেখে মনে হচ্ছে মিথ্যেটা ইনায়াহ্’র হজম হয়েছে। তাই আরেকটু এগিয়ে শান বলে,”কি বলোতো মা, তোমার মুন সাইন এসছে থেকে আমায় সময় দিচ্ছো না।তোমায় মিস করি তো।তাই লুকিয়ে তোমায় দেখতে আসি।”
ইনায়াহ্ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,”কিন্তু তুমি যে মুন সাইনের দিকে যাও। কি যেন করে আবার চলে যাও”
শান হরবরিয়ে বলে, “ও কিছু না এমনিই আরকি।চকোলেট খাবে মা?”

খুশিতে গদগদ হয়ে ইনায়াহ্ বলে,”হ্যা হ্যা ”
“ওকে কাল অনেক গুলো চকোলেট দেব।বাট প্রমিজ করো তোমার মুন সাইনকে কিছু বলবা না”
কিছু একটা ভেবে ঠোঁট উল্টিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”ওকে”
অনিচ্ছাসত্বেও হেসে শান ইনায়াহ্’কে বুকে জড়িয়ে নেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সরি মা।সত্যিটা জানলে তুমি তোমার মুন সাইনকে বলবা। যেটা আমি চাই না”
বেরিয়ে যায় শান।রাহিলা সিঁড়িতে উঠে সবটা দেখে মুখে আঁচল ঠেকায়।অবাক হয়ে ভাবে, “এতোটা অধঃপতন শানবাবার!”

প্রতিদিনের ন্যায় আজও ইনায়াহ্’কে সাথে করে স্কুলে যায় পাখি।স্কুল শেষে ফিরে আসে। তবে আগেকার মতো শানের সামনে যায় না বললেই চলে। রাহেলাও প্রয়োজনের বাহিরে টু শব্দটিও করে না।অসহায় মুখে পাখি সারাটা দিন ঘরবন্দি পাখির মতো শুয়ে বসে কাটায়।
সন্ধ্যেবেলায় শান দরজায় এসে ডাকে ইনায়াহ্’কে।তখন ইনায়াহ্ পাখির কাছে পড়তে ব্যস্ত।ইনায়াহ্ অনুমতির অপেক্ষায় তাকায় পাখির দিকে। একবার শানের দিকে তাকিয়ে পাখি চোখ সরিয়ে মুচকি হেসে বলে,”যাও।পাঁচ মিনিট টাইম।তাড়াতাড়ি চলে আসবে। কেমন!”

“আচ্ছা”
কিছুক্ষন পর ইনায়াহ্ কতোকগুলো চকোলেট সমেত ঘরে ঢোকে।পাখি ভ্রু কুচকে বলে, “এতো চকোলেটস!”
“হুমমমম।সান সাইন দিলো।”
“কেন? তিনি কি জানে না এতো চকোলেটস বাচ্চাদের জন্যে কতোটা ক্ষতিকারক?”,কথাটা ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে পাখি।
ইনায়াহ্ পাংশুটে মুখে বলে,”সান সাইন প্রতিদিন রাতে তোমার ঘরে আসে।তোমার দিকে গিয়ে কি যেন করে। আমি ভালো করে তাকাতেই চলে যায়”
অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখি।অস্ফুটস্বরে বলে,”তারপর?”
অবুঝ মন একে একে কাল রাতের সব কথা জানায় ইনায়াহ্।
পাখির অবাক হয়ে ঠাঁয় বসে ইনায়াহ্’র কথাগুলো শুনে যায়।

রাতে না ঘুমিয়ে পাখি আজ অপেক্ষা করছে শানের লুকিয়ে আগমনের।
“আজ আপনাকে বলতেই হবে এতো লুকোচুরির কী কারণ”,ভাবতেই চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে পাখির।কিছুক্ষন পর তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে ১.২০ মিনিট।আর চোখ দুটো খুলে রাখতে পারছে না পাখি।
” শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করি”,ভাবতেই গা এলিয়ে দেয় বিছানায়।কতোক্ষন থাকতেই রাজ্যের ঘুম এসে জমা হয় চোখের পাতায়।এক ঘুমে সকাল হয়ে যায় পাখির।

“এই হাড়িপাতিল, হাড়িপাতিল “,হাড়িপাতিল ওয়ালার করা কড়া ডাকে ঘুমে ভাঙ্গে পাখির।জোড়পূর্বক চোখ খুলে দেখে ৭.৩০ বাজে।
হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙ্গে পাখি।তখনি মনে হয় কাল রাতের কথা।নিজের ব্যর্থতায় মুখটা চুপসে যায়।
আজও স্কুলের জন্যে চলে যায় পাখি।আধাবেলা স্কুল শেষে বাড়ি ফেরে। কিন্তু কোথাও ইনায়াহ্’র বলা কথাগুলো ভুলতে পারছে না পাখি।বার বার মনে হয়,”কেন লুকিয়ে আসে উনি!কী সে কারণ?জানতে তো আমায় হবেই।”

আজ দুপুর বেলাতেই শান চলে আসে বাড়িতে।শরীরটা বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল সেরে লম্বা ঘুম দেয় শান।
বিকেল গড়াতেই ইনায়াহ্’র জন্যে হালকা নাস্তা বানিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে পাখি।ফ্যানের নিচে রেখে ঠান্ডা হতে দেয় সেগুলো।ইনায়াহ্ পাশে বসে অপেক্ষা করছে খাবার ঠান্ডা হওয়ার আশায়।রাহেলা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বসে ইনায়াহ্’র পাশে।

“কই শান”,বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে কয়েকজন পুরুষ-মহিলা।পাখিসহ রাহেলা বেগম তাকায় সেদিকে।মহিলাদের দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না এনারা সেদিনের ভদ্র মহিলারা।যারা পাখিকে নিয়ে ভালো মন্দ বলে গিয়েছিল।রাহেলা তাদের দেখে চিন্তিত মুখ বিড়বিড় করে,”এবার সবটা শেষ”
আগত সবাই গিয়ে দাঁড়ায় ড্রয়িংরুমে।তন্মধ্যে পাখির দিকে নোংড়া দৃষ্টিতে তাকায় কয়েকজন মানুষ।পাখি বেশ বুঝতে পারে এবার বদনামের আর কিছুই বাকি নেই।শুকনো মুখে তাদের দিকে তাকায়।

“কি নোংড়া মেয়েরা বাবা”
“শুনলাম না, ওরে রেখে আসলো!”
“আরে আবার নিয়ে আসছে।”
“বোঝ না এ যুগের ছেলে মেয়েদের মতিগতি!”
“কত্তোবড় সাহস ভাবুন ভাবি।আমরা না করা সত্বেও আবার নির্লজ্জের মতো একসাথে থাকছে’
সবাই একে অপরকে টিপ্পনী কেটে পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলছে।
রাহেলা এগিয়ে গিয়ে বলে, “চেয়ারম্যান সাহেব, আসুন না বসুন এদিকে”
হাত উচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,”শানকে ডাকো ”

“শানবাবার তো শরীর ভালো না, ঘুমিয়েছে”,কাপা কাপা গলায় বলে রাহেলা।
পাশ থেকে একজন বয়স্ক গোছের লোক বলে ওঠেন,”অবৈধ কাজ করলে কারোরই শরীর সুস্থ থাকে না।কি বলো? ”
“আরে সব দোষ এই বে* মেয়ের।ও যদি এখনি চলে যায় সব ঠিক হয়ে যাবে।নোংড়া, বেজন্মা মেয়ে কোথাকার”
কথাটা শুনে পাখির কান গরম হয়ে আসে।
“শেষমেশ এতোটা নীচে নামতে হলো!”,আনমনে ভাবতেই পাখির সারা শরীর অবশ হয়ে আসে যেন।
রাহেলার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় পাখি।রাহেলা করূন চোখে সেদিকে চেয়ে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশ্যে বলে,”এভাবে মেয়েটাকে হেনস্থা না করে শান বাবার থেকে সবটা শুনে একটা ব্যবস্থা করলে হয় না আপা”

“আর কতো ব্যবস্থা করবে শান?শানের ব্যবস্থা তো দেখলামই।পূনরায় বাড়িতে পতিতা এনে বিবাহ ছাড়াই সংসার করছে”
“ওর ব্যপারে আর একটাও বাজে কথা বললে একজনকেও এখান থেকে সুস্থ হাত পায়ে বাড়ি ফিরতে দেবো না।জবান চিরতরে বন্ধ করে দেব।”,রাগে গর্জন করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে শান।উপস্থিত সবাই একপ্রকার ক্ষিপ্ত হয় শানের প্রতি।

ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হয় না পাখির।হাত পা যেন কনকনে শীতের মতো কাপঁছে।অসাড় হয়ে পরছে পাখির শরীর।শান দ্রুত এগিয়ে এসে একহাতে পাখিকে জড়িয়ে বলে,”ও বউ হয় আমার।”
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায় শানের কথায়।ক্ষিপ্ত অনুভূতি এবার আশ্চর্যে পরিনত হয়।রাহেলাও অবাক হয়ে যায় শানের কথায়।

কান্নাটা যেন গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে পাখির।অবাক বিষ্ময়ে মাথা তুলে তাকায় শানের দিকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে শান পাখির দিকে চেয়ে বলে,”কান খুলে শুনে রাখো ও আমার বউ।হ্যা ঠিকই শুনছো সবাই।আমার বিয়ে করা বউ ও।দেশের পূর্ণ আইন মেনে বিয়ে হয়েছে আমাদের।”
মাঝখান থেকে কেউ একজন গলা উচিয়ে বলে, “তুমি বললে আর আমরা মানলাম তাই না,এতো বোকা ভাবো আমাদের”

“চাচি পাখিকে ধরো একটু “,দাঁতে দাঁত পিষে বলে শান।এরপর দৌঁড়ো উঠে যায় উপরে।কাগজ পাতির ভাঁজ থেকে যত্ন করে রাখা রেজিস্ট্রির কাগজ টা সাবধানে বের করে আনে শান।নিচে নেমে ছুড়ে মারে উপস্থিত লোকদের দিকে।আঙ্গুল উচিয়ে শান বলে,”আমি এখন এই মূহূর্তে আপনাদের নামে মানহানির মামলা করব চেয়ারম্যান চাচা।পারলে আটকায়েন”

কাগজে চোখ বুলিয়ে সবার মুখ চুপসে যায়।চেয়ারম্যানের কাছে কাগজ টা দেয়া হলে তিনিও চোখ বুলিয়ে নেন।ভেজা বিড়ালের মতো চুপসে গিয়ে বলেন, “দেখো বাবা আমাদের তো জানা কথা নয় তোমাদের মাঝে কি সম্পর্ক।আগে থেকে ব্যপারটা জানানো উচিত ছিলো।”
“আপনারা জানানোর সুযোগ দিয়েছেন আমায়?আগে বলেছেন সহ্য করেছি।আর না।আমার ওয়াইফকে যা নয় তাই বলেছেন।ঠিক করেছেন কি?”

“মাথা ঠান্ডা করো বাবা।যেহেতু সবটা মিটে গেলো তাই কেস ফেসে যাও না।তুমি ডাক্তার মানুষ। ফেসলস হয়ে গেলে ব্যপার টা কেমন না?আর আমারও সামনে ইলেকশন”
শান নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে, “এখন থেকে কারো ব্যপারে না জেনে কোন রকম মন্তব্য করবেন না।আর আপনারা।আপনারা মেয়ে হয়ে কী করে অপর একটা মেয়েকে এতোকিছু বলতে পারেন। বাঁধে না একটুও!”
“আমরা বুঝতে পারি নি বাবা”
এরপর আরো কিছু কথা শুনিয়ে দেয় শান।যে যার মতো চলে যায় বাড়ি থেকে।

এতোক্ষন রাহেলার বুকে মুখ লুকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে একদৃষ্টে চেয়েছিলো পাখি।সবাই চলে যাওয়ার সাথে সাথে পাখি এলোমেলো পায়ে অনুভূতিহীন মনে দ্রুত চলে যায় নিজের ঘরে।ইনায়াহ্ ভয়ার্ত চোখে পাখিকে অনুসরন করে চলে যায় ওর সাথে।ইনায়াহ্’কে ঘরে টেনে নিয়ে দরজা লক করে দেয় পাখি।বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে ।ইনায়াহ্ও কান্নারত অবস্থায় পাখির মাথা বুলাতেই পাখি মাথা তুলো ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে হুহুস্বরে কেঁদে ফেলে।যে কান্নার শব্দ নিচ থেকে রাহেলার অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়।নিজেকে অপরাধী মনে হয় রাহেলার।শান হতভম্ব বনে যায় ঘটনার আকষ্মিকতায়।পাখির কান্নার করূনস্বর টা এবার আর শানকে নিজের মাঝে থাকতে দেয় না।

রাহেলা ক্রুর চোখে শানের দিকে চেয়ে বলে,”বিয়ে করেছো অথচ মেয়েটাকে কতো নিচে নামিয়েছো। ছিহ শানবাবা।এতোটা নিচ তুমি ভাবতেও পারছি না।আর আমিও না জেনে মেয়েটাকে কতো কথাই না বলে ফেললাম”,
আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে রাহেলা।শান সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে যায় উপরে।পাখির দরজায় কড়া নাড়ে শান।শান্তস্বরে বলে, “পাখি, দরজাটা খোল”

শানের কথায় কান্না থেমে যায় পাখির।রাগে ফোঁস ফোঁস করে চিল্লিয়ে বলে,”আর কি বাকি আছে?আর কতো অপমান বাকি আছে?শেষ পর্যন্ত পতিতা,বে*……!”
শান বুঝতে পেরেছে পরিস্থিতি কতোটা ঘোলা হয়ে গেছে।উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
ইনায়াহ্’কে খাইয়ে ঘুমিয় দেয় পাখি

রাত গভীর হলে শান নিজের ঘর থেকে বের হয়।আজ কিছুতেই দুচোখে ঘুম আসছে না তার।প্রতিদিনকার ন্যায় আজও পাখির ঘরে ঢোকে শান।
নির্ঘুম চোখে পাখি ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।দরজা খোলার শব্দে ফট করে চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমের ভান করে।চোখ পিটপিটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে শান কী করে।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২৪

এদিকে শান আজ আর ভয়ে ভয়ে না বেশ সাবলিল ভাবে পাখির দিকে এগিয়ে যায়।মাথার কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে মেঝেতে।স্বাভাবিকভাবেই পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় শান।সবটাই পরোখ করে পাখি।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় তা আর চোখে পড়ে না শানের।এরপর চোখের কোণা দুটো মুছে পাখির কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দেয়।এবার আর চোখ আধখোলা রাখতে পারে না পাখি।অজানা ভালো লাগায় চোখ বুজে নেয় সে।

শান মাথা তুলে বলে,”আই’ম সরি জান।আমার জন্যে তোমায় কতোটা বদনাম সহ্য করতে হচ্ছে!আমার কী’ই বা করার আছে বলো তো। আমি কী করে আমার ঘৃন্য অতীতের সাথে তোমায় জড়াবো। কী করেই বা অক্ষম ভবিষ্যতের মায়ায় তোমায় মেশাব?তাই তো তোমার থেকে দূরে দূরে থাকি।আর তুমি উঠে পরে লেগেছ আমাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে।আর তোমার এই পাগলামি দূর করতেই সে রাতে তোমার ড্রাংক হওয়ার সুযোগে একটা মিথ্যে বাহানা তৈরী করেছি।আর যেটা কাজেও দিয়েছে।ভালো তুমি একা না আমিও বাসতে পারি জানপাখি”

শান উঠে আবারও পাখির কপালে চুমু দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,”আই লাভ ইউ ”
ফট করে চোখ খোলে পাখি।দুহাতে চেপে ধরে মাথায় রাখা শানের হাতটা।অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, “এভাবে রাতের আঁধারে কারা সত্যি কথা বলে জানেন? যারা অপরাধী;আলোতে যাদের ভয়।আপনি কোন অপরাধে অপরাধী আজ আমি জানতে চাই।আপনাকে আজ বলতেই হবে সবটা।না হলে ফল এতোটা খারাপ হবে যে সারাজীবন পস্তাবেন।বলুন কেন এতো লুকোচুরি? কেন এতো ভালোবেসে আমায় দূরে সরানো?কেন রাতের আঁধারে আমার কাছে আসা?আর সে রাতে আপনার সাথে করা সমস্ত ঘটনা আজ আমি জানতে চাই।আমার এতো কেন’র উত্তর না নিয়ে আমি ছাড়ছি আপনাকে”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২৬