প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৮
Writer Mahfuza Akter
“আমি তোমার হাতটা এখন ধরতে পারবো না, অর্ণব ভাই!”
কথাটা বলেই তরী নিজের হাতটা অর্ণবের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অর্ণবের মুখখানা মুহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তরীর কাছ থেকে এই রকম উত্তর সে আশা করেনি। সৌহার্দ্যের বুকের ওপর থেকে যেন একটা ভারি বোঝা সরে গেল! তরীর কথাটা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তরী পুনরায় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“কিন্তু তোমায় বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
অর্ণবের চোখ দুটো খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই তরীকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেটা করতে না পেরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মুখে প্রাপ্তির হাসি ফুটিয়ে তরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে তরীর সামনে মেলে ধরলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এই রিং-টা আমি তোর জন্য কিনেছি। তোকে পরিয়ে দেবো বলে।”
তরী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“কিন্তু সেটা তো বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর! এখন এটা এনেছো কেন?”
“বিয়ের ডেট ফিক্সড হলে তো মা তোকে আংটি পরাবে! আজকের এই দিনে তোকে এটা পরাবো বলেই কিনেছিলাম।”
বলেই অর্ণব তরীর হাত টেনে ধরে আংটিটা অনামিকা আঙুল পরিয়ে দিলো। ঘটনাক্রমে তরী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। অর্ণব তরীর হাত ধরেই বললো,
“আমি জীবনসঙ্গী হওয়ার আনঅফিশিয়াল গ্রিনকার্ড পরিয়ে দিলাম। এই হাত আমি আর এ জীবনে ছাড়ছি না।”
তরী কিছুটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। হাত ছাড়াতে চেয়েও পারলো না। অর্ণব শক্ত করে ধরে রেখেছে। এই ভরসার বন্ধন ছিন্ন করার ইচ্ছে তরীরও নেই।
সৌহার্দ্যের মনে হচ্ছে, সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। তার পায়ের নিচটাও শূন্য মনে হচ্ছে। চোখ দু’টো অনবরত জ্বলছে। হঠাৎ বুকের বাঁ পাশে কেমন তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। হৃদপিণ্ড ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে যেমন। সন্তর্পণে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সৌহার্দ্য। এখানে আরও কয়েক মুহূর্ত থাকলে সে হয়তো মরেই যাবে।
ডক্টর শাহরিয়ারের ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মুগ্ধর ওপর নিবদ্ধ। ভেতরে একরাশ ক্রোধ জমা বাঁধছে ধীরে ধীরে। মুগ্ধর সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। নিজের মতো আপনমনে খাওয়াদাওয়া করছে সে। মুগ্ধর মা মিসেস শিরিন ছেলেকে আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,
“আর কিছু লাগবে, বাবা? আরেকটা ব্রেড দেই?”
মুগ্ধ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ডক্টর শাহরিয়ার থমথমে গলায় বললেন,
“এতো খাইয়ে কী হবে? এই বাঁদরকে তো মানুষ বানানো যাবে না!”
“এভাবে কেনো বলছো আমার ছেলেকে? তুমি সবসময় ওকে এভাবে কথা শোনাও!”
মিসেস শিরিনের প্রতিবাদে এবার মুগ্ধও গলা মেলালো,
“ঠিকই বলেছো, মা! আজকাল ভালোমানুষদের কেউ দেখতেই পারে না!”
ডক্টর শাহরিয়ার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি ভালো মানুষ? ভালো মানুষেরা কখনো মেয়েদের ডিস্টার্ব করতে পারে, সেটা আমার জানা ছিল না!”
মুগ্ধ কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে খাচ্ছে। মিসেস শিরিন অবাক হয়ে বললেন,
“কী বলছো এসব তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
ডক্টর শাহরিয়ার এতোক্ষণ নিজের মধ্যে পুষে রাখা রাগটুকু ঝেড়েই ফেললেন। রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“আমার মাথা ঠিকই আছে। মাথা খারাপ হয়েছে তোমার ছেলের! ও আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সব কিছুর জন্য তুমি দায়ী, শিরিন। তুমিই এই ছেলেকে আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর বানিয়েছো।নিজের বড় ভাইকে দেখেও তো একটু শিখতে পারে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে আমার গৌরব বাড়ানোর পরিবর্তে আমার নাককাটার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে ও!”
“সকাল সকাল খাবার টেবিলে বসে কী নিয়ে এতো চেঁচামেচি করছো তিনজন মিলে?”
কথাটা শুনে শাহরিয়ার, শিরিন ও মুগ্ধ দরজার দিকে তাকালো। কালো ট্রাউজার, কালো টি-শার্ট ও কেডস পায়ে ঘর্মাক্ত মুখে সুপুরুষ ভঙ্গিতে আছে ছেলেটি। রাগের মাঝেও হাসি ফুটে উঠলো ডক্টর শাহরিয়ারের মুখে। তার এই ছেলেটাকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। বললেন,
“আজ জগিং করতে গিয়ে একটু লেইট করে বাড়ি ফিরলে মনে হচ্ছে।”
ছেলেটা লম্বা শ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। হাত-মুখে পানি দিয়ে খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললো,
“অভীক শাহরিয়ার কারণ ছাড়া কোনো কাজ করে না, বাবা। তোমার সেটা বোঝা উচিত!”
মিসেস শিরিন ছেলেকে খাবার পরিবেশন করলেন। মুগ্ধ মুখ বাকিয়ে বললো,
“তোমার এসব ডায়লগের জন্য বাবা এখন তোমার বিগ ফ্যান হয়ে গেছে, ভাইয়া। সারাদিন শুধু তোমার জিকিরই করে!”
ডক্টর শাহরিয়ার রাগী চোখে তাকালেন মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ সেটা দেখেও না দেখার ভান করে খেতে লাগলো। ডক্টর শাহরিয়ার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার ভাইকে বোঝাও। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকতে বলো। একটা ভদ্র ফ্যামিলিতে বিলং করে ও। সমাজে আমার যথেষ্ট সম্মান আছে। আমি চাই না ইন ফিউচার ওর নামে কোনো কমপ্লেইন শুনতে।”
ডক্টর শাহরিয়ার নিজের এপ্রোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিসেস শিরিন হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে মুগ্ধর দিকে তাকালেন কিছুক্ষণ। মুগ্ধ পানি খেয়ে বললো,
“বাবা সবসময় আমাকে বকাবকি করে কী যে মজা পায়, বুঝি না! আমার প্রেমের লাইনেও এখন রেড সিগনাল বসিয়ে দিয়েছে। বাবাকে একটু বুঝিয়ে বল না, ভাইয়া?”
“বড় ভাইয়ের কাছে এসব লাভ কেইসে হেল্প চাইছিস? বাবা ঠিকই বলে! তুই দিন দিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছিস।”
“ভাইয়া, তুই-ই তো আমার একমাত্র ভরসা! আর আমিও তো তোর একটা মাত্র ছোট ভাই! বল!”
“পাম্পিং করতে হবে না। ব্যস্ততা কাটিয়ে তোর মামলা হ্যান্ডেল করার চিন্তা করবো। আপাতত নিজেরটা নিজে বোঝ!”
মিসেস শিরিন বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিসের ব্যস্ততা?”
“ভার্সিটির ক্লাস নিয়েই আপাতত ব্যস্ত আছি। স্টুডেন্টদের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলে আরও ব্যস্ত হয়ে যাবো।”
“তাহলে কুঞ্জনগর যাওয়ার ব্যাপারটা?”
“সৌহার্দ্যের সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। ঝামেলা একটু কমলে ওর সাথে দেখা করতে গ্রামে যাবো একবার।”
মিসেস শিরিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ, তা-ই কর! সৌহার্দ্যের একমাত্র কাছের বন্ধু বোধহয় তুই-ই! ছেলেটা তোকে বড্ড ভালোবাসে। দেশে ফিরেই তোকে ফোনে না পেয়ে আমায় কল দিয়ে তোর কথা বারবার জিজ্ঞেস করছিল।”
বলেই মিসেস শিরিন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু আবার ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“প্রহর! শোন?”
প্রহর খাওয়া বন্ধ করে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে কিছু বলতে হবে না। মুগ্ধ সাথে নিয়েই বের হবো আমি।”
মিসেস শিরিন হেসে চলে গেলেন। মুগ্ধ কিছু বললো না। তার মাথায় এখন সৌহার্দ্য নামক ব্যক্তিটা-ই ঘুরছে। সেদিন অরুণীর মুখেও এই নামটা শুনেছিল। কিন্তু একই নাম তো একাধিক মানুষেরও হতে পারে! তবে কাকতালীয়ভাবে যদি প্রহরের সৌহার্দ্য-ই অরুণীর সৌহার্দ্য হয়! তাই প্রহরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললো মুগ্ধ,
“সৌহার্দ্য কে, ভাইয়া?”
দুপুরের রোদের তীব্রতা এখন কিছুটা কমে এসেছে। আকাশটা একটু মেঘাচ্ছন্ন-ই লাগছে! বৃষ্টি হবে নাকি? বেশ কয়েকদিন যাবৎ বৃষ্টির দেখা পাওয়া-ই যায় না। আজ হঠাৎ আকাশে মেঘ জমায় বৃষ্টির আশায় চাতক পাখির মতো ব্যাকুল হয়ে আছে গ্রামের মানুষের মন।
রোজকার মতো আজও সৌহার্দ্যের কাছে পড়তে এসেছে তরী। দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো, সৌহার্দ্য বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। গায়ে একটা সাদা টিশার্ট ও কালো ট্রাউজার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। শুভ্রসুন্দর মুখটা আজ বড্ড ফ্যাকাশে লাগছে। তরী ভেতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সিদ্ধান্তহীনতায় হাসফাস করতে করতে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।
“এভাবে উঁকি দিতে নিষেধ করেছিলাম না?”
তরী চমকে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য এখনোবিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তবে চোখ দুটো শূন্য দৃষ্টিতে মেলে রেখেছে। সৌহার্দ্য আবার মুখ খুললো,
“ভেতরে এসো।”
তরী বিনাবাক্য ব্যয়ে ভেতরে এসে চেয়ার টেনে বসলো। সৌহার্দ্য সময় নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ার টেনে বসে প্রতিদিনের মতোই তরীকে পড়ানো শুরু করলো। তরী খেয়াল করলো, এতোক্ষণ পর্যন্ত একবারও সৌহার্দ্য তার দিকে তাকায়নি। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলছে না। সৌহার্দ্যের এমন গুমোট ভাবটা বেশ অস্বাভাবিক লাগলো তরীর। তবুও কিছু বললো না। কিছু বলার সাহসও তার নেই।
পড়ানোর মাঝে সৌহার্দ্য তরীকে একটা প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা সলভ করে দেখাও।”
তরী ডান হাত দিয়ে লিখা শুরু করতেই তরীর হাতের আংটিটা দৃষ্টিগোচর হলো সৌহার্দ্যের। ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো! সাথে সাথেই সৌহার্দ্য বলে উঠলো,
“থাক! লিখতে হবে না। এটা তোমার হোমওয়ার্ক রইলো।”
বলেই সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ালো। নীরবে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। তরী নিজের বইপত্র গোছাচ্ছে। সৌহার্দ্য সেদিকে একপলকের জন্যও নজর দিলো না। তরী চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সৌহার্দ্য বললো,
“তরী!”
তরী অবাক চোখে তাকালো। এই প্রথম সৌহার্দ্য ওকে তরী বলে ডাকলো। এতোদিন তো চাঁদ বলে ডাকতো! আজ হঠাৎ এই নামে ডাকলো কেন? তরী বুঝে উঠতে পারলো না। সৌহার্দ্য শূন্যে দৃষ্টি মেলে বললো,
“আমার জন্য এক মগ কফি দিয়ে যেতে বলিও মাকে।”
তরী আরেক দফা চমকায়। সৌহার্দ্য সবসময় তরীকে বলতো, কফি নিয়ে আসতে। আজ তাহলে কফি পাঠাতে বলছে কেন? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছে। আজ সৌহার্দ্যকে বড্ড অগোছালো লাগছে। এই এলোমেলো মানবটিকে তরীর চোখে অচেনা লাগছে। কিন্তু সৌহার্দ্যকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস তার নেই। তাই নীরবে মাথা হেলিয়ে চলে গেল সে।
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৭
সৌহার্দ্যের বাঁ চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা নোনাজল। এই অসহ্যকর অনুভূতি নিয়ে সারাজীবন সে কীভাবে কাটাবে? আবারও দূরে পালিয়ে যাবে? এই দহন যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এই দহন থেকে হয়তো মৃত্যুযন্ত্রণাও শান্তির হয়!